ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প || কে?

মুহাম্মদ মহিউদ্দিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১২, ৪ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || কে?

|| মুহাম্মদ মহিউদ্দিন ||

কলিংবেল বাজল। পরপর দু’বার।

মাহমুদ সাহেব গোঙানির স্বরে ‘কে’ বলে পাশ ফিরে শুলো। রাহেলা আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। তারপর রাজ্যের বিরক্ত চেহারা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। এ সময় বাসায় কেউ আসার কথা নয়। ঝি কলিমের মা মেয়ের বিয়ের অজুহাতে গ্রামের বাড়ি গেছে সপ্তাহ দু’য়েক হলো। ফেরার নাম-গন্ধ নেই। কলিমের মা-ই কি ফিরে এলো? ভাবে রাহেলা। পরক্ষণেই মনে পড়ে কলিমের মা তো মেয়ের বিয়ে দিয়ে ঘরের ছাউনি ঠিক করে মাস খানেক পরে আসবে বলেছিল।

তাহলে কে এলো?

কলিমের মা আগে-ভাগে ফিরে এলো না তো? এলে ভালোই হয়। বেশ ধকল যাচ্ছে আমার একা হাতে- ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে গিয়ে বলল, কে?


দরজার ওপাশে সাড়া শব্দ নেই। পুনরায় কলিংবেল বাজল।

কে?

এটা কি মাহমুদ সাহেবের বাসা? দরজার ওপাশ থেকে বলল।

আপনি কে? উল্টো প্রশ্ন করলো রাহেলা।

আমি রাহেলা ফুফির কাছে এসেছি।

রাহেলা থমকে দাঁড়ায়। ভেতরটা চমকে ওঠে। আমাকে ফুফি ডাকছে কে?

দোদুল্য মন নিয়ে দরজা খোলে রাহেলা। আটাশ-ত্রিশ বছরের এক যুবক। মোটামুটি লম্বা। মাঝারি গড়নের শরীর। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। দাড়ি-গোঁফ নেই। ক্লিন শেভ। পরনে জিন্সের প্যান্ট আর হাফ হাতা শার্ট। পায়ে চামড়ার স্যান্ডেল।

তুমি কে বাবা? রাহেলা বলল।

আমি জাহিদ। ফুফি আমাকে আপনি চিনতে পারেন নি? এ কথা বলতেই বলতেই ঘরে ঢোকে যুবক। রাহেলা পথ আটকাতে চেয়েও আটকায় না। তবে সে দরজাটা আলতো ঠেলে দেয়। ছিটকিনি লাগায় না। জাহিদ কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটি সোফায় এক পাশে রাখে। ফিরে  এসে রাহেলার পা ছুঁয়ে সালাম করে।

রাহেলা কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

বাসো বাবা বসো। বলল রাহেলা। ইচ্ছে করে বসতে বলেনি রাহেলা। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেছে।

আমার তো নিজের ভাই একজনই। কামরান। ওর তো এক মেয়ে। ছেলে নেই। কামরান মেয়ে শিলা আর ভাবীকে নিয়ে আমেরিকায় সেটেল্ড। তাহলে এই ছেলেটি কে? কোনো দূর সম্পর্কের কেউ নয় তো। ভেবে কুল-কিনারা খুঁজে পায় না রাহেলা।


ফুফা আর স্বপ্না কি ঘুমোচ্ছে? জানতে চায় জাহিদ।

ধ্যান ভাঙে রাহেলার। জাহিদের মুখে স্বপ্নার নাম শুনে আরো বেশি চমকে যায় সে। স্বপ্নার নাম যেহেতু বলেছে নিশ্চয়ই আত্মীয় হবে। সে বলে, হ্যাঁ বাবা। ওরা ঘুমোচ্ছে।

ঘুমাক। এখন ডেকে বিরক্ত করার দরকার নেই। আমি এখানে বসি।

চুপ করে থাকে রাহেলা। বসতে বলবে কি বলবে না দ্বিধায় পড়ে।

ফুফি আমি ঠিক বুঝতে পেরেছি। আপনি আমাকে চিনতে পারেন নি। বলল জাহিদ।

ঠিক তা না বাবা। বয়স হয়েছে তো। মেমোরিটা ফেরাতে পারছিলাম না।

ফুফি এটা তো স্বাভাবিক। প্রায় পনেরো-বিশ বছর পর আপনি আমাকে দেখছেন। এতোদিনে আমি কতো বড় হয়েছি।

হ্যাঁ বাবা। তাও ঠিক। আচ্ছা তোমার বাবার নাম কী?

আমার বাবা মাহবুব আখন্দ। আপনার বাবার মামাতো ভাই। বাড়ি আমাদের এক গ্রামেই। পানগুছিয়া। জাহিদের মুখে পানগুছিয়া গ্রামের নাম শুনে আশ্বস্ত হয় রাহেলা। তারপরও সে ঠিক চিনতে পারে না। তাছাড়া মাহবুব আখন্দ নামে কাউকে তার মনে পড়ছে না। অবশ্য থাকলে থাকতেও পারে। আমার বাবার মামাতো ভাই, ফুফাতো ভাইদের অনেককেই তো আমি চিনতাম না। ছেলেটি সকাল বেলাই এসে পড়েছে। এখন ওকে নিয়ে কী করি? ভাবছে রাহেলা।

ফুফি?

হুম।

আমাকে নিয়ে টেনশান করবেন না। আপনি কাজে যান। ফুফা উঠুক। আমি এখানে বসি।

না। তুমি এতো দূর থেকে জার্নি করে এসেছ। এখানে বসে থাকবে? এসো আমার সাথেই এসো।ব্যাগ নাও।



রাহেলা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে এলো। জাহিদ ব্যাগ নিয়ে রাহেলার পিছু পিছু গেল। একটি ঘর।  দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো রাহেলা। বাতি জ্বালালো। ডান পাশে একটি জানালা। পর্দা ঝুলছে।

ওঠা বাথরুম। এটাচড্ বাথরুম দেখিয়ে বলল রাহেলা, জামা-কাপড় পাল্টে নাও।

জি ফুফি।

রাহেলা বেরিয়ে গেল। মাহমুদ সাহেব বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে। রাহেলা গিয়ে বসলো।

কে এলো? বললেন মাহমুদ সাহেব।

আমার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে।

তোমার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে! অবাক হয়ে বিছানায় উঠে বসলো মাহমুদ সাহেব। তোমার কোন ফুফাতো ভাই আছে বলে তো জানতাম না। হঠাৎ করে এটা কোত্থেকে উদয় হলো।

আমার বাবার মামাতো ভাই মাহবুব আখন্দের ছেলে। ও তোমাকে চেনে। এমনকি স্বপ্নাকেও চেনে। আমাদের একি গ্রামের। পানগুছিয়াতেই ওদের বাড়ি।

তোমার বাবার মামাতো ভাই মাহবুব আখন্দকে তুমি চিনতে? বললেন মাহমুদ সহেব।

ঠিক মনে করতে পারছি না।

এই সেরেছে। ঠিকমতো চেনো না, জানো না কোথাকার কে গ্রামের পরিচয় দিলো আর ঘরে ঢুকিয়ে রসগোল্লা খাওয়াতে শুরু করলে!

রসগোল্লা খাওয়ালাম কই? আস্তে কথা বলো। ছেলেটি আমাদের সবার নাম বলতে পারছে। গ্রামের পরিচয় দিচ্ছে। আমি কি ওকে বের করে দেব?

এখন কোথায়? ড্রইংরুমে?

না। গেস্ট রুমে।

এক্কেবারে সোজা গেস্টরুমে নিয়ে তুলেছ?

কী আর করবো। ছেলেটা সারা রাত জার্নি করেছে।

ভালো। খুব ভালো। থামলেন মাহমুদ সাহেব। পুনরায় শুরু করলেন, এরকম অনেকেই বিপদে পড়েছে, গ্রামের ছেলে, পরীক্ষা দিতে এসেছে, এসব বলে ঘরে ঢুকে পড়ে। তারপর ঘরের সবাই কে জিম্মি করে গয়না, টাকা-পয়সা নিয়ে পালায়। অনেক সময় খুন করতেও  এদের আটকায় না। খবরের কাগজে দেখোনি এরকম কতো ঘটনা ঘটছে? দেখেছি। বলল রাহেলা।

তাহলে কোন্ আক্কেলে ছেলেটিকে গেস্টরুমে নিয়ে গেলে? বললেন মাহমুদ সাহেব।

ছেলেটিকে দেখে, কথা বলে আমার সে রকম খারাপ ছেলে বলে মনে হয়নি। তুমি গিয়ে কথা বলে দেখ। যদি সে রকম কিছু হয়ে থাকে তাহলে পুলিশে খবর দাও।

আচ্ছা।

কডলেস টেলিফোনটা হাতে নেয় মাহমুদ সাহেব। পুলিশে ফোন করতে গিয়েও করে না।

বাথরুমে ঢোকে।


চুলোয় খিচুড়ি বসিয়ে স্বপ্নার ঘরে যায় রাহেলা। স্বপ্না বিছানায় নেই। বাথরুমে উঁকি দেয় রাহেলা । সেখানেও নেই। কোথায় গেল স্বপ্না? বুকের ভেতরটা খচ্ করে ওঠে। দৌড়ে ড্রইং রুমে যায় রাহেলা সোফায় পা তুলে আজকের খবরের কাগজ পড়ছে স্বপ্না। রাহেলা গিয়ে দাঁড়ায়।

তুই এখানে?

কেন মা? প্রতিদিন সকালেই তো আমি ড্রইংরুমে পত্রিকা পড়ি। দরজার নিচের মেঝে থেকে কি পত্রিকাটা তুমি উঠিয়েছ?

হ্যাঁ।

প্রতিদিন তো আমিই ওঠাই। আজ তুমি এলে?

তোর একটা কাজিন এসেছে।

কাজিন?

হ্যাঁ।

কেমন কাজিন?

মামাতো ভাই।

কোথায়?

গেস্ট রুমে।

আচ্ছা। যাও। নাস্তাটা তাড়াতাড়ি দিও। কী করছো আজ কে?

খিচুড়ি।

স্বপ্না পত্রিকায় মন দিল। রাহেলা রান্না ঘরে ফিরে যেতেই মাহমুদ সাহেব ডাকলেন, শুনে যাও।

মাহমুদ সহেব অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছেন। আচ্ছা এমনকি হতে পারে ছেলেটির সাথে স্বপ্নার কোন রকম সর্ম্পক আছে। ওরা পরিকল্পনা করেই ছেলেটিকে ঘরে ঢুকিয়েছে।

কী বলছো তুমি! বলল রাহেলা।

আমার মনে হয় সেরকম কিছু।

না। স্বপ্নার সাথে আমি কথা বলেছি। ছেলেটি সম্পর্কে ও কিছুই জানে না।

তুমি এখনো বোকাই রয়ে গেছ। ওরা যদি পরিকল্পনা করে এটা করে থাকে তাহলে তোমাকে বুঝতে দেবে? বললেন মাহমুদ সাহেব।

স্বপ্নাকে নিয়ে তুমি এমন ভাবছো কেন ? বলল রাহেলা।

কেন ভাবছি জানো না। সেবার তোমার মেয়ে...। থাক। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।

সকালে নাস্তার টেবিলে মাহমুদ সাহেব ও স্বপ্নার সাথে দেখা হলো জাহিদের। মাহমুদ সাহেবকে পা ছুঁয়ে ছালাম করলো।

জাহিদকে আপাদমস্তক দেখল মাহমুদ সাহেব। কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। শরীরে শিরা ধমনীতে হঠাৎ যেন একটি শীতল রক্তের স্রোত প্রবাহিত হলো। কেন এমনটি হলো ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না মাহমুদ সাহেব। বললেন, বসো বাবা।


নাস্তার টেবিলে সবাই বসলো। পাতে পাতে খিচুড়ি তুলে দিল রাহেলা।

তোমার বাবার নাম মাহবুব আখন্দ। বললেন মাহমুদ সাহেব।

জি।

বেঁচে আছেন ?

জি না। পাঁচ বছর আগে ক্যান্সারে মারা গেছেন।

ও। দুঃখিত। আচ্ছা কী করতেন তোমার বাবা?

বাবা স্কুলে মাষ্টারি করতেন।

কোন স্কুলে?

আমাদের উত্তর পাড়ায় নতুন যে স্কুলটা হয়েছে ওখানে। নতুন স্কুলের খবর মাহমুদ সাহেব জানেন না। গ্রামে তেমন একটা যাওয়া আসা হয় না। বছর দু’বছরে এক দু’বার যাওয়া পড়ে। তাও সবকিছু খোঁজখবর নেয়া হয় না। কথা বাড়ালেন না মাহমুদ সাহেব।

ফুফা আপনি আমাদের স্কুলের পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। বলল জাহিদ।

হ্যাঁ। কখন যে কোন স্কুলে গিয়েছি তা মনে নেই।

আপনি ঢাকায় কেন এসেছেন? হঠাৎ প্রশ্নটা করে বসলো স্বপ্না।

আামর একটা চাকরির ইন্টারভিউ আছে।

কোথায়?

প্রাইভেট ফার্মে।

ও আচ্ছা।

আর কেউ তেমন কথা বাড়ায় না। জাহিদ খিচুড়ি শেষ করে গেস্ট রুমে চলে যায়।

মুখ খোলেন মাহমুদ সাহেব।

পুরো বিষয়টা আমার কছে গোলমেলে মনে হচ্ছে।

আমারও তাই। বলল স্বপ্না।

থাক। এখন আর কিছু বলো না। ছেলেটা পরীক্ষা দিয়ে ফিরুক। রাতে কথা বলা যাবে। বললেন মাহমুদ সাহেব। আর শোন সাবধানে থেকো। স্বপ্না তুই কি ভার্সিটিতে যাবি?

হ্যাঁ বাবা। আজ অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেয়ার শষ দিন।

ঠিক আছে যা। তাড়াতাড়ি ফিরিস।

আচ্ছা বাবা।

জাহিদ বেরুনোর সময় রাহেলাকে ডেকে বলল, ফুফি আমি বেরুচ্ছি। এমনকি পা ছুঁয়ে সালামও করল। রাহেলা দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে গেস্টরুমে ফিরল। বিছনায় ব্যাগ পড়ে আছে। একটি ভেজা গামছা আলনায় ছড়ানো। বাথরুমের দরজা খোলা। বিছানার চাঁদর কোঁচকানো।

রাহেলা ভাবলো ঘরটা গুছিয়ে দেয়। পরক্ষণেই মনে হলো, যেমন আছে তেমনই থাক। দরজাটা আলতো টেনে দিয়ে রান্না ঘরে ফিরে গেল।

অফিসে যাওয়ার পর থেকে বেশ ক’বার ফোনে খোঁজ নিল মাহমুদ সাহেব। রাহেলা গেস্ট রুমের কথা আর জাহিদের সালাম করে যাওয়ার কথা বলল।

মাহমুদ সাহেব আশ্বস্ত হতে পারলেন না। বললেন, জাহিদ ফিরলে আমাকে জানাইও।



দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। মাহমুদ সাহেব, স্বপ্না বাসায় ফিরল। জাহিদ ফেরেনি। ছেলেটি এখনো ফিরল না। বলল রাহেলা।

জাহিদ ভাইয়ার জন্য তোমার কি খুব টেনশান হচ্ছে মা? বলল স্বপ্না।

টেনশান হবে না। ছেলেটা সেই সকালে বেরুলো। দুপুরে কোথায় খেল না খেল!

এমন টেনশান করছো যেন তোমার নিজের ছেলে?

মাহমুদ সাহেব কিছুই বললেন না। সকালের বাসি পত্রিকাটিতে চোখ বোলাচ্ছেন। রাহেলা চা বিস্কিট দিল। একটু পরই কলিংবেল বাজল। জাহিদ ফিরল। এতো দেরী করলে কেন বাবা? বলল রাহেলা।

কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল।

এরপর আর কোনো কথা হলো না। রাতে খাবার টেবিলে মাহমুদ সাহেব অনেক কথাই জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু তার সন্দেহ কাটল না। কিসের যেন একটা খটকা লেগেই থাকলো। শুতে যাবার আগে জাহিদ মাহমুদ সাহেবের ঘরে গেল। হঠাৎ জাহিদকে রুমের দরজায় দেখে চমকালো মাহমুদ সাহেব ও রাহেলা।

কিছু বলবে? বললেন মাহমুদ সাহেব।

ফুফা আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।

বলো।

এখানে নয়। গেস্ট রুমে বলি।

রাহেলা চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে আছে।

এখানে কোন সমস্যা? মাহমুদ সাহেব বললেন।

না সমস্যা নেই। কথাগুলি আমি আপনাকে একা বলতে চাই।

একা!

জি।

রাহেলার সন্দেহ বাড়ে।

চলো। বললেন মাহমুদ সাহেব।

জাহিদের পিছু পিছু গেস্টরুমে আসলেন মাহমুদ সাহেব। রাহেলা কয়েক কদম এগিয়ে এসে থামল।

দরজাটা কি লাগিয়ে দেব? বলল জাহিদ।

না। খোলাই থাক।

দরজাটা লাগিয়ে দিলেই ভালো হয়ে। কথাগুলো অন্য কেউ শুনলে সমস্যা হতে পারে।

কোন সমস্যা নেই। তুমি বল। বললেন মাহমুদ সাহেব।



বিছানায় বসলেন মাহমুদ সাহবে। দেয়ালের পাশে রাখা আলনার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো জাহিদ। দুজনে চুপচাপ।বলো-নীরবতা ভাঙলেন মাহমুদ সাহেব।

মমতাকে চিনতেন?

চমকে ওঠে মাহমুদ সাহেব। চোখ ছানাবড়া করে জাহিদের দিকে তাকায়। তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক করে নেয়। মমতা? কোন মমতার কথা বলছো তুমি?

মমতা সুলতানা। ত্রিশ-পয়ত্রিশ বছর আগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তো।

বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালেন মাহমুদ সহেব। কিছুটা রেগে গেলেন। মমতা-টমতা কাউকে আমি চিনি না।

সেজন্যই আমি বলেছিলাম দরজার ছিটকিনিটা লাগিয়ে দিই। কথাগুলো বাড়ির অন্য কেই শুনলে সমস্যা হতে পারে।

মাহমুদ সাহেব নিজে গিয়ে ছিটকিনি লাগালেন। ফিরে এসে বললেন, বলো কী বলতে চাও?

বলুন মমতা সুলতানা নামে কাউকে আপনি চেনেন কিনা?

চিনি না।

মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অস্কীকার করতে পারে না।

মানে?

আমি কি মমতা সুলতানার পূর্ণ পরিচয়টা আপনাকে বলব?

থাক। লাগবে না।

বিছানায় গেড়ে বসেন মাহমুদ সাহেব। ফিরে গেলেন পয়ত্রিশ বছর আগে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জহুরুল হক হলের ৩০০৭ নাম্বার কক্ষে থাকতেন মাহমুদ। পড়তেন লোক প্রশাসনে। মমতা পড়তো ঢাকা মেডিকেল কলেজে। রুমমেট রায়হানের প্রেমিকার সাথে মমতা টিএসসিতে এসেছিল। সেখানেই পরিচয়। তারপর দিন যায়। মাঝে মাঝে দেখা হয়। ভালো লাগা গড়ায় ভালোবাসায়। টিএসসি, শহীদ মীনার, উদ্যানসহ অনেক জায়গায় এক সাথে যাওয়া হয়। রিকশায় ঘোরা হয়। বিশ্ববিদ্যালায়ের টং দোকানের খিচুড়ি, তেহারী খেয়ে কতো দিন পেরিরে যায়। ভালোবাসা গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। দুজনের আবেগের উচ্ছলতায় একসময় মাসিক বন্ধ হয়ে যায় মমতার। মানসিক উত্তেজনা আর উদ্বেগে কথাটা জানায় মাহমুদকে। অজান্তেই বাবা হতে যাচ্ছে মাহমুদ। এ উত্তেজনা ধরে রাখতে পারে না সে। মমতাকে সাবধানে চলাফেরা করতে বলে। টার্ম পরীক্ষাটা শেষ হলেই বিয়ের কাজটা সেরে নেবে, একথাও জানিয়ে দেয় মমতাকে।

মমতা আশ্বস্ত হয়। ভালোবাসার অগাধ বিশ্বাস প্রেরণা যোগায় মমতার মন ও মননে। মাস পেরিয়ে যায়। যখন মমতা সাত মাসের গর্ভবতী তখন পালিয়ে যায় মাহমুদ।



রাহেলার সন্দেহ ও ভয় বাড়তে থাকে। যে ছেলেটাকে তখনই বের করে দিতে চেয়েছিল তার সাথে এতো কী বলছে মাহমুদ। উত্তেজনা আর কৌতূহল নিয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় রাহেলা।

আপনি যদি অস্বীকার করেন তাহলে আমি কিছুই বলব না।

তুমি কে?

আমি কে সেটা জানার আগে আপনাকে স্বীকার করতে হবে আপনি মমতা সুলতানাকে চিনতেন। এবং তার সথে আপনার একটা সম্পর্ক ছিল।

দরজার ওপাশে রাহেলা পাথড় হয়ে যায়-কী বলছে এই ছেলে?

তবে আপনাকে এটুকু কথা দিতে পারি বাড়ির অন্য কেউ এর বিন্দুমাত্রও জানবে না। ফ্যানের সুইচটা মাহমুদ সাহেব অন করেছেন অনেক আগেই। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে। তারপরও মাহমুদ সাহেব ঘামছেন। একটু ধাতস্থ হয়ে মাহমুদ সাহেব বললেন, হঠাৎ আমার অতীত বর্তমানে নিয়ে এসে তুমি কী প্রমাণ করতে চাও?

মমতা একটি ছেলে জন্ম দিয়েছিল। জম্মের পর ছেলেটিকে সে একটি অনাথ আশ্রমে দিয়ে দেয়। সেখানে রেজিস্ট্রি বইতে আপনার গ্রামের ঠিকানা দেয়া ছিল। ছেলেটির বয়স যখন তিন তখন মমতা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। আর ছেলেটির বয়স চার হতে হতেই মমতা ছেলের মায়া ছিন্ন করে চলে যায়। আমি আপনাদের পানগুছিয়া গ্রামে গিয়েছি। কেউ আপনাদের সঠিক তথ্য দিতে পারে নি। বলল জাহিদ।

এ বাসার ঠিকানা পেলে কোথায় ?

কিছুদিন আগে স্বপ্না ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিল।

হ্যাঁ।

আমি ঐ থানার সহকারী পুলিশ কমিশনার। স্বপ্নার দেয়া বর্ণনা থেকেই আপনার ঠিকানা আমি পেয়ে যাই।

তুমি যে সকালবেলা বললে তোমার বাবা মাহবুব আখন্দ। স্কুলের মাষ্টার। রাহেলার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে।

মিথ্যে বলেছিলাম। জাহিদ আমার নাম নয়।

তাহলে তুমি কে?

আমি অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মমতা সুলতানার ছেলে। অনেকদিন হন্য হয়ে ঘুরেছি আমার জম্মদাতার মুখটি দেখব বলে। আজ আমার সে সৌভাগ্য হয়েছে। তবে আমি আপনাকে ‘বাবা’ ডাকবো না। সে ইচ্ছে আমার নেই।

মাহমুদ সাহেব নতমুখে বসে থাকেন নিশ্চল পাথরের মতো। জাহিদ বলতে থাকে, ও হ্যাঁ, আপনার ভয়ের কিছু নেই। এই থানা থেকে আমি ট্রান্সফার হয়েছি। আমাকে আর পাওয়া যাবে না। বলেই বেরিয়ে যায় জাহিদ। পাথর হয়ে বসে থাকে মাহমুদ সাহেব।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৪ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়