ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:০৪, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জন্ম যদি তব বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল!

শাহ মতিন টিপু : মৃত্যুর পরও তিনি নিজেকে স্মরণীয় করে রেখেছেন তার সৃষ্ট পংক্তিমালার মাঝেই। সেখানে সদর্পে বলেছেন-

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল! এ সমাধি স্থলে/(জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি/বিরাম) মহীর পদে মহা নিদ্রাবৃত/দত্তকুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন!/যশোরে সাগরদাঁড়ি কবতক্ষ-তীরে/জন্মভূমি, জন্মদাতা দত্ত মহামতি/রাজনারায়ণ নামে, জননী জাহ্নবী।’

যুগের পর যুগ নিজেকে চিত্রায়িত করে রাখার এমন পংক্তিতে আজও মুগ্ধ হচ্ছে মানুষ। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ১৯৪তম জন্মবার্ষিকী আজ।১৮২৪ সালের ২৫ জানুয়ারি যশোর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে তার জন্ম। মৃত্যু কলকাতায় ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন।

বাংলা সাহিত্যের অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রবর্তক এই মহাকবি। সত্যিকার অর্থে বাংলা সাহিত্যে মধুসূদনের সৃষ্টি অসাধারণ ও অতুলনীয়।মাইকেল মধুসূদন দত্ত আমাদের বাংলা কাব্যের অনুপ্রেরণা।দেশের প্রতি সুগভীর টান, নদী-মাঠে আত্ম-অনুসন্ধান ছড়িয়ে আছে তার কবিতার ছত্রে ছত্রে। তিনি বাংলার আধুনিক কবিতার জনক।

বাবা রাজনারায়ণ দত্ত কলকাতায় ওকালতি করতেন। মাতা জাহ্নবী দেবী সাধ্বী ও গুণশালিনী রমণী । যশোর জেলার এক সম্ভ্রান্ত বংশে জন্ম হলেও মধুসূদন খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে ইংরেজি ভাষায় সাহিত্য রচনায় মনোনিবেশ করেন। জীবনের দ্বিতীয় পর্বে মধুসূদন আকৃষ্ট হন নিজের মাতৃভাষার প্রতি। জন্ম দেন বাংলা ভাষায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দের ।

তার আগমন ছিল সৃষ্টিধর্মী। জন্মেছিলেন এক বিরল প্রতিভা নিয়ে। বিদ্রোহ ছিল তার সহজাত প্রবৃত্তি। নিজ ধর্ম, সমাজ, পরিবার ও পরিজন ত্যাগ করে হয়েছিলেন দেশান্তরী। সৃষ্টিধর্মী দুঃসাহসিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই তার জীবনে এসব ঘটে।

শিশুকালেই মাতা জাহ্নবী দেবীর কোলে এই অসাধ্য সাধনের মন্ত্র তিনি পাঠ করেছিলেন। কপোতাক্ষের কুলুকুলু ধ্বনি দুই কূলের সবুজ শস্যখেত, পাখির কাকলি, ঘনসবুজ বন-লতাপাতা আর ধূসর মাটির ধূলিকণা শিশু মধুসূদনের দেহ ও মনকে গড়ে তুলেছিল বাঙালি করে।

কৈশোরে কলকাতায় হিন্দু কলেজের সংস্কারমুক্ত বিপ্লবী পরিবেশের ছায়াতলে বেড়ে উঠেছিলেন মধুসূদন। হিন্দু কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ডিরোজিওর সাথে কবিতার মাধ্যমে মধুসূদনের আত্মার পরিচয় ঘটে। ডিরোজিওর সংস্কারমুক্ত মুক্তিবাদের দীক্ষা ও রিচার্ডসনের শিক্ষা মধুসূদনকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছিল। এখানেই তিনি বিশ্বসাহিত্যের জানালা দেখতে পেয়েছিলেন।

‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকটি মধুসূদনের এক অনন্য সৃষ্টি। শর্মিষ্ঠার কাহিনী গ্রহণ করেছেন মহাভারতের আদিপর্ব থেকে। এ নাটকে আধুনিক চরিত্র রূপায়ণে তার সুকৌশলী মনোভাব তাকে সার্থক নাট্যকার হিসেবে এনে দিয়েছে দুর্লভ খ্যাতি ও কৃতিত্ব। নাটকটি সম্পর্কে রাজা যতীন্দ্র মোহন ঠাকুর অভিমত ব্যক্ত করে বলেছেন, এ নাটক হলো আমাদের ভাষায় সেরা নাটক।

তিনি সৃষ্টির উন্মাদনায় পদ্মাবতী (১৮৬০), একেই কি বলে সভ্যতা (১৮৬০), বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ (১৮৬০), কৃষ্ণকুমারী (১৮৬১) এবং মায়া কাননের (১৮৭৪ মৃত্যুপরবর্তী প্রকাশিত) মতো অসাধারণ নাটক ও প্রহসনগুলো রচনা করেছিলেন।

মেঘনাদবধ কাব্য রামায়ণের পৌরাণিক কাহিনী থেকে সংগৃহীত হলেও প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবনার সংমিশ্রণে মধুসূদনের এ এক অপরূপ সৃষ্টি। মেঘনাদবধ মহাকাব্যের অসাধারণ সাফল্যের মাধ্যমেই মধুসূদন কবি হিসেবে লাভ করেছেন ব্যাপক যশ ও খ্যাতি।

কবি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে শ্রী মধুসূদন থেকে মাইকেল মধুসূদন হয়েছিলেন বটে। বাঙালিত্বই ছিল তার আমৃত্যু অহঙ্কার। শুধু তাই নয়, নিজেকে নিয়ে তার সেই সরস পরিহাসও সবিশেষ উল্লেখের অপেক্ষা রাখে ‘আমি শুধু বাঙালি নহি, আমি বাঙাল, আমার বাটি যশোহর।’

তিনি নিজের ভাষার চেয়ে আরও কঠিন এক স্তরে চলে গিয়ে সাধনা করেছিলেন আরো বড় কিছু করার এবং তা করেছেনও।

মাইকেলের ব্যক্তিগত জীবন ছিল নাটকীয় এবং বেদনাঘন। মাত্র ৪৯ বছর বয়সে কলকাতায় কপর্দকশূন্য করুণ অবস্থায় মৃত্যু হয় এই মহাকবির। মধুসূদনের শেষ জীবন চরম দুঃখ ও দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। আইন ব্যবসায় সাফল্য পাননি। অমিতব্যয়ী স্বভাবের জন্য হয়ে পড়েন ঋণগ্রস্ত।

দাম্পত্যজীবন বলতে মধুসূদন রেবেকা ম্যাকটিভিস নামে এক ইংরেজ যুবতীকে বিবাহ করেন। এই বিয়ে সাত বছর স্থায়ী হয়েছিল। রেবেকার গর্ভে মধুসূদনের দুই পুত্র ও দুই কন্যার জন্ম হয়। মাদ্রাজ জীবনের শেষ পর্বে রেবেকার সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়ার পর এমিলিয়া আঁরিয়েতা সোফিয়া নামে এক ফরাসি তরুণীকে বিয়ে করেন। আঁরিয়েতা মধুসূদনের সারাজীবনের সঙ্গিনী ছিলেন।

মহাকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী প্রদান করেছেন। জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে কবির জন্মভিটা সাগরদাঁড়িতে ২০ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে সপ্তাহব্যাপী মধুমেলা। শেষ হবে কাল ২৬ জানুয়ারি। মধুমেলা উপলক্ষে সাগরদাঁড়ি সেজেছে বর্ণিল সাজে। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় যশোরের জেলা প্রশাসন এ মেলার আয়োজন করেছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৮/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়