ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মা || ফিরোজ আলম

ফিরোজ আলম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৩, ২৯ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মা || ফিরোজ আলম

রাজিবের যখন ঘুম ভাঙলো তখন চারদিকে বেশ রোদ উঠে গেছে। আসলে জানালা দিয়ে বিছানার উপর আছড়ে পড়া এক চিলতে রোদের তাপেই তার ঘুম ভেঙেছে। আগের দিন অনেক রাত পর্যন্ত হাসপাতালে কাটানোর জন্য ঘুমাতে ঘুমাতে প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে রাজিব দ্রুত বিছানা ছাড়লো। দ্রুত বিছানা ছাড়তে দেখে তার স্ত্রী শায়লা কিছুটা ধমকের সুরে বললো, ভোরে এসে ঘুমিয়েছো। এখনি উঠছো কেন? আরেকটু ঘুমাও।

রাজিব চুপচাপ বাথরুমে ঢুকে গেলো। গোসল সেরে যখন বাইরে এলো, দেখলো শায়লা আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছে। রাজিব বুঝলো চুপ থেকে এ যাত্রা পার পাওয়া যাবে না। তাই মুখ কাচুমাচু করে বললো, সকাল ১০টা থেকে আউটডোরে বসতে হবে। শায়লা আরেকটু রেগে গিয়ে বললো, কাল রাতে না তুমি নাইট করলে! রাজিব ডাইনিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে বললো, কাল আমার নাইট ছিল না।

শায়লা বললো, নাইট ডিউটি না থাকলেও হাসপাতালে এত রাত পর্যন্ত কী করো?

রাজিব উত্তর না দিয়ে নাস্তা করতে লাগলো। এরপর অ্যাপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ নিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেল।


রাজিব বের হয়ে যাওয়ার পর শায়লা বড় বোন রাহেলাকে ফোন করলো- আপু আজ একটু আমার বাসায় আসতে পারবে? বোনের কণ্ঠের আকুলতা বুঝতে পেরে রাহেলা বললো, কী হয়েছে রে?

শায়লা বললো, তুমি এলে সামনাসামনি বলবো।

ছেলেকে স্কুল থেকে নিয়ে ফেরার পথে রাহেলা ছোটবোনের বাসায় এলো। এসে দেখলো শায়লা মুখ শক্ত করে বারান্দায় বসে আছে। রাহেলা বোনের পাশে বসে হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো, কী রে, এমন মুখ ভার করে বসে আছিস কেন?

শায়লা বড়বোনকে নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। এরপর স্বামীর কিছুদিনের অদ্ভুত আচরণের ফিরিস্তি দিল সে। রাত করে বাড়ি ফেরা, হুটহাট বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া- সব খুলে বললো শায়লা। শুনে রাহেলাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। এতিমখানায় মানুষ হওয়া রাজিবের সাথে শায়লার সম্পর্কটা বাবা কোনোমতেই মেনে নিচ্ছিলেন না। তখন রাহেলা ও তার স্বামী তারেক মিলে একপ্রকার জোর করে রাজিব-শায়লার বিয়ে দেয়। এখন এদের সংসারে কোনো সমস্যা হলে বাবা-মা দুজনই রাহেলাকে দোষ দেবেন। আর দোষের কথা না ভাবলেও বোনের সুখের সংসারে অশণিসংকেতে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো রাহেলা। বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো, আমি তোর দুলাভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখছি কী করা যায়। তুই চিন্তা করিস না। আর মাথা গরম করে রাজিবের সাথে ঝগড়া বাধাস না আবার!


রাজিব আউটডোরের রোগী দেখা শেষ করে ক্যাফেটেরিয়ায় গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে যখন খেতে বসবে তখন নার্স বকুলের ফোন এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বিরক্ত কণ্ঠে বকুল বললো, স্যার ৪০২ নাম্বারের রোগী তো কিছুতেই দুপুরের খাবার খাচ্ছে না। খালি বলছে খোকা কই? খোকা এলে খাবো। রাজিব ‘আচ্ছা আমি আসছি’ বলে ফোনটা কেটে ক্যাফেটেরিয়ার বয় রতনকে বললো, রতন খাবারটা পরে দিস। আমি একটু লেডিস ওয়ার্ড থেকে ঘুরে আসছি।

রাজিব ৪০২ নং কেবিনে ঢুকেই রোগীকে একটা কপট ধমক দিল। কী হলো আজ আবার খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করছেন কেন? রোগিনী মুখ গোমড়া করে বললেন, খাবো না আমি। সকালে এই মেয়েকে বললাম- আজ আমি গরুর মাংস খাবো। আর ও নিয়ে এসেছে রুই মাছ, করল্লা ভাজি। আমি খাবো না এসব। রাজিব নার্সের দিকে তাকিয়ে বললো, সিস্টার উনি খাবেন গরুর মাংস, আর আপনি এসব কী এনেছেন? তাড়াতাড়ি গরুর মাংস আনান। আজ এই সুযোগে আমিও গরুর মাংস খাব। যদিও আমার হাই কোলেস্টেরল, তবুও খাব। গরুর মাংস ছাড়া কি খাওয়া জমে বলুন? বলে বৃদ্ধার দিকে তাকালো সে। মহিলা এবার আরো রেগে গিয়ে বললেন, হয়েছে তোমার আর হাই কোলেস্টেরল নিয়ে গরুর মাংস খেতে হবে না। ওই করল্লা ভাজিই দাও, আমি ওগুলোই খাবো। নার্সকে ইশারা করতেই খাবারের ট্রে এগিয়ে দিল। মহিলা খেতে খেতে বললো, আমার খোকার কোনো খোঁজ পেলে বাবা? রাজিব মুখ কাচুমাচু করে বললো, না মা। এখনো পাইনি। হয়তো দুই-একদিনের মধ্যেই পেয়ে যাবো। মহিলা খেতে খেতে বললো, আমার খোকারও হাই কোলেস্টেরল। কিন্তু গরুর মাংস খুব পছন্দ করে। বাড়িতে ইচ্ছে করে গরুর মাংস খেতে চাইতাম। যাতে খোকা লুকিয়ে এক-দুই টুকরো খেতে পারে। খোকা বিদেশ গেলে এটা নিয়ে ঝগড়া করে ছেলের বউটা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আচ্ছা তুমি তো ডাক্তার, বলো তো মাঝে মাঝে দুই-এক টুকরো গরুর মাংস খেলে কি খুব ক্ষতি হয়? ছেলেটার আমার এত পছন্দ। আমার খোকা বাড়িতে থাকলে আমাকে এভাবে তাড়িয়ে দিতে পারতো না। খোকা বোধহয় আমাকে খুঁজতে খুঁজতে অনেক কষ্ট পাচ্ছে। তোমাকে বললাম, তোমার গাড়িটা নিয়ে আমাকে একটু পথে পথে ঘোরাও। আমি ঠিকই বাড়িটা চিনতে পারবো।


রাজিব দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে বারান্দায় চলে গেল। মহিলার কথাগুলো রাজিবের বুকে তীরের মতো বিঁধছিল। কারণ রাজিব এই মহিলাকে যেদিন পথ থেকে তুলে এনে নিজের মায়ের পরিচয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে, তার পরদিন মহিলার পরিবারের সন্ধান চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। এরপর এক ভদ্রলোক তার চেম্বারে এসেছিলেন। নিজেকে ওই মহিলার পুত্র পরিচয়ে বলেছিলেন, আমি আপনাকে কিছু টাকা দিচ্ছি, মা কিছুটা সুস্থ হলে কোনো বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেবেন। মাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যেতে পারবো না। রাজিব অবাক হয়ে বললো, তার মানে আপনার মাকে পথে ফেলে যাওয়ার পেছনে আপনারও সায় ছিল? লোকটি মাথা নিচু করে বললো, কী করবো। আমার আর কোনো উপায় ছিল না। রাজিব রেগে গিয়ে বললো, বেরিয়ে যান আমার চেম্বার থেকে। আপনার মতো অমানুষের সাথে কথা বলতেও আমার ঘেন্না লাগছে। এবার ভদ্রলোক কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতো ডাক্তারদেরও আমার চেনা আছে। পথ থেকে তুলে এনে হাসপাতালে রেখে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে পরিবারের লোক খুঁজছেন তো মোটা অঙ্কের বিল আদায়ের লোভেই। এখন টাকা দিচ্ছি নিয়ে চুপ থাকুন। আর রিলিজ ডেটটা ফোন করে জানিয়ে দেবেন, আমার ড্রাইভার এসে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবে। এই বলে এক তোড়া টাকা ও বিজনেস কার্ড টেবিলে রাখলো লোকটি। রাজিব টাকাগুলো ফেরত দিয়ে লোকটিকে বললো, আপনি টাকাগুলো নিয়ে যান ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। বলা তো যায় না কখনো হয়তো আপনাকেও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। তখন আপনার ছেলে হয়তো টাকা দিতে রাজি নাও হতে পারে। আর রিলিজ ডেট এলে আপনাকে জানিয়ে দেবো। এখন আপনি চলে গেলে খুশি হবো। তবে একটা অনুরোধ করি, আপনার মা সারাদিন খোকা খোকা করে। পারলে মায়ের সাথে দেখা করে যান। ৪০২ নং কেবিনে আছেন তিনি। তবে লোকটি তার মাকে দেখতে যায়নি। রাজিব ভাবে কত অদ্ভুত মানুষ জন্ম নেয় পৃথিবীতে। এক রাজিব মায়ের অভাবে হাহাকার করে ফেরে, আরেকজন মাকে বাড়তি মনে করে পথে ফেলে যায়।


দুই
রাহেলা চলে যাওয়ার পর শায়লা আবার বারান্দায় গিয়ে বসলো। অনেকদিন পর পুরোনো অনেক কথাই মনে পড়ছে আজ। রাজিবের সাথে শায়লার পরিচয় স্টার সিনেপ্লেক্সে ছবি দেখতে গিয়ে। শায়লা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। বাংলা ছবির দুর্দিনে রিয়াজ-পূর্ণিমা অভিনীত ‘মনের মাঝে তুমি’ সিনেমাটি তখন খুব দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল। শায়লারা চার বান্ধবী মিলে সিনেমাটি দেখতে প্রথমে বলাকাতে গিয়েছিল। সেখানে টিকিট না পেয়ে স্টার সিনেপ্লেক্সে আসে। সেখানেও যখন টিকিট পেলো না তখন শায়লার প্রায় কাঁদো কাঁদো অবস্থা। এই সময় রাজিব এগিয়ে এসে তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, কী হয়েছে আপনার? শায়লা করুণ কণ্ঠে বলেছিল, রিয়াজের ছবিটি দেখবো কিন্তু কোথাও টিকিট পাচ্ছি না। 

রাজিবের হাতে তখন চারটি টিকিট ছিল। চোখ পড়তেই সেগুলো ছো মেরে হাতে নিয়ে উল্লসিত হয়ে শায়লা বলেছিল, আপনি টিকিট ব্ল্যাক করেন? কত দিতে হবে? রাজিব শায়লার আনন্দিত মুখ দেখে ভুলে গেল ওরা চার বন্ধু মিলে ছবি দেখতে এসেছিল। বন্ধুরা এসে যখন ওকে ধাক্কা দিয়ে- ‘কিরে টাকা হাতে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল চল হলে ঢুকি’ বলে তাড়া দিতে লাগল তখন রাজিব সম্বিত ফিরে পেল। ওর হাতে দুটি পাঁচশ টাকার নোট গুজে মেয়েটি টিকিট নিয়ে চলে গেছে। রাজিব বন্ধুদের বললো, আজ ছবি দেখবো না। টিকিট বেচে দিয়েছি।

বন্ধুদের গালমন্দ খেতে খেতে রাজিব যখন হোস্টেলে ফিরছিল তখন বারবার উল্লসিত শায়লার মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন রাতে নাকি রাজিব ঘুমাতে পারেনি। এগুলো পরে রাজিবের কাছ থেকেই শুনেছে শায়লা। এর কিছুদিন পর নীলক্ষেতে বই কিনছিল শায়লা। হঠাৎ ওর মুখের সামনে দুটো একশো টাকার নোট মেলে ধরলো একটা ছেলে। চমকে উঠে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো। সেই টিকিট ব্ল্যাক করা ছেলেটিই তো!

রাজিব বললো, আপনি সেদিন দুশো টাকা বেশি দিয়ে এসেছিলেন। এরপর থেকে আপনাকে খুঁজছি। আজ পেয়ে গেলাম। নিন আপনার টাকা ফেরত নিয়ে আমাকে ঋণ মুক্ত করুন। শায়লা হেসে বললো, ওটা আপনার প্রফিট। আপনি কষ্ট করে টিকিট কেটেছেন ওইটুকু প্রফিট আপনি করতেই পারেন। হঠাৎ রাজিব উল্টো হেঁটে চলে গিয়ে মিনিটখানেক পর আবার ফিরে এলো। শয়লা বললো, হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলেন? রাজিব বললো, পাশের সেলুনে আয়না দেখতে। শায়লা কিছুটা অবাক হয়ে হেসে বললো, আয়না দেখতে কেন? রাজিব বললো, না মানে আমি দেখতে টিকিট ব্ল্যাকারের মতো কিনা সেটা দেখে এলাম। শায়লা এবার খেয়াল করলো রাজিবের হাতে অ্যাপ্রোন আর স্টেথোস্কোপ। শায়লা খুব বিব্রত হলো। রাজিবই তাকে সেই অবস্থা থেকে উদ্ধার করলো। বললো, আমার নাম রাজিব। ঢাকা মেডিক্যাল থেকে এমবিবিএস শেষ করে এখন ইন্টার্নশিপ করছি।

শায়লা জিভ কেটে বললো, আই অ্যাম স্যরি। সেদিন ছবি দেখার নেশায় বুঝতে পারিনি। ক্ষমা করে দিন প্লিজ। রাজিব বললো, ক্ষমা করতে পারি একটা শর্তে। আমার সাথে চা খেতে হবে। এরপর নীলক্ষেত থেকে হাঁটতে হাঁটতে দুজন টিএসসিতে গেল। শায়লা তার পরিচয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ে, কোন হলে থাকে, বাড়িতে কে কে আছে সব বললো। রাজিবকে জিজ্ঞেস করলো, আপনার বাড়ি কোথায়? রাজিব হেসে বললো, বাড়ি ছিল জামালপুরে। তবে দূর সর্ম্পকের এক ফুপু ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। ওই ফুপুই বাবা-মা মারা যাওয়ার পর কিছুদিন নিজের কাছে রেখেছিলেন। এরপর দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে হিমশিম খাওয়া ফুপু আমাকে রেখে যান ঢাকার আহসানিয়া মিশন এতিমখানায়। এরপর সেখানেই বড় হয়েছি।

রাজিব তার জীবনের গল্প হাসিমুখে বললেও শায়লার মনটা কেমন যেন মুচড়ে উঠলো। এরপর সেই মোচড় ভালোবাসায় রূপ নিতে বেশি সময় নেয়নি। ওরা যখন বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন এই এতিম ছেলের সাথে শায়লার বাবা কিছুতেই মেয়ের বিয়ে দেবেন না। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে তাদের বিয়েটা শেষ পর্যন্ত পারিবারিকভাবেই হয়েছে। রাজিবের ফুপু তত দিনে মারা গেছেন। তাই এতিমখানার ভাই-শিক্ষক আর বন্ধুরাই ছিল বরযাত্রী। এসব নিয়ে শায়লার কখনো দুঃখ ছিল না। কিন্তু ইদানিং রাজিবের অদ্ভুত আচরণ শায়লাকে কষ্ট দিচ্ছে। বসার ঘর থেকে রাতুন-তুতুন চিৎকার করে মাকে ডাকছিল। রাতুন-তুতুন শায়লাদের জমজ ছেলে। ছেলেদের ডাক শুনে শায়লা বারান্দা থেকে ঘরে এলো। এরপর সে সংসার জীবনে ডুবে গেল রাতের অপেক্ষায়। কারণ আজ রাতে রাজিবের সাথে সরাসরি কথা বলবে সে।


হাসপাতালের ডিউটি শেষ করে আজ সকাল সকাল বাড়ি ফিরলো রাজিব। আজ শায়লার সাথে জরুরি কিছু কথা বলা দরকার। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বৃদ্ধাকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ দিলে তাদের বাসায় নিয়ে রাখবে। চার বেডরুমের একটি ঘর ফাঁকা পড়ে আছে। যদিও শায়লা কখনোই রাজিবের ইচ্ছায় দ্বিমত করবে না, তবুও সংসারটা যেহেতু দুজনের তাই শায়লার মতামত নেবে রাজিব। আর শায়লা রাজি না হলে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই রাজিব বাসায় ঢুকলো। ঢুকেই বুঝলো বাড়ির পরিবেশ বেশ থমথমে। শায়লাকে কোনো প্রশ্ন করলে হু-হা বলে উত্তর দিচ্ছে। রাতের খাবার খেয়ে শোবার ঘরে এসে বসতেই রাজিবের ফোন বেজে উঠলো। আড়চোখে শায়লা দেখলো নার্স বকুলের কল। রাজিব ফোন নিয়ে যথারীতি বারান্দায় চলে গেল। এরপর ঘরে ঢুকে দ্রুত পোশাক পাল্টে গাড়ির চাবি নিয়ে বেড়িয়ে যাচ্ছিল। শায়লা সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। বললো আজ রাতেও কোথায় যাচ্ছো? বকুলের কল পেলেই তুমি কেন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাও? রাগে চিৎকার করছিল শায়লা।

রাজিব শান্ত গলায় বললো, সব বলবো তোমাকে। এখন প্লিজ আমাকে একটু হাসপাতালে যেতে দাও। বলেই শায়লাকে সামনে থেকে সরিয়ে বেরিয়ে গেল রাজিব।

রাজিব যখন গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে রাস্তায় নামলো তখন রাত প্রায় ১১টা বাজে। কলাবাগান থেকে মিরপুর খুব দূরের পথও নয়। মিনিটবিশেক পর হন্তদন্ত হয়ে সিসিইউয়ের সামনে গেল। ভিতরে গিয়ে দেখলো তিন-চারজন ডাক্তার আর নার্স বৃদ্ধার জীবন বাঁচানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে। বাতাস থেকে অক্সিজেন নিতে না পারায় কৃত্রিমভাবে তার শ্বাসপ্রশ্বাস চালানো হচ্ছে। রাজিব বারান্দায় গিয়ে বসলো। কে একজন তাকে এক বোতল পানি এগিয়ে দিলো। ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে রাজিব হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠলো। সিসিইউতে ডাক্তার সাজিদের চোখমুখ দেখেই বুঝতে পেরেছে বৃদ্ধার সময় বেশি নেই। যে পরিমাণ ব্লক তার হার্টে রয়েছে তাতে এতদিন বেঁচে থাকাটাই অবাক করা বিষয়। বয়স আর শরীরের কন্ডিশনের কারণে ওপেন হার্ট সার্জারিও সম্ভব না। তবুও আশা ছিল নিয়মিত ওষুধ আর যত্ন পেলে আরো বেশ ক’বছর বেঁচে যেতে পারেন। কিন্তু আজ হঠাৎ অ্যাটাকটাই সবকিছু এলোমেলো করে দিল। রাজিব বসে থাকতে থাকতেই বকুল এলো। রাজিব তাকে জিজ্ঞেস করলো, হঠাৎ এমন হলো কী করে? বকুল মাথা নিচু করে রইলো। কী হয়েছিল আমাকে বলুন। বকুল বললো, আজ তার ছেলে আর ছেলের বউ এসেছিল। এসে তাকে অনেক উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়েছেন। আপনাকে নিয়েও অনেক বাজে কথা বলেছেন তার ছেলে। তিনি সবকিছু চুপচাপ শুনে গেলেও আপনার সম্পর্কে বাজে কথা শোনার পর বিছানা থেকে উঠে ছেলেকে একটা চড় মেরেছেন। এরপরই এই অবস্থা! ছেলে, ছেলের বউ তাকে  মেঝেতে ফেলে রেখেই চলে গেছেন। সব শুনে পাথর হয়ে বসে রইলো রাজিব।


রাজিব বেরিয়ে যাওয়ার পর শায়লাও দ্রুত তৈরি হলো। এরপর বুয়াকে ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে খেয়াল রাখতে বলে নিচে নেমে একটি উবার নিয়ে হাসপাতালের পথ ধরলো। আজ দেখতেই হবে আসলে কোথায় যায় ও। রাজিব হাসপাতালে গেলেও কী করে? আজ সব কিছুর হিসাব মেলাতে হবে শায়লার। হাসপাতালের গেটে এসে ভাড়া মিটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে রিসিপশনে গিয়ে ডা. রাজিব আছে কিনা জানতে চাইলো। রিসিপশনের মেয়েটি কাকে যেনো ফোন করে জেনে নিয়ে বললো, স্যার সিসিইউতে আছেন। এখন দেখা করা যাবে না।

শায়লা তার পরিচয় দিয়ে বললো, সিসিইউ কোন দিকে আপনি দেখিয়ে দিন। আমি বাইরে অপেক্ষা করবো। সিসিইউয়ের কথা শুনে শায়লার মন কিছুটা শান্ত হয়েছিল। কিন্তু রিসিপশনের ভদ্রমহিলার দেখানো পথে সেখানে গিয়ে দূর থেকে রাজিবকে বকুলের সাথে কথা বলতে দেখে মনটা আবার বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। রাজিব অর্থোপেডিক্সের ডাক্তার হয়ে হৃদরোগ বিভাগে কিসের রোগী দেখে! এসব ভাবতে ভাবতে মৃদু পায়ে সামনে এগিয়ে গেল। কিন্তু রাজিবের কাছাকাছি যাওয়ার আগেই সে ভেতরে ঢুকে গেল। বকুল শায়লাকে দেখে চমকে উঠলেও সিসিইউয়ের দরজা খুলে ভেতরে যাওয়ার পথ করে দিল। শায়লা ভেতরে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলো তার জন্য মোটই প্রস্তুত ছিল না সে।


রাজিব ভেতরে যেতেই ডা. সাজিদ রাজিবকে একটু দূরে নিয়ে রোগীর বর্ণনা করলেন। তিনি বললেন, শোনো রাজিব, এ অবস্থায় আমি কোনোভাবেই রোগীকে কথা বলতে দিতাম না। কিন্তু তার অবস্থা আসলেই খারাপ। এখন একটু ভালো বোধ করছেন, সেটা আসলে সাময়িক। তোমাকে কী যেন বলতে চায়। ভাবলাম শেষ আশাটা অন্তত পূরণ হোক। যাও কথা বলো। রাজিব আস্তে আস্তে বৃদ্ধার পাশে গিয়ে বসলো। নার্স তার অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দিলেন। বৃদ্ধা রাজিবের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলেন। রাজিব বললো, মা আপনার খোকাকে একটা ফোন করি? বৃদ্ধা বললেন, আমার খোকা তো আমার সামনেই বসে আছে। পেটে ধরলেই কি কেউ সন্তান হয় রে পাগল। আমার হার্টের অসুখটা অনেক পুরোনো। ছেলে কখনো ভালো করে চিকিৎসা করায়নি। আত্মীয়স্বজন সার্জারির কথা বলতো। আমি মিথ্যে ভয়ের অভিনয় করতাম। আমার আসলে বাঁচার ইচ্ছাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোর ভালোবাসায় কিছুদিন থাকার পর আমার আবার বাঁচতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু দেখ আমি তোর মতো একটা ছেলে পেলাম জীবনের শেষ সময়ে এসে। তবুও তৃপ্তি নিয়ে মরতে পারছি যে, একটি ছেলে কেমন হতে পারে সেটা অন্তত জেনে গেলাম। তোকে যিনি পেটে ধরেছেন তিনি অনেক ভাগ্যবতী। রাজিব বৃদ্ধার হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, মা আপনি মরবেন কেন? আপনি মরলে আমার রাতুন-তুতুন কাকে দাদু বলে ডাকবে। স্বামীর পেছনে দাঁড়িয়ে তার এমন অঝোর কান্না দেখে শায়লা চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না। অনেকটা শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে। রাজিব শায়লাকে দেখে কিছুটা অবাক হলেও সামলে নিল। বৃদ্ধাকে বললো, মা ও শায়লা। আপনার বৌমা। বৃদ্ধা হাত ইশারায় শায়লাকে কাছে ডাকলেন। রাজিবকে দেখিয়ে বললেন, আমার ছেলেটাকে দেখে রেখো বৌমা। আমি যেন দূর থেকে তোমাদের দেখে শান্তি পাই।


এরপর বৃদ্ধার শরীরের সাথে লাগানো নলগুলোর সাথে সংযুক্ত মনিটরের বৈদ্যুতিক রেখাগুলোর দ্রুত ওঠানামা বেড়ে যাওয়ায় ডাক্তার সাজিদ রাজিবদের সরে যেতে বললেন। সবাই বাইরে চলে এলো। শায়লা রাজিবের হাত ধরে বারান্দায় বসে কাঁদছিল। ওরা অপেক্ষা করছিল একটি নতুন সকালের যেখানে রাজিব পাবে তার মাকে আর শায়লা পাবে তার আগের রাজিবকে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়