ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ফ্রিদা কাহলো: আত্মজৈবনিক শিল্পী

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪০, ১০ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ফ্রিদা কাহলো: আত্মজৈবনিক শিল্পী

ফ্রিদা কাহলো

মুহাম্মদ ফরিদ হাসান : বিশ্ব চিত্রকলার অর্জন, অগ্রগতি ও বিশেষ প্রবণতার কথা উল্লেখ করতে হলে যে ক’জন শিল্পীর নাম অপরিহার্যভাবে চলে আসে, তাদের মধ্যে মেক্সিকান চিত্রশিল্পী ফ্রিদা কাহলো অন্যতম। চিত্রকলার ইতিহাসে তিনি আত্মজৈবনিক শিল্পী হিসেবে বিশেষ স্থান দখল করে আছেন। ব্যক্তি ফ্রিদা ও তার ঘটনার অনুষঙ্গ ব্যবহারের সাথে প্রতীকের ব্যবহার, মিথের প্রয়োগ এবং ঐতিহ্যের উপস্থাপন তার চিত্রকর্মকে উজ্জ্বল করে তুলেছে। জীবনের দুঃখের ছোবল, বেদনা ও রক্তাক্ততার প্রকাশ তার অধিকাংশ ছবিতে সরলমাত্রায় উন্মোচিত হয়েছে। 

ফ্রিদা কাহলোর জন্ম মেক্সিকো সিটিতে, ১৯০৭ সালের ৬ জুলাই। ফ্রিদার বয়স যখন মাত্র ছয়, তখন পোলিও রোগে আক্রান্ত হন। এ রোগে চিকন হয়ে যায় ডান পা। এমনকি পায়ের পাতাও বেঁকে যায়। এই শারীরিক অসঙ্গতি ফ্রিদাকে কম তাড়িয়ে বেরায়নি। কিন্তু ফ্রিদা হয়তো জানতেন না যে, স্রষ্টা তার জন্যে ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ কিছু জমা রেখেছিলেন। এই ‘ভয়াবহ’ অবস্থা এমন যে- যার জন্যে তাকে আমৃত্যু জ্বলে-পুড়ে ছাই হতে হয়েছে। অমানবিক হলেও সত্য, শিল্পের জন্যে এ ঘটনাটি ছিলো ইতিবাচক। কেননা, এই দুর্ঘটনাটি কেবল ফ্রিদাকে দুঃসহ জীবনের দিকে ঠেলে দেয়নি, সাথে সাথে তাকে চিত্রশিল্পী হওয়ার পথেও ধাবিত করেছিল। এ দুর্ঘটনা না ঘটলে তিনি হয়তো আর চিত্রশিল্পী হয়ে উঠতেন না। 

১৯২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, তখন ফ্রিদার বয়স আঠারো। দিনটি বৃষ্টিতে মাখামাখি। ফ্রিদা মেক্সিকো সিটি থেকে কোরোকান যাচ্ছিলেন। হঠাৎ বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ট্রলির সাথে তীব্র ধাক্কা খেলো। বিশিষ্ট চিত্রসমালোচক অমিতাভ মৈত্র এ প্রসঙ্গে লিখেছেন: ‘একটা মোটা লোহার পাত ফ্রিদার শিড়দাঁড়া চূর্ণ করে তলপেট, জননঅঙ্গ ছিন্নভিন্ন করে বেরিয়ে এসেছে রক্ত ক্লেদ মাংস মাখামাখি হয়ে। পরে দেখা গেল এছাড়া ফ্রিদার কাঁধ, পাঁজরের দুটো হাড় ভেঙেছে। এগারো টুকরো হয়ে গেছে ডান পায়ের হাড়, পায়ের পাতা ভেঙে দুমড়ে গেছে।’

উইদাউট হোপ। ১৯৪৫ সালে আঁকা ফ্রিদা কাহলোর চিত্রকর্ম

এ দুর্ঘটনাটিই ফ্রিদার জীবনের আলো কেড়ে নিলো এবং তার যাপনকে এক ঝলকে পতিত করলো ঘোর অমাবস্যায়। দুর্ঘটনার কারণে পরবর্তী সময়ে ফ্রিদার শরীরে ৩২ বার অপারেশন করতে হয়। বলা হয়ে থাকে, মেক্সিকান এ শিল্পী  জীবনের তিনভাগের একভাগ হাসপাতালে কাটিয়েছেন। ফ্রিদা কাহলো ম্যুরালশিল্পী দিয়েগো রিভেরার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। ১৯২৯ সালের ২১ আগস্ট ২২ বছর বয়সে ফ্রিদা ৪২ বছর বয়সী রিভেরাকে বিয়ে করেন। ফ্রিদা রিভেরার মধ্য দিয়ে তার অপূর্ণ জীবনের পূর্ণতা খুঁজে পেয়েছিলেন ঠিকই কিন্তু তাও টেকসই হয়নি। গবেষকগণ মনে করেন, তাদের সম্পর্কের তিক্ততার পেছনে ‘হঠকারিতা’ ও ‘বিবিধ সম্পর্ক’ই দায়ী। ফ্রিদা কাহলো আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার জীবনের মারাত্মক দুর্ঘটনা দুটি। একটি বাসের দুর্ঘটনা, অন্যটি দিয়েগো।’

ফিদ্রা কাহলোর বাবা গুইলেরমো কাহলো ছিলেন ফটোগ্রাফার। যখন ফ্রিদা বাস দুর্ঘটনায় বিপর্যস্ত, কোনো কিছুতে মন বসছে না, সেসময়ে গুইলেরমো মেয়ের হাতে রঙ-তুলি তুলে দেন। যদিও কোনো লক্ষ্য ছাড়াই ফ্রিদা রঙ-তুলি হাতে নিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি চিত্রকলাকেই প্রবলভাবে আকড়ে ধরে ছিলেন। ১৯২৬ সালে তার আঁকা প্রথম চিত্রকর্মটি ক্যানভাসে বন্দী হয়। চিত্রটির শিরোনাম ছিলো-Self Portrait in a Velvet Dress। ফ্রিদা কাহলো সারাজীবন ১৪৩টি ছবি এঁকেছেন। এ ছবিগুলোর মধ্যে ৫০টি ছবি রয়েছে, যে ছবিগুলোতে নিজেকে নিজে এঁকেছেন ফ্রিদা কাহলো। আর এ কারণেই তাকে ‘আত্মজৈবনিক শিল্পী’ বলা হয়। কারণ, তার ছবি শৈল্পিকরূপে তাকে ও তার জীবনকে নানাভাবে ক্যানভাসে উপস্থাপন করেছে। স্বাভাবিকভাবেই ব্যক্তি জীবনের তীব্র দহন, ভাঙন, অসুস্থতা ফ্রিদার দেহ থেকে তার ক্যানভাস পর্যন্ত সঞ্চারিত হয়েছিলো। ফলে তার আঁকা ছবিগুলো হয়ে উঠেছে স্বরবিদ্ধ, নির্মম জখমভরা এবং ভীষণভাবে রক্তাক্ত।

ফ্রিদা কাহলো নিজের জীবন ও যাপন কেন আঁকতেন- এ প্রশ্ন সহজভাবেই সামনে আসে। এর ব্যাখ্যা হতে পারে এরকম- ফ্রিদার জীবনের সবচেয়ে বড় একটি বিষয় ‘বাস দুর্ঘটনা’। অন্যদিকে রিভেরা-বিচ্ছেদও কম বড় ঘটনা নয়। ফ্রিদার জীবনের এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনা আসেনি, যে ঘটনা তাকে এবং তার শিল্পকে অতিমাত্রায় প্রভাবিত করতে পারে এবং চলমান সময় থেকে তিনি নিস্তার লাভ করতে পারেন। ফলে ফ্রিদা তার জীবনের বড় ঘটনা প্রবাহটিকেই বারবার এঁকেছিলেন। ফ্রিদা নিজেই একবার বলেছিলেন, ‘আমি প্রায় সময়ই একাকিত্বের মধ্যে নিমজ্জিত থাকি। আমি কেবল আমার ছবি আঁকি, কারণ, ব্যক্তি আমিই হচ্ছে এমন একটি বিষয়, যাকে আমি সবচেয়ে ভালোভাবে জানি।’ ফ্রিদা মনে করেন, যদিও তার ছবিগুলো বেদনার প্রকাশবাহক, তবু চিত্রকলাই তার জীবনকে পূর্ণতা দিয়েছে। ফ্রিদার আত্মবিশ্বাস যে যথাযথ, তা আর নতুন করে বলা সময়ক্ষেপণ মাত্র। জীবনের দুঃখ ও নিরাশা, দহন ও পীড়ন যে জীবনকে অর্থবহ ও প্রসারিত করতে পারে- এটি ভাবা খুব কষ্টসাধ্য। কিন্তু একজন ফ্রিদা কাহলো এই ভাবনার ক্ষেত্রে অগ্রগণ্য উদাহরণ হয়ে রইলেন। তার সৃষ্টি তাকে শিল্পের রাজদরবারে অমর করে রেখেছে। একজন শিল্পীর জন্যে এমন প্রাপ্তি সর্বোচ্চ আনন্দের ও জীবনের জন্যে সর্বোচ্চ সার্থকতার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ ডিসেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়