ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

হিসাব কিতাব || গুলজার

ফজল হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০১, ২৩ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হিসাব কিতাব || গুলজার

গুলজার


ভাষান্তর : ফজল হাসান

 

মাষ্টার রাম কুমারের মেয়ে ঊষার সঙ্গে বাবু দীননাথ তার ছেলে সারভান কুমারের বিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ।

মাষ্টার রাম কুমার ভীষণ খুশি। তিনি মেয়েকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন এবং বিএ ডিগ্রি নেয়ার জন্য উৎসাহ যুগিয়েছেন। এছাড়া তিনি মেয়ের উচ্চ আদর্শকে পরিপূর্ণ করার জন্য সহায়তা করেছেন। তবে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ঊষা যখন কাজ করার অনুমতি চেয়েছে, তখন তিনি সামান্যতম আপত্তি জানাননি। তিনি যদি চিন্তিত হতেন, তাহলে একটা কারণেই- মেয়ে যদি নিজের পছন্দ মতো কোনো ছেলে খুঁজে নিয়ে আসে। তখন অবশ্য ঊষার বয়স অনেক কম ছিল। শারীরিকভাবে ছেলেমেয়েরা বড় হলেও অনেক সময় ওরা বিচক্ষণ হয় না। যাহোক, ঊষা কখনই বাবাকে অনুযোগ করার সুযোগ দেয়নি । তবে সত্যি কথা বলতে কি, যতবারই তার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছে, ততবারই সে রীতিমতো মাথা নিচু করে শ্রদ্ধার ভঙ্গিতে বলেছে, ‘আপনার সিদ্ধান্ত আমি মেনে নেব।’

তিন বা চার বছর ধরে ঊষা চাকরি করে এবং পরিবারের আর্থিক বোঝার কিছুটা সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হলো তখনো সে অবিবাহিতা এবং আস্তে আস্তে মাষ্টার রাম কুমারের ঘাড়ে ভারি বোঝা হয়ে যাচ্ছিল। তার কাছে অনেকগুলো বিয়ের প্রস্তাব এসেছে, কিন্তু সমঝোতার সময় সবগুলো প্রস্তাবই ভেস্তে গেছে। সবাই অর্থকড়ি দাবি করে। কেউ যদি পঁচিশ হাজার রুপি যৌতুক হিসাবে চায়, তবে অন্যপক্ষ চায় এক লাখ। অন্যদিকে যাদের অর্থকড়ির প্রয়োজন নেই, তারা ছেলের জন্য স্কুটার বা গাড়ির আবদার করে।

‘মোদ্দা কথা স্বর্ণ এবং হীরক হলো আশীর্বাদস্বরূপ। যাহোক, সেগুলো তো আপনার মেয়েই ব্যবহার করবে। মাষ্টারজি, সত্যি বলতে কি, জগতে কেউ এমন আছে যে, যার ভালো এবং খারাপ সময় যায় না। খারাপ সময় যখন আসবে, তখন বাবা-মায়ের দেয়া আশীর্বাদই একজনকে সাহায্য ...’

 


মাষ্টার রাম কুমার অনুভব করেন যে, ঘুণপোকা তার মস্তিষ্ক খেয়ে ফেলেছে । তিনি কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলেন না, সেই সময়ে তার কী করা উচিত ছিল। বিষয়টা যদি পাঁচ কিংবা দশ হাজার রুপির হতো, তাহলে তিনি কারোর কাছ থেকে ধারকর্জ করে দুর্যোগটা কাটিয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু যৌতুকের পরিমাণ খুবই বেশি, যা তার ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি যা উপার্জন করেছেন, তা ঊষার লেখাপড়ার পেছনে ব্যয় করেছেন। তাঁর শুধু একটা বাড়ি আছে, যেখানে তিনি পরিবার নিয়ে বাস করেন। বাড়িটা ছেড়ে যদি অন্য কোথাও চলে যান, তাহলে তিনি অর্থকড়ি যোগাড় করতে পারবেন। কিন্তু তখন তাঁর মাথার উপর কোনো ছাদ থাকবে না ।

আকস্মিকভাবে দীননাথের সঙ্গে মাষ্টার রাম কুমারের সাক্ষাৎ ঘটে। সাইন বোর্ড লেখার একটা দোকান রয়েছে দীননাথের। তার দোকানের ব্যবসা ভালোই চলছিল। রাস্তাঘাটের নাম হরদম পরিবর্তন করা হচ্ছে। পৌরসভার সঙ্গে তার দহরম ভালো। হাতের গোপন কাজের বিনিময়ে সে কয়েকটি কাজ বাগিয়ে নিয়েছে। রাস্তার নতুন নামকরণ করা হলে পুরনো নাম লোকজনের মনে রাখতে সত্যি কতদিন আর সময় লাগে। বাড়িঘরের নতুন নাম এবং নাম্বারের কোনো অভাব নেই । দীননাথের দোকানে চার বা পাঁচজন লোক কাজ করে। এছাড়া তার একমাত্র ছেলে ভালোভাবেই ব্যবসা পরিচালনা করছিল। কখনই কোনো ইংরেজি বর্ণ ভুল লেখা হয়নি। এবং এখন তার দোকানে একটা হিন্দী-ইংরেজি অভিধানও আছে।

মাষ্টার রাম কুমার স্কুলের জন্য একটা সাইন বোর্ড লেখার কাজে দোকানে গিয়েছিলেন। সেখানেই দীন নাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয়। সাইন বোর্ডের জন্য তিনি চক দিয়ে সুন্দর হস্তাক্ষরে কথাগুলো লিখে নিয়ে যান। দীননাথ জানতে চেয়েছিল কার অমন সুন্দর হাতের লেখা।

‘মার মেয়ে। একসময় ও স্কুলে আঁকতো।’

‘সত্যি! এখন কী করে? পড়াশোনা?’

‘সে গ্র্যাজুয়েট। চাকরি করে।’

‘ভালো, খুব ভালো।’


যেদিন মাষ্টার রাম কুমার সাইনবোর্ড আনতে দোকানে গিয়েছিলেন, সেদিন তিনি দীননাথের সঙ্গে দীর্ঘ সময় গল্প করেন ।

দীন নাথের চিন্তা-ভাবনার বিষয় এবং পরিধি নিয়ে মাষ্টার রাম কুমার ভীষণ আনন্দিত।

‘মেয়েদের কাজ করা আমি সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করি। তারা অবশ্যই হেঁশেল থেকে বেরিয়ে আসুক এবং বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে পরিচিত হোক– সত্যি বলতে কি, আমি মনে করি, তারা শুধু নিজেদের পায়ে দাঁড়াক না, বরং তারা হাঁটুক, এমনকি দৌড়াক। আমাদের কথাই ধরুন। সারভানের মা যদি নিজের ঘর ছেড়ে বাইরে এসে দোকানে কাজ করতে চায়, তাহলে আমাদের মধ্যে একজন যাবো এবং তাকে নিয়ে আসবো। আমরা দ্বিগুণ ভাড়া ব্যয় করি। এটা কী সনাতন নিয়ম না, মাষ্টার... মাষ্টার রাম কুমারজি?’


ক্রমে তাদের দুজনের মধ্যে ভালো সখ্য গড়ে উঠে।

দীননাথ চায়ের নিমন্ত্রণে একদিন মাষ্টার রাম কুমারের বাড়ি যায়। সেখানে ঊষার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অন্য আরেক দিন দীননাথ রাতের খাবার খেতে মাষ্টার রাম কুমারকে নিমন্ত্রণ করে । তাঁর সঙ্গে ঊষাও গিয়েছিল । পারিবারিকভাবে পরিচয় হওয়ার পর থেকে দুই পরিবারের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এবং তারপর একদিন ...

বাবু দীননাথ তার ছেলে সারভান কুমারের সঙ্গে মাষ্টার রাম কুমারের মেয়ে ঊষার বিয়ের আয়োজন করে ।

উভয়েই ভীষণ খুশি ।


মাষ্টার রাম কুমার তাঁর মেয়ে ঊষাকে বলেছেন, ‘‘বাবু দীননাথের আদর্শ অত্যন্ত উঁচু মাপের। আজকাল এবং তোমার মতো বয়সের যে কেউ স্বামী খুঁজে পাবে, কিন্তু তার মতো শ্বশুর পাওয়া যাবে কী? সে আমাকে বলেছে, ‘যৌতুক হিসাবে আমি এক পয়সাও চাই না। মেয়েকে পরনের কাপড়েই পাঠিয়ে দিন। বাইরে কাজ করার জন্য আপনার মেয়ের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে।’ আমি অত্যন্ত আশ্চার্য্যান্বিত হয়েছি। সে আরো বলেছে, ‘সত্যি বলতে কি, আমার একমাত্র শর্ত হলো এই বাড়িতে আসার পর ঊষা বাইরের কাজ চালিয়ে যাবে। আমি হেঁশেলে আরেকজন কাজের মেয়ে চাই না ...’’


এবং দীননাথ তার স্ত্রীকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করে এবং বলে, ‘রাগ করো না, ঈশ্বরী । তুমি যা সোনাদানা এনেছিলে, তার থেকে কী এখনো কিছু আছে? দোকান দেয়ার সময় কিছু স্বর্ণ বিক্রি করতে হয়েছিল এবং বাকিটুকু আয়কর দিতে চলে গেছে। আমি স্বর্ণ এনেছি, যা জীবিত এবং শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করে, পেনশন এবং যৌতুক একই সূত্র গাঁথা। সে মাসে চৌদ্দশ রুপি উপার্জন করে এবং রীতিমতো স্বচ্ছল। একজন কর্মচারীকে বাদ দিয়ে আমরা অনায়াসে বারোশ রুপি জমাতে পারি। তাই নয় কী?’
 

লেখক পরিচিতি : ভারতের প্রথিতযশা গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্র পরিচালক, কবি, ছোটগল্প লেখক এবং ঔপন্যাসিক গুলজার। তাঁর আসল নাম সাম্পুরাণ সিং কারলা । তৎকালীন অখণ্ড ভারতের পাঞ্জাব (বর্তমানে পাকিস্তানে) প্রদেশের ঝিলাম জেলার দিনা শহরে তিনি ১৯৩৪ সালের ১৮ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন। মূলত হিন্দি, উর্দু এবং পাঞ্জাবি ভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষায় লেখালেখি করেন। ‘টু’ তাঁর একমাত্র উপন্যাস, যা ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরে শরণার্থীদের করুণ কাহিনী নিয়ে রচিত। তিনি তিনটি কাব্যগ্রন্থ এবং দুটি ছোটগল্প সংকলন রচনা করেন।

গুলজারের কর্মজীবন শুরু হয়েছে সংগীত পরিচালক হিসেবে। পরবর্তী সময়ে তিনি গীতিকার, চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সুপরিচিতি লাভ করেন। গীতিকার হিসাবে তিনি ২০০৪ সালে পদ্ম ভূষণ এবং ২০০২ সালে সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার অর্জন করেন। এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারসহ একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড লাভ করেছেন। ‘স্লামডগ মিলনিয়র’ চলচ্চিত্রের গান ‘জয় হো’ রচনার জন্য তিনি অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড এবং গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও অর্জন করেছেন।

গল্পসূত্র : ‘হিসাব কিতাব’ গল্পটি গুলজারের ইংরেজিতে অনূদিত কিন্তু হিন্দী ভাষায় একই শিরোনাম গল্পের অনুবাদ। হিন্দী থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মাসুমা আলি। গল্পটি লেখকের ‘রাভি পার অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ ছোটগল্প সংকলন থেকে নেয়া।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ মার্চ ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়