ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য, ভারত-পর্ব

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৪৯, ১৪ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য, ভারত-পর্ব

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

চীনের পর দ্বিতীয় বৃহত্তর ডায়াসপোরা সাহিত্যের দেশ ভারত। ভারতীয় কয়েক প্রজন্মের নারী-পুরুষ এখন সংকর (হাইব্রিড) ও অন্বয় সাধিত (হাইফেনেটেড) পরিচয় নিয়ে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। তারা তাদের সৃজনশীলতার ভেতর দিয়ে বৈশ্বিক মানবতাবাদের ওপর ভিত্তি করে নতুন মূল্যবোধের অনুসন্ধান করছে। ভারতীয় ডায়াসপোরাকে নিজেদের সাহিত্যের বিষয়বস্তু করে তুলেছেন ভিএস নাইপল, সালমান রুশদি, রোহিনটন মিস্ত্রি, অমিতাভ ঘোষ, ঝুম্পা লাহিড়ী, অনিতা দেশাই, আর কে নারায়ণ, রাজা রাও, বিক্রম শেঠ, অমিত চৌধুরী প্রভৃতি খ্যাতিমান লেখক। দ্বিতীয় পর্যায়ে আছেন কিরণ দেশাই, অরুন্ধতী রায়, ভারতী মুখার্জী, এম জি ভাসানজি, শ্যাম সেলভাদুরাই, বিক্রম চন্দ্র, ফারুক ঢোন্ডি, রমেশ গণেশকেরা, গীতা মেহতার মতো লেখকরা। যেহেতু আগের পর্বগুলোতে ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রকৃতি ও তত্ত্ব নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা হয়েছে। এ পর্বে কেবল কয়েকজন লেখকের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হলো।

ভিএস নাইপল : ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখকদের ভেতর স্যার ভিএস নাইপলই একমাত্র সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। বুকার পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। নাইপল নিজেকে ‘কলোনিয়াল প্রডাক্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। নিজের জাতিসত্তার প্রশ্নে বলেছেন: ‘Many-Sided Background’. এটা বলার কারণ, নাইপলের পরিবার ব্রিটিশ ভারত থেকে ব্রিটিশ ত্রিনিদাদে যায়। সেখানে থেকেও যায় তারা পাকাপাকিভাবে। সে-কারণে নাইপলের জন্ম ত্রিনিদাদে। নাইপলের যখন জন্ম তখন ত্রিনিদাদ ছিল ব্রিটিশ উপনিবেশ। ফলে তিনি হিন্দু সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠলেও মিশেছেন-পড়াশোনা করেছেন খ্রিস্টান কম্যুনিটিতে। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে থেকে যান ইংল্যান্ডে। নাইপল তাঁর ত্রিনিদাদে বেড়ে ওঠার দিনগুলো নিয়ে যেমন গল্প-উপন্যাস লিখেছেন, তেমনি ভারতীয় প্রেক্ষাপটও চলে এসেছে তাঁর লেখায়। ডাবল ডায়াসপোরার কারণে তাঁর জন্য বিষয়টা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। যে কারণে তিনি লেখালেখিতে উপনিবেশ ও নির্বাসন থেকে বের হতে পারেননি। ‘এ হাউস ফর মি. বিশ্বাস’, ‘ইন এ ফ্রি স্টেট, ‘হাফ এ লাইফ’, ‘মিগুয়েল স্ট্রিট’, ‘দ্য মিসটিক মসিউর’ তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ও গল্পের বই।

সালমান রুশদি : ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্য থেকে সবচেয়ে খ্যাতিমান ও আলোচিত লেখকদের ভেতর অন্যতম ব্রিটিশ ভারতীয় ঔপন্যাসিক-প্রাবন্ধিক সালমান রুশদি। ঐতিহাসিক পটভূমিতে জাদু-বাস্তবতার মিশেল এবং ভারতীয় উপমহাদেশ, পূর্ব ও পশ্চিমের অসংখ্য সংযোগ, বিচ্ছিন্নতা ও অভিপ্রয়াণের পটভূমি তাঁর লেখনীর স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের ভেতর পড়ে। তিনি মুসলিম বিশ্বে বিতর্কিত হন ‘দ্য স্যাটানিক ভার্সেস’ উপন্যাসের জন্য। ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসের জন্য বুকার পুরস্কার পান রুশদি। কেন সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন না সেটি অব্যাখ্যাত। ‘মিডনাইটস চিলড্রেন’ উপন্যাসে সুন্দরবন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ কিছুটা এসেছে। এই উপন্যাসের জন্য তিনি ভারতে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েছেন। ২০০০ সালের পর থেকে রুশদি নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করে আসছেন।

ঝুম্পা লাহিড়ী : সাম্প্রতিক ভারতীয় ডায়াসপোরা সাহিত্যে প্রতিনিধিত্বশীল লেখক হলেন ঝুম্পা লাহিড়ী। তিনি ডায়াসপোরা সংকট থেকেই লিখে চলেছেন। ভারতীয় লেখকদের ভেতর তিনিই সর্বপ্রথম পুলিৎজার পুরস্কার পান। ঝুম্পার পরিবার লন্ডন থেকে আমেরিকা পাড়ি দেয় যখন তার বয়স মাত্র দুবছর। এরপর তারা সেখানেই থেকে যান। নিজেকে এখন আমেরিকান হিসেবে পরিচয় দেন ঝুম্পা। তিনি বলেন, ‘I wasn't born here, but I might as well have been.’ ‘ইন্টারপ্রেটার অব ম্যালাডিস’, ‘আনঅ্যাকাস্টমড আর্থ’, ‘দ্য নেইমসেক’, ‘দ্য লোল্যান্ড’ তার সবচেয়ে প্রশংসিত বই। ‘দ্য নেইমসেক’ থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ভারতীয় ডায়াসপোরা চলচ্চিত্র পরিচালক মিরা নায়ার। তিনি কানাডায় বাস করছেন। ঝুম্পার অধিকাংশ গল্প-উপন্যাসে ভারতীয় আমেরিকানদের বিশেষ করে বাঙালি-আমেরিকানদের জীবনচিত্র উঠে এসেছে। তিনি যে সংকটকে উপজীব্য করেছেন, সেখানে ভারতীয়দের নতুন দেশে মানিয়ে নেওয়ার বিষয়টিই প্রধান নয়, পাশাপাশি অভিবাসী জীবনে একঘরের ভেতর প্রথম প্রজন্মের সাথে দ্বিতীয় প্রজন্মের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ও বোঝাপড়ার ফাঁকটাও বড় হয়ে উঠেছে। মা-বাবা চাচ্ছেন সন্তান দেশের ভাষা-সংস্কৃতিটাও শিখুক-জানুক। এতে তাদের সঙ্গে সন্তানদেরও একটা আত্মিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগ থাকে। অন্যদিকে সন্তানরা এটা না করে দ্রুত মানিয়ে নিতে চাচ্ছে বসবাসরত দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে।

অনিতা দেশাই ও কিরণ দেশাই : ছোটগল্পকার ও ঔপন্যাসিক অনিতা দেশাইয়ের জন্ম ১৯৩৫ সালে ভারতের দিল্লিতে। তাঁর মা জার্মান; বাবা বাঙালি। পশ্চিমে বড় হয়ে উঠলেও বাবার মতোই টান অনুভব করেছেন পিতৃভূমি ভারতের প্রতি। বাড়িতে জার্মান ভাষা এবং বাড়ির বাইরে বাংলা, উর্দু, হিন্দি এবং ইংরেজি শিখে বড় হয়েছেন। ইংরেজি তাঁর সাহিত্যভাষা হয়ে উঠেছে। উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ক্রাই দ্য পিকক’ (১৯৬৩), ‘আ ক্লিয়ার লাইট অব ডে’ (১৯৮০), ‘ইন কাস্টোডি’ (১৯৮৪), ‘বমগার্টনার্স বম্বে’ (১৯৮৮) ইত্যাদি। অনিতা ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিটিউট অব টেকনোলজির মানবিক অনুষদের অধ্যাপক। বুকার প্রাইজের জন্য তিনবার সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছেন। পেয়েছেন ভারতের সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ‘দ্য ভিলেজ বাই দ্য সি’ গ্রন্থের জন্য পেয়েছেন গার্ডিয়ান চিলড্রেন’স ফিকশন অ্যাওয়ার্ড। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব লিটারেচার, দি আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস অ্যান্ড লেটার্সের ফেলো। ২০১৪ সালে ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান পদ্মভূষণে সম্মানিত হয়েছেন।
 

 


এই খ্যাতনামা ভারতীয় ডায়াসপোরা লেখকের মেয়ে কিরণ দেশাইও কথাসাহিত্যিক। মাত্র ৩৫ বছর বয়সে তিনি তাঁর ‘দ্য ইনহেরিটেন্স অফ লস’ উপন্যাসের জন্য ২০০৬ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার এবং ন্যাশনাল বুক ক্রিটিকস সার্কেল ফিকশন পুরস্কারে ভূষিত হন। এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন লেখক ১৯৭১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ভারতের চন্ডিগড়ে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কাটে পুনে ও মুম্বাইতে। ১৪ বছর বয়সে তিনি ও তার মা ভারত ছেড়ে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান এবং এক বছর পরে তিনি তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। সৃজনশীল সাহিত্যের ওপর পড়াশোনা করেন। প্রথম উপন্যাস ‘হুলাবালু ইন দ্য গুয়াভা অর্চার্ড’ ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হলে সালমান রুশদির মত খ্যাতিমান লেখক এই উপন্যাসের প্রশংসা করেন। এই উপন্যাসের জন্য তিনি বিটি টাস্ক পুরস্কার অর্জন করেন।

রোহিনটন মিস্ত্রি : কানাডীয় পার্সি বংশোদ্ভূত ভারতীয় লেখক রোহিনটন মিস্ত্রি এ সময়ের আলোচিত ডায়াসপোরা লেখক। জন্ম ১৯৫২ সালে বম্বেতে। বম্বে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে গ্র্যাজুয়েট করে ১৯৭৫ সালে চলে যান কানাডা। মূলত সেখানেই তিনি লেখক হয়ে ওঠেন। ১৯৮৫ সালে কানাডিয়ান ফিকশন ম্যাগাজিন সেরা কন্ট্রিবিউটর পুরস্কার দেয় তাকে। তবে কানাডায় বসে লিখলেও তার লেখার বিষয়বস্তু ভারতীয় উপমহাদেশ। মিস্ত্রি নিজেকে আখ্যায়িত করেন ‘ডাবলি মার্জিনাল’ হিসেবে। পার্সিরা ভারতে ছিলো সংখ্যালঘু, অভিবাসী হয়ে বিদেশে শিকড়হীন। পার্সি সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক টানাপড়েন, আত্মপরিচয়ের সংকট রোহিনটন মিস্ত্রির লেখায় উপজীব্য হয়ে উঠে এসেছে। ১৯৮৭ সালে পেঙ্গুইন কানাডা তেকে প্রকাশিত হয় তার প্রথম ছোটগল্প সংকলন ‘টেলস ফ্রম ফিরোজশাহ বাগ’। বইটির নামকরণ করা হয়েছে মুম্বাইয়ের একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের নামে। ১৯৯১ সালে প্রকাশিত ‘সাচ এ লং জার্নি’ উপন্যাসের প্লট সত্তর দশকের বম্বে। ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘এ ফাইন ব্যালান্স’ উপন্যাসেরও প্রেক্ষাপট সত্তর দশকের মুম্বাই শহর। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শহরের সংখ্যালঘু পার্সি জনগোষ্ঠী। ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘ফ্যামিলি ম্যাটার্স’ উপন্যাসে ভারতীয় ঐতিহ্যবাহী পরিবারকে ব্যবচ্ছেদ করেছেন তিনি। মিস্ত্রির তিনটি উপন্যাসই বুকারের জন্য মনোনীত হয়।

আঘা শহিদ আলী : কাশ্মীরী-আমেরিকান কবি আঘা শহিদ আলী দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান সাহিত্যের এক নক্ষত্র। ১৯৪৯ সালে দিল্লিতে জন্ম। কাশ্মীরে বেড়ে ওঠা এবং শিক্ষা। ১৯৭৫ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকা চলে যান। সেখানেই পাকাপাকিভাবে থেকে যান। আমেরিকান কবি হিসেবে তিনি খ্যাতি পান। আলীর শক্তি ছিল বহুজাতিক বৈশিষ্ট্যকে কাব্যভাষায় ধারণ করা। একইসঙ্গে হিন্দু-মুসলিম এবং পশ্চিমা ঐতিহ্য তার সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ইন্দো-মুসলিম গজল ট্র্যাডিশনকে তার মতো করে কেউ ইংরেজি কবিতায় তুলে আনতে পারেননি। মার্কিন সাহিত্য সমালোচক ব্রুস কিং তার মূল বিষয়কে চিহ্নিত করছেন এভাবে: Ali’s poetry swirls around insecurity and obsessions [with]…memory, death, history, family ancestors, nostalgia for a past he never knew, dreams, Hindu ceremonies, friendships, and self-consciousness about being a poet. আলী ২০০১ সালে মারা যান আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস শহরে।

ভেন বেগামুদ্রে : ভারত-বংশোদ্ভূত কানাডীয় সাহিত্যিক ভেন বেগমুদ্রের জন্ম ১৯৫৬ সালে। দক্ষিণ ভারতে, ব্যাঙ্গালোরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে পরিবারের সাথে ভেনকে চলে আসতে হয় কানাডাতে। ‘বিষ্ণু ড্রিমস’ তাঁর অন্যতম সেরা সৃষ্টি। ভারতীয় পৌরাণিক কাহিনির সূত্রকে ব্যবহার করে তিনি এই উপন্যাস লিখেছেন। ‘বিষ্ণু ড্রিমস’ উপন্যাসের প্রধান দুই চরিত্র একজোড়া ভাই-বোন। বোনটির নাম দুর্গা। দুর্গার ভাইয়ের নাম সুভাষ। শৈশবেই ভাই-বোনের ছাড়াছাড়ি। দুইজনের জন্মই ভারতে, কিন্তু বেড়ে ওঠা ভিন্ন ভিন্ন দেশে। দুর্গা কানাডাতে আর সুভাষ আমেরিকায়। দুর্গা-সুভাষকে নিয়ে একজন ভারতীয় অভিবাসীর চিরন্তন যে প্রশ্ন ‘সে ভারতীয় নাকি কানাডীয়’-কে কেন্দ্র করে ভেন রচনা করেছেন এই উপন্যাস।
 


কেতকী কুশারী ডাইসন : কেতকী কুশারী ডাইসন নাইপলের মতো ডাবল ডায়াসপোরা লেখক। তিনি যেমন ভারতীয় ব্রিটিশ, তেমনটি বাংলাদেশি-ভারতীয় ব্রিটিশ। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর তিনি বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ববঙ্গ) পূর্বপুরুষের ভিটে এবং বাবার কর্মস্থল ছেড়ে পরিবারসহ কলকাতায় চলে যান। ১৯৬৪ সাল থেকে স্থায়ীভাবে যুক্তরাজ্যে বসবাস করছেন। বাবা অবনী মোহন কুশারী ছিলেন অবিভক্ত নদীয়া জেলার মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। কেতকীর পৈতৃক ভিটে ঢাকার বিক্রমপুরে এবং মাতুলালয় ফরিদপুর। কেতকী প্রথম ভারতীয় নারী যিনি অক্সফোর্ডে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণি পান। কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর অধ্যাপনা করেন। ১৯৬৪ সালে কলকাতায় রবার্টস ডেভিড ডাইসনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়; এরপর থেকে যুক্তরাজ্যের কিডিলিংটনে স্থিত হয়েছেন। বাংলা ও ইংরেজি দু’ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ। ইংরেজিতে কবিতা লিখলেও উপন্যাস তিনি বাংলা ভাষায় লিখে থাকেন। প্রথম দিকের উপন্যাস ‘নোটন নোটন পায়রাগুলো’য় তিনি লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালিদের জীবনচিত্র তুলে ধরেছেন। প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের অপূর্ব মেলবন্ধন  ঘটেছে এই উপন্যাসে, বাংলা উপন্যাসে এমনটা ইতোপূর্বে লক্ষ করা যায়নি। এই উপন্যাসে যেমন বাঙালি পরিবার আছে, তেমনি রয়েছে আলজেরিয়ান, উত্তর আইরিশ, দক্ষিণ আইরিশ, ক্যারিবিয়ান চরিত্র। তিনি বাঙালি নারীর দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিদেশি নারীদের জীবন তুলে ধরেছেন। ২০০৩ সালে বের হয় তাঁর উপন্যাস ‘জল ফুঁড়ে আগুন’। এখানে তিনি বাঙালি ও ইংরেজদের অসবর্ণ বিবাহের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।

ভারতী মুখার্জী : ঝুম্পার মতো ভারতীয় মানুষ বিশেষ করে ভারতীয় নারীদের নিয়ে আমেরিকায় বসে লিখে চলেছেন ভারতী মুখার্জী। তিনি একইসঙ্গে ইংরেজির প্রফেসর, সাংবাদিক এবং লেখক। লেখেন উপন্যাস এবং প্রবন্ধ। অভিবাসী সমস্যা, মিশ্র সাংস্কৃতিক প্রভাব, বর্ণবাদ এসব তাঁর উপন্যাস ও গল্পের মূল উপজীব্য। তিনি নিজে যেমন আমেরিকান সাহিত্য-ঐতিহ্যের অংশ হতে চান তেমন নিজের অস্তিত্বটাও টিকিয়ে রাখতে চান, যে কারণে ‘Two Ways to Belong in America’ গদ্যে তিনি বলছেন, তিনি এখানে আছেন অস্তিত্ব রক্ষা করতে, পরিবর্তন করতে নয়।

গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক: গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক ভারতী সাহিত্য সমালোচক, তাত্ত্বিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ‘Can the Subaltern Speak?’ এবং জাক দেরিদার ‘De la grammatologie’ বইটিকে মূল ফরাসি থেকে ইংরেজি অনুবাদ। ১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় জন্ম। ১৯৫৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে প্রথম শ্রেণি সম্মানসহ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ইংরেজি ও বাংলা সাহিত্যে স্বর্ণপদক অর্জন করেন। এরপরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করেন এবং সেখানে তিনি ইংরেজিতে এমএ এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচডি করেন। ১৯৬০ সালে ট্যালবট স্পিভাকের সঙ্গে তিনি সীমিত সময়ের জন্য বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন।

অরুন্ধতী রায় : ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ উপন্যাসের জন্য ১৯৯৭ সালে বুকার পুরস্কারজয়ী অরুন্ধতী রায়ের কথাও বলতে হয়। অরুন্ধতী রায়ের জন্ম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শিলং শহরে। বাবা বাঙালি, মায়ের দিকে কেরালাইট ক্রিশ্চিয়ান। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকার কর্মী। অরুন্ধতী যতটা না লেখক তার চেয়ে বেশি অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে আলোচিত।

রুপি কাউর : ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় রুপি কাউর একাধারে কবি, লেখক, চিত্রশিল্পী ও অভিনেত্রী। জন্ম ১৯৯২ সালের ৫ অক্টোবর। ‘মিল্ক অ্যান্ড হানি’ তাঁর প্রথম কবিতা ও গদ্য-সংকলন। প্রকাশিত হয় ২০১৪ সালে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে নিউইয়র্ক টাইমস-এর বেস্ট সেলার লেখক আর চিত্রশিল্পী হিসেবে আখ্যা পান তিনি।

সাউনা সিং বাল্ডুইন : কানাডিয়ান-আমেরিকান লেখক সাউনা সিং বাল্ডুইনের জন্ম ভারতে। তিনি ‘What the Body Remembers’ উপন্যাসের জন্য Commonwealth Writers Prize-ভূষিত হন। তাঁর লেখায়ও ঘুরেফিরে পিতৃমাতৃভূমির কথা এসেছে।

চিত্রা ব্যানার্জী : The American Book Award-জয়ী চিত্রা ব্যানার্জীও জনপ্রিয় হয়েছেন। তিনিও অভিবাসী জীবন, দক্ষিণ এশিয়ার সংস্কৃতি, ইতিহাস ও পুরাণ নিয়ে লেখেন। তাঁর লেখা গ্রন্থের ভেতর ‘Arranged Marriage’, ‘The Mistress of Spices and Sister of my Heart’ প্রশংসিত হয়েছে।

অখিল শর্মা : ছোটগল্পের জন্য The PEN/Hemingway Award পেয়েছেন ছোটগল্পকার-টেলিভিশন নির্মাতা অখিল শর্মা। তাঁর লেখাতেও প্রবাসজীবনে ভারতীয় জনগণের সংকট ও সমস্যা উঠে এসেছে।

ঋণস্বীকার : অনুবাদক, অধ্যাপক অভিজিৎ মুখার্জি




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়