ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছড়ার সঙ্গে বেঁধেছি প্রাণ || আনজীর লিটন

আনজীর লিটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০৫, ৩০ আগস্ট ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছড়ার সঙ্গে বেঁধেছি প্রাণ || আনজীর লিটন

আমার প্রথম ছড়ার বই ‘খাড়া দুটো শিং’ প্রকাশিত হয়  ১৯৯২ সালে। সেই থেকে ছড়াসাহিত্যের অগ্রযাত্রায় যুক্ত হতে পেরে গৌরববোধ করি। প্রাচীনকালে মানুষ মুখে মুখে ছড়া বানাতো। গ্রামীণ জনপদে ছড়িয়ে থাকা সেসব ছড়ার প্রমাণ আমরা ছড়াসাহিত্যের ইতিহাস ঘেঁটে পাই। রবীন্দ্রনাথ সেই তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আধুনিককালে মুখে মুখে ছড়া শুধু বানানো হয় না, লেখা হয়। ছড়াসাহিত্যের পরম্পরায় ছড়াকারদের চিন্তা-চেতনায় যে-ভাবের জন্ম হয় আমিও সেই ভাবের ভাবুক। ছড়ার মধ্য দিয়ে নতুন সময়ের কথা বলতে চাই। নতুন কিছু দেখাতে চাই। জানাতে চাই। তাইতো পাঠকের মন জয় করা ছড়া লিখতে চাই বারবার। এই প্রত্যাশা নিয়ে ছড়ার সঙ্গে বেঁধেছি প্রাণ। কিন্তু ছড়া শুধু ছোটদের বিষয়- এই কথাটি যারা বলেন, আমি মনে করি তারা বয়সের ধুঁয়ো তুলে ছড়াকে ছোট্ট গণ্ডির চার দেয়ালে বন্দি করতে চাইছেন। সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার ছড়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ ছড়ার সম্প্রসারিত রূপই হচ্ছে কবিতা। আমি মনে করি, ছড়া শুধু ছোটদের নয়, ছড়া বড়দের নয়, ছড়া আসলে পাঠকের।

খুব সত্য, ছড়াবিষয়ক সমালোচনামূলক সাহিত্যচর্চা গড়ে ওঠেনি। আন্তরিকভাবে কলমও ধরেননি কোনো সমালোচক-গবেষক। যে কারণে এই প্রশ্নের সহজ উত্তরও মেলে না। যেভাবে গল্প, কবিতা বা উপন্যাসের সাম্প্রতিক চর্চার ধরন আলোচিত হয়, ঠিক সেভাবে সমালোচক-গবেষকের দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্ব পায়নি ছড়ার ক্ষেত্রে। আলোচিত হয়নি বর্তমান ছড়ার রূপ, গতি-প্রকৃতি কিংবা ছড়াকারদের নিবেদিত শক্তিমত্তা সম্পর্কে। এমনকি সাহিত্য সম্পাদকদের আগ্রহও দেখা যায় না সাহিত্য পাতায় ছড়াবিষয়ক প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করতে। তো এই যখন সামগ্রিক চিত্র তখন আমার ব্যক্তিগত উপলব্ধি এরকম- সাহিত্যের বিশাল ভাণ্ডার ছড়াকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। ছন্দ থেকেই ছড়া শব্দটি এসেছে। কারো মতে ‘ছটা’ শব্দ থেকে ছড়া শব্দটির উৎপত্তি। নগেন্দ্রনাথ বসু সম্পাদিত ‘বাংলা বিশ্বকোষ’ গ্রন্থে ‘ছড়া’ শব্দটিকে দেশজ বলে উল্লেখ করে বলেছেন, ‘বিস্তৃত পদ্য বিশেষ। এর মূলে আছে ঐতিহ্যাশ্রয়ী ছন্দ। লোকজ ধারায় রচিত ছড়া সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ছড়া ছন্দে গাঁথা গ্রাম্য উক্তি। অনেকের কাছে ছড়াকে ছন্দে গাঁথা আর ছড়ার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেয়েছে ছন্দময় অনুভূতি। বাংলা ছড়ার আদি উৎস খুঁজতে গেলে দৃষ্টি পড়ে লোকজ ছড়ায়। গ্রাম্য কবিতা, ধাঁধা, খনার বচন- এসবের আবরণে ছড়ার প্রাণভোমরাকে খুঁজে পাওয়া যায়। লোক গবেষকদের মতে-
‘বাংলার ঐতিহ্যাশ্রয়ী ছড়াগুলি কালের বিচারে প্রাচীন। এ অবস্থায় সব ভাষা ছন্দই গানের সুর ও নাচের তালের সঙ্গে বিশেষ ভাবে যুক্ত, পরে ভাষার ক্রমবিকাশ ছন্দকে নানা রূপ দেয়, আর এ ক্রমবিকাশের সূত্রপাত ঘটে লেখন পদ্ধতি ও ছাপাখানার ক্রমবিকাশকে কেন্দ্র করে। কিন্তু মানুষ দীর্ঘদিন জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছন্দকে ভুলতে পারেনি। একালে স্বজ্ঞানে সাহিত্যের অঙ্গরূপে অনেকেই ছড়া রচনা করে থাকেন। এগুলি সচেতন সাহিত্য সৃষ্টি, অতএব লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নয় এবং প্রাচীন ছড়ার সঙ্গে একই মাটির হাঁড়িতে রাখা সঙ্গত হবে না। শব্দচয়নের দিক দিয়েও একাল-সেকাল দুই কালের ছড়ার পার্থক্য লক্ষণীয়। বাংলার বিপুল ছড়ার ভাণ্ডার প্রথমত দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে :

                ১। লোকসাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত গ্রাম্য ছড়া

                ২। পরিশীলিত সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত নাগরিক ছড়া’

                   [সংগৃহীত তথ্য : বাংলার ছড়া ছড়ার বাংলা, সম্পাদনা : সৌগত চট্টোপাধ্যায়]

ছড়া লৌকিকতার গণ্ডি ভেঙে লাবণ্যে পরিপূর্ণতা পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের হাত ধরেই। ১৩০১ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধটি ‘সাধনা’ পত্রিকায় আশ্বিন-কার্ত্তিক সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘বাংলা ভাষায় ছেলে ভুলাইবার জন্য যে সকল মেয়েলি ছড়া প্রচলিত আছে, কিছু কাল হইতে আমি তাহা সংগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত ছিলাম। আমাদের ভাষা এবং সমাজের ইতিহাস-নির্ণয়ের পক্ষে সেই ছড়াগুলির বিশেষ মূল্য থাকিতে পারে, কিন্তু তাহাদের মধ্যে যে একটি সহজ স্বাভাবিক কাব্যরস আছে সেইটিই আমার নিকট অধিকতর আদরণীয় বোধ হইয়াছিল।’

রবীন্দ্রনাথ ছড়াকে আত্মস্থ করেছেন শিল্পবোধের জায়গা থেকে। তার প্রকাশ এই উদ্ধৃতির মধ্যে পাওয়া যায়: ‘ছড়ার মধ্যে একটা চিরত্ব আছে। কোনোটির কোনো কালে কোনো রচয়িতা ছিল বলিয়া পরিচয়মাত্র নাই এবং কোন্ তারিখে কোনটা রচিত হইয়াছিল এমন প্রশ্নও কাহারও মনে উদয় হয় না। এই স্বাভাবিক চিরত্বগুণে ইহারা আজ রচিত হইলেও পুরাতন এবং সহস্র বৎসর পূর্বে রচিত হইলেও নূতন।’   

১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে যোগীন্দ্রনাথ সরকার ‘খুকুমণির ছড়া’ শীর্ষক একটি গ্রন্থ সংকলিত করেন। সেই গ্রন্থের ভূমিকায় ছড়াকে প্রথমবারের মতো সাহিত্যের বিষয় বলে উল্লেখ করেন আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী। লৌকিক ছড়াপাঠকে রবীন্দ্রনাথ শৈশবের মেঘদূত হিসেবেই চিত্রিত করেছেন। আর এই বোধটাকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন শিশুদের মাঝে। মেয়েলি ছড়া এবং ছেলেভুলানো ছড়া নামে ছড়াকে দুই ভাগে চিহ্নিত করে রবীন্দ্রনাথ ছড়ার বিষয় হিসেবে তুলে এনেছেন জগত সংসারের নানান বিষয়। ১২৯২ বঙ্গাব্দে ‘বালক’ পত্রিকায় সর্বপ্রথম প্রকাশিত ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর’ ছড়াটি রবীন্দ্রনাথের হাতে আধুনিক চেহারা পেয়েছে। এই ছড়াটি রবীন্দ্রনাথ নিজে সংগ্রহ করেন এবং সে বিষয়ে অনবদ্য ভাষ্য রচনা করেন। ছড়াটি হলো-

                ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান।

                শিবঠাকুরের বিয়ে হ’ল তিন কন্যা দান ।।

                এক কন্যে রাঁধেন বাড়েন, এক কন্যে খান।

                এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি যান ।।

উল্লেখিত ছড়াটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে রবীন্দ্রনাথ বলেন, ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান। এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই। আমি আমার সেই মনের মুগ্ধ অবস্থা স্মরণ করিয়া না দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিব না ছড়ার মাধুর্য এবং উপযোগিতা কী। বুঝিতে পারিব না, কেন এত মহাকাব্য এবং খণ্ডকাব্য, এত তত্ত্বকণা এবং নীতিপ্রচার মানবের এত প্রাণপণ প্রযত্ন, এত গলদধর্ম ব্যায়াম প্রতিদিন ব্যর্থ এবং বিস্মৃত হইতেছে, অথচ এই-সকল অসংগত অর্থহীন যদৃচ্ছাকৃত শ্লোকগুলি লোকস্মৃতিতে চিরকাল প্রবাহিত হইয়া আসিতেছে।’

১৯৪০ পর্যন্ত প্রচলিত ছড়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে শিশুদের নৈতিক শিক্ষাদানের বিষয়। আর এমনই সময় সুকুমার রায়ের আবির্ভাব ছড়ার আকাশে নতুন সূর্য হয়ে উদিত হয়। শব্দ চয়নে, ছন্দে, ব্যঞ্জনায় এবং বিষয় বৈচিত্র্যে সুকুমার রায় বাংলা সাহিত্যে ছড়ার মাধ্যমকে নতুন মাত্রায় অলংকৃত করেন। সুকুমার রায়ের ধারাবাহিকতায় ছড়ার মধ্য দিয়ে যুক্ত হতে থাকে সমকালীন বিষয়-আশয়। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, প্রতিবাদ, ক্ষোভ, দুর্ভিক্ষ- এসবের ছবি ছড়ার মধ্য দিয়ে লিখিত হতে থাকে। এক সময় যে ছড়া মুখে মুখে প্রচলিত ছিল সেই ছড়া নতুন আবরণে, নতুন বক্তব্যে, নতুন ছন্দ-তালে প্রচলিত দেয়াল ভেঙে লিখিত আকারে, মুদ্রিত আকারে প্রকাশ পেতে থাকল সাহিত্যের পাতায় পাতায়। ছড়ার এক নতুন বিনির্মাণ শুরু হলো। আর এই বিনির্মাণের পুরোধা হয়ে এলেন বাংলা ছড়ার আধুনিক রূপকার অন্নদাশঙ্কর রায়।

                তেলের শিশি ভাঙলো বলে

                খুকুর প’রে রাগ করো

                তোমরা যে সব বুড়ো খোকা

                ভারত ভেঙে ভাগ করো!

                তার বেলা?

আধুনিক ছড়ার এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়ার এই পঙ্‌ক্তিমালায়। লোকগবেষক ড. আশরাফ সিদ্দিকী আধুনিক ছড়ার আঙ্গিক প্রসঙ্গে লিখলেন- ‘ছড়া শুধু সমাজ সংসার নিয়ে বলে না, দেশ ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও বলে। ... ছড়া কালের সাথে অনবরত তার রূপ বদলায়।

সেই থেকে ছড়া নিঃসন্দেহে আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। বদলেছে উপস্থাপন রীতি। বদলেছে বিষয়-ভাবনা ছন্দ। বদলেছে চিত্রকল্প। বাংলা সাহিত্যে ছড়ার এই বদলে যাওয়া রূপের কারিগররা হলেন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন, ফররুখ আহমদ, বন্দে আলী মিয়া, খান মোহাম্মদ মঈনুদ্দীন, সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান, আহসান হাবীব, হোসনে আরা, হাবিবুর রহমান, সরদার জয়েনউদ্দীন। সময়ের হাত ধরে বাস্তবতার নিরিখে ছড়া নতুন মাত্রায় বিকশিত হয়েছে।
বাংলাদেশে গত চার দশকের ছড়ায় গুণগত বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। ষাটের দশকে ছড়ায় প্রকাশ পেয়েছে রবীন্দ্রভাবনার উত্তরাধিকার। যেখানে প্রভাব পড়েছে লোকজধারা। সত্তরের দশকে ছড়ায় দেখা গেছে অন্তঃমিলগত নতুন ছন্দ খোঁজার প্রবণতা এবং আশির দশকে সমসাময়িক ঘটনার আলোকে জীবনবোধের ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গি। নব্বইয়ে ছড়ার মাঝে পাওয়া গেছে রাজনৈতিক ধারার স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ নির্মাণ কৌশল। সেই সঙ্গে বিষয়বৈচিত্র্য।

দশকওয়ারি বিবেচনায় ছড়া-চর্চার ক্ষেত্রে সৌন্দর্য সচেতন রীতির প্রকাশ ঘটলেও মূলত সত্তরের দশকে নানারকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার স্বাক্ষর স্পষ্ট হয়েছে ছড়াকারদের রচনায়। যার ধারাবাহিকতা আশির দশকেও বিদ্যমান। তবে এ সময়টাতে কখনো শব্দ নিয়ে, কখনো বা আঙ্গিক নিয়ে, কখনো বা বিষয়বৈচিত্র্য নিয়ে ছড়াকাররা উজ্জ্বলতম প্রকাশভঙ্গি দেখিয়েছেন। আর যে কারণে কেউ কেউ পাঠকদের কাছে চিহ্নিত হয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক ছড়া রচনার গুণে।
শিশুসাহিত্যের অনন্যধারায় ছড়া অনেক বড় প্রাণশক্তি। যা শিশুদের আকর্ষণ করে, বড়দেরও করে। ‘আর ক’টা দিন সবুর কর রসুন বুনেছি’- এটা রাজনৈতিক ছড়া। কিংবা ‘আয়রে খোকন ঘরে আয়, দুধমাখা ভাত কাকে খায়’ অথবা ‘তেলের শিশি ভাঙল বলে খুকুর প’রে রাগ করো’- এর চেয়ে সমাজের প্রকৃত চিত্র আর কী হতে পারে। তখনকার সময়ের কবিরা যদি এটা রচনা করতে পারেন যা শিশুপাঠ্য হয়ে উঠল, এখন কেন সমভাবনার ছড়া রচিত হবে না? এ কথা সত্য বাংলা শিশুসাহিত্য যখন আক্ষরিক অর্থে অবস্থান তৈরি করল, সে সময়কার শিশু আর আজকের শিশু এক নয়। সে সময়কার পাঠক রুচি এবং আজকের পাঠক রুচিও এক নয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যে অভাবনীয় অগ্রগতি ঘটেছে গত দুই-তিন দশকের মধ্যে তার পরিপ্রেক্ষিতে অনেকের চাওয়া-পাওয়া পাল্টে গেছে। এখনকার দিনের শিশু-কিশোরদের কাছে বই একমাত্র অবসর যাপনের সঙ্গী নয়। টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট, সবকিছু হাতের নাগালে। তো এই চেনা জায়গাগুলো ছোটদের রচনায় প্রকাশ করা সময় উপযোগী। শুধু তাই নয়, রাজনীতির প্রসঙ্গ প্রতিকী উপমায় তুলে আনা দোষের কিছু নয়। সময়ের বাস্তবতায় প্রযুক্তি নির্ভর যে জীবনযাপন আজকের শিশু এবং বড়রা উপভোগ করছে তার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রেখে শিশুসাহিত্য রচিত হোক, এটাই প্রত্যাশা।

একজন কবি যেমন ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, মাটির বন্ধনে, যেখান থেকে তুলে নেন ঐতিহ্যের গল্প, ঠিক একজন ছড়াকারও তার সময়ের কাছে, সমাজের মানুষের কাছে, ঋণী হয়ে বারবার ফিরে যান তার নিজস্ব শেকড়ে, সেই মাটির বন্ধনে। এখন প্রশ্ন হলো ছড়া কার জন্য রচিত? কার কাছে নিবেদন করবো ছড়া? ছোটদের কাছে নাকি বড়োদের কাছে? শিশুসাহিত্য বলে ছড়াকে কবিতা থেকে পাশ কাটিয়ে দিতে চাইছেন। এমনকি ছড়ার মধ্যে সমাজ জাগরণের যে বক্তব্য থাকে, সে বক্তব্যকেও শিশুসাহিত্য হিসেবে আড়াল করে দিতে চাইছেন। এই পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করতে চাই। তিনি শিশুসাহিত্য বলতে ছেলেভুলানো লেখাকে মানতেন না। তাই তো রবীন্দ্রনাথ লেখেন: ‘এখনকার দিনে শিশুদের জন্য সাহিত্য রসে প্রভূত পরিমাণে জল মিশাইয়া যে সকল ছেলেভুলানো লেখা হয় তাহাতে শিশুদিগকে নিতান্তই শিশু বলিয়া মনে করা হয়। তাহাদিগকে মানুষ বলিয়া গণ্য করা হয় না। ছেলেরা যে বই পড়িবে তাহার কিছু বুঝিবে এবং কিছু বুঝিবে না, এইরূপ বিধান থাকা চাই। আমরা ছেলেবেলায় একধার হইতে বই পড়িয়া যাইতাম; যাহা বুঝিতাম এবং যাহা বুঝিতাম না দু-ই আমাদের মনের উপর কাজ করিয়া যাইত।
‘বালক’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ স্বীয় রচনার গৌরব কাহিনী যেমন লিখেছিলেন তেমনি লিখেছিলেন শিশু-কিশোরদের জন্য স্বদেশ চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার আহ্বানপূর্ণ লেখা।

 “বাঙ্গালা দেশের মাঝখানে দাঁড়াইয়া একবার কাঁদিয়া সকলকে ডাকিতে ইচ্ছা করে- বলিতে ইচ্ছা করে, ‘ভাই সকল, আপনার ভাষায় একবার সকলে মিলিয়া গান কর। বহু বৎসর নীরব থাকিয়া বঙ্গদেশের প্রাণ কাঁদিয়া উঠিয়াছে। তাহাকে আপনার ভাষায় একবার আপনার কথা বলিতে দাও। বাঙ্গলা ভাষায় একবার সকলে মিলিয়া মা বলিয়া ডাক। কেরানীগিরির ভাষা আপিসের। দরাজের মধ্যে বন্ধ রাখিয়া মাতৃস্তন ধারায় পুষ্ট মাতৃভাষায় জগতের বিচিত্র সঙ্গীতে যোগ দাও। বাঙ্গালী কণ্ঠের সহিত মিলিয়া বিশ্বসঙ্গীত মধুরতর হইয়া উঠিবে।”

শিশু চেতনাকে জাগিয়ে দিতে রবীন্দ্রনাথ আরো লিখলেন আহ্বান গীত। প্রকাশ পেল ‘বালক’ পত্রিকাতেই-

                ‘‘...  ...  ...

                উঠ বঙ্গ কবি, মায়ের ভাষায় মুমূর্ষুরে দাও প্রাণ-

                জগতের লোক সুধায় আমার সে ভাষা করিবে পান।

সমাজের এই পালাবদলে সাহিত্যে ভাষা ও ভাবনার ক্ষেত্রেও পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তিত রূপ শিশুসাহিত্যেও ঝলকে উঠুক নতুন ভাষায়, নতুন ভাবনায়, নতুন চিত্রকল্পে। যদি একদিন ছড়া এমনভাবে লিখিত হয়-

‘নদীর মাছ-

রেলগাড়িতে চড়ে চড়ে চড়ে ...

যাচ্ছে নিজের ঘরে,

কোথায় সে ঘর? শুকনো নদী

ডাঙায় এসে মরে!’

 

কিংবা

‘শহরতলির গাঁ ঘেঁষে সব

রাতের ট্রেন

ঝকর ঝক

ঝকর ঝক

ঝকর ঝক...

কয়টা বগি? যায় গোনা কি?

ওমা! মানুষ কই! যাত্রী দেখি জোনাকী!’

শিশুর গল্পশক্তিকে বাড়িয়ে দিতে ছড়ার ভাষায় গঠনপ্রক্রিয়া বদলে দিতে হবে। চিত্রগল্প হতে পারে এমন-

‘কোন একদিন

পকেটে নিয়েছি মেঘ

মেঘ বলল, পকেটে কেন তুললে

আমি বললাম, ভিজব বিনামূল্যে!’

নতুন ভাষা, নতুন ভাবনা, নতুন চিত্রকল্পের ওপর ভর করে শিশুসাহিত্যের ভবিষ্যৎ পাঠককে নতুন পথ দেখানোর আলো ছড়িয়ে দিতে হবে। আনতে হবে জাদুবাস্তবতার নতুন অ্যাডভেঞ্চার। এসবের মধ্যে থাকবে দেশপ্রেমের কথা। থাকবে নৈতিকতা, মূল্যবোধ, মেধাবিকাশের কল্পনাশক্তি, মানবিকতা আর সৃজনশীলতার অপূর্ব সমন্বয়ে শিষ্টাচারের রূপকল্প। বাংলাদেশের মানুষের কাছে যে অহংকারটি সত্য ও সাহসের প্রেরণা তার নাম মহান মুক্তিযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের সত্য ইতিহাসের কথা শুধু ছড়ার ছন্দে নয়, শিশুসাহিত্যিকরা ছড়িয়ে দিক গল্পে-ছড়ায়, গদ্যে-পদ্যে। আমি মনে করি, প্রতিটি ছড়ায় জীবন-দর্শন থাকতে হবে। দেশ-মাটি-প্রকৃতি আর মানুষকে ভালোবাসার কথা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে ছড়ায় নির্মল আনন্দ-বিনোদনেরও প্রয়োজন রয়েছে। সময় এবং সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এমন বিষয়ও ছড়ায় থাকা প্রয়োজন। তাহলেই ছড়া হয়ে উঠবে পাঠকপ্রিয়। শিশুসাহিত্য হয়ে উঠবে বর্ণাঢ্য।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ আগস্ট ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়