ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একুশ ও শহীদ মিনারের বাংলাদেশ || পিয়াস মজিদ

পিয়াস মজিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:২৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একুশ ও শহীদ মিনারের বাংলাদেশ || পিয়াস মজিদ

স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো
চার কোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো। যে ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরের মুকুট নীল পরোয়ানা     খোলা তলোয়ার
খুরের ঝটিকা ধুলায় চূর্ণ          যে পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি আর তুলি হাতিয়ার    হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা     সেই অনন্য।
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। ভয় কী বন্ধু, আমরা জাগরী
                 চার কোটি পরিবার ॥

এই কবিতা ১৯৫২ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বসে বিশ বছরের তরুণ আলাউদ্দিন আল আজাদের লেখা; পাকিস্তান পুলিশ কর্তৃক ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মরণে ছাত্রদের নির্মিত শহীদ মিনার ভাঙার প্রতিবাদে এভাবেই নিঃশব্দ বজ্রের মতো জ্বলে উঠেছিলো পূর্ববাংলার চৈতন্য।

এই ইতিহাস সবারই জানা যে, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ১৯৫২’র ২১শে ফেব্রুয়ারি সালাম, বরকত, রফিক, শফিক, জব্বারের মতো তাজা-তরুণপ্রাণ নিজেদের রক্তের আল্পনায় রঞ্জিত করেছিলো রাজপথ। এর অব্যবহিত পর ২৩শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল ছাত্রাবাসের ছাত্রদের তাৎক্ষণিক পরিকল্পনা ও শ্রমে ঢাকার বুকে ভাষাশহীদদের রক্তসিক্ত স্থানে নির্মিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ যা লোকবয়ানে ‘শহীদ মিনার’ নামে পরিচিতি পায়। তবে বর্বর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাংলার ছাত্রজনতার সে বিশুদ্ধ শোকাবেগকে বিন্দুবৎ মূল্য দেয়নি। তাই ২৬শে ফেব্রুয়ারি উদ্বোধনের পরপরই সে শহীদ মিনার মূঢ়ের আক্রোশে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু তারা জানত না যে, বাঙালির শোক ক্রমশ রূপ নেবে শক্তিতে। ভাঙনের শিকার সে শহীদ মিনারের প্রেরণায় সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠে অসংখ্য শহীদ মিনার আর ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয় ‘শহীদ দিবস’ হিসেবে। ১৯৫৬ সালের একুশের সকালে পূর্ববাংলা সরকারের প্রণোদনায় বর্তমান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। এরপর আতাউর রহমান খানের আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার কার্যকালে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শিল্পী হামিদুর রহমান এবং ভাস্কর নভেরা আহমেদ ১৯৫৭ থেকেই ১৯৫৮ পর্যন্ত চালিয়ে যান মিনারের নির্মাণ কাজ।

এরপর পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হলে বন্ধ হয়ে যায় নির্মাণ কাজ। তবে ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত অসম্পূর্ণ শহীদ মিনারেই বাঙালি নিবেদন করেছে শ্রদ্ধার অর্ঘ্য। ১৯৬৩-তে শহীদ মিনার সম্পূর্ণতার কাঠামো পায়। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭১-এর মার্চ পর্যন্ত এই শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে বাঙালি জাতির মুক্তি ও স্বাধীনতার শপথ-সংকল্পের স্থান। একাত্তরে আরও অনেক কিছুর মতো শহীদ মিনারও পাক-সেনার নির্মমতার শিকার হয়। ২৫শে মার্চ গণহত্যা শুরুর পর শহীদ মিনার ভেঙে পাক বর্বরবাহিনী সেখানে ‘মসজিদ’ পরিচয়-বিজ্ঞপ্তি লিখে বিভ্রান্ত ছড়ানোর চেষ্টা করে। যদিও তাদের সকল অপকৌশলের জবাব বাংলাদেশ দেয় মার্চ থেকে ডিসেম্বর- এ নয়মাস অসমসাহসে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে। স্বাধীন বাংলাদেশে শহীদ মিনার পরিণত হয় মুক্তি ও স্বাধীনতার নতুন প্রতীকে।

বাংলাদেশ পর্বেও নানা সময়ে যখন শহীদ মিনারে সভা-সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে কিন্তু প্রাণদীপ্ত শপথে মানুষ সমবেত হয়েছে এখানেই। বিশেষ পরিস্থিতিতে যখন রাজনীতি প্রকাশ্য থেকে ‘ঘরোয়া’ পর্যায়ে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে তখন মানুষ শহীদ মিনারে জড়ো হয়ে শৃঙ্খলমুক্তির গান গেয়েছে। যখন বাংলাদেশের গুণী-কৃতী কোনো মানুষ প্রয়াত হন তখন তাঁর প্রতি হৃদয়ের নৈবেদ্য প্রকাশের জন্য মিনারের পাশেই রাখা হয় তাঁর মৃতদেহ। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা থেকে শুরু করে হাসপাতালের সেবক-সেবিকারাও তাদের দাবি আদায়ে অবস্থান নেন, অনশন করেন শহীদ মিনারের প্রান্তে বসে। নীতি ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য আজ থেকে প্রায় সাত দশক আগে যে শহীদ মিনার এলাকায় তরুণেরা প্রাণ দিয়েছিল হয়তো তাদেরই প্রেরণায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেদের দাবি আদায়ের উজ্জীবন লাভ করে এখানে এসে।

বাংলাদেশের এমন কোনো বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে একটি শহীদ মিনার নেই। এমনকি অনেক গ্রামেও গড়ে উঠেছে শহীদ মিনার। সেসব শহীদ মিনারে মানুষ কেবল শ্রদ্ধাই নিবেদন করেন না, সে শহীদ মিনারগুলো স্থানীয় সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রবিন্দুও বটে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীরা চাঁদা তুলেও শহীদ মিনার গড়ে তুলেছে। বর্হিবিশ্বে যেখানেই বাংলাদেশের মানুষ কর্মসূত্রে বসবাস করছে, তাদের অনেকেই দূতাবাসের সহায়তায় বিদেশের মাটিতে গড়ে তুলেছে স্বদেশের ইতিহাসের স্মারক-শহীদ মিনার। মানুষের ব্যক্তিগত অশ্রু কীভাবে স্মৃতিস্তম্ভের অবয়বে গোটা জাতির অশ্রুসিক্ত রক্তজবা হয়ে ফুটে থাকে তার সাক্ষ্য ছড়ানো শহীদ মিনারের বেদিতে, কার্নিশে।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের দেশজোড়া বিস্তৃতির বিষয়টি নিয়ে প্রয়াত কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখেছিলেন: ‘আমার মনে হয় একদিন আমাদের কোন আলোকচিত্রশিল্পী তার ক্যামেরায় ধরে রাখবেন সারা দেশে ছড়ানো ছিটানো এই শহিদ মিনারগুলো; তিনি রচনা করবেন একটি অ্যালবাম কিংবা করবেন একটি প্রদর্শনী, আমরা এক আয়ত্তের ভেতর দেখতে পাবো মানুষ তার অন্তরের ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে কীভাবে প্রতিবার নতুন করে রচনা করেছে শহিদ মিনার, একটি মিনারকে মনে রেখে, ঢাকার কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার।’

বাংলাদেশজুড়ে গড়ে ওঠা লক্ষ লক্ষ শহীদ মিনারের চারপাশে উৎকীর্ণ থাকে এমন চৈতন্যদীপ্ত বাণীগুচ্ছ- ‘এক একটি বাংলা অক্ষর এক একটি বাঙালীর জীবন’, ‘মোদের গরব, মোদের আশা আমরি বাংলা ভাষা’ কিংবা ‘যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।’ একুশের প্রথম প্রহরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে এদেশে বসবাসরত ক্ষুদ্র ভাষাসত্তার মানুষও শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন, নিজের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষায় একুশের চেতনার প্রেরণাপ্রবাহে যেন অবগাহন করেন তারা। শহীদ মিনার বাংলাদেশজুড়ে তার ব্যাপ্তি বিস্তৃত করেনি শুধু, একই সঙ্গে বাংলা অভিধানে এই শব্দের সীমাও বৃদ্ধি করেছে। পৃথিবীর নানা স্থানেই নানা স্মরণে শহীদ মিনার গড়ে উঠেছে কিন্তু আর কোথাও শহীদ মিনারকে ‘প্রাণের মিনার’ নামে সম্বোধনের তথ্য আমাদের জানা নেই। যে ভাষা মানুষের প্রাণপ্রতিম, সে ভাষার জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণবিসর্জনের ইতিহাস রচনাকারী জাতিই তো শহীদ মিনারকে ডাকতে পারে ‘প্রাণের মিনার’ বলে। একুশের প্রথম প্রহর থেকে দুপুরজুড়ে চলে সকলের ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্পণ, তারপর বাংলাদেশের বালক-বালিকা স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায়, পরম মমতায় শহীদ মিনারে মানুষের দেয়া পুষ্পমাল্য ছড়িয়ে দেয়, বিছিয়ে দেয়, সাজিয়ে দেয় মিনারের চারপাশ। গাঁদা আর গোলাপ ফুল তো উপলক্ষমাত্র, কেন্দ্র থেকে প্রান্তজুড়ে বাংলাদেশের মানুষের অন্তর-সুরভি এক হয়ে যেন স্মরণ করে ১৯৫২-এর অসমসাহসী শহীদ তারুণ্যকে।

পাকিস্তানিরা শহীদ মিনারের স্তম্ভ নয়, ভয় করেছিলো বাঙালির স্মৃতির শক্তিকে। বাংলাদেশের মানুষ কিন্তু সে স্মৃতি সংগ্রামের উপজীব্য করেছে এবং জয়ী হয়েছে। ১৯৫২’র পথ বেয়ে  এসেছে ১৯৭১। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের এই সংগ্রামী পরিক্রমায় শহীদ মিনার হয়ে উঠেছে এক অমোঘ প্রেরণাবিন্দু; যে বিন্দুতেই লুক্কায়িত ছিল মুক্তির মহাসিন্ধু।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়