ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

কে বলেছে বই বিক্রি হয় না : দীপংকর

পলিয়ার ওয়াহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:২৮, ৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কে বলেছে বই বিক্রি হয় না : দীপংকর

দীপংকর

প্রথমে বইয়ের ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা। তারপর ছোট আকারে বইয়ের দোকান। এক সময় সেটি বড় পরিসরে রূপ পেল। প্রতিষ্ঠিত হলো বাতিঘর। বই বিক্রির স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানটি বইপ্রেমী পাঠকের কাছে পরিচিত। সেই পরিচয় সূত্রেই চট্টগ্রামের পর বাতিঘর এখন রাজধানীতে। পলিয়ার ওয়াহিদ কথা বলেছেন বাতিঘরের স্বত্ত্বাধিকারী দীপংকরের সঙ্গে।

পলিয়ার: প্রথমে আমরা বাতিঘরের নাম শুনি; সাথে আরেকটি নাম- দীপংকর। বইয়ের প্রতি দীপংকরের ভালোবাসা তৈরি হলো কীভাবে?

দীপংকর: ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে পড়তে ভালোবাসা তৈরি হয়। তখন বই সংগ্রহ করতাম। আমরা বন্ধুরা মিলে বই পড়তাম। ফলে সবাই নতুন বইয়ের সন্ধান করতাম। যদিও অনেক সময় বইগুলো পেতাম না। ঢাকা এসেও অনেক সময় বই খুঁজেছি। এভাবে এক সময় আমি বইয়ের প্রেমে ডুবে যাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংস্পর্শে এসে।  বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমি দীর্ঘদিন চাকরি করেছি। তো চট্টগ্রামের অবস্থা ঢাকার চেয়ে খারাপ ছিলো। কোনো বই পেতাম না। ভালো বই খুঁজে না পাওয়ার ফলে একটা আগ্রহ তৈরি হয়। সেই আগ্রহ থেকে ১৯৯২ সালে আমি চট্টগ্রামে একটা বইঘর দেই। কিন্তু এটা যে ব্যবসা হিসেবে নেব কখনো ভাবিনি। কারণ তখন আমাদের কাছে টাকা-পয়সা ছিলো না।

পলিয়ার: ঐ সময়টাতে বাতিঘরের সাথে আর কেউ জড়িত ছিলো?

দীপংকর: না। সিদ্ধান্তটা আমিই প্রথমে নেই। কারণ আমি যেহেতু বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কাজ করেছি, ভাবনাটা আমার ভেতরেই প্রথম মাথা চাড়া দেয়। তারপর আস্তে আস্তে পাঠকের সাড়া পাওয়া যায়। পাঠক নতুন নতুন বইয়ের অর্ডার দিতে থাকেন। আমরা তাদের চাহিদা পূরণের একটা তাগাদা অনুভব করতে থাকি। এভাবেই ‘বাতিঘর’ সত্যিই একদিন বাতিঘরে রূপ নিলো।

পলিয়ার: ‘বাতিঘর’ নামটি কেন বেছে নিয়েছিলেন? অন্য নাম কেন নয়?

বাতিঘর: এই শব্দ চট্টগ্রামের সাথে ঐতিহাসিকভাবে জড়িত। বাতিঘর মানেই তো আলোকবর্তিকা। বই তো প্রকৃতপক্ষে আলো দেখায়। রাস্তা তৈরি করে দেয়। মনের চোখ খুলে দেয়।
 


পলিয়ার: এই যে ছোটবেলা থেকে বই পড়া এবং সংগ্রহ করার নেশায় আপনি বুঁদ হয়ে আছেন। এজন্য কাউকে কী দায়ী মনে হয়, মানে প্রভাবটা জানতে চাচ্ছি।

বাতিঘর: (হাসতে হাসতে)হু, দায়ী করার মতো লোক তো আছেই। বিশেষ করে আমার কাকা ও মামারা বই পড়তেন। আমিও তাদের বই ঘাটাঘাটি করতাম। বিশেষ করে ‘পটিয়া মোস্তাফিজুর রহমান পাবলিক লাইব্রেরি’ আমাকে বেশি বেশি বই পড়ার দিকে টেনে আনে। এখানেই আমরা বেশিরভাগ সময় কাটাতাম। নানা রকম বই হাতের কাছে পেতাম।

পলিয়ার: চট্টগ্রামে ‘বাতিঘর’ কার্যক্রম শুরু করল কবে?

দীপংকর: ২০০৫ সালে। সেখানে আমরা ঢাকা, কলকাতা থেকে বই সংগ্রহ করে রাখতাম। অন্য দেশ থেকেও বই এনেছি। এমনকি ঢাকার অনেক লেখক চট্টগ্রাম বাতিঘর থেকে বই অর্ডার করে সংগ্রহ করেছেন। তারপর দেখি বেশ চাহিদা বাড়ছে বইয়ের। ছোটঘরে আর সম্ভব হচ্ছে না। ২০১২ সালে আমরা চট্টগ্রামে বড় পরিসরে বাতিঘরকে সাজালাম।  প্রথমে তো অনেক শঙ্কা ছিলো। কতটা চলবে। আমরা কতোটা পারব- এসব ছিলো। তবু আমি আশা হারাইনি। মানুষ এতো ব্যস্ত, এতো বিনোদনের মাধ্যম থাকা সত্ত্বেও বই পড়ছে। বই কিনছে।

পলিয়ার: ঢাকায় ইতিমধ্যে বেশ কিছু বইয়ের বড় দোকান গড়ে উঠেছে। এটা ভালো খবর। কিন্তু অনেকে বইয়ের সঙ্গে চা-কফি, টিক্কা-কাবাবের আয়োজনও রাখছেন। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখেন?

বাতিঘর: বিষয়টিকে আমি মোটেও পজেটিভলি দেখি না। বইয়ের সাথে চা-কফির নিবিড় সম্পর্ক থাকলেও সেটাকে ব্যবসায়ীক মনোভাবে চালানো মোটেও ঠিক না। বইয়ের সাথে অন্য কোনো কিছুর তুলনা চলে না। ফলে বইয়ের সাথে অন্য ব্যবসা কেন? তাছাড়া বই নিয়ে সিরিয়াস নয় বলেই তারা এমনটা করছে বলে আমার মনে হয়। আমার উদ্দেশ্য শুধু বই নিয়ে। অন্যকিছু আমি বইয়ের সাথে মেলাতে পারি না। কারণ খাবারের সাথে আবর্জনা থাকে। তখন পরিবেশটা নষ্ট হবে। কোলাহল হবে।

পলিয়ার: আপনিও তো চা-কফির ব্যবস্থা রেখেছেন?

বাতিঘর: এটা আমি ব্যবসা করার জন্য রাখিনি। শুধুমাত্র সৌজন্যের খাতিরে এই ব্যবস্থা রেখেছি। ধরুন কেউ পানি পান করতে চাইল। কেউ অনেকক্ষণ বই খুঁজছে। তখন চায়ের তেষ্টা পেল। সে চা পান করবে। এজন্য তাকে বাড়তি টাকা দিতে হবে না। বই পড়ে বই কেনে এমন পরিচিত-অপরিচিত সবাই এই সুযোগটা যেন পায় সেজন্য আমি এটা করেছি। বসে যেন একটু ভাবতে পারে। দুই পৃষ্ঠা পড়ে বইটা কিনতে পারে। আর যারা মূলত পড়ুয়া তারা বেশি ঘুরঘুর করে না। তালিকা বা বইয়ের চাহিদা নিয়ে আসে। অর্ডার করে। কাউন্টারে বই পেলে নিয়ে চলে যায়।
 


পলিয়ার: একটা বিষয় লক্ষ্য করেছি, আপনি বাতিঘরে থাকলে সেলসম্যানের মতো গ্রহকের সঙ্গে মন খুলে কথা বলেন। নিজেই তাদের সাহায্য করার চেষ্টা করেন।

বাতিঘর: এটাই তো আমার মূল কাজ। আমি তো শুধু বই নিয়ে ভাবি। পাঠকের চাহিদা পূরণে আমি সর্বদা চেষ্টা করি। নিজ থেকেই লেখক-পাঠকদের সাথে কথা বলি। কী রকম বই তারা খুঁজছে জানার চেষ্টা করি। সবার পাঠক-মন আমি বুঝতে চাই। নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাদের সময় দেই। এতে অন্যের রুচি-মন-মেজাজ ধরা যায়। পাঠকের রুচি অনুযায়ী তাদের বই রাখার চেষ্টা করি। ফলে তাদের রুচি অনুযায়ী নতুন বইয়ের সন্ধানও পাওয়া যায়। সে বই না থাকলে এনে দিতে পারি। পড়ুয়া মানুষের সাথে সম্পর্ক মানেই তো শত শত বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক।

পলিয়ার: বাতিঘরের স্লোগান নেই যে!

বাতিঘর: স্লোগান বলতে দেখুন পড়ুন শুনুন। এছাড়া আর কি বলার আছে? স্লোগানেই তো আর কেউ বদলে যাবে না। বরং যদি পড়ে, তবেই বদলে যেতে পারেন যে কেউ।

পলিয়ার: এবার একটু ভিন্ন প্রশ্ন করি?

বাতিঘর: তাহলে একটু চা-পানি খেয়ে নিতে পারি আমরা।

পলিয়ার: ধন্যবাদ। মন্দ হয় না। তবে চা পান করতে করতে আমরা কথা বলতে পারব তো?

বাতিঘর: কেন নয়?

পলিয়ার: (চা পানের ফাঁকে)প্রথমে সংগ্রহশালা। তারপর ছোট আকারে বইঘর। তারপর বড় পরিসরে বাতিঘরে রূপ নিলো। এখন তো প্রকাশনাও আছে।

বাতিঘর: আমি বাতিঘর থেকে ২০০৯ সালে একটা বই প্রকাশ করি। এটাই বাতিঘরের প্রথম বই। তারপর বইঘর চালাতে গিয়ে পেরে উঠছিলাম না। আর সিরিয়াসলি প্রকাশনা করব তাও ভাবিনি। কিন্তু ২০১৬ সালে আমরা ১০-১২টা বই প্রকাশ করি এবং মেলায় আসি। পরের বছরও আমরা মেলায় অংশগ্রহণ করি এবং পুরস্কারও পেয়ে যাই সেরা আয়োজনের জন্য। তখন আমরা ভাবলাম, এবার আমরা একটা প্রকাশনা দাঁড় করাতে পারব হয়তো। সেভাবেই শুরু করেছি।
 


পলিয়ার: একটা কমন কথা বাজারে চালু আছে- বই বিক্রি হয় না। এটা প্রকাশকরাই বেশি বলেন। বই যদি বিক্রি না-ই হবে তাহলে এতো প্রকাশনা টিকে থাকে কীভাবে? বিষয়টিকে কীভাবে দেখেন?

বাতিঘর: বিষয়টি যে একেবারে  ঠিক নয়, এমন না। কিছু ছড়ানো-ছিটানো প্রকাশনা আছে। কিন্তু আমরা এভাবে ড্রিল করি না। আমরা লেখকদের সঙ্গে একটা আস্থার সম্পর্ক তৈরি করতে চাই। যে বই বিক্রি হচ্ছে তার সম্মানী দিয়ে দেই। আবার যার বই চলেনি, সেটাও জানিয়ে দেই। গতবারও আমি অনেক লেখককে সম্মানী দিয়েছি। এমনকি অগ্রীম টাকাও দিয়েছি এবার। পাঁচশ কপি করবো তার টাকা আগেই দিয়ে দিয়েছি। তবে হ্যাঁ, গতবার থেকে প্রকাশক সমিতি আইন জারি করেছে, লেখকের সাথে চুক্তি ছাড়া কোনো বই করা যাবে না। এবং এটা কার্যকরও হচ্ছে। অন্যথায় যদি কেউ বই প্রকাশ করেন  এবং কোনো ঝামেলা সৃষ্টি হয় তাহলে সেই প্রকাশনা সকল দায় বহন করতে বাধ্য থাকবে। এটা অবশ্য আস্তে আস্তে ঠিক হবে। প্রকাশকরা এ ব্যাপারে বেশ সচেতন হচ্ছে। আপনি দেখবেন, নতুন কিছু প্রকাশনা এক বছর বই করে আর বাজারে থাকে না। যাদের উদ্দেশ্য টিকে থাকা তারা ঠিকমতো কাজ করতে বাধ্য। আর বই তো বিক্রি হয়। কে বলেছে বই বিক্রি হয় না? এখনো মানুষ যথেষ্ট বই পড়ে। প্রতিদিন আমরা শত শত বই বিক্রি করছি।

পলিয়ার: এই মেলায় বাতিঘর থেকে নতুন কী বই আসছে?

বাতিঘর: ১৫-২০টি বই আসবে। উল্লেখযোগ্য বলতে বিষ্ণু দের ‘বাংলাদেশ’, আবুল ফজলের ‘চিত্রলেখা’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ হচ্ছে, শুভাশিস সিনহার ‘আখ্যানকাব্য’, বুদ্ধদেব বসুর অখণ্ড ‘আত্মজীবনী’, ‘নিঃসঙ্গতার একশো বছর’-এর সূবর্ণজয়ন্তি সংখ্যা করব। চাকমা ও আদিবাসি গল্প রয়েছে। সৈয়দ শামসুল হকের কিশোর উপন্যাসও উল্লেখযোগ্য।

পলিয়ার: প্রযুক্তির কল্যাণে পিডিএফ বা ই-বুক এবং গুগলের মতো তথ্য ভাণ্ডার বাড়ছে। কাগজের বইয়ের ভবিষ্যত কী মনে করেন?

বাতিঘর: কাগজের বইয়ের বিকল্প অন্য কিছু হতে পারে না। তরুণরা যারা পিডিএফ বা ই-বুক পড়ছে তাদের একটা বড় অংশ কিন্তু শহরের। এটা সময়ের দাবি। যেটা সহজে আমরা হাতের কাছে পাই সেটাই ব্যবহারে সুবিধা মনে করি। সিরিয়াস পাঠক শুধু পড়ে না, বই সংগ্রহ করতেও পছন্দ করে। সেক্ষেত্রে কাগজের বইয়ের বিকল্প কই?  এর যেমন পজেটিভ দিক আছে, তেমনি আছে ভয়ংকর নেগেটিভ দিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়