ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

হীরা-দ্যুতি বাংলা চলচ্চিত্রের পাথেয়

কমলেশ রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০০, ২ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
হীরা-দ্যুতি বাংলা চলচ্চিত্রের পাথেয়

||কমলেশ রায়||


‘সেন’ শব্দটার প্রতি দুটি কারণে বিশেষ আগ্রহ। বোধকরি কমবেশি সবার, বাঙালি মাত্রই। এক. বনলতা সেন, দুই. সুচিত্রা সেন। দু’জনের ক্ষেত্রেই আমাদের মুখ থেকে যেন নিজের অজান্তেই বেরিয়ে আসে: ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’

পাখির নীড়ের মতো চোখ তোলা বনলতা তো জীবনানন্দ দাশের কল্পিত মানবী। তার সঙ্গে যোগসূত্র খোঁজা অবাস্তব, বোকামি। তবে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আত্মীয়তার একটা যোগসূত্র রয়েছে। কার? হীরালাল সেনের।

চলচ্চিত্রের ইতিহাস নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন, খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন হীরালাল সেন কে। তিনি এই উপমহাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাতা। শুধু কী তাই? না, তিনি আসলে একের মধ্যে অনেক। ছিলেন অনেক গুণের অধিকারী, অনেক তাঁর পরিচয়। হীরালাল সেন এককথায় একটি উল্কার নাম। বাঙালি হিসেবে যিনি আমাদের গর্ব করার সুযোগ করে দিয়েছেন। সিনেমার আম-দর্শক, সাধারণ শিক্ষিত সমাজ কতটুকু জানেন তার সম্পর্কে? হীরালাল সেনের ভাগ্য এক্ষেত্রে খুব সুবিধের নয়। সাময়িক তারকা-দ্যুতির নিত্তিতে উনি বরং কিছুটা পিছিয়ে। তবে নিঃসন্দেহে ওজনদার। ‘চকচক করিলেই সোনা হয় না।’ আর তাই সময় যত যাচ্ছে হীরালাল সেনের হীরক-দ্যুতি ততই উজ্জ্বল হয়ে ছড়াচ্ছে চারদিকে। সর্বমহলে উনি সমাদৃত হচ্ছেন। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়ছে। এক্ষেত্রে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের সাথে তার খানিকটা সাদৃশ্য আছে বৈকি!

সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কী ধরনের আত্মীয়তা ছিল হীরালাল সেনের ? খুব কাছের নয়, তবে আত্মীয়তা একটা ছিল। হীরালাল সেনের তৃতীয় সন্তান প্রতিভা সেন তথির বিয়ে হয়েছিল হরনাথ সেনের সাথে। হরনাথ সেনের ভাইপো দিবানাথ সেনের স্ত্রী ছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। প্রখ্যাত লোকসাহিত্য বিশারদ ড. দীনেশচন্দ্র সেনের নিকট-আত্মীয় ছিলেন হীরালাল সেন। ড. সেন ছিলেন তার পিসতুতো (ফুপাতো) ভাই ও সহপাঠী। মানিকগঞ্জ থেকে প্রাইমারী (মাইনর) পাস করে তারা দুজনেই ভর্তি হন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে। কিশোর বয়সে দীনেশচন্দ্র সেন কাগজ কেটে ‘রামের বনবাস’র ছবি তৈরি করে দেখাতেন ‘ছায়াবাজি’ খেলা। লণ্ঠনের আলো ও কাপড়ের সাহায্যে এটা দেখানো হতো। এই ছায়াবাজির খেলা হীরালালের মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। পরবর্তীতে ফটোগ্রাফি ও বায়োস্কোপের প্রতি ঝোঁক ও অনুরাগের পেছনে এটার বড়সড় ভূমিকা ছিল। দুই বছরের বড় ড. দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে হীরালাল সেন নিজেই তা স্বীকার করেছেন, ‘এই ঝোঁকের মূলে তুমিই, তুমি যে আমাকে লইয়া ছবি আঁকিতে, সেই সময় ইহার সূত্রপাত, তুমি যেদিন ছায়াবাজি দেখাইয়াছিলে, সেদিন যে আমার মনে যুগ উল্টাইয়া গিয়াছিল, তাহা তোমায় বলি নাই। কিন্তু সেই ছায়াবাজি দেখার কথা কৈশোর জীবনে প্রতিদিনই আমার মনে পড়িয়াছে, উহাই এই রয়াল বায়োস্কোপের ভিত্তি।’

হীরালাল সেনের জন্ম ১৮৬৮ সালের ২ আগস্ট (মতান্তরে ১৮৬৬), মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে। তার ঠাকুরদা (দাদা) গোকুলকৃষ্ণ সেন ছিলেন মানিকগঞ্জের জমিদার, ঢাকার নামকরা উকিল। তার ছিল তিন পুত্র ও তিন কন্যা। চন্দ্রমোহন সেন ছিলেন তার দ্বিতীয় পুত্র। আর বিধুমুখী ছিলেন দিনাজপুরের বিখ্যাত সেরেস্তাদার শ্যামচাঁদের মেয়ে। এই চন্দ্রমোহন-বিধুমুখী দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান হীরালাল। তাদের ছিল চার পুত্র ও চার কন্যা। হীরালাল সেন বিয়ে করেন হেমাঙ্গিনী দেবীকে। তাদের সন্তানদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায়, তারা হলেন: সুরবালা দেবী, প্রফুল্লবালা দেবী, প্রতিভা সেন তথি ও বৈদ্যনাথ সেন।

একটা বিষয়ের উল্লেখ হয়ত অপ্রাসঙ্গিক হবে না, জমিদার গোকুলকৃষ্ণ সেনের অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন ঢাকার নবাব আবদুল গণি। তাই বলা চলে, হীরালাল সেনের পরিবারের সঙ্গে ঢাকার নবাব পরিবারের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও হৃদ্যতা ছিল। ঢাকার জিন্দাবাহার লেনে তাঁদের বাসাবাড়ি ছিল। এ বাড়িতে থেকেই হীরালাল সেন ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন। এরপর আইনজীবী বাবার সঙ্গে লেখাপড়া করতে কলকাতা যান।

কলকাতা গিয়ে মা বিধুমুখীর কাছে ক্যামেরার বায়না করলে তিনি তা কিনে দেন। তখন হীরালাল সেন আইএসসির ছাত্র। ক্যামেরা হাতে পেয়ে ছবি তোলার নেশা তাকে পেয়ে বসে। এরপরই ঘটে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি। ১৮৯০ সালের মধ্যে মানিকগঞ্জ ও কলকাতায় স্টুডিও খোলেন। নাম ছিল: এইচ এল সেন অ্যান্ড ব্রাদার্স ও অমরাবতী ফটো আর্টস অ্যাসোসিয়েশন। এতে জড়িত ছিলেন তাঁর ছোট দু’ভাই মতিলাল সেন ও দেবকীলাল সেন। পরবর্তীতে দেবকীলাল সেন উচ্চ পদের সরকারি চাকরিতে যোগ দেন।  ফটোগ্রাফির প্রতি ছিল দুর্বার আকর্ষণ, এর চর্চা ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান, আর তাই এ ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য সাতবার স্বর্নপদক পান হীরালাল সেন। সেটাও আবার ১৮৯৮ সালের মধ্যে, ভাবা যায় এসব অর্জন তিনি করেছিলেন যখন তাঁর বয়স ত্রিশ মাত্র !

ফরাসি সহোদর আগস্ট লুমিয়ের ও লুই লুমিয়ের ( ব্রাদার্স নামে সর্বাধিক পরিচিত ) ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বরে চমকে দেন গোটা পৃথিবীকে। তারা সন্ধান দেন অন্যরকম এক শিল্পমাধ্যমের, যার নাম চলচ্চিত্র। এ দিনে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে  প্রথমবারের মতো সিনেমা প্রদর্শন করেন প্যারিসের গ্রান্দ ক্যাফেতে। এর পরপরই  প্যারিস, লন্ডন, নিউইর্য়ক ও ওয়াশিংটনে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু হয়ে যায়। হীরালাল সেন তখন আলোকচিত্র চর্চায় নিমগ্ন। ১৮৯৬ সালের ৭ জুলাই মুম্বাইয়ে উপমহাদেশের প্রথম বায়োস্কোপ দেখানো হয়। কাছাকাছি সময়ে কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের অধ্যাপক ফাদার ল্যাফো বায়োস্কোপ আনেন বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের দেখানোর জন্য। স্টিফেন্স নামে আরেক ইংরেজ ভদ্রলোক কলকাতার স্টার মঞ্চে বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করেন একই সময়ে।

হীরালাল সেন এই বায়োস্কোপ দেখে বিস্মিত ও অভিভূত হন এবং এ ব্যাপারে ভীষণভাবে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ফাদার ল্যাফো ও স্টিফেন্স নামের এই  দুই বিদেশির কাছ থেকে তিনি বায়োস্কোপ প্রদর্শনের বিষয়ে জ্ঞান লাভ করেন। বিদেশ থেকে আমদানি করেন প্রজেক্টর ও চলচ্চিত্র । ভাই মতিলাল সেনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি, ১৮৯৮ সালের ৪ এপ্রিল। কলকাতার ক্ল্যাসিক থিয়েটারে শুরু করেন বায়োস্কোপ প্রদর্শনী। হীরালাল সেনের জয়যাত্রা এরপর থেকেই শুরু হয়, সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। ঢাকার সদরঘাটের ক্রাউন থিয়েটারে বায়োস্কোপ দেখানো হয় একই সালে। পরে মানিকগঞ্জের বগজুরি, ভোলার এসডিও ডাক বাংলো, জয়দেবপুর রাজপ্রাসাদ ও ঢাকার নবাববাড়িতে বায়োস্কোপ দেখায় রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি। বায়োস্কোপ দেখাতে গিয়ে হীরালাল সেন চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আগ্রহী হন। স্টিফেন্সের কাছ থেকে মুভি ক্যামেরার খুটিনাটি শেখেন। আর চলচ্চিত্র নির্মাণের কারিগরি কৌশল রপ্ত করেন ফ্রান্স থেকে কলকাতায় আগত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠান প্যাথে কোম্পানির সঙ্গে থেকে।

সিনেমা তৈরির জ্ঞান অর্জন করেই তিনি বসে থাকেননি। ১৯০০ সালের সেপ্টেম্বরে লন্ডন থেকে মুভি ক্যামেরাসহ  চলচ্চিত্র নির্মাণের আধুনিক যন্ত্রপাতি আমদানি করেন। কোম্পানিকে উন্নীত করেন বিশ্বমানে। প্রথমে মানিকগঞ্জের বগজুরি গ্রামে করেন শুটিং। নির্মাণ করেন ‘পুকুরে স্নান’ ও ‘কোটের খেলা’ নামে দুটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

হীরালাল সেনের সৃষ্টিশীলতার ব্যাপ্তির স্বাক্ষর মেলে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে তিনি নির্মাণ করেন ৪০টিরও বেশি চলচ্চিত্র। বাঙালির সেরা বিনোদন তখন থিয়েটার। বেশিরভাগ চলচ্চিত্রেই তিনি ক্যামেরাবন্দি করেন বিখ্যাত নট অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারে মঞ্চস্থ বিভিন্ন নাটকের দৃশ্য। ১৯০১ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে ক্ল্যাসিক থিয়েটারের পক্ষে অনেকগুলো চলচ্চিত্র তৈরি করেন তিনি। যেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ভ্রমর, হরিরাজ, সীতারাম ও বুদ্ধদেব। ১৯০৩ সালে তিনি উপমহাদেশের প্রথম পূর্ণদৈঘ্যের নিবার্ক ছবি ‘আলী বাবা ও চল্লিশ চোর’ নির্মাণ করেন। ভারতীয় উপমহাদেশে (সম্ভবত বিশ্বে)  ফিল্ম ব্যবহার করে হীরালাল সেনই প্রথম বিজ্ঞাপন চিত্র বানিয়েছিলেন ১৯০৩ সালে। ‘জবাকুসুম হেয়ার অয়েল’ ও ‘অ্যাডওয়ার্ডস টনিক’ -এর বিজ্ঞাপন চিত্র বানিয়েছিলেন তিনি। ভারতের (সম্ভবত বিশ্বে) প্রথম রাজনীতিক ছবি বা তথ্যচিত্রও তিনিই নির্মাণ করেন ১৯০৫ সালে। এটি ছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। নামও বেশ লম্বা,  ‘অ্যান্টি-পার্টিশন ডেমোনস্ট্রেশন অ্যান্ড স্বদেশি মুভমেন্ট, অ্যাট দ্য টাউন হল ক্যালকাটা অন ২২ সেপ্টেম্বর ১৯০৫’। এ ছবির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল :  ‘আমাদের নিজেদের স্বার্থে খাঁটি স্বদেশী সিনেমা’। সেই হিসেবে হীরালাল সেনই প্রথম স্বদেশি চলচ্চিত্রের নির্মাতা। সেই সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক নিষিদ্ধ হয় তার তথ্যচিত্র।

এছাড়াও আরও অনেক প্রথমের সঙ্গে জড়িত হীরালাল সেন। প্রথম রঙিন চলচ্চিত্রের স্রষ্টা, সেলুলয়েডে রঙ লাগিয়ে এ অভাবনীয় কাজ করেন তিনি। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতার টাউন হলে প্রথম সবাক চলচ্চিত্র প্রক্ষেপণ প্রচেষ্টা চালান। প্রথম বাঙালি ল্যাব টেকনিশিয়ান তিনি, প্রথম বাঙালি ফিল্ম ডেভেলপারও। ভারতের প্রথম স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র প্রদর্শক তার কোম্পানি রয়াল বায়োস্কোপ। হীরালাল সেনের হাত ধরে চলচ্চিত্র জগতে প্রতিষ্ঠা পান অনেক কুশলী, অভিনেতা ও অভিনেত্রী। কুশলীদের মধ্যে অন্যতম তার ভাই মতিলাল সেন। ভাগ্নে ভোলানাথ গুপ্তকে ( কুমার শংকর গুপ্ত) নিজ হাতে শিখিয়েছিলেন চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর যাবতীয় কলাকৌশল। যিনি পরে আরেকজনের সঙ্গে মিলে গঠন করেন লন্ডন বায়োস্কোপ। উল্লেখ্য কুমার শংকর গুপ্তের কন্যা জ্যোৎস্না গুপ্ত (জন্মেছিলেন ১৯১৪ সালে) বাংলা চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেত্রী ছিলেন, নির্বাক ও সবাক দুই পর্বেই।  অন্য দুই শিষ্য অনিল চট্টোপধ্যায় ও নলিনী চট্টোপধ্যায় গড়ে তুলেছিলেন ইম্পেরিয়াল বায়োস্কোপ। হীরালাল সেনের মাধ্যমে প্রথম চিত্রনায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন কুসুম কুমারী। দ্বিতীয় চিত্রনায়িকা প্রমোদা সুন্দরী। তৃতীয় হরিদাসী, এরপর নায়িকা হন তারা সুন্দরী। অমরেন্দ্রনাথ দত্ত, নৃপেন্দ্র বসুর মতো নামকরা নাট্যাভিনেতারাও অভিনয় করেন তাঁর চলচ্চিত্রের বিভিন্ন দৃশ্যে।

আলো-ছায়া নিয়ে ছিল যার কারবার, সেই হীরালাল সেনের জীবন থেকে হঠাৎ করেই সরে যেতে থাকে আলো। হতাশা আর আর্থিক অসচ্ছলতার ছায়া আস্তে আস্তে গ্রাস করতে থাকে তাকে। ১৯০২ সালে কলকাতায় এসে এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি খোলেন পার্সি ব্যবসায়ী জে এফ ম্যাডান। মুম্বাইয়ে তার দুটি পার্সি থিয়েটার ছিল। অর্থও কামিয়েছিলেন প্রচুর। শেষদিকে তার কোম্পানির কাছে ব্যবসায়িকভাবে মার খায় হীরালাল সেনের কোম্পানি। কথিত আছে, হীরালাল সেনের ভাগ্নে ভোলানাথ গুপ্ত এ ব্যবসায় নামিয়েছিলেন ম্যাডানকে। অন্যদিকে বনিবনা না হওয়ায় আলাদা হয়ে যায় ব্যবসা , ১৯১৩ সালে তাই দু’ভাই ওঠেন কলকাতার আলাদা দুই বাড়িতে। মতিলাল সেন দখলে নিয়ে নেন রয়াল বায়োস্কোপ কোম্পানি। এসময় নায়িকা কুসুম কুমারীর সঙ্গে মামলায় জড়িয়ে পড়েন হীরালাল সেন। এ দিকে দেহে বাসা বেঁধেছে কর্কট রোগ, শরীরও একটু একটু করে প্রতিদিন ভেঙ্গে পড়ছে। ভাবতে কষ্ট হয়, এই উদ্যোমী মানুষটি একসময় অর্থকষ্টের চাপে সাধের ক্যামেরা দুটিকে বন্ধক রেখেছিলেন। কী কপাল! টাকারও আর জোগাড় হয়নি, ক্যামেরা দুটিও আর ফিরিয়ে আনতে পারেননি তিনি।

১৯১৭ সালের ২৪ অক্টোবর মতিলাল সেনের বাড়ির  গুদামে আগুন লেগে পুড়ে যায় হীরালাল সেনের সব চলচ্চিত্র ও নথিপত্র। ছাই হয়ে যায় বাঙালির চলচ্চিত্র সৃষ্টির আদিপর্ব। এ ঘটনায় পুড়ে মারা যায় তাঁর প্রিয় ভাতিজি মতিলাল-কন্যা অমিয়বালাও।

ঠিক দু’দিন পর ২৬ অক্টোবর চলে যান হীরালাল সেন। মারা যান ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে। কলকাতায় মৃত্যুকালে ছোটবেলার বন্ধু কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তার শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন। শোকবার্তা প্রেরণসহ তার পরিবারকে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়। তার স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র অধিদফতর চালু করেছে ‘হীরালাল সেন  স্মৃতিপদক’।  ইতিহাসের পাতার ওপর ধুলো জমে ছিল। যা সরতে শুরু করেছে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে বেরিয়ে এসেছে দাদাসাহেব ফালকে নন, ভারতীয় উপমহাদেশের  প্রথম চলচ্চিত্রকার হীরালাল সেন। আর এই উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জনকের খেতাবটাও আসলে তার প্রাপ্য। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন চলচ্চিত্র গবেষক ও কর্মী এ ব্যাপারে উচ্চকণ্ঠ হয়েছেন এবং নিরলস গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।  ভবিষ্যতে গবেষণার মাধ্যমে আমরা আরও অনেক নতুন তথ্য পাব। নতুন করে আবিষ্কার করব আমাদের হীরালাল সেনকে। একদিন বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতে মিলবে তার যথাযোগ্য সম্মান ও প্রাপ্য আসন। আমরা সেই অপেক্ষাতেই আছি।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যসেবক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়