ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

চৈত্রসংক্রান্তি : নিম্নবর্ণের উৎসব

রওশন জাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ১৩ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চৈত্রসংক্রান্তি : নিম্নবর্ণের উৎসব

ছবি : ইন্টারনেট

 

|| রওশন জাহিদ ||

বঙ্গাব্দের শেষ দিন অর্থাৎ বাংলা হিসেবে বছর গণনার শেষ দিনকে ‘ক্রান্তি’ বলা হয়ে থাকে। আর যেহেতু এটি চৈত্র মাসের শেষ দিন তাই এটি ‘চৈত্রসংক্রান্তি’ হিসেবে পরিচিত। পুরাতন বছরের নানা সুখ-দুঃখ আর আশা আকাঙ্ক্ষার বিষয়াদি নিয়ে মানুষ সামনের বছরের দিকে এগিয়ে যায়। কখনও হতাশা, কখনও ভালোবাসা মানুষকে উদ্বেল করে তোলে। প্রকৃতিও মানুষের সঙ্গে উদ্বেল হয়ে ওঠে পুরাতনকে বিদায় আর নতুনকে বরণ করার জন্য। তাই বসন্তের সমীরণ মানুষের মনে যে দোলার সৃষ্টি করে পরে আবার গ্রীষ্মের খর তাপে তাতে বেশ আগুনের মধু লেপ্টে যায়। উৎসব প্রিয় বাঙালি প্রকৃতির রঙের যে পরিবর্তন সাধিত হতে দেখতে পায় তা শুধু নয়ন ভরে উপভোগই করে না, উৎসবের উপলক্ষ হিসেবে বেশ কাজেও লাগায়। তাই উৎসবের নেশায় মেতে ওঠা বাঙালি চৈত্রসংক্রান্তি উপভোগ করে থাকে।

সংস্কৃত শব্দ ‘চক্র’ থেকে ‘চড়ক’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ বর্ষচক্র শেষ করে বছরের সমাপ্তি ঘোষণা।  চৈত্রসংক্রান্তি অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিনে চড়কপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দীর  গোবিন্দানন্দের ‘বর্ষক্রিয়াকৌমুদি’ কিংবা রঘুনন্দের ‘তিথিতত্ত্বে’ কোনো দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় না যারা আজকাল চড়ক পূজায় বেশ জোরেশোরে পূজিত হচ্ছেন। লোকউৎসব হিসেবে চড়ক বেশ পরিচিত। এটি চৈত্রসংক্রান্তির দিনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এটি শৈব অনুষ্ঠান হিসেবেও পরিচিত। চড়ক উপলক্ষে যে আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়ে থাকে তা অনেক এলাকায় গাজন, গম্ভীরাপূজা বা নীলপূজা নামে পরিচিত। গবেষকগণের মতে এটি সাধারণত স্থান, অনুষ্ঠানের ধরন ও কালের কারণেই এমন আলাদা আলাদা নাম ধারণ করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মালদহ বা মুর্শিদাবাদে যে আচার-প্রথার মাধ্যমে চড়ক পালিত হতে দেখা যায় তাতে এটি স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, এসব চড়ক পূজারই বিভিন্ন রূপ। আবার শৈব অনুষ্ঠান বলারও কারণ জানা যায়। লোকমাধ্যমে কথিত আছে যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে বাণরাজা যুদ্ধে লিপ্ত হন। এই বাণরাজা ছিলেন শিব ভক্ত। শিব উপাসক-ভক্ত বাণরাজা যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে ভগবানের নিকট অমরত্ব লাভের প্রার্থনা জানান। কিন্তু তাঁর প্রার্থনা জানানোর প্রক্রিয়া ছিল আলাদা। তিনি শিবভক্তিসূচক গীত অভিনয় আকারে উপস্থাপন করে তাঁর আর্জি জানান। এবং অবশেষে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হন। এই কারণেই যারা শিব ভক্ত বা যারা শৈব সম্প্রদায়ের তারা এই উৎসব পালন করে থাকেন। অর্থাৎ শৈব অনুষ্ঠান বলার কারণ এটিই।

চৈত্রসংক্রান্তির দিনে যে পূজা হয় তা চড়ক নামে কোনো দেবতার নামে নয়। ধর্মীয় শাস্ত্র কিংবা প্রাচীন পুঁথি কোথাও চড়ক নামে কোনো দেবতার খোঁজ পাওয়া যায় না। অনুষ্ঠানটি ব্রাহ্মণ্যও নয়। এটি অস্মার্ত, অবৈদিক এবং অপৌরাণিক। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শিবোৎসবের উল্লেখ আছে। আর বৃহদ্ধর্ম পুরাণে চৈত্রমাসে বেত্রহস্তে সারা দিন এবং সারা রাত ধরে নাচ-গানসহ শিবের উৎসব পালনের বিধান আছে। অর্থাৎ এটি নিপাট শৈব উৎসব। উপর্যুক্ত দুই পুরাণের কোথাও চড়ক দেবতা বা চড়ক উৎসবের কথা লেখা নেই। তবে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, শিবের আরাধনা করা হলেও এটি চড়ক পূজার প্রধান উদ্দেশ্য।

যদিও শিবের আরাধনাই উৎসব পালনের প্রধান উদ্দেশ্য তারপরও এতে আরও দুই দেবতার প্রসঙ্গ এসে যায়। একজন নীলপরমেশ্বরী, অন্যজন কালাকরুদ্র। নীলপরমেশ্বরীর আরেক নাম নীলচণ্ডিকা। সাধারণ জনগণ একে  নীলাবতী বা নীল নামেও ডাকে। কোনো কোনো এলাকায় নীল এবং গম্ভীর এই দুইটি যেহেতু শিবেরই অন্য নাম তাই এই দুই পুরুষ দেবতার নামে পূজাচার পালিত হতে দেখা যায়। চড়কপূজা যেসব এলাকায় নীলপূজা বা গম্ভীরপূজা নামে পরিচিত সেসব এলাকায় আসলে দুই দেবতার পূজার সম্পর্কও বদ্যিমান। কালাকরুদ্র নামে যে আরেকজন দেবতা আছেন তিনি ত্রিনেত্র বিশিষ্ট। তাঁর ভীষণাঙ্গ এবং উজ্জ্বল দীপ্তিবর্ণ পূজারির কাছে বিশেষ দৈবশক্তির প্রমাণস্বরূপ। সাধারণত এই দেবতার উদ্দেশ্যে পশুবলি দেয়া হয়ে থাকে। পূর্বে উল্লিখিত নীলপূজা উপলক্ষে গ্রামের বাইরে ঠিক শ্মশানের ঘাটে হাজরা ঠাকুর বা দানো বারণো নামে আরও এক দেবতার পূজা করা হয়ে থাকে।

 


ছবি : মোহাম্মদ আসাদ


প্রাচীন তথ্য, প্রাচীন পুরাণ আর নানা লোককথার বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমারা দেখতে পাই যে, আসলে শুরুতে উচ্চবর্ণের লোকজনের মধ্যে চড়ক পূজার প্রচলন হয়নি। সমাজের আর্থিক বৃত্ত বিবেচনায় যারা নিচের কোটিতে বসবাস করেন তারা অর্থাৎ যাদের আর্থিক সঙ্গতি কম বা নিঃস্বপ্রায় তারাই চড়কের পূজক শ্রেণি। অন্যভাবে বললে বর্ণপ্রথার মাধ্যমে পরিচিত নিম্নবর্ণের লোকজনের সাহায্যে গঠিত সমাজে চড়ক বা গাজনের অনুষ্ঠানের চল ছিল। আজও মূলত তারাই এই অনুষ্ঠান পালন করে থাকে।

সাধারণত স্বতঃস্ফূর্ত জনগণই চড়কপূজা উপভোগ করে। চড়কপূজার অংশগ্রহণকারীদের সন্ন্যাসী বা ভক্ত্যা বলা হয়। এদের মধ্যে থেকেই একজন হন মূল সন্ন্যাসী যিনি পূজার পূজারীও বটে। শুধু তিনিই নন তার সাথে আরও বেশ কিছু সাহায্যকারী থাকেন। এরা সাঁই, সঙ্গী বা বালা নামে পরিচিত। তবে এই ব্যাপারে বেশ সতর্ক থাকার কারণ জানা যায় যে, কখনও কোনোভাবে সঙ্গীরা কোনো উচ্চ বর্ণের কেউ হতে পারবে না। অব্রাহ্মণ্য পূজা হওয়ায় এই পূজায় কোনো ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয় না। তবে ‘শিবের পাট’ পূজা করার জন্য একজন ব্রাহ্মণ পুরোহিতের প্রয়োজন হয়ে থাকে। যেহেতু ‘শিবের পাট’ পূজায় শিবমহিমা, শিবতুষ্টি ও শিবভক্তির নানা আচার ও ব্রতানুষ্ঠান পালন করা হয়ে থাকে তাই ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কোনো বিকল্প নাই।

চড়ক উৎসেবর জন্য যারা সন্ন্যাসী হিসেবে নিয়োজিত থাকেন তাদের কঠোর নিয়ম-কানুন পালন করতে হয়। এরা ভক্ত্যা নামেও পরিচিত। এরা পূজার কয়েক দিন নানা ধরনের ব্রতাচার ও সংযম পালন করেন।  সারাদিন না খেয়ে কাটান ও ধূপের ধোঁয়া উড়িয়ে শিবের আরাধনা করেন। এ সময় ধূপধূনা পোড়ানোর মন্ত্রের ক্ষেত্রে স্থান ও সম্প্রদায় বিশেষে ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। ভাষার ভিন্নতা ও মন্ত্রের পরিমাণের ভিন্নতা পরিদৃষ্ট হয়ে থাকে। কোনো কোনো এলাকায় চৈত্রসংক্রান্তির দুই দিন আগে থেকে হনুমান যেভাবে কাঁধে করে গন্ধমাদন পর্র্বত এনেছিল তেমন অভিনয়ও করা হয়। যারা এভাবে সন্ন্যাসীর কাজে লিপ্ত থাকেন তাদের ‘গিরি সন্ন্যাসী’ বলা হয়ে থাকে। আবার ভক্ত্যাগণ যখন একসঙ্গে একাধিক ফলসহ আমগাছের ডাল ভেঙে আনেন তখন তাদের ‘বাবর সন্ন্যাস’ বলা হয়ে থাকে।

চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন হয় নীল পূজা আর পরদিন চড়কপূজা। যেহেতু পরদিন বিবাহ হয় তাই আগের দিন হাজরা দেবতাকে বিবাহের সভায় উপস্থিত থাকতে অনুরোধ জানানো হয়। পূজার দিন সন্ধ্যাবেলা নীলকে বাজনা সহযোগে পাড়া পেরিয়ে খোলা মাঠে উপস্থিত করা হয়। একটি সোজা নিম বা বেল গাছের কাঠ থেকেই নীলের মূর্তি তৈরি করা হয়ে থাকে। সাধারণত এটির দৈর্ঘ্য সাড়ে চারহাত বা দেড়হাত। আর প্রস্থে আঠারো ইঞ্চি বা বারো ইঞ্চি। নীল যে বাড়িতেই যাক সেই বাড়ির কর্তা অথবা বধূ সকলেই পরম আদরে তাকে আসন পেতে দেয়। শুরু হয় সেখানে নীলসন্ন্যাসীদের বাজনা, গান আর সঙের নৃত্য। এই সময়ে যে গান গাওয়া হয় তা অষ্টক গান হিসেবে পরিচিত। সাধারণত ঢাক, ঢোল, কাঁশী ও বাঁশি সহযোগে এই গান পরিবেশিত হতে দেখা যায়। কোনো কোনো এলাকায় নীল পূজার রাতে শিবের উদ্দেশ্যে আগুনে পোড়ানো শোল মাছ ও খিচুড়ি নৈবেদ্য হিসেবে দেয়া হয়। অনেক সময় দুই একজন সন্ন্যাসীর ভর উঠতে দেখা যায়। সাধারণত শিবের আরাধনার সময় যখন প্রবল বেগে মন্ত্র আওড়াতে থাকেন তখন সঙ্গাহীন হয়ে পড়েন। অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এমন ধরনের ভর ওঠা অবস্থায় সন্ন্যাসী যা বলেন তার সবই বিশ্বাসযোগ্য।

 

ছবি : ইন্টারনেট


চড়ক পূজার দিন শিবের আরাধনার ক্ষেত্রে এক ধরনের ব্যঞ্জনাময় পরিবেশের সৃষ্টি হয়। সন্ন্যাসীগণ দেবতার প্রতি অবিচল ভক্তি প্রদর্শনের জন্য যেভাবে নিজেদের উপস্থাপন করেন সে দৃশ্য খুবই কৌতূহল জাগানিয়া। এক্ষেত্রে নানান ভঙ্গিমায় দেবতা শিবকে যেভাবে প্রণাম জানানো হয়ে তাও যথেষ্ট উপভোগ্য। কারণ, আন্তরিকভাবে প্রণামের এমন রূপ অন্য কোনো সময় দেখতে পাওয়া যায় না। তারা দেবতার প্রতি নিষ্ঠা প্রদর্শনের জন্য ধারালো বঁটি কিংবা গাছের কাঁটার উপরও ঝাঁপ দিয়ে থাকে। এমনকি মাঝে মাঝে তারা উল্টা হয়ে অর্থাৎ মাথা নিচের দিকে আর পা উপরের দিকে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দেবতাকে প্রণাম জানায়। এগুলো বটি ঝাঁপ, কাঁটা ঝাঁপ আর ঝুল ঝাঁপ নামে পরিচিত। এছাড়া আরও কিছু মাধ্যম আছে যেগুলোর সাহায্যে তীব্র যন্ত্রণা ভোগের মাধ্যমে দেবতার প্রতি প্রণতি জানিয়ে থাকে ভক্ত্যা বা সন্ন্যাসীরা। প্রায় পাঁচ ইঞ্চি লম্বা একটি লোহার বর্শি সারাদিন জিহবার মাঝখানে এফোঁড় ওফোঁড় করে রাখার নাম বাণ সন্ন্যাস। এক্ষেত্রে সূর্যোদয়ের পরপরই জিহবাতে বর্শি বিঁধিয়ে দেয়া হয়ে থাকে এবং সূর্যাস্তের সময় পুকুরের পানিতে নেমে তা খুলে ফেলা হয়। পিঠের দিকে মেরুদণ্ডের দুই পাশে ছিদ্র করে তাতে বেত ঢুকিয়ে দেয়া হয়। একে বলে বেত্র সন্ন্যাস। আর এক ধরনের নাম বড়শি সন্ন্যাস। সন্ন্যাসী পিঠের শিরদাঁড়া ভেদ করে একটি বর্শি ঢুকিয়ে দেয়। এরপর তা চড়ক গাছের আলপাটে ঘুরানো হয়। চড়ক গাছ হলো একটি প্রায় কুড়ি হাত লম্বা শালকাঠের দণ্ড। সারা বছর এই কাষ্ঠদণ্ডটি পুকুরের পানিতে ভিজানো থাকে এবং চড়ক পূজার সময় হলে তুলে তাতে তেল মাখিয়ে রেখে দেয়া হয়। এই গাছ উঠানোকে বলা হয়ে থাকে চড়ক জাগান। পূজার দিন এই গাছ মাটিতে পোঁতা হয় এবং এর মাথার উপরে আড়াআড়িভাবে আরেকটি কাঠের দণ্ড ছিদ্র করে লাগানো হয় যাতে ঘোরানো যায়। এই ঘোরানোর উপযুক্ত কাঠটিকে বলা হয় আলপাট। আলপাটের একপ্রান্তে পিঠের চামড়ায় বর্শি বিঁধে একজন সন্ন্যাসী ঝুলে পড়েন আর অন্য প্রান্তে দড়ি বেঁধে আলপাটটি চক্রাকারে ঘোরানো হয়। তবে বর্তমানে আর খুব বেশি বড়শি সন্ন্যাস দেখা যায় না। চড়কের এই আচার প্রাণঘাতী হতে পারে বিবেচনায় ব্রিটিশ উপনিবেশকালে পূর্ববঙ্গের গভর্নর স্যার সিসিল বীডন চড়ক পূজা আইন করে বন্ধ করে দেন ১৮৬৩ সালে।

সংস্কৃতির বহু উৎপত্তিবাদ তত্ত্ব অনুসারে পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলেও এ ধরনের কিছু উৎসব পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। ইউরোপে প্রচলিত মেপাল উৎসব অনেকটা চড়কের মতোই। শ্রীলংকায় প্রচলিত টুককুম উৎসবও চড়কের মতো। লাদাখ, সিকিম এবং ভুটানের বৌদ্ধদের চোড়গ উৎসবের সঙ্গে চড়ক পূজার মিল পাওয়া যায়। অনেক গবেষক পৃথিবীর অন্য কোনো এলাকা থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে এই চড়ক পূজার প্রচলন বলে মনে করেছেন কিন্তু ভারতীয় উপহাদেশের চড়ক পূজার নৃতাত্ত্বিক দিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, এতে এমন কিছু উপাদান আছে যেগুলো আর্যপূর্ব সভ্যতার চিহ্ন বহন করে। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, ‘সামাজিক  জলতত্ত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক পূজা দুই-ই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত; প্রত্যেক কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের কামনাতেই এই পূজার বার্ষিক অনুষ্ঠান।’ তবে বড়শি কিংবা বাণ সন্ন্যাসের মাধ্যমে নরবলি প্রথার চিহ্ন আছে বলেও অনেকে মনে করেন। বর্তমানে ধারণার পরিবর্তন হয়েছে। নরবলির পরিবর্তে পাঁঠা, কবুতর বলি দেয়া হয়ে থাকে। সাংসারিক মঙ্গল কামনায় মানত করেই চড়ক পূজার আয়োজন হয় বলে ক্ষেত্র সমীক্ষায় দেখা যায়। বাংলাদেশের নানা স্থানে চড়ক পূজার পাশাপাশি মেলা অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। অনেকে এটিকে চৈত্রসংক্রান্তির মেলাও বলে। মেলায় সকল ধরনের পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়। মেলায় কাঠের তৈজসপত্র, মাটির তৈরি নানা জিনিসপত্র, খেলনা, কাঁসা পিতলের বাসন-কোসন, পূজার নৈবেদ্য আর মিষ্টান্ন বিক্রি হয় দেদারসে। তবে সাধারণত খাবার জিনিসই বেশি বিক্রি হয়। আর কিছু রূপসজ্জার জিনিসও বিক্রি হয়। কারণ, যারা চড়ক উপভোগ করতে আসে তারা কোনো ধর্মের বাঁধনে আবদ্ধ নয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পুরো সময় মেলা চলতে থাকে মহাসমারোহে। চড়ক যদিও নির্দিষ্ট একটি গোষ্ঠীর আচার-অনুষ্ঠান কিন্তু যে মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে তাতে বাঙালির ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সুস্পষ্ট প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায়।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়