ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

সুকুমার দর্জির গোল || তাপস রায়

তাপস রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৫৩, ১৮ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সুকুমার দর্জির গোল || তাপস রায়

সংগৃহীত ছবিটি প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে

হঠাৎ করেই পৃথিবীটা গোলময় হয়ে উঠেছে। চারপাশ গোলে গোলাকার। ফুটবল এমনিতেই গোলের খেলা। গোলেই নির্ধারণ হয় জয়-পরাজয়। তারপর দেখুন, যেখানে খেলা হবে সেই স্টেডিয়াম গোল, যে বস্তু দিয়ে খেলা হবে সেটা গোল, জয়ী হলে যে শোরগোল হবে সেখানেও গোল। আবার যারা খেলছে তাদের অনেকেরই বিশ্বকাপ জেতাটাই নাকি জীবনের গোল! গোলে গোলে একেবারে তালগোল অবস্থা! এমন হবে নাই বা কেন? উত্তেজনায় থার্মোমিটারের পারদ ক্রমশ বাড়ছে। জ্বরে ভুগছে তাবৎ ফুটবলপ্রেমী। এই জ্বরের নাম বিশ্বকাপ।


আমাদের মহল্লায় পোশাকের কারুকাজে নারী অঙ্গের শ্রী বৃদ্ধিতে সুকুমার দর্জির সুনাম পুরনো এবং পোক্ত। এতটাই পোক্ত যে, তার কুমারত্ব ঘুঁচেছে ওই দর্জিগিরির কল্যাণেই। বৌদি স্বয়ং এসেছিলেন গজ কাপড় নিয়ে। ফিতা দিয়ে দেহের মাপ নিতে নিতে সুকুমারদা মনের মাপ নিতে তৎপর হয়েছিলেন। তৎপরতার তালাশ পেয়ে অপরপক্ষ তাল মেলাতে সময় নেয়নি। ফলাফল বিনা বাধায়, নিশঙ্কচিত্তে সটান ছাদনাতলা। সেই থেকে দুজনের গলাগলির সংসার।

তবে হ্যাঁ, ‘গলাগলির সংসার’ কথাটিতে দাদার কিঞ্চিৎ আপত্তি। তিনি বলেন ‘জোড়াতালির সংসার’। আমরাও মেনে নেই। কারণ জোড়াতালি দিতে দাদা ওস্তাদ বটে!

আমরা তো প্রায়ই বলি, বাড়ির ছাদ ছাড়া সুকুমারদা সবই সেলাই করতে পারে। এমনই তার সুনাম! চাহিদাও সে অনুপাতে কম নয়। একবার এক মহিলা ব্লাউজ বানাতে দিয়েই জানতে চাইলেন, ‘দাদা কবে দেবেন?’

‘এক সপ্তাহ পর আসেন।’

সুকুমারদার কথা শুনে মহিলার চক্ষু দেবদারু গাছ! দাদাকে তিনি প্রায় দেবতার আসনে বসিয়েছিলেন; জুনিয়র বিশ্বকর্মা। সেই দাদার মুখেই কিনা দারুখোরের মতো কথা! তিনি ভ্রু উঁচিয়ে বলেন, ‘দাদা বলেন কি! ঈশ্বর ছয় দিনে এই পৃথিবী বানিয়েছে। আর আপনি...’

‘এতো তাড়াহুড়ো করে তৈরি করার জন্যই তো পৃথিবীর আজ এই দশা! ব্লাউজের অমন দশা আপনি চাইলেও আমি তা হতে দিতে পারি না।’


এই হলো আমাদের সুকুমারদা। অথচ সেই তিনিই কিনা লেহেঙ্গা, জিপসী, আনারকলি, মাসাক্কালি ফেলে পতাকা তৈরিতে ব্যস্ত। তার দুই সাগরেদ এখন মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ (পতাকার ফেরিওয়ালা)।

রুমাল থেকে শুরু করে শাড়ি- সব সাইজের পতাকা সুকুমারদার টেইলার্সে আছে। কিন্তু সমস্যা হলো বাকিতে পতাকা বিক্রি করতে দাদা একেবারেই রাজি নয়। মেয়েদের কাছে ডোন্ট মাইন্ড মুডে পাঁচ-দশ টাকা কম নিতে আমি নিজে সুকুমারদাকে অজস্র বার দেখেছি। অথচ পতাকার ক্ষেত্রে দামাদামি মুলামুলি পর্যন্ত নিষেধ।

ঘটনা কী? একদিন সুকুমারদাকে আমি চেপে ধরি। ধরতেই বেড়িয়ে আসে থলের বেড়াল। দাদা বলে, ‘আরে! কাস্টমারের ব্লাউজ, পেটিকোটের কাপড় কেটে পতাকা বানাইতেছি। পরে কাপড় কিনে কাস্টমারের জিনিস তৈরি করে দিতে হবে না?’

আমি সুকুমারদাকে আশ্বস্ত করে বলি, ‘তা না হয় বুঝলাম। অতি পরিচিতদের বাকি দিতে সমস্যা কী?’

দাদা প্রায় লাফিয়ে ওঠেন, ‘এইডা তো আরও রিস্ক!’

‘কী রকম?’

‘ধরো, পতাকা বাকিতে দিলাম। দল জিতলে ভালো। হারলে সেই পতাকার ট্যাকা আর চাওয়া যাবে? চাওয়াও যাবে না, পাওয়াও যাবে না- ফক্কা!’

কথা মিথ্যা নয়। তারপরও ফকরামি করে বলি, ‘বাকির টাকা চাইলে মানুষ দেবে না?’

‘ব্যবসা না করলে মানুষ চেনা যায় না। একবার এক বেডিরে বাকিতে ম্যাক্সি বানাইয়া দিছিলাম। এক সপ্তাহ পর ফেরত দিয়া কয়, ফিটিং হয় নাই। আমিও চিটিং কম জানি? পরে সেই ম্যাক্সির কাপড় কেটে জামা বানাইয়া ‘খালি পঞ্চাশ, খালি পঞ্চাশ’ বলে বিক্রি করছি। কিনছে কে জানো?’

আমি দুপাশে মাথা নারি- ‘জানি না।’

‘সেই বেডির জামাই।’


দাদার বুদ্ধিতে আমি বিস্ময়ে দইয়ের মতো জমে যাই। কিন্তু একটা জিনিস মাথায় খেলে না। কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া দাদা সব বাদ দিয়ে পতাকা বানানোর ব্যবসায় নামে নাই। আমি কৌশলে জানতে চাই, ‘দাদা, এটা  সিজনাল ব্যবসা। হঠাৎ এই ব্যবসা নিয়ে মেতে ওঠা কী ঠিক হলো? রেগুলার কাস্টমার নষ্ট হবে না?’

আমার কথা শুনে দাদা মুচকী হাসে। তারপর পা নাচাতে নাচাতে বলে, ‘সবাই গোল গোল কইরা মাইতা আছে। এই ব্যবসায় আমারও একটা গোল আছে।’

আমার কৌতূহল উপচে পরে। গোলটা কী সেটাই তো জানতে চাই। আমার আগ্রহ দেখে দাদা গলা নামিয়ে বলে, ‘কাউকে বলবা না তো?’

‘না না। কাকপক্ষিও জানবে না।’

‘ধুরও! কাকপক্ষি জানলে অসুবিধা নাই। মানুষ জানলেই সমস্যা।’

‘আরে না! মানুষও জানবে না।’

‘শিওর?’

‘বললাম তো। শিওর শিওর শিওর। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর।’ আমার কণ্ঠে এবার বিরক্তি ঝরে পড়ে।

দাদা হেসে বলে, ‘বেশি বেশি কোনো কিছুই ভালো না। বুঝছ?’

‘এখানে আপনে কম-বেশির কী দেখলেন?’

‘এই যে, এতবার শিওর বললা।’

‘আচ্ছা দিব্যি দিয়ে বলছি। আমি কাউকে বলব না।’

‘আরে না না। কথায় কথায় দিব্যি কাটা ভালো না। তোমারে আমি এমনিই বলি, এই যে এতো পতাকা বানাই। মানুষ কেনে। বাড়ির ছাদে, কার্নিশে, দরজা, জানালায়, দুই চাকা, তিন চাকা, চার চাকা, ছয় চাকায়, মাথায়, শরীরে যে যেমনে পারে পতাকা টানায়। একমাস পর এই পতাকা কই থাকব কও দেখি?’

আমি বুঝি না। হাঁ করে দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি।

দাদা ঋত্বিক ঘটকের মতো উপদেশ ঝাড়ে, ‘ভাবো ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।’ 

আমি ভাবি। তল পাই না। দাদা সবজান্তার হাসি দিয়ে বলে, ‘বলতে পারলে না? পারার অবশ্য কথাও না। সব ব্যবসার গোমর থাকে, বুঝছো না? শোনো, একমাস পর এই পতাকার কোনো দামই থাকব না। ঠিক?’

আমি মাথা ঝাকাই- ‘ঠিক ঠিক ঠিক। হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক।’

‘আহ্ তুমি আবারও শতকরা অঙ্কে ভুল করলা।’

‘ভুল?’

‘হ্যাঁ। ভুল। তুমি একশ তিন বার ঠিক বলছ। যে-কথা একবার বললেই হয়, সে-কথা একশ তিনবার বলার দরকার কি? তাছাড়া পৃথিবীর কোনো কিছুই হান্ড্রেড পার্সেন্ট ঠিক না। জানো?’

‘জানি।’

‘জানো তাইলে ভুলে যাও ক্যান?’

‘দাদা এবার আপনি নিজেই কিন্তু ভুলে যাচ্ছেন!’ আমি দাদাকে বাগে পেয়ে কথার প্যাঁচে ফেলি।

‘আমি আবার কি ভুলে গেলাম?’

‘ওই যে, আপনার গোলের কথা বলবেন। অথচ কথায় কথায় কোথায় চলে গেলেন!’

‘হা হা হা। দাদা হাসে। কথার ওই এক দোষ।’

‘কথার দোষ না। যে বলে দোষটা তার।’ আমি শুধরে দেই।

‘এই কথাটা ঠিক বলছ।’ দাদা বলেন, ‘শোনো, একমাস পর এই পতাকাগুলার খোঁজ কেউ রাখবে না। তখন আমার মার্কেটিং এক্সিকিউটিভরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে পতাকাগুলা সংগ্রহ করবে।’

‘বিক্রি করা পতাকা ওরা আবার কিনে নিয়ে আসবে!’ আমার বিস্ময় দেখে দাদা বলেন, ‘না না ফেলে দেয়া জিনিস কেউ কেনে নাকি? জাস্ট চেয়ে নিয়ে আসবে। কুড়িয়ে নিয়ে আসবেও বলতে পারো। তারপর...’

‘তারপর?’

‘তারপর আর কি?’ দাদা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে। আমি উল্টো চেপে ধরি- ‘তারপরের কথাই তো জানতে চাই।’

‘তারপর ওই আর কি। ঝুট কাপড়ের ব্যবসা করলেও লস নাই।’


দাদা ঝুট বলছে, আমি ঠিক বুঝতে পারি। ঝুটের ব্যবসায় অনেক ঝক্কি। ডিশের ব্যবসার মতো ওটা বিশেষ শ্রেণীর দখলে। সেই ধকল দাদা সামলাতে পারবে না আমি নিশ্চত। এবার আমি কৌশলী হই। ওঠার ভঙ্গি করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলি, ‘ঠিক আছে, বিশ্বাস করলেন না তো? না করলেন। চলি তাহলে।’

দাদা এবার শশব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত ধরে টেনে বসান। ‘আরে! কই যাও? তোমারে অবিশ্বাস করছি কখনও? ধুরও বসো তো।’

আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বসি। উদাস ভঙ্গিতে সারি সারি ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, জার্মানির পতাকা দেখি। সালোয়ার, কামিজ, ব্লাউজ সেগুলোর আড়ালে চলে গেছে। নাহ্, এখানে আর ভালো লাগছে না। পুনরায় উঠতে যাব ঠিক সে সময় দাদা  আমার দিকে সরে এসে প্রায় ফিসফিস করে বলেন, ‘শোনো, ওই পতাকাগুলো কেটে জামা বানাইয়া ‘খালি পঞ্চাশ, খালি পঞ্চাশ’ বলে বিক্রি করবো। তখন হবে আরেক ব্যবসা। এই বিশ্বকাপে এইটাই আমার গোল।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়