ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য : ইতিহাস ও তত্ত্ব পর্ব

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৬, ১৯ জুন ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য : ইতিহাস ও তত্ত্ব পর্ব

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

ডায়াসপোরা শব্দটি গ্রিক। ‘dia’ মানে দূরে, ‘speirein’ মানে ছড়িয়ে পড়া; অর্থাৎ যার অর্থ দাঁড়ায় দূরে ছড়িয়ে-পড়া। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে ফসলের বীজ ছড়িয়ে পড়া। শব্দটির অন্য ব্যবহার লক্ষ্য করা যায় খ্রিস্টপূর্ব ২৫০ শতাব্দীর দিকে। ইসরাইল থেকে বিতাড়িত হওয়া দেশত্যাগী ইহুদিদের প্রথম ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। ঐ সময় আলেক্সান্দ্রিয়ার পণ্ডিতরা হিব্রু বাইবেল বা ‘তোরাহ’র প্রথম ৫টি বই (আদিপুস্তক, যাত্রাপুস্তক, লেবীয় পুস্তক, গণনাপুস্তক এবং দ্বিতীয় বিবরণ) গ্রীক ভাষায় অনুবাদ করেন। এই অনুবাদে গৃহহীন ইহুদিদের জন্য ক্রিয়াপদ ‘diaspeirein’ এবং বিশেষ্যপদ ‘diasporá’-এর ব্যবহার করা হয়। এই শব্দ দ্বারা ইহুদিদের জন্মভূমি থেকে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভেতর যে আধ্যাত্মিক এবং মানসিক কষ্ট তৈরি হয়, সেটা প্রকাশিত হয়।

উনবিংশ শতকে এসে, বিশেষ করে প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন দেশ থেকে নানা-কারণে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ডায়াসপোরা শব্দটির ব্যবহার শুরু করে। এখন সম্প্রসারিত অর্থে, কেবল বহিষ্কৃতরা না, জীবিকার জন্য স্বেচ্ছায় দেশান্তরী হয়ে বিভিন্ন স্থানে বসতি গড়েছেন এমন লোকদেরও ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইতিহাসের অধ্যাপক ভিনয় লাল বহিষ্কৃতদের বলছেন ‘diaspora of labour’ এবং স্বেচ্ছায় দেশত্যাগীদের বলছেন ‘diaspora of longing’। ইউএন’র তথ্যমতে, বর্তমানে ১৫ মিলিয়ন মানুষ শরণার্থী হিসেবে বিভিন্ন দেশে আছে, দেশের অভ্যন্তরীণ গৃহহীন মানুষ আছে আরও ১৫ মিলিয়ন, ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ আছে স্টেটলেস বা দেশহীন অবস্থায়। এই ব্যাপক ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর কারণে বর্তমান সময়কে আমরা ‘Age of Diaspora’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি।

ডায়াসপোরার প্রকারভেদ : ডায়াসপোরাকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে মোটাদাগে কয়েকটা ভাগে আলাদা করা যায়। আলোচনার সুবিধার্থে আমি দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াসপোরাকে তিনভাগে ভাগ করছি।

ক. উপনিবেশ-পূর্ব ডায়াসপোরা
সমুদ্রপথে বাণিজ্য করার জন্য দক্ষিণ এশীয় বণিকেরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অনুরূপভাবে অন্যদেশের বণিকেরা ভারতবর্ষে আসে। এই কারণে তাদের মারিটাইন ডায়াসপোরাও বলা হয়। ১৮২০ থেকে ১৯৩০ সালের মধ্যে ভারতীয় শ্রমিক চীন, পারস্য দেশ এবং ক্যারিবীয় দ্বীপাঞ্চলে বাণিজ্য করতে গেছে। পাশাপাশি এখানে অভ্যন্তরীণ ডায়াসপোরার ঘটনাও ঘটেছে। বৃহৎ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বণিক এবং শ্রমজীবী মানুষ শ্রীলঙ্কা, বার্মা বা মিয়ানমারে গেছে। বাংলা ভূখণ্ড থেকেও এই অঞ্চলের মানুষ কাজের জন্য ভারতের উত্তর-দক্ষিণ এবং মিয়ানমারে গেছে। এমনকি আমরা ছোটবেলায় শুনেছি, দেশের অভ্যন্তরে এক জেলা থেকে আরেক-জেলায় মানুষ দীর্ঘদিনের জন্য চুক্তিতে কাজ করতে গেছে। পরিবার বলত, ভিনদেশে গেছে। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না, যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল অনুন্নত। ফলে দূরত্ব আক্ষরিকভাবে বেশি না হলেও মানসিক দূরত্ব কম ছিল না। এই স্থানচ্যুতও মানুষের ভেতর হোমসিকনেসের সৃষ্টি করেছে। তবে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এই মেরিটাইন কিংবা দেশের ভেতরে ভূমিভিত্তিক (ল্যান্ড-বেসড্) ডায়াসপোরা-কালে সেই অর্থে সৃজনশীল বা মননশীল সাহিত্যসৃষ্টি হয়নি। কারণ যারা গেছে তারা বেশিরভাগই অক্ষরজ্ঞানহীন ব্যবসায়ী বা শ্রমিক। তারা হয়ত মুখেমুখে লোকসাহিত্যের সৃষ্টি করেছে যা আজ আমাদের সামনে দলিল হিসেবে লিপিবদ্ধ নেই।

খ. ঔপনিবেশিক ডায়াসপোরা বা মধ্যযুগীয় ডায়াসপোরা
এশিয়ান ডায়াসপোরা সাহিত্য আমরা পাই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে। যখন এ অঞ্চলের মানুষ স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে ভারত থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে গেছে, বিশেষ করে ক্যারিবীয় অঞ্চলে। এ সময় দুটি বড় ঘটনা ঘটে বিশ্ব-শ্রমবাজারে। এক. ১৮৩০ সালে বিশ্বে বৈধ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ হয়; দুই. শিল্পবিপ্লব এবং পূঁজির বিকাশ ঘটতে শুরু করে পশ্চিমে। শহর তৈরি হতে থাকে বাণিজ্যনির্ভর দেশগুলোতে। বিশ্বের সম্প্রসারিত শ্রমবাজারে শ্রমিকের যে শূন্যস্থান সৃষ্টি হয় সেটা পূরণ করার জন্য ভারতবর্ষ থেকে শ্রমিক আমদানি করা হয়। এই সময় থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত কয়েক মিলিয়ন দক্ষিণ এশীয় শ্রমিক বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে আফ্রিকার দ্বীপাঞ্চলে। এদের খুব কম শ্রমিকই পরে স্বাধীন ভারতে ফিরে এসেছে। বা আসতে পেরেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয় নারীদের বিয়ে করে তারা সেখানেই ঘর বসিয়েছে। পরে তারা সেখানে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর নিজেদের প্রয়োজনে শিক্ষিত ভারতীয়দের চাকরি দিয়ে নিয়ে গেছে। যেমন মহাত্মা গান্ধীকে আফ্রিকায় আইনজীবী হিসেবে নিয়ে যান গুজরাটের এক ব্যবসায়ী। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে খ্যাতিমান ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক হলেন ভিএস নাইপল। তিনি ডাবল ডায়াসপোরা লেখক। ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য-অংশে তাঁকে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা যাবে।

গ. উপনিবেশ-উত্তর ডায়াসপোরা/ আধুনিক ডায়াসপোরা
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশ শাসন থেকে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলে ডায়াসপোরা নতুন মাত্রা পায়। বৃহৎ পরিসরে ইউরোপীয়-এশীয় এবং আমেরিকীয়-এশীয় ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়। শিক্ষিত ভারতীয় জনগোষ্ঠী তখন বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রমবাজারের পাশাপাশি শিক্ষিত বা একাডেমিক ডায়াসপোরার সৃষ্টি হচ্ছে। ডায়াসপোরা সাহিত্যের ভারতীয় তাত্ত্বিক বিজয় মিশ্র তাঁর ‘ডায়াসপোরাস’ প্রবন্ধে বলছেন,…post-war South Asian, Chinese, Arab and Korean communities settled in Britain, Europe, America, Canada and Australia as diaspora। এই সময় দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ঘটনা হলো একইসঙ্গে ভারতবর্ষ স্বাধীন ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হওয়া। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ ও পাকিস্তান) থেকে হিন্দুরা যেমন ভারতে গেছে, তেমনি ভারত থেকে মুসলমানরা তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশে ছড়িয়ে পড়েছে। এভাবে ভারতে অভ্যন্তরীণ ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। সত্তর এবং আশির দশকে এসে স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে ভারত এবং এশিয়ার অন্যান্য দেশ থেকে তো বটেই শিক্ষার জন্য আমেরিকা, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডার মতো দেশগুলোতে তরুণরা পাড়ি দেন। তাদের অনেকেই কাজ জুটিয়ে সেখানে পাকাপাকিভাবে থেকে যান। তাদের কারণে এখন সেখানে দ্বিতীয় প্রজন্মের ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছে। ভারতীয় জনগণ ভারতীয় পাসপোর্ট ছেড়ে দিয়ে নতুন এনআরআই (অনাবাসী ভারতীয়) পরিচিতি বহন করছেন। আমেরিকার গ্রিন কার্ডের কথা আমরা জানি। বাংলাদেশে থেকে প্রচুর মানুষ আমেরিকা গেছেন গ্রিনকার্ড পেয়ে।

দুটি বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতীয়তাবোধের বিষয়টি তীব্র হয়ে উঠলে ডায়াসপোরার জনগোষ্ঠীর ভেতর অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অনাবাসী ভারতীয় হিসেবে তারা না হোন ভারতীয়, না হোন যে দেশে বাস করছেন সে দেশের স্থানীয়। যেমনটি ব্রিটিশ বাংলাদেশি নৃত্যশিল্পী আকরাম খান তাঁর ‘দেশ’ নাটকে বলছেন, I am no more Bangladeshi, and, I will never be a British। তাত্ত্বিক বিজয় মিশ্র এই কারণে বলছেন, দুটি সংস্কৃতির মাঝখানে পড়ে ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠীর জন্য কোনো সংস্কৃতি ভিত্তি হিসেবে কাজ করে না, ফলে জাতিসত্তার প্রশ্নে শিকড়হীন অবস্থা তৈরি হয়। এই কারণে ব্যক্তির সঙ্গে দুদেশের একটা ট্রাবলড্ রিলেশন গড়ে ওঠে। যেটা মূলত উঠে আসে স্থানচ্যুত লেখকদের গল্প-কবিতা-উপন্যাসে। যাকে আমরা ডায়াসপোরা সাহিত্য বলছি।

ডায়াসপোরা সাহিত্য : ডায়াসপোরা পরিস্থিতিতে বাস করছেন অর্থাৎ কোনো কারণে নির্বাসনে থেকে বা জীবিকার অন্বেষণে নিজ দেশ ছেড়ে ভিনদেশে বাস করছেন এমন পরিস্থিতিতে কোনো লেখক যে সৃজনশীল সাহিত্য রচনা করেন সেটিই ডায়াসপোরা সাহিত্য। অনুরূপভাবে ডায়াসপোরা থিয়েটার, চলচ্চিত্র, চিত্রকলাও এখন আলাদাভাবে স্টাডির বিষয় হয়ে উঠেছে। এখন প্রশ্ন হলো, ডায়াসপোরা অবস্থায় একজন লেখক যা লিখবেন সেটাই কি ডায়াসপোরা সাহিত্য বলে বিবেচিত হবে? যদি তিনি অভিবাসী জীবনের সংকট ও পিতৃ-মাতৃভূমির প্রতি যে নস্টালজিয়া এবং ক্ষয়ে যাওয়া সময়ের জন্য হাহাকার কিংবা আগন্তুক হিসেবে নতুন জীবনের কথা উপজীব্য করে কিছু না লেখেন সেটি ডায়াসপোরা সাহিত্য হবে কিনা? এক অর্থে হবে আবার আরেক অর্থে হবে না। প্রত্যক্ষ ডায়াসপোরা সাহিত্য হলো সেই সব সাহিত্যসৃষ্টি যেখানে ডায়াসপোরা জীবনে থেকে হোমল্যান্ড এবং হোস্টল্যান্ডের টানাপড়েন উঠে আসবে। আর যদি কোনো লেখক যে দেশে বাস করছেন সে দেশের সংকট বা জনজীবন উপজীব্য করে কিংবা পিতৃ-মাতৃভূমির কোনো রাজনৈতিক-সামাজিক বিষয় নিয়ে কিছু লেখেন তাহলে সেই পার্টিকুলার টেক্সটটি প্রত্যক্ষ ডায়াসপোরা টেক্সট হিসেবে গণ্য হবে না। তবে পরোক্ষভাবে হবে এই কারণে যে কোনো লেখক স্বদেশ (প্রথম প্রজন্মের ডায়াসপোরা লেখকদের ক্ষেত্রে) বা পিতৃমাতৃভূমির (দ্বিতীয় প্রজন্মের ডায়াসপোরা লেখকদের ক্ষেত্রে) কোনো প্রসঙ্গ নিয়ে যদি কোনো গ্রন্থ লেখেন তাহলে সেই গ্রন্থ বাইরের লেখক হিসেবে স্বদেশে কতটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে সেটিও বিবেচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। যে কারণে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার মুহূর্তের ইতিহাস নিয়ে ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক সালমান রুশদি যখন ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ লেখেন তখন ভারতে তাঁর বিরুদ্ধে ‘ইতিহাস বিকৃতি’র অভিযোগ ওঠে। এবং রুশদিকে তখন ডায়াসপোরা লেখক হিসেবে নিজ দেশের দেশের ইতিহাসের বিশ্বস্ত কথক হিসেবে ভারতীয় পাঠকরা বিবেচনা করেন না। ফলে ‘মিডনাইট চিলড্রেন’ ডায়াসপোরা টেক্সট না হলেও ডায়াসপোরা লেখকের টেক্সট হিসেবে পঠিত হয়।

বেশ কয়েক বছর থেকে ইউরোপ এবং আমেরিকায় যে ডায়াস্পোরা লেখকদের রাজত্ব চলছে তার অধিকাংশই বৃহৎ-এশীয়। এক্ষেত্রে আমরা দেখছি স্বদেশ বা পিতৃমাতৃভূমের চেয়ে ইউরোপ-আমেরিকায় এসব ডায়াসপোরা লেখকের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। ডায়াসপোরা লেখকদের এই গ্রহণযোগ্যতা তৈরির কারণ হিসেবে ২০১৭ সালে সাহিত্যে নোবেলজয়ী এশীয় ডায়াসপোরা লেখক ইশিগুরো বলছেন : ‘আশির দশকে ঔপন্যাসিক হিসেবে ব্রিটেনে আমি যে দ্রুত জায়গা করে নিতে পেরেছি এর অংশত কারণ আমি এমন একটা সময় লিখতে শুরু করেছি যখন এই নব্যধারার আন্তর্জাতিকতাবাদের বড় রকমের চাহিদা তৈরি হয়েছিল। লন্ডনের প্রকাশক, সাহিত্য-সমালোচক এবং সাংবাদিকরা এমন এক নতুন প্রজন্মের লেখকদের চেয়েছেন যারা প্রচলিত ইংরেজি সাহিত্যের ঐতিহ্য থেকে আলাদা…এবং আমি মনে করি, আমাকে সেখানে সাহিত্যমঞ্চের দৃশ্যপটে স্থান দেওয়া হয়েছে কারণ আমাকে আন্তর্জাতিক লেখক বলে তারা ভেবেছেন।’

ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বে কিছু বিষয় প্রণিধানযোগ্য, যেমন: গৃহত্যাগ করা, নিজ-বাসভূমের জন্য নস্টালজিক হয়ে পড়া, নতুন ভূমিতে একাকীত্ব বোধ করা, সমঝোতা করা, নতুনভাবে নিজের আত্মপরিচয় নির্মাণ করা, দুই দেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভেতর আটকে পড়া; প্রভৃতি। এসব কারণে ডায়াসপোরাকে বলা হচ্ছে জাতীয়তাবাদ-উত্তর (post-nationalism) কাল।

দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য : দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে কথা বলার আগে, এই অঞ্চলের ডায়াসপোরার ইতিহাস ও প্রকৃতি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। এই মুহূর্তে চীনের পর ভারত দ্বিতীয় বৃহত্তর ডায়াসপোরা সাহিত্য নিয়ে আমাদের সামনে আছে। ভারতীয় তৃতীয় প্রজন্ম হাইব্রিড আইডেনটিটি নিয়ে এখন বিশ্বে নানাভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তারা তাদের সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে ভারতীয় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদ থেকে বের হয়ে এসে বৈশ্বিক মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন মূল্যবোধের অনুসন্ধান করছে। দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে কথা বলতে গেলে আমাদের বেশিরভাগ কথা বলতে হবে ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য এবং ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পূর্বে আমরা একই ইতিহাসের অংশ ছিলাম।

দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্ব : শারীরিকভাবে স্বদেশ থেকে অন্যদেশে চলে গেলেও মনটা স্বদেশ এবং নতুনদেশে মাঝে নিত্য যাতায়াত করে। বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয়। ছেড়ে আসা স্বদেশের সংস্কৃতি ও স্মৃতির জন্য বিলাপ প্রকাশের জন্য নয়া-নির্মিতি হিসেবে ইন্দো-ফিজিয়ান কবি সুদেশ মিশ্র হিন্দি কবিতার ‘বিদেশিয়া ট্র্যাডিশন’কে গ্রহণ করেছেন। ডায়াসপোরা মানুষের সংকটকে চিহ্নিত করে ‘Diaspora and the Difficult Art of Dying’ শিরোনামে তিনি কাব্যগ্রন্থও লিখেছেন।

ডায়াসপোরা সাহিত্যতত্ত্বের বিবেচ্য বিষয় হিসেবে ফিজিয়ান-অস্ট্রেলিয়ান কবি সুদেশ মিশ্র তাঁর Diaspora criticism গ্রন্থে বলছেন, ‘Diaspora criticism takes the concept 'diaspora' as its object of inquiry and provides a framework for discussing displaced communities in a way that takes contemporary social, cultural and economic pressures into account. It also offers an alternative to Postcolonial Studies.’

ভারতীয় ডায়াসপোরা তাত্ত্বিক বিজয় মিশ্র তার The Literature of Indian Diaspora: Theorizing the Diasporic imaginary প্রবন্ধে বলছেন, ‘All Diasporas are unhappy, but every diaspora is unhappy in its own way. Diaspora refers to people who do not feel comfortable with their non-hyphenated identities as indicated on their passport...’ এই ‘Non-hyphenated’ শব্দবন্ধনীকে আমাদের সামনে আরও খোলসা করেছেন তাঁর The Law of the Hyphen and the postcolonial Condition গদ্যে। এখানে তিনি বলছেন, ‘The hyphen — Indo-Americans, Indian-Americans, Hindu-Americans, Muslim-Britons — signals the desire to enter into some kind of generic taxonomy and yet at the same time retain, through the hyphen, the problematic situating of the self as simultaneously belonging ‘here’ and ‘there.’ তিনি আরও বলছেন, এই ‘হাইফেন’একইসঙ্গে একজন লেখকের জন্য নেতিবাচক এবং ইতিবাচক অভিজ্ঞতা বয়ে আনে। দুটি সংস্কৃতির মেলবন্ধনে যেমন তৃতীয় একটা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির জন্ম হয়, তেমনি ভেতরে ভেতরে জন্ম হতে থাকে অতৃপ্তি ও অনিশ্চয়তা। মিশ্র এই পরিস্থিতিতে স্থানচ্যুত হওয়া লেখকদের স্মৃতির ভেতর দিয়ে নিজের স্বদেশকে খোঁজার প্রয়াসকে তিনি বলছেন Diasporic imaginary।

এই নেতিবাচক এবং ইতিবাচক অভিজ্ঞতা কেবল ডায়াসপোরা লেখকদের মধ্যে নয়, ডায়াসপোরা লেখকদের কারণে স্বদেশি লেখক ও পাঠকদের ভেতরেও সৃষ্টি। ভারতীয় ডায়াসপোরা পণ্ডিত জাসবির জেইন তাঁর The Indian Diasporic Experience প্রবন্ধে বলছেন, ইতিবাচক দিক হলো ডায়াসপোরা লেখকেরা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ভারতীয় (বা স্বদেশি) ইতিহাস-ঐতিহ্য তুলে ধরছেন। তাঁর ভাষ্যে, ‘…histories of diaspora act like myriad mirrors which reflect on our notions of Indianness, Indian history and identity।’ অন্যদিকে এর মন্দ দিক হলো, ডায়াসপোরা লেখকদের আন্তর্জাতিক প্রভাব ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে আমাদের (বা স্বদেশি লেখকদের) নিজস্ব কণ্ঠস্বর হারিয়ে যায়। তাঁর ভাষায়, ‘It obstructs our view and silences our voice. And in the creative act we need to be wary as to how it uses our experience, our reality, our history.’ ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক ভিম এস দাহিয়া ডায়াসপোরা সাহিত্যকে চিহ্নিত করছেন এই বলে, “The phenomenon of multi-culturalism, responsible for the production of diasporic writing, is itself an aspect of post-modernism, which proclaims multicultural and ethnic societies, promoting the politics of differences…Diasporic writing draws our attention… our era in which responsibilities of citizens go across national boundaries. The earlier modernist notions of centre and margin, home and exile and familiar and strange are falling apart” (Some thoughts on Diasporic writing and the Politics of Difference)

সুদেশ মিশ্র ডায়াসপোরা সাহিত্যকে তাত্ত্বিকভাবে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছেন; একটি Sugar Diaspora অন্যটি Masala Diaspora. ‘From Sugar to Masala: Writings by the Indian Diaspora’ গদ্যে তিনি বলছেন, ডায়াসপোরা সাহিত্য-প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে আমাদের ‘গৃহ’ (home) ধারণাটি নতুন করে নির্মাণ করতে হবে; যেহেতু ‘this (home) occurs aginst the backdrop of the global shift from the centring or centripedal logic or monopoly capitalism to the decentering or centrifugal logic of transnational capitalism. Whereas for the Sugar Diaspora ‘home’ signifies an end to itinerant wandering, in putting down the roots, ‘home’ for the masala diaspora is linked to the strategic espousal of rootlessness, to the constant mantling and dismantling of the self in makeshift landscape.’

সুদেশ মিশ্র অবস্থানগতভাবে আবার ডায়াসপোরাকে দুইভাবে ভাগ করছেন; একটি হলো পুরানো ডায়াসপোরা, অন্যটি নয়া ডায়াসপোরা। পুরানো ডায়াসপোরা ভেতর পড়ে যারা মনের দোটানার ভেতর ফিজি, ত্রিনিদাদ, মরিসিয়াচ, দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া এবং গায়ানার মতো কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোতে গেছে। নয়া ডায়াসপোরার ভেতর পড়ে যারা অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্যের মতো বাণিজ্যনির্ভর মহানগরগুলোতে গেছে। আমেরিকান-তার্কিশ ঐতিহাসিক আরিফ ডিরলিক নয়া ডায়াসপোরা সম্পর্কে বলছেন, ‘New Diasporas have relocated the self there and other here and consequently borders and boundaries have been confounded. And the flow has become at once homogenizing and heterogenizing; some groups share in common global culture regardless of locations while others take refuge in cultural legacies that are far apart from one another as they were at the origin of modernity.’

ভারতীয় নারীবাদী তাত্ত্বিক চন্দ্র মোহন্তি তাঁর Defining Genealogies: Feminist Reflections on being South Asian in North America প্রবন্ধে হোম বা গৃহ বলতে তিনি প্রশ্ন করছেন: গৃহ আসলে কোনটা- যেখানে আমি জন্মেছি? যেখানে আমি বড় হয়ে উঠেছি? যেখানে আমি পেশাজীবী হিসেবে আছি? যেখানে আমি আমার নিজের লোকজনকে পাচ্ছি? এরপর তিনি প্রশ্ন করছেন, আমার নিজের লোকজন বলতে আমি কাদের বুঝবো? গৃহ কি তবে ভৌগলিক-আবেগযুক্ত স্থান? ডায়াসপোরা তাত্ত্বিকদের জন্য জন্য এসব প্রশ্ন বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। এবং এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে তাঁরা উপলব্ধি করছেন ‘গৃহ’ আসলে ব্যক্তির রাজনৈতিক-পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত। এই ধারণার সঙ্গে আরও কতগুলো বিষয় যুক্ত যেমন অবসেশন, স্মৃতিতাড়না, পূর্বপুরুষের ইতিহাস এবং আত্মঅন্বেষণ; যার সম্পূর্ণ প্রকাশ ঘটে কাশ্মিরী-আমেরিকান কবি আঘা শহিদ আলীর লেখায়। তাঁর কবিতার মূল বিষয় হলো, মার্কিন সাহিত্য সমালোচক ব্রুস কিং যেমনটি বলছেন, ‘...obsessions [with]…memory, death, history, family ancestors, nostalgia for a past he never knew, and self-consciousness about being a poet.’

আলী  তাঁর Postcard from Kashmir কবিতায় বলছেন:

‘কাশ্মীর আমার ডাকবাক্সে এঁটে যায়

চার বাই ছ ইঞ্চি—ঝকঝকে-পরিষ্কার আমার বাড়ি

আমি সবসময় পরিচ্ছন্নতা পছন্দ করতাম

এখন আমার হাতে আধা ইঞ্চি হিমালয়—

এটা আমার গৃহ, আমার পরিচয়।’ [তর্জমা: বর্তমান আলোচক]

কিন্তু এভাবে ছবির ফ্রেমে বা স্মৃতিচিহ্ন দিয়ে আত্মপরিচয় নির্মাণ করা যায় না। বরং সেটা আরও বায়বীয় হয়ে ওঠে। তুলনামূলক সাহিত্যের শিক্ষক রুশ লেখক সভেতলানা বউম যে কারণে বলছেন, ডায়াসপোরা সাহিত্যে হারানো গৃহের প্রতি স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠার ভেতর দিয়ে একজন লেখক তার ক্ষয়িষ্ণু আত্মপরিচয় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারেন না। একইকথা বলছেন ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখক ভিএস নাইপল তাঁর A Way in the World উপন্যাসে। তিনি বলছেন, আমরা (ডায়াসপোরা জনগোষ্ঠী) বংশানুক্রমে যা ধারণ করি, সবকিছু বুঝে করি না। ফলে কখনো কখনো আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের অপরিচিত মনে হয়। (চলবে)



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ জুন ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়