ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

হতাশ হলে, তার জীবনের কোনো মূল্য নাই: সত্যরঞ্জন মৈত্র

অলাত এহ্‌সান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৫, ২৮ জুলাই ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হতাশ হলে, তার জীবনের কোনো মূল্য নাই: সত্যরঞ্জন মৈত্র

সত্যরঞ্জন মৈত্র


প্রশ্ন : আপনার জন্ম রাজশাহীর আঁত্রাই, বড় হলেন ফরিদপুরের রাজবাড়ীতে, তাই না?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : রাজবাড়ী আমার মামাবাড়ি। মামারাই আমাকে নিয়ে আসলো। আমি মামা বাড়িতেই বড় হয়েছি, লেখাপড়া করেছি। আমি ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন মামাবাড়ি আসি।

প্রশ্ন : আপনার তো আরো ভাই-বোন ছিল, তারা কোথায়?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : বোন ছিল না, শুধু ভাই ছিলাম। পাঁচ ভাই। আমি সবার বড়। এখনো বড়। মাঝখানে আমার পরে যে সে মারা গেছে। তাই এখন আমরা চার ভাই। আমি ছাড়া ওপাড়ে (পশ্চিমবঙ্গে) সব। আমার ভাইরাও শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ওপাড়ে গিয়েও তারা এই রাজনীতিতে যুক্ত আছেন।

প্রশ্ন : বেঁচে থাকতে কেমন লাগে? দীর্ঘ জীবনের প্রান্তে দাঁড়ানো আপনাকে এই প্রশ্নটা করা যায়।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : মানুষ মরতে চায় না, আমিও মরতে চাই না। কিন্তু খুব কষ্ট হয়। কারণ এখনকার যারা দেখা যায় তাদের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছি না। এটা হচ্ছে সব চেয়ে বড় সমস্যা। এখন চিন্তার জগতে যে বড় পরিবর্তন ঘটেছে। মানুষের মধ্যে স্যাক্রিফাইস করার মানসিকতা নাই। জনগণের জন্য কাজ করবো স্বার্থ ত্যাগ করে, সেই মানসিকতা নাই। যেটা ছিল এক সময়। হয়তো তখনকার পরিস্থিতিই ছিল আলাদা। তখন বেশির ভাগ রাজনীতিতে আসতো মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। কাজেই সেদিক থেকে কোনো সমস্যা ছিল না। আর্থিক দিক দিয়েও সমস্যা ছিল না। অনেকেই রাজনীতি করতে এসে সংসার ধর্ম করেনি বা আয়-ইনকাম করার জন্য ব্যস্ত হয়নি। তখনকার দিনে জমিদার প্রথা থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে এসেছে।

প্রশ্ন : বর্তমানে বিপ্লবী রাজনৈতিক কর্মীদের ভেতরও তো পরিবর্তন এসেছে। যেমন দাদু, একটা কথা আমরা জানি যে, সে সময়ের সশস্ত্র বিপ্লবী, বিশেষত মাস্টারদা’ সূর্য সেনের সঙ্গে যারা কাজ করতেন, সূর্য সেন বিপ্লবীদের ভেতরে মানসিক সম্পর্ক মানে ভালোবাসার সম্পর্ক ঠিক অনুমতি দিতেন না। যে করণে সরোজিনী দত্তের সঙ্গে এক বিপ্লবীর সম্পর্ক হওয়ায় তাকে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা পাঠিয়ে দেন। তাই কী?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : ও হ্যাঁ। তো?

প্রশ্ন : মানে, কমরেডদের ভেতর ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠলে বা বৈবাহিক সম্পর্ক দাঁড়ালে বিপ্লবের ক্ষতি হবে, ব্যাপারটা এমন ছিল কি না? সূর্য সেন ও প্রীতিলতাকে নিয়েও তো এমন কথা পড়ি। বিয়ে না করার পেছনে কি ওই কারণ ছিল?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : প্রথম দিকে ছিল তো। তখন আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুতিও তেমন ছিল। আমরা অনেকেই সংসারের দায়িত্ব নেইনি। আবার আমি বিয়ে করেছি, বাচ্চা হয়েছে। আমার স্ত্রী তার দায়িত্ব নিয়েছে। তার ওই সচেতনতা না থাকলে আমি তা করতে পারতাম না। নিষেধটা টেররিস্ট পার্টি যখন ছিল...

প্রশ্ন : এটা তো ব্রিটিশদের কাছে। মানে ওদের কাছে যা টেররিস্ট আমাদের কাছে তা বিপ্লবী বা সশস্ত্র বিপ্লবী।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : হ্যাঁ। তো এই পার্টিগুলো বিয়ে-শাদির চিন্তা করতো না। বিয়ে করলে, সংসার করলে বিপ্লবী থাকা যায় না-এইসব মানসিকতা তখন ছিল। ধীরে ধীরে সেসব পরিবর্তন হয়। তারপর বিপ্লবীরা বিয়ে করে, সংসার করে, রাজনীতিও করে। এরকম তো হয়ই। তখন অর্থনৈতিক অবস্থা আর এখনকার অর্থনৈতিক অবস্থা এক নয় তো। অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য তারা অনেক কিছু করতে পেরেছে। ফ্যামিলির সাপোর্টটা পেয়েছে। ফলে তারা রাজনীতি করতে পেরেছে। তারপর জেলখানায় পড়ে থেকেছে।

প্রশ্ন : আপনার মামাবাড়িও বেশ সম্পদশালী ছিল। একটি সম্পদশালী পরিবারে বড় হয়েও আপনি কী করে জমিদার প্রথার বিরুদ্ধে বিপ্লবী রাজনীতিতে যুক্ত হলেন।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : সে তো আর দুই লাইনে বলা যায় না। কারণ যেখানে আমার মামাবাড়ি সেটা একটা বর্ধিষ্ণু জায়গা।

রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততা সেখানেই। ওটা রাজনীতির গ্রাম। ওখানে বিপ্লবীরা এক-একজন জেল খেটেছে। ১৬ বছর ১৭ বছর পর বিপ্লবীরা জেল থেকে বেরিয়ে এসেছে। তাদের সহযোগিতা পেয়ে আমি রাজনীতির মধ্যে ঢুকে পড়ি। পড়াশুনা থেকে এদের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে। তারা রাজনীতি শিখিয়েছে। আমার লাভ হয়েছে।

প্রশ্ন : আপনি তো ধনি ঘরের সন্তান, তারা রাজনীতি করেন আপনার বিপরীত। আপনার সঙ্গে দূরত্ব থাকাটাই স্বাভাবিক ছিল না?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : বর্ধিষ্ণু গ্রাম বলে মানুষের ভেতর ব্রিটিশবিরোধী মানসিকতা সেখানে ছিল। এটা হচ্ছে প্রধান দিক। আর যে গ্রামে আমার মামাবাড়ি সেই গ্রামের বেশকিছু ছেলে জেল খেটে বেরিয়ে এসেছে ১৫-১৬ বছর পর। সেই সব এলাকায় আমি বড় হয়েছি। অতএব তাদের প্রভাব আমার ওপর পড়েছে। তারাই আমাকে ধীরে ধীরে এই দিকে নিয়ে গেছে। আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি, তখন এর সঙ্গে পুরোপুরি সম্পৃক্ত হয়ে গেলাম। তারা ক্লাস নিতেন।

প্রশ্ন : এখন যেমন বিশ্বে কমিউনিস্ট অর্থনীতি ও দর্শনের ওপর বই পাওয়া যায়। তখন তো এত বই ছিল না। তখন কি ওই ক্লাসগুলোই শেখার মাধ্যম ছিল? তখন তো এমএন রায়ের কিছু বই বেরিয়েছে মাত্র।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : এমএন রায় সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন ছিল। তার বই ছিল, কিন্তু এমএন রায়কে আমরা যথার্থ কমিউনিস্ট মনে করতাম না। ওই সময়েই। আমি যখন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সম্পৃক্ত হই তখন আমাদের রিসোর্স ছিল ওইসব বিপ্লবীরা।

প্রশ্ন : আমাদের দল বলতে কি ‘অনুশীলন’, ‘যুগান্তর’-এর কথা বলছেন?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : অনুশীলন, যুগান্তর পাড় হয়ে এসেছি আমরা। আমাদের সময় এদের প্রভাব শেষ হয়ে আসছে। তখন কমিউনিস্ট পার্টি হচ্ছে, ১৯৩৪। যারা জেলে ওই সময়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ফলে; তারা জেল থেকেই কমিউনিস্ট হয়ে বেরিয়ে আসে। তারা পার্টি করে। তাদের মধ্যে আন্দামানের বন্দিও ছিল। 

প্রশ্ন : তখন কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠলেও সশস্ত্র বিপ্লবীদের রাজনীতি আলাদা ছিল না?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : আলাদা থাকলেও আস্তে আস্তে এক হয়ে যায়। তাদের ভেতরে যোগাযোগ তো ছিলই। তখন একটা জিনিস বোঝা গেল যে, জনগণ ছাড়া কিছু করা যায় না। তখন আমরা যে একজন একজন করে ধরছি (বিপ্লবী দলে সদস্য তৈরিকে ইঙ্গিত করে), এইভাবে কিছু হবে না। যদি না জনগণের সমর্থন পাওয়া যায়। তাই জনগণের মধ্যে পড়ে থাকতে হবে আমাদের। এই আমরা জনগণের মধ্যে পড়ে থাকলাম। কৃষক-শ্রমিকদের ভেতরে পড়ে থাকলাম। বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তুললাম ইত্যাদি ইত্যাদি বহু ঘটনা।

প্রশ্ন : আপনি কি সশস্ত্র বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত হলেন, নাকি পার্টি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেন?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : যারা সশস্ত্র রাজনীতি করতো, তারা জেল থেকে বেরিয়ে এসে, আমরা যে গ্রামে বাস করতাম, বললাম তো বর্ধিষ্ণু গ্রাম,  এখানে যেমর প্রতিক্রিয়াশীল ছিল, তেমনি প্রগতিশীল বিপ্লবীরাও ছিল। এদের সঙ্গেই আমাদের ওঠা-বসা, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। যেহেতু একই গ্রামে আমাদের বাড়ি। এর ফলে জনগণের মধ্যে কাজ করেছি। আবার জেলেও গেছি।

প্রশ্ন : মাস্টারদা’ সূর্য সেনের সশস্ত্র বিপ্লবীদের তৎপড়তা আপনাদের গ্রামেও ছিল। আপনার কি তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : না। তবে তাদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল। তারা আমাকে টানতে চেষ্টা করেছেন। আমরা জেল ফেরত বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত হই। জেল থেকে বিপ্লবীরা কমিউনিস্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছিল, এই কথা মনে রাখতে হবে।

প্রশ্ন : আমি যদি আপনাকে সময় ধরে প্রশ্ন করি...
সত্যরঞ্জন মৈত্র : তা আমি পারবো না। কারণ আমার যে বয়স তাতে দেখা যাবে এখন যে কথা বলছি, পড়ে মনে হবে সেই কথা ভুল বলেছি। বয়সটা বিট্রে করে। যে কারণে সাধারণভাবে আমি কোনো ইন্টারভিউ দেই না।
 

সত্যরঞ্জন মৈত্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহীতা অলাত এহ্‌সান


প্রশ্ন : দেশ ভাগের আগেই পার্টি রাজনীতিতে দুটো ভাগ ছিল। তো দাদু, দেশ ভাগ তো দুই পার্টি একভাবে নেয়নি। তাই না?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : দেশভাগকে আমরা সমর্থন করিনি।

প্রশ্ন : কিন্তু দেশভাগের ফলে সীমান্ত তৈরি হলো। পার্টি কর্যক্রম-নেতৃত্বেরও বিভাজন তৈরি হলো।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : এটা তো বস্তবতা। কিছুদিন একত্র ছিল। তারপর সিদ্ধান্ত হলো- আর তো একত্র রাখা যায় না। দেশ যেহেতু ভাগ হয়ে গেছে। দুটো রাষ্ট্র, দুটো রাজনীতি, দুটো চিন্তা। কাজেই একত্র আর থাকা যায় না। আলাদা হতেই হলো। এজন্য আমাদের দ্বিতীয় পার্টি বলে আমাদের একটা আলাদা পার্টি হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। এই পার্টি কংগ্রেসে দুটো পার্টি হয়ে গেলে। তার আগে কমরেড জ্যোতিবসুর সঙ্গে ছিলাম। এটা ১৯৪৮-এর আগে। তিনি যখন শ্রমিক আন্দোলন করতেন। 

প্রশ্ন : পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলন যে বাঙালির জাতিসত্তা নির্মাণ ও মুক্তির আন্দোলন হয়ে উঠলে, এর পেছনে কমিউনিস্টদের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। ফরিদপুরে আন্দোলন সংগঠিত করায় আপনিও তো যুক্ত ছিলেন।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : সে কথা তো মনে করা কঠিন। যদি ভুল বলে ফেলি। ভুল ইনফরমেশন দিয়ে আমার লাভটা কি? এজন্য আমি ইন্টারভিউ দিতে চাই না। তো আমার পড়ালেখা শেষ হয়েছে ১৯৪৫ সালে। তার আগেই ফুল টাইম রাজনীতি করতাম। লেখাপড়া শেষ করার পর তো কোনো বাঁধা রইলো না।

প্রশ্ন : হ্যাঁ, আপনি তথ্য দেয়ার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল। স্মৃতি থেকে...
সত্যরঞ্জন মৈত্র : সংক্ষেপে বলছি, আমার দূর্বলতা বলা যায়, সেই সময় আমি সম্পূর্ণ জেলখানায়। অতএব জেল জীবনই হচ্ছে আমার প্রধান। ১৯ বছর আমি জেলখানায় থেকেছি। ফলে বহু জিনিসের সঙ্গে আমার ডাইরেক্ট সম্পর্ক নাই। সে সময় জেলখানায় বহু ছেলেপুলে এসেছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, আলোচনা করেছি।

প্রশ্ন : জেলাখানায় আপনার সাথী তো সত্যেন সেন, সরদার ফজলুল করিম এরা। সেখানে তো আপনারা শারীরিক কসরৎ, পাঠচক্র ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের সংগঠিত রাখতেন।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : হ্যাঁ, সত্যেন সেন আমার বড় ছিলেন। সেখানে পাঠচক্র ছিল। এক সাথে ৮০-৯০ জন ছিলাম আমরা। ক্লাস করা হতো। বই পড়া হতো। তাদের মধ্যে অনেকে থেকে গেছে। অনেকে দেশভাগের ফলে থাকতে পারেনি। ওপারে চলে গেছে। কারণ তাদের ফ্যামিলি চলে গেছে। আর মধ্যবিত্ত শ্রেণিই তো ছিল প্রধান শ্রেণি। মধ্যবিত্তের বিরাট অংশ ওপারে চলে গেল। ফলে পার্টি বিভাজন অনিবার্য হয়ে পড়লো। নেতৃত্বশূন্য হয়ে পরলো।

প্রশ্ন : পরে আপনাদেরই তার হাল ধরতে হলো।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : যাই হোক আমি ১৯ বছরে জেলে ছিলাম। আত্মগোপনে ছিলাম ২৩ বছর। তখন একটার পর একটা ঘটনা ঘটছে আর আমাদের নামে মামলা পড়ছে। বিনা বিচারে আটকই ছিলাম প্রধান। তখন মামলা ছাড়াই রাজবন্দী হিসেবে জেলে আটক রাখা যেত। বিনা বিচারে আটক রাখলেও তখন আমাদের ওপর অত্যাচারটা ভালোই হতো। আমরা যারা এক সঙ্গে ছিলাম-চলাফেরা করা, জিনিস নিয়ে আসা, পাস করা, শরীর চর্চা, চিন্তা-মতাদর্শকে ধারণ করা তাদের ওপর অত্যাচার হতো।

প্রশ্ন : রাজশাহীর খাপড়া ওয়ার্ড জেল হত্যাকাণ্ড, ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল, তখন তো আপনি জেলে ছিলেন?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : হত্যাকাণ্ডের কয়েকদিন আগে আমরা হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিলাম। লাস্ট আমরা হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিলাম ষাট দিন, সিক্সটি ডেস। এর পরপরই হত্যা চালানো হয়। তার প্রতিশোধ নিলো ওখানে আমাদের যারা ছিল তার ওপর। যাই হোক সে সময় ভুল রাজনীতির ফলে এটা হয়েছে।

প্রশ্ন : মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করতে পেরেছিলেন কি?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করতে আসলে পারিনি। কারণ আমি তখন জেল খানায়।

প্রশ্ন : দেশ স্বাধীনতার পর তো পার্টিতে বড় রকমের পরিবর্তন আসলো। আপনি কীভাবে পার্টিতে যুক্ত হলেন।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : তখন আমাদের যোগাযোগ ছিল। আমাদের ভেতরে আলাপ-আলোচনা হতো। আমরা আমাদের মতামত বাইরে পাঠাতাম। আমাদের মতামত ওরা নিতো। পার্টি নেতৃত্বে তখন মণি সিংহ, খোকা রায় এরা যারা ছিলেন।

প্রশ্ন : হ্যাঁ, জ্ঞান চক্রবর্তী, অনিল মুখার্জি নেতৃত্বে ছিলেন।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : একাত্তরের যুদ্ধের সময় যে পার্টিতে যুক্ত ছিলাম, সেই পার্টির সেক্রেটারি ছিলেন সুখেন্দু দস্তিদার। সরদিন্দু দস্তিদার, নজরুল ইসলাম এরা। পার্টি ছিল পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। খোকা রায়-মণি সিংহের হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি।

প্রশ্ন : কমরেড সিরাজ সিকদার তো এই পার্টি থেকেই বেরিয়ে এসেছিলেন? কেন?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : হ্যাঁ। ১৯৬৫ সালে সিরাজ সিকদার ছাত্র ইউনিয়ন নেতা। সে সময় তিনি মাও রিসার্স সেন্টার করেন। সে সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। মতিন-আলাউদ্দিন-টিপু বিশ্বাস একভাগ হয়। অন্যভাগে সিরাজ সিকদার থাকে। তবে ’৭১-এ সে আলাদাভাবে অংশগ্রহণ করে। তখনই সে তার পার্টি গঠন করে, বরিশালে। একাত্তরে আমি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির লোক। যুদ্ধের পর বেরিয়ে এসে আবার পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-এ যোগ দেই।

প্রশ্ন : আবার পার্টি বিপর্যয় এসেছে নব্বই দশকের শুরুতে। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গনের ফলে। তখন তো পার্টি একদল নেতারা বললেন, কমিউনিস্ট পার্টির আর প্রয়োজন নেই।
সত্যরঞ্জন মৈত্র : সমায়িকভাবে ইতিহাসের এমন ওঠা-নামা হয়। সব কিছুর মধ্যে একটা আদর্শ থাকে। তাকে ধরে রেখেই এগুতে হয়। তাই যারা এগোয় তারা এগিয়ে যাচ্ছে, যারা যাচ্ছে না তারা পিছিয়ে পরছে। এই তো হয় ইতিহাসে।

প্রশ্ন : আপনা রাজনৈতিক জীবন শুরুতে প্রতিকূলতা ছিল। এখনো আছে। তবে সে সময় কমিউনিস্ট পার্টিগুলো শক্তিশালী ছিল। বিভক্তি সেই শক্তিকে কমিয়ে দিচ্ছে। মুক্তিকে পিছিয়ে দিচ্ছে। দীর্ঘ জীবনেও আপনি তা দেখতে পারছেন না। পার্টিগুলোর এই বিভক্তি কী মনে হয় ?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : না। আমি ইতিহাসকে এভাবে দেখি না। এটা স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক কিছু না। কালের পরিবর্তনের সাথে সাথে চিন্তা জগতের-কর্মের-মানুষের-পেশার পরিবর্তন ঘটে। আমার সময় যা দেখেছি, এখন তা নেই। যে শ্রমিক আমরা দেখেছি, যে শ্রমিক নিয়ে এত হইচই, সেই শ্রমিক আর শ্রমিক নেই। মার্কস যে সব শ্রমিকের কথা বলেছেন, সেই সব শ্রমিক আর খুঁজে পাওয়া যায় না। মাও যে কৃষকের কথা বলেছেন সেই কৃষকও পাবে না।

প্রশ্ন : এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, মুক্তিযুদ্ধের পরেও কী আমাদের এই অঞ্চলে ভূমির পর্যালোচনা, ভাবাদর্শের পর্যালোচনাটা ঠিক মতো হয়েছে?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : আমাদের এখানে ভাববাদী আদর্শ প্রধানত। ভাববাদ, কল্পনা। এই কল্পনা জগতে আমরা বাঁচি। বাস্তবের দিকে তাকানো উচিত। চিন্তা ও তত্ত্ব বাস্তবতা যা বলে তাকে ধরে এগুতে হবে। তা হচ্ছে না। তা অনুধাবন করে কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে যাওয়া। তাদের কথা শোনা ও আমাদের কথা বলা। দেখা যায় তারা কি বললে আর আমরা কি বললাম। 

প্রশ্ন : আচ্ছা, দাদু, আপনার পারিবারিক নাম সত্যরঞ্জন মৈত্র, কিন্তু আপনি যখন বিপ্লবী তৎপরতায় যুক্ত হলেন, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজর এড়াতে আপানি ‘মোমেন’ নাম গ্রহণ করেছিলেন। এমন অনেকেই করেছেন। এটা কি রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক কারণে?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : হ্যাঁ। শোন, এক-একটা দেশে এক-একটা যুগে এক-একটা সংস্কৃতিতে মন-মানসিকতা কাজ করে, পরিবর্তন হয়। এখন আমাদের দেশে মানুষের পরিবর্তন আমরা চোখেই দেখছি।

প্রশ্ন : এই পরিবর্তন কি ভালোর দিকে, না মন্দ দিকে যাচ্ছে?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : ভালো-মন্দ দুটোই আছে। শুধু মন্দ বলবো না। পরিবর্তনের একটা দিক আগে তারা ছিল অশিক্ষিত, তাদের চাষা বলা হয়, তাদের কথা বলার অধিকারই ছিল না। এখন আমাদের দেশে আবার সেই চেষ্টা হচ্ছে। এইভাবে দেখা যাচ্ছে পরিবর্তন কিন্তু হচ্ছে। সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না, মানুষও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। সমাজও এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকে না। অনবরত পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তনকে যদি ধরতে না পারি, আমরা ভুল করি। আমরা ভুল পথ দেখাই। আমরা অনেক সময় ভাববাদ দ্বারা পরিচালিত হই।

আগে যা দেখেছি, এখন সেই ধারাই যদি আনি, আকড়ে ধরে থাকি, তাহলে মানুষের সমর্থন পাবো না। মানুষকে বুঝে উঠছি না তো। যে পরিবর্তন ঘটেছে সেই পরিবর্তন থেকে আমার কথা-চেতনা-চলাফেরায় মিল নাই তো। কাজেই মানুষ ভয় পায়, দূরে সরে থাকে। এখন সেই অবস্থা বিরাজমান। এই অবস্থাও বেশিদিন থাকবে না। দু-চার বছর পর আবার পরিবর্তন ঘটেবে। এটাই তো স্বাভাবিক।

প্রশ্ন : আমরা ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার ভেতরে ঢুকে পারছি না?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : অস্থিরতা আছে, ধর্মীয় প্রভাবটা পড়ছে। কিন্তু নতুন পথ, যাকে বলে আস্থা, সেই আস্থাহীন অবস্থা বিরাজ করছে। আস্থার জায়গায় ভাঙন ধরেছে। দল ভাগ হয়ে গেলে মানুষের আস্থাটা থাকে না। মানুষ মনে করে, এরা সবাই একই কথা বলছে অথচ দশটা পার্টি। এটা মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে।

প্রশ্ন : তাহলে উপায় কী, রাজনৈতিক দলগুলো মধ্যে ঐক্য হওয়া জরুরি?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : এক সাথে হওয়া উচিতই। কিন্তু এক সাথে হতে হলে যে সমস্ত ইন্টারেস্ট দরকার, আমাদের মধ্যে সেই ইন্টারেস্ট নেই। আমরা যে দেশে বাস করছি, সেই বাংলাদেশের মানুষকেই আমরা বুঝতে পারি নাই। বাংলাদেশের মানুষ কী ভাবে, কী চিন্তা করে, কী তারা চায় তা জানি না। অথচ আমাদের কথা তাদের জানাতে চাই। তাহলে তো হবে না। এটাই আমাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখছে। শেখ মুজিবুরের যত সমস্যাই থাক, তিনি কিন্তু বুঝেছিলেন। মানুষের পালস তিনি ধরতে পেরেছিলেন এবং সেটাকে ব্যবহার করেছিলেন। সেটা ভালোর জন্য না হোক, তিনি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু আমরা বুঝতেই পারি না, ব্যবহার করব তো আরো পরে।

প্রশ্ন : আপনি দীর্ঘ জীবন যাপন করছেন। এদিক দিয়ে সার্থক। কিন্তু আপনি কতটা সফল? যে স্বপ্ন নিয়ে এই রাজনীতি, সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হলেন সে ক্ষেত্রে আপনি কতটা সফল?
সত্যরঞ্জন মৈত্র : আমি তো ইতিহাসকে এই ভাবে দেখিনি। এর উত্তর তো ইতিহাস দেয়। সেখানে দেখা যায়, এই পরিস্থিতির জন্য এই কারণ। এটা বাস্তব। এভাবে যদি বিচার করা হয়, তাহলে এক রকম ফল হবে। আবার আমার স্বপ্ন, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলছে না। তাহলে আরেক রকম হবে। আমি সেই ধরণের কোনো অবাস্তব চিন্তা কখনো করিনি। আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি যে, এমন ঘটলো কেন? কোথা থেকে উৎপত্তি? এই যে সার্চ করা, এই যে কেন’র উত্তর খোঁজা, এর মধ্যে থাকলে মানুষ কখনোই হতাশ হয় না। আমি যদি জানার চেষ্টা করি, বোঝার চেষ্টা করি। এটা এইভাবে হতে পারতো কি না? হলো না কেন? কোথায় আমাদের ভুল ছিল? মানুষের চিন্তা-চেতনা এই রকম হলো কেন? এই ভাবে যখন দেখি, তখন আমার ভেতরে কোনো হতাশা হয় না। ইতিহাসের নিয়মকে যারা অস্বীকার করতে চায়, তারা হতাশ হয়। হতাশা ভিড় করলে, হতাশ হলে, তার জীবনের কোনো মূল্য নাই।

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জুলাই ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়