ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

বুক রিভিউ

‘কমৎকার’ উপন্যাসে চলচ্চিত্রের স্বাদ

কামরুজ জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৪৭, ১১ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কমৎকার’ উপন্যাসে চলচ্চিত্রের স্বাদ

কামরুজ জামান: উপন্যাসের ঘটনা প্রাণ পায় চরিত্রগুলোর পারস্পরিক সংলাপে। যে কারণে ঔপন্যাসিক সচেষ্ট থাকেন স্থান-কাল অনুযায়ী চরিত্রের মুখে ভাষা দিতে। অনেক সময় বর্ণনার চেয়ে চরিত্রের মুখের একটি সংলাপ সেই চরিত্র উপলব্ধির জন্য বহুল শক্তিশালী ও অব্যর্থ হয়। সংলাপের দ্বারা ঘটনাস্রোত উপস্থাপন করে লেখক নির্লিপ্ত থাকতে পারেন এবং পাঠকের বিচার-বুদ্ধির প্রকাশ ঘটাতে পারেন। সংলাপ চরিত্রের বৈচিত্র্যময় মনস্তত্ত্ব প্রকাশ করে এবং উপন্যাসের বাস্তবতা নিশ্চিত করে তোলে। পরিবেশ বর্ণনায় উপন্যাসের কাহিনিকে হতে হয় বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য। ঔপন্যাসিক উপন্যাসের দেশ-কালগত সত্যকে পরিস্ফুটিত করার অভিপ্রায়ে পরিবেশ নির্মাণ করেন। পরিবেশ বর্ণনার মাধ্যমে চরিত্রের জীবনযাত্রার ছবিও কাহিনিতে ফুটিয়ে তোলা হয়। এই পরিবেশ মানে কেবল প্রাকৃতিক দৃশ্য নয়; স্থান কালের স্বাভাবিকতা, সামাজিকতা, ঔচিত্য ও ব্যক্তি মানুষের সামগ্রিক জীবনের পরিবেশ। দেশ-কাল ও সমাজের রীতি-নীতি, আচার প্রথা ইত্যাদি নিয়ে গড়ে ওঠে উপন্যাসের প্রাণময় পরিবেশ।

শৈলী বা স্টাইল হচ্ছে উপন্যাসের ভাষাগত অবয়ব সংস্থানের ভিত্তি। লেখকের জীবনদৃষ্টি ও জীবনসৃষ্টির সঙ্গে ভাষা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উপন্যাসের বর্ণনা, পরিচর্যা, পটভূমিকা উপস্থাপন ও চরিত্রের স্বরূপ নির্ণয়ে অনিবার্য ভাষাশৈলীর প্রয়োগই যেকোনো ঔপন্যাসিকের কাম্য। উপজীব্য বিষয় ও ভাষার সামঞ্জস্য রক্ষার মাধ্যমেই উপন্যাস হয়ে ওঠে সমগ্র, যথার্থ ও সার্থক আবেদনবাহী। উপন্যাসের লিখনশৈলী বা স্টাইল নিঃসন্দেহে যেকোনো লেখকের শক্তি, স্বাতন্ত্র্য ও বিশিষ্টতার পরিচায়ক। এতে মননশীলতার পরিচয়ও পাওয়া যায় বটে। লেখকের সামগ্রিক জীবন-দর্শন মানবজীবন সংক্রান্ত যে সত্যের উদ্ঘাটন উপন্যাসের মধ্য দিয়ে পরিস্ফুট হয় তাই লেখকের জীবনদর্শন। আমরা একটি উপন্যাসের মধ্যে একই সঙ্গে জীবনের চিত্র ও জীবনের দর্শন এই দুই খুঁজি। ফলে সার্থক উপন্যাস পাঠ করলে পাঠক মানবজীবনসংক্রান্ত কোনো সত্য গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেন। এই দীর্ঘ গৌরচন্দ্রিকার মধ্য দিয়ে আমি যে উপন্যাসের গভীরে দৃষ্টিপাত করবো তার নাম ‘কমৎকার’। লিখেছেন মুম রহমান।

আমাকে প্রথমে আলোড়িত করেছে উপন্যাসের নাম। কারণ বাংলা অভিধানে কমৎকার শব্দের অস্তিত্ব আমি খুঁজে পাইনি। আট বছরের জন্মদিনে বাবা-মা’র সঙ্গে বেড়াতে যায় অটিস্টিক শিশু অয়ন। গাড়ি দুর্ঘটনায় বাবা-মা দুজনেই মারা যান। অটিস্টিক এই শিশুকে গ্রহণ করার মতো তেমন কেউ থাকে না। ভাগ্যক্রমে নিঃসন্তান এক দম্পতির আশ্রয় পায় সে। তাদেরকেই বাবা-মা জেনে বড় হয়। অটিস্টিক হলেও অয়নের কিছু গুণ আছে। সে ছবি আঁকায় এবং কম্পিউটারে দক্ষ হয়ে ওঠে। মায়ের মত গান ভালোবাসে। আশ্রয় দেওয়া বাবা-মা'র একান্ত যত্ন আর চেষ্টায় অয়ন অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফেরে। কিন্তু হঠাৎই সব বদলে যায়। অয়ন জানতে পারে, তার বাবা-মা দুর্ঘটনায় মারা যায়নি। তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে। বিমর্ষতা আর আত্ম-অনুসন্ধানের ভেতর দিয়ে শুরু হয় তার অন্যজীবন।

শহরের বিখ্যাত নিউরো সার্জন ডাক্তার মামুন এবং ব্যারিস্টার রেবেকা নিঃসন্তান দম্পতি। দুর্ঘটনায় বেঁচে যাওয়া অয়ন আশ্রয় পায় এই নিঃসন্তান দম্পতির সংসারে। হঠাৎ একদিন ডাক্তার মামুনের বাড়িতে আসে অয়নের ছোট চাচা সৈয়দ জামিল। জামিল স্বভাবে বোহেমিয়ান তবু দীর্ঘ দিন পর তার উপলব্ধি হয় তার ভাই ভাবী সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় নি। এটি ছিলো হত্যাকান্ড! এই হত্যাকান্ডের বিচারের আশায় এবং তার ভাতিজা অয়নকে দেখার জন্য হঠাৎ দেশে আসে সে। অয়নকে সবিস্তারে ঘটনা খুলে বলে। তারপর শুরু হয় অয়নের এক গোপন সংগ্রাম! বাসার পাশের কম্পিউটারের দোকানের মালিক কবিরের সাথে তার ধনী চাচাতো ভাইয়ের বিয়ের দাওয়াতে যায় অয়ন! বিয়ের অনুষ্ঠানে গান গাইতে আসে সহজ সুন্দর শিউলি ফুলের মত এক মেয়ে নাম লাভলী! শিউলির চেহারার মত মায়াময় তার গান! গানে মুগ্ধ হয়ে ভিডিও করতে থাকে অয়ন। গান শেষে লাভলী চলে যাওয়ার সময় সুমন সর্দার নামে একজন বখাটে ধনীর দুলালের মুখোমুখি হয়। লাভলীর সাথে অশোভন আচরণ করতে থাকে সুমন সর্দার! এক পর্যায়ে সেখানে উপস্থিত হয় অয়ন। এই অসৌজন্যমূলক ঘটনা ভিডিও করে রাখে অয়ন। তারপর লাভলীর নামে একটা ওয়েবসাইট খোলে অয়ন! সেই ওয়েবসাইটে গানের ভিডিও আপলোড করলে গানটি ভাইরাল হয়ে যায়। অন্যদিকে সুমন সর্দারের অসৌজন্যমূলক আচরণের ভিডিও সুমনের ফেসবুক আইডি হ্যাক করে সেখানেই পোস্ট করে অয়ন। ঘটনার সূত্রপাতে অয়ন জেনে যায়, সুমন সর্দারের বাবা রাজাকার বাচ্চু সর্দারই অয়নের বাবা মায়ের হত্যাকারী। তারপর অনেক নাটকীয়তার পরে একটি সুখী সমাপ্তি হয়। গল্পের প্রয়োজনে আসে মুক্তিযোদ্ধা মতিন এবং পেশাদার খুনী কেরামত চরিত্র। এই দুই চরিত্র গল্প বিনির্মাণে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

উপন্যাস পড়ে আমি চলচ্চিত্রের স্বাদ পেয়েছি। নাটকীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন লেখক উপন্যাসজুড়ে। লেখকের বর্ণনা করার ক্ষমতা অসাধারণ। তবু ঔপন্যাসিক কখনো কখনো গল্পে প্রবেশ করে পাঠককে দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। ব্যাপারটা অভিনব কিন্তু একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে আমার কাছে দৃষ্টিকটু লেগেছে। গল্পের স্থান কাল পাত্র বিনির্মাণে আরো মনোযোগ আশা করি লেখকের কাছে। উপন্যাস পড়ে আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু মনে স্থায়ী দাগ ফেলতে পারে নি। বইটির প্রচ্ছদ প্রশংসার দাবি রাখে। ‘অটিস্টিক ইজ ফ্যান্টাসটিক’- এই ভাবনা থেকেই লেখা হয়েছে ‘কমৎকার’ উপন্যাস। মানুষ যে কোনো প্রতিবন্ধকতা পেরুতে পারে।মানুষ সব কিছুর চেয়ে বড়।এটাই এই উপন্যাসের মূল কথা।শারীরিক, মানসিক কোন বাধাই মানুষের জন্য বাধা নয়। এই বার্তা প্রদান করে ‘কমৎকার’।

বইটির প্রচ্ছদ এঁকেছেন তৌহিন হাসান। প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লি.। মূল্য ২৭০ টাকা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১১ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়