ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বাংলার লোকবাহন

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:১১, ৬ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বাংলার লোকবাহন

অঞ্জন আচার্য : যে কোনো দেশের ঐতিহ্য সেই দেশের সম্পদ। আমাদেরও রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্যের গৌরব। প্রকৃতপক্ষে নানা ঐতিহ্যের অধিকারী আমরা। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, লোকশিল্প, লোকখেলা, লোকখাবার, উৎসব, মেলা, উপকরণ ও লোকসামগ্রী, অলঙ্কার, লোকযান, লোকাচার, লোকগান, লৌকিক পূজা ও ব্রত, লোকসাহিত্য ইত্যাদি আবহমান বাংলার ঐতিহ্য। মূলত একটি জাতির ঐতিহ্যের মধ্যেই নিহিত থাকে সভ্যতার শেকড়। সেই ঐহিত্যের অংশ লোকবাহন নিয়ে এ লেখা।

আবহমান বাংলায় গাড়ি টানার জন্য গরু-মোষের ব্যবহার চলে আসছে সুদীর্ঘ কাল থেকে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনো গরুর গাড়ি দেখা যায়। একসময় গরুর গাড়ি ছাড়া নিকট দূরত্বে পণ্য আনা-নেয়া কল্পনাও করা যেত না। শুধু তাই নয়, মানুষের যাতায়াতের মাধ্যম ছিল গরুর গাড়ি। গরুর পাশাপাশি এক সময় মোষের ব্যবহারও ছিল। এখনও স্থান বিশেষে এই দৃশ্য দেখা যায়। মোষ ও গরুর গাড়ি এখনো গ্রামাঞ্চলের মানুষের কাছে, বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে কৃষক ও রাখালদের অন্যতম বাহন হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে।

বছর ২৫ আগেও নওগাঁয় অধিকাংশ নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের আয়ের উৎস ছিল গরু-মহিষের গাড়ি। এই গাড়ির উপর নির্ভর করে চলতো তাদের সংসার। বাস্তবতা হলো, ইঞ্জিনচালিত গাড়ির পাশে টিকে থাকাটা দায় হয়ে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী গরু-মোষের গাড়ির। গ্রামীণ রাস্তায় এদের দাপট এতটাই ছিল যে, সিনেমা, গানেও গাড়িয়াল ভাইদের কথা, জীবন ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এক সময়। ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই...’ জনপ্রিয় এই গানটি সে কথার সাক্ষ্য দেয়।

গরু-মহিষের পাশাপাশি যাতায়াতের জন্য ঘোড়ার গাড়ির ব্যবহারও ছিল। ব্যবসায়ীদের মালামাল বহনের ক্ষেত্রেও এর গুরুত্ব ছিল। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে, বিশেষ করে রাজশাহী অঞ্চলে ঘোড়ার গাড়ির ব্যাপক ব্যবহার ছিল লক্ষণীয়। দ্রুতগামী বাহন হিসেবে এসব গাড়ির বিকল্প ছিল না। আগের দিনে অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষের সৌখিন ভ্রমণের অন্যতম মাধ্যম ছিল ঘোড়ার গাড়ি। এখনো সীমিত পর্যায়ে এর ব্যবহার দেখা যায় পুরনো ঢাকায়।

সুপ্রাচীনকাল থেকে বাংলার স্থলপথের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে হাতি। প্রাচীন ও মধ্যযুগে রণক্ষেত্রের বাহন হিসেবেও হাতি ব্যবহৃত হতো। কখনো কখনো রাজা-বাদশাহ এবং আমির-ওমরাহগণ সৌখিন বাহন হিসেবে হাতি ব্যবহার করতেন। বনাঞ্চলের লোকজীবনের জীবিকার অন্যতম অবলম্বনও ছিল হাতি। এছাড়াও নানা উৎসব-অনুষ্ঠানে বাহনের ভূমিকায় হাতির গুরুত্ব ছিল সব কালে। এখনো সৌখিন ভ্রমণের জন্য পর্যটন এলাকায় এর সীমিত ব্যবহার দেখা যায়।
 


এককালে উত্তর ভারত থেকে গাধা আসত বাংলাদেশে। সেগুলো হাটে-বাজারে মালামাল বহনের কাজে, বিশেষত ধোপা ও ধাঙ্গড় পেশার কাজে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে এই প্রাণীর ব্যবহার আর লক্ষ করা যায় না।

মানুষ বহনের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন বাহন হলো পালকি। পালকিতে একজন বা দুজন যাত্রী নিয়ে দুই বা চারজন বাহক এটিকে কাঁধে তুলে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। ‘পালকি’ শব্দটি সংস্কৃত ‘পল্যঙ্ক’ বা ‘পর্যঙ্ক’ থেকে উদ্ভূত। অনেক জায়গায় এই যানকে ‘ডুলি’ বা ‘শিবিকা’ নামেও ডাকা হয়। সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে এবং পরবর্তী সময়ে সেনাধ্যক্ষদের যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল পালকি। আধুনিক যানবাহন আবিষ্কৃত হওয়ার আগে অভিজাত শ্রেণির লোকেরা পালকিতে চড়েই যাতায়াত করতেন। অভিজাত পরিবারে এবং গ্রামাঞ্চলে বিয়ের অনুষ্ঠানে একসময় পালকির প্রচলন ছিল ব্যাপক। এ উপলক্ষে ‘পালকির গান’ নামে এক ধরনের গানেরও প্রচলন ছিল। এছাড়া অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসালয়ে নেওয়ার জন্যও ব্যবহৃত হতো এটি। ঐহিত্যবাহী এই বাহন এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।

যাতায়াতের জন্য একসময় গ্রামাঞ্চলে ডুলিরও ব্যাপক ব্যবহার ছিল। বাঁশ ও রশি দিয়ে তৈরি ডুলি দুজন বাহক বহন করত। এতে সাধারণত একজন যাত্রী বসতে পারত। ডুলির ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে।

জলপথে প্রাচীনকাল থেকেই বাংলাদেশে চলাচলের প্রধান বাহন নৌকা। এখনও বর্ষাকালে নিম্নাঞ্চলের মানুষের প্রধান বাহন এটি। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত, মালামাল পরিবহন এবং সৌখিন ভ্রমণের জন্য নৌকার ব্যবহার হয়। এজন্য আছে বিভিন্ন ধরনের নৌকার প্রচলন। সাধারণত নৌকাগুলোকে তিন শ্রেণিতে ভাগ করা হয়- বজরা, কোষা ও ডিঙা। এর মধ্যে বজরা হচ্ছে সৌখিন নৌকা; সাধারণত ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এগুলো ব্যবহার করতেন। কোষা ও ডিঙা এখনো নদী তীরবর্তী জনপদের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বর্ষাকালে গ্রামের সাধারণ মানুষ বা দরিদ্র মানুষ যাতায়াতের জন্য কলাগাছের তৈরি ভেলাও ব্যবহার করে। ‘মনসামঙ্গল’ কাব্যে এমন ভেলা ব্যবহারের উল্লেখ আছে। ভেলায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল লখিন্দরের মৃতদেহ। কোনো কোনো অঞ্চলে তালগাছের খোলও জলপথের বাহন হিসেবে ব্যবহৃত হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়