ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিমূর্ত শিল্পে ফ্রয়েডিয় ভাবনা || শরীফ আতিক-উজ-জামান

শরীফ আতিক-উজ-জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ১৮ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিমূর্ত শিল্পে ফ্রয়েডিয় ভাবনা || শরীফ আতিক-উজ-জামান

বিশ শতকের শিল্পকলায় বিমূর্তধারাকে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসাবে বিবেচনা করা হয়। ক্লেমেন্ত গ্রীনবার্গ একে অতি প্রয়োজনীয় হিসেবে বিবেচনা করলেও সকলেই তার সঙ্গে একমত নন। তাই এর প্রয়োজনীয়তা ও নান্দনিকতা নিয়ে হামেশাই প্রচুর বিতর্ক চলে আসছে। এর আবির্ভাবের ফলে অতীতের অবয়বধর্মী চিত্রকলার অস্তিত্ব হুমকির মুখে না পড়লেও তার সমালোচনার আদল পাল্টে যেতে থাকে। আধুনিক শিল্পতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে ফেলে তার পুনর্বিবেচনা শুরু হয়। প্রথম দিকে বিমূর্ত চিত্রকলাকে বিচ্ছিন্ন প্রবণতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল, কিন্তু ধীরে ধীরে তার ব্যাপ্তি বৈশ্বিক চিত্রকলার জগতকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে থাকে। প্রভাববাদ, উত্তর-প্রভাববাদ, প্রকাশবাদ, ঘনকবাদ, পরাবাস্তববাদ, দাদাবাদ ইত্যাদি মতবাদের নামে যে অবয়বহীন চিত্রকলার চর্চা হতে থাকে তা এক কথায় বিমূর্ত চিত্রকলা। একই সাথে তা আধুনিক হিসেবে সর্বত্র বিপুল সমাদর লাভ করতে থাকে। বিমূর্ত ও আধুনিক যেন সমার্থক হয়ে ওঠে। ধারণা করা হয় যে বিগত শতাব্দীর প্রথম দিকে মানুষের জটিল মনস্তাত্তিক সংকট তার শৈল্পিক প্রকাশকেও জটিলতর করে তুলেছিল। সবকিছুকে মানুষ অবয়বধর্মীতায় প্রকাশে ব্যর্থ হয়েই বিমূর্ততার আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। পাশাপাশি অবয়বর্ধী শিল্পকলা উপভোগের সামর্থ্য বিশেষভাবে ধাক্কা খাওয়ায় সমঝদারদের একটি বড় অংশ বিমূর্ত শিল্পকলাকে স্বাগত জানাতে পারেনি। এর জটিল-কুটিল ব্যাখ্যা আত্মস্থ করে তাকে অনুধাবনের চেষ্টা চলে আসছে বটে কিন্তু সার্বজনীন কোনো গ্রহণযোগ্যতার মাপকাঠি নির্মিত হয়নি। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন ব্যাখ্যা ও বিবেচনা একে নতুন মাত্রা দান করেছে। বিমূর্ত শিল্পের ফ্রয়েডিয় ব্যাখ্যাও তদ্রুপ এক বিশেষ নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি, যা নতুন এক প্রতর্কের জন্ম দিয়েছে। বিমূর্ততা সৃষ্টির পিছনে শিল্পীর মনের অবদমিত ভীতিকেও অনেকে কারণ বলে মনে করে থাকেন, কেননা আধুনিক জগত অবচেতনভাবে শিল্পের প্রতি হুমকি নিয়ে হাজির হয়েছিলো। সমস্ত প্রথাগত মূল্যবোধ ঝেড়ে মুছে সাফ করে ফেলার সাথে সাথে শিল্পের অত্যুচ্চ মূল্যও হটিয়ে দিচ্ছিলো। ফলে আতঙ্কিত শিল্পী শিল্প ও নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে নতুন কিছুতে আশ্রয় খুঁজছিলেন। সেই নতুন বা পরিবর্তিত ধারা পরিবর্তিত জগতের সঙ্গে মিল রেখেই নির্মিত হয়েছিলো। আর এতে করেই শিল্পনির্মাণের মৌলিক ধারণার পরিবর্তন ঘটেছিলো। আধুনিক জগতের অনেক কিছুর মতোই শিল্পের প্রচলিত অর্থ নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পাল্টে যাওয়ার সাথে সাথে এক ধরনের দুর্বোধ্যতাও তৈরি করছিলো। সেই দুর্বোধ্যতা নির্মাণের দৃশ্যগ্রাহ্যরূপ সৃষ্টিতে শিল্পীর অক্ষমতার ফসলই বিমূর্ততা। এতে শিল্প নবরূপ পেল বটে কিন্তু অনিরাপদও হয়ে পড়লো। বোধগম্যতা ও নান্দনিক পরিতৃপ্তির ক্ষেত্রে সে নিজেই বড়সড় এক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠলো। সেই প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের প্রচেষ্টা থেকেই তার নানাবিধ ব্যাখ্যা দাঁড়াতে লাগলো। ফ্রয়েডিয় ব্যাখ্যা সেই ধরনেরই এক প্রতর্ক যা সর্বজনীন নয় তবে অনেক বৈশিষ্টের একটি।

আধুনিক জগত সময়ের গতিশীল এক বাস্তবতাকে ধারণ করে। একে অবজ্ঞা করার কোনো সুযোগ নাই। ঘনকবাদের পরিসরে সময়ের খণ্ড খণ্ড রূপের সজীব উপস্থিতি অনুভব করা যায় যে গুলো ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড গতিশীল কারণ তা একই সাথে ইতি ও নেতিবাচক, অস্তিমান ও শূন্য এবং উন্মুক্ত ও বদ্ধ। তারা দুই মেরুতে দোদুল্যমান, মনে হয় একসাথে মিলতে চায়। নতুন যুগচেতনা সম্পর্কে সচেতন উদ্দীপনা স্তিমিত হয়ে গেলে পরিবর্তন সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি লাভ সম্ভব হয়। আধুনিক শিল্পীরা এই সময়জ্ঞান লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে শিল্পের সময়হীনতার জ্ঞানও লাভ করেন। মনস্তাত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী অস্তিত্বের অনুভূতি এক ধরনের শিশুসুলভ ভ্রম। আরো সুস্পষ্ট করে বললে প্রাথমিক পদ্ধতি সম্পর্কে এক ধরনের ভ্রান্তি। আধুনিক জগত মানুষকে তার ফ্যান্টাসি ধারণ করতে দেয় না এবং যখন আরো জটিল হয়ে ওঠে তখন শিল্পী নিজেই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আধুনিক হন। এই শিল্পীরা বিমূর্ততা ধারণ করেন, কারণ তারা গতিশীল বাস্তবতার আধুনিকতাকে ধারণ করতে চান। মন্দ্রিয়ান, রোথকো, নিউম্যান, রায়মান প্রমুখ শিল্পীরা সময়ের এই গতিশীলতাকেই ধারণ করতে চেয়েছেন। আভাঁ গ্রাদ শিল্পীরা শিল্পকে জটিল করার মধ্য দিয়ে তার শক্তিকে জাহির করা যায় বলে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু তাতে করে তার দৃশ্যমানতা এবং নির্দিষ্ট কোনো কিছুকে যোগাযোগ করার ক্ষমতা সংকুচিত হয়ে যেতো এমনকি স্বীকৃত কোনো বারতা সেখানে লক্ষ্য করা যেতো না। গ্রীনবার্গ যাকে বিশুদ্ধতা বলেছেন তা আসলে এক ধরনের বোধগম্যতা বা মরমীবাদী ধারণা।

পরাবাস্তববাদীরা স্বপ্ন ও বাস্তব নিয়ে যে খেলা শুরু করলেন তা সিগমুন্ড ফ্রয়েডের প্রভাবজাত। অবচেতন মনকে সামনে নিয়ে আসার প্রচেষ্টায় তারা শিল্পের ঐতিহ্য-পরম্পরা থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। স্বাভাবিক অবস্থায় যা মানুষের ভাবনায় আসে না তা তারা ছবিতে নিয়ে এলেন। কিন্তু স্বপ্ন, দুরদৃষ্টি বা মনের ভেতরের ভাবনাকে শিল্পে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত অনেক পুরানো। এডওয়ার্ড মুঙ্খ বিচ্ছিন্নতার বেদনা বা পরিত্যাক্ত হওয়ার ভীতি তুলে ধরে তার সময়কে চেনাতে চেয়েছেন। ওডিলন রেডন চোখকে বিশাল এক বেলুন কল্পনা করে একটি নৈসর্গিক দৃশ্যের ওপর নজরদারি ক্যামেরারূপে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাববিস্তারকারী ছবি এঁকেছিলেন ইতালীয় শিল্পী জর্জিও সিরিকো যার অদ্ভুত ছবিকে Pittura Metafisica নামে চিহ্নিত করা হয়েছে। ফ্রয়েডের লেখনীর সরল অনুধাবন থেকেই পরাবাস্তববাদী তত্ত্বের উদ্ভব হয়। তবে পরাবাস্তববাদের কল্যাণেই ফ্রয়েড জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার কারণেই মানুষের মনঃস্তত্ত্ব শৈল্পিক সৃষ্টির অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে। ফ্রয়েডের মতে, অবচেতন মনের একটি প্রকাশ কাঠামো থাকলেও তা মূক। সামাজিক বিধিনিষেধের কারণে মানুষ তার আদি আকাঙ্ক্ষা ও প্রবণতাগুলো চেপে রাখতে বাধ্য হলেও বিকল্পপথে তার প্রকাশ ঘটে। সেই বিকল্প ভাবনাগুলোর মাঝে উদ্ভটত্ব থাকে, কারণ তা একান্ত ও নিজস্ব ভাষাকে ধারণ করে। পরাবাস্তববাদের রূপকার আঁদ্রে ব্রেতোঁ বোদলেয়ারের সুন্দরের সংজ্ঞা পুনঃনির্মাণ করেছেন। বোদলেয়ার সুন্দরকে অদ্ভুত (Strange) বলেছেন। আর ব্রেতোঁ সুন্দরকে আক্ষেপ সৃষ্টিকারী (Convulsive) হিসেবে অভিহিত করেছেন। গড়নহীন কোনো কিছু থেকে সৃষ্টি হয়ে সুন্দর নতুন এক গড়ন নেবে। তবে তা চেনা জগতের কোনো কিছুর সাথে সাদৃশ্য বহন করবে এমন নয়। চোখ তা দেখে শুধু আক্ষিপ্ত হবে।

ফ্রয়েড শিল্পকলা শুধু পছন্দই করতেন তা নয়, রীতিমতো ভালোবাসতেন। কোপার্নিকাস ও ডারউইন যেমন মানুষের ভ্রান্ত ধারণার মূলে আঘাত করেছিলেন তেমনি ফ্রয়েড মনে করতেন তিনি তৃতীয় ব্যক্তি যিনি মানুষের শিল্প সম্পর্কিত ভ্রান্ত অহংবোধকে বড়সড় ধাক্কা মারতে সক্ষম হয়েছেন। পরাবাস্তববাদী আন্দোলনের শুরু থেকেই আধুনিক চিত্রকলার পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়ে আসছে। আঁদ্রে ব্রেতোঁ, ম্যাক্স আর্নেস্ট ও সালভাদর দালি তাদের ‘গুরু’র লেখনী সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ১৯৩৮ সালে দালি ফ্রয়েডের সাথে দেখা করেন যখন এই মনঃসমীক্ষক নাজি অধ্যুষিত অস্ট্রিয়া থেকে লন্ডন এলেন। তিনি সাথে করে তাঁর The Metamporphoses of Narcissus নিয়ে গেলেন। শিরোনাম, বিষয় ও শৈলী সবকিছুই ছিল ফ্রয়েডিয় বৈশিষ্ট্যের। দালির অনেক শিল্পকর্মে প্রচুর অস্পষ্টতা থাকলেও এই কাজটিতে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তাঁর পরাবাস্তববাদী চিত্রকলার একটা বড় অংশজুড়ে ফ্রয়েডের প্রত্যক্ষ প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। কোনো কোনো ছবি বিশাল শিরোনাম রয়েছে যা মনে রাখা দুরূহ। এই বড় শিরোনামও একটি বিশেষ মানসিক অবস্থার প্রকাশ বলে মনে হয়। Dream Caused by the Flight of a Bee Around a Pomegranate One Minute Before Awakening (১৯৪৪)  শিরোনামের শিল্পকর্মটি সবদিক দিয়েই ফ্রয়েডিয় বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে। সমুদ্রে ভাসমান বরফের ওপর এক নগ্নিকা সূর্যস্নান করছে; অসম্ভব সরু পায়ের একটি হাতি পিঠের ওপর একটি স্মৃতিস্তম্ভ নিয়ে হেঁটে আসছে; নারীটির পাশে দুইফোঁটা জল ও একটি ছোট ডালিম পড়ে আছে; বড় ডালিমটা ভেঙে বের হয়েছে একটি মাছ যার মুখগহ্বর থেকে বের হচ্ছে একটি বাঘ; তার সামনে রয়েছে আরেকটি বাঘ এবং এই দ্বিতীয় বাঘের সামনে একটি রাইফেলের বেয়োনেট নারীটির ডান হাতে খোঁচা মারছে। বেয়োনেট প্রতীকী অর্থে দংশনরত মৌমাছি যা হঠাৎ করেই ঘুমন্ত নারীটিকে তার স্বপ্নের আবহ থেকে জাগিয়ে তুলেছে, ছোট ডালিমের গায়ে বসতে উদ্যত মৌমাছির যৌনপ্রতীক রয়েছে বোঝা যায়। হাতিটি রোমে স্থাপিত বারনিনি’র ভাস্কর্যের বিকৃত অবয়ব। জলে ছোট ডালিমের হৃদপিণ্ড আকৃতির ছায়া ভেনাস ও উর্বরতার প্রতীক। সমগ্র চিত্রটির মাঝে একটি আগ্রাসী যৌনচেতনা রয়েছে দেখা যায়। ফ্রয়েডের গুণমুগ্ধ পাঠক দালি, যিনি কড়া কোনো মাদকদ্রব্য সেবন করতেন না কিঞ্চিত মদ ছাড়া, অবচেতন মনের অবস্থা তুলে ধরার জন্য সবচেয়ে অস্বাভাবিক পথে পরিভ্রমণ করেছেন। তিনি মনে করতেন ঘুম ও জাগরণের মাঝামাঝি অবস্থা সৃষ্টিকর্মের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। দালি এই সৃষ্টিশীল সময়টাতে যতটা সম্ভব থাকতে চাইতেন। তিনি মনে করতেন স্বপ্ন ও কল্পনাই মানুষের চিন্তার মূল সময়কাল।

ফ্রয়েডের তত্ত্বের শিকড় সমস্ত শিল্প ও সংস্কৃতির ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাঁর সংগ্রহে রোমান ফ্রেস্কো চিত্রকলা, রোমান প্রতিকৃতি, ভাস্কর্য, মমি’র অংশবিশেষ ইত্যাদি ছিল। মিশর, রোম ও গ্রিসের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মাঝেই তার বিনিদ্র সময় কাটতো এবং ঘুমের মাঝেও তিনি তা থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এমন নয়। ফ্রয়েড তাঁর অনেক স্বপ্নের উল্লেখ করেছেন যা শিল্পরসিকদের কাছে রীতিমতো ফ্যান্টাসি। তিনি এমনও বলেছেন যে সুইস শিল্পী আরনল্ড বকলিনের শৈলীতে একজনকে তিনি সমুদ্রের মাঝখানে বিচ্ছিন্ন খাড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন। বকলিন ফ্রয়েডের আগে চিত্রকলায় মানুষের মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
 


ফ্রয়েড প্রকৃতপক্ষে একজন বিষণ্ন মানুষ। তিনি যে সমস্ত প্রাচীন নিদর্শন সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলো তার কাছে মনে হতো স্বপ্নে দেখা মৃত মানুষের দ্বীপ থেকে সংগৃহীত। এগুলো বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব, কিন্তু মানুষের অবচেতনে এইসব ভাবনার অস্তিত্ত্ব রয়েছে। আর সেই কারণেই তিনি আধুনিক চিন্তক। যেভাবে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চিকে তিনি তাঁর গ্রন্থে এক ‘রহস্য’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন সেভাবে তিনিও এক অর্থে তাই। লিওনার্দো শিল্পী ও বিজ্ঞানী ছিলেন বলে তিনি যে মত দিয়েছিলেন তার তীব্র সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু তিনি শিল্প ও বিজ্ঞানের মাঝে সমন্বয় করতে চেয়েছেন বলে তিনি মনে করতেন। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সবচেয়ে শক্ত শিকড় রয়েছে গ্রিক নাটকে। ইনগ্রিসের ‘ঈদিপাস ও স্ফিংস’ চিত্রকর্ম দর্শনের পরই ফ্রয়েডের মনে ‘ঈদিপাস কমপ্লেক্স’ সম্পর্কিত তাত্ত্বিক ধারণাটির জন্ম হয়েছ বলে অনেকের ধারণা। ইনগ্রিসের ছবিতে দেখা যাচ্ছে যে ঈদিপাস পিতাকে হত্যার পর স্ফিংসের ধাঁধার উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফ্রয়েড বলেছেন, ‘the riddle of the Sphinx - that is the question of where babies come from’।

প্লেটো মনে করতেন যে, সৌন্দর্য হলো নিখুঁত, অপার্থিব এবং সব আকাঙ্ক্ষার চালিকাশক্তি। যে প্রেমিক শারীরিক আকাঙ্ক্ষা বা যে মানুষ বন্ধুত্বের ইচ্ছা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয় সে তার কোনো আকাঙ্ক্ষাকেই চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে না। ফ্রয়েড মনে করতেন আদর্শিক নয়, পার্থিব জগতই সত্য। মনস্তাত্ত্বিকত স্তরে মানুষের যে কোনো কর্মকাণ্ডের মৌলিক চালিকাশক্তি হলো যৌনচেতনা ও আগ্রাসী আচরণ। মানুষের সব ভাবনা, আবেগ ও উদ্দেশ্য এই দুই আদিম সূত্র দ্বারা চালিত। এক্ষেত্রে ফ্রয়েড প্লেটোর ভাবশিষ্য। শিল্পকে তিনি আনন্দ ও যৌন পরিতৃপ্তির মাধ্যম হিসেবে গণ্য করেন। চরম উপভোগ্য সৌন্দর্য অবদমিত যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে আসে বলে তিনি মনে করতেন। অবদমন অবচেতন মনে আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। অবদমনের মাত্রা স্বল্প হলে তা স্বাভাবিক, বেশি হলে তা স্নায়ুবৈকল্যের কারণ হতে পারে, আর তখন মনঃবিশ্লেষকের প্রয়োজন হয়। অবচেতনে লুকানো আকাঙ্ক্ষার বিকল্প হলো চরম সৌন্দর্যচেতনা যা সামাজিকভাবে অধিক গ্রহণযোগ্য। আর তা ব্যক্তির ওই আকাঙ্ক্ষাসমূহের পরিতৃপ্তি ঘটায়। সভ্যতার জন্য সৌন্দর্যচেতনা জরুরি। সভ্যতা লাগামহীন কামবসনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কামতাড়িত ব্যক্তিও যখন তার কামবাসনার পরিতৃপ্তি ঘটাতে চায় প্রকৃতপক্ষে সে সুখ অনুসন্ধান করে। চরম যৌনচেতনা একটি ইতিবাচক শক্তি। জীবনের সুখচেতনার সাথে সৌন্দর্য উপভোগের একটি যাগসূত্র রয়েছে। মানুষের অনুভূতিতে যে সৌন্দর্যের উপস্থিতি তার দ্বারাই সে সবকিছুর বিচার করে। অর্থাৎ যে মনুষ্য আকার-আকৃতি, পরিচিত প্রাকৃতিক পরিবেশ, নিসর্গ ইত্যাদির সাথে তার পরিচয় তা দিয়েই সব বিচারের চেষ্টা করে। মানুষের নান্দনিক চেতনা জীবনের দুঃখকষ্টের হুমকির বিরুদ্ধে ছোটখাট প্রতিরোধ সৃষ্টিতে সক্ষম, কিন্তু তা বড়সড় ক্ষতিপূরণ দিতে পারে না। সৌন্দর্যচেতনা অনুভূতিতে এক ধরনের অদ্ভুত ও নমনীয় মত্ততা তৈরি করে থাকে। সৌন্দর্যের তেমন কোনো সুস্পষ্ট ব্যবহার নেই। তারপরও সভ্যতা সৌন্দর্য ছাড়া অচল। নন্দনতত্ত্ব খুঁজে ফেরে কোন শর্তের কাঠামোর মাঝে বস্তু সুন্দর দেখায়। তার প্রকৃতি ও উৎস সম্পর্কে ব্যাখ্যা দেয় না। মনোবিশ্লেষকরা সৌন্দর্য সম্পর্কে  তেমন কিছু বলেন না। কিন্তু এর উৎস যৌন অনুভূতি। ‘সৌন্দর্য’ ও ‘আকর্ষণ’ মূলত যৌন-অনুভূতিজাত বৈশিষ্ট্য। যেমন- ফ্রয়েড মনে করতেন যে সঙ্গীত শ্রবণে যে আনন্দ তা কামবাসনার অবমুক্তি ঘটায়।

ফ্রয়েড ইতালিয়ান ভাস্কর লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’র ভক্ত ছিলেন। তার ওপর ছোটখাট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ একটি গ্রন্থও রচনা করেছেন। লিওনার্দোর ফ্যান্টাসিতে শকুন ও জননী সমার্থক হিসেবে ধরা পড়েছিল যদিও এটা তাঁর মৌলিক ধারণা নয়। মূলত গ্রিক লেখক হোরাপোলো’র মাধ্যমে এই মিশরীয় উপাখ্যানের ইতালিতে পরিচয় ঘটেছিল এবং পরবর্তী সময়ে তা একইসাথে গ্রিক, রোমান ও মিশরের ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায়। সবাই মনে করত যে শকুন শুধুমাত্র স্ত্রীলিঙ্গের হয় এবং এই অদ্ভুত পাখিটির বাতাসের মাধ্যমে গর্ভধারণ হয়ে থাকে। কৌমারিকেয় জন্মের (Virgin Birth) এটাই আদিরূপ। যদি বাতাসের মাধ্যমে শকুনের গর্ভধারণ হতে পারে তবে পবিত্র আত্মার মাধ্যমে কেন মেরির গর্ভধারণ হবে না? লিওনার্দোর সময় ইতালিয় সমাজে এই বিশ্বাস প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রন্থ পাঠ করে লিওনার্দো তাঁর নিজের মায়ের সাথে শকুনের সাদৃশ্য আবিষ্কার করেছিলেন। একটি অবৈধ সন্তান পিতা ছাড়াই বড় হয় আর সে মাকে কুমারি হিসেবে ভাবতে শেখে। ফ্রয়েড ধারণা করেন, যেহেতু লিওনার্দোর জন্মের পরপরই তার পিতা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন সেহেতু নিঃসঙ্গতার মাঝে একজন মা তার সমস্ত ভালোবাসা সন্তানকে ঢেলে দিয়েছিলেন, কিন্তু বাবা থাকলে হয়ত তা দিতেন না। যে আবেগমথিত চুমু তিনি তাকে দিয়েছেন তা লিওনার্দোর বালপক্ব যৌনতাকে উসকে দিয়েছিল এবং মায়ের প্রতি বিশেষভাবে অনুরক্ত হতে শিখিয়েছিল। এ থেকেই তিনি মা ও শিশু প্রতিকৃতির প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। নারী ও শিশু নিয়ে তাঁর একাধিক চিত্র রয়েছে। এ থেকেই তাঁর মাঝে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমকামিতার অনুভূতি তৈরি হয়েছিল। পিতার অনুপস্থিতিতে তাঁর মনে যে শিশুসুলভ জিজ্ঞাসা উসকে উঠেছিল পরবর্তী সময়ে তা থেকেই অবাধে তাঁর অনুসন্ধানের প্রবণতা বিকশিত হয়েছিল। আর তা প্রচলিত বিশ্বাসের বাইরে। ফ্রয়েড পড়লে আমাদের ধারণা হবে যে শিল্পী হিসেবে লিওনার্দো’র ফ্যান্টাসি নারী ও শিশুর কোমল রূপ এবং তরুণের নারীসুলভ বৈশিষ্ট্যের মাঝেই বোধহয় ঘুরপাক খেয়েছে, কিন্তু অমিত তেজোদীপ্ত যে স্বাস্থ্যবান পুরুষ তাঁর ক্যানভাস জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে তা তাঁর দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। ফ্রয়েডের মতে, বয়স পঞ্চাশ হলে একটি অস্পষ্ট জীবতাত্ত্বিক পদ্ধতির ভিতর দিয়ে নতুন শক্তিতে কামোদ্দীপনা জেগে ওঠে। লিওনার্দোর ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন এসেছিল মোনালিসা’র সাথে তাঁর সাক্ষাতের মধ্য দিয়ে। মৃদু হাসির ভিতর দিয়ে প্রকাশিত তার ব্যক্তিত্ব লিওনার্দোর শৈশবের স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছিল বলে ফ্রয়েড মনে করেন। কমোদ্দীপনার নবায়নের ভিতর দিয়ে তিনি আবার অবিস্মরণীয় চিত্রকলা নির্মাণের সক্ষমতা ফিরে পেয়েছিলেন। কিন্তু পৃষ্ঠপোষক না থাকায় এই পুনর্জাগরণ দীর্ঘস্থায়ী হয় নি এবং তিনি চিত্রকলা ছেড়ে বিজ্ঞানচর্চায় মনোনিবেশ করেন।

ফ্রয়েডের শিল্পতত্ত্বের বেশিটা জুড়ে আছে সৃষ্টির প্রণোদনা সম্পর্কিত বিষয়াবলী। তাঁর শিল্পতত্ত্ব ব্যক্তিত্বের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়াবলী- ইদম, অহং ও অধ্যহং নিয়ে গঠিত। ইদম হচ্ছে মানুষের মৌলিক, আদিম ও পাশব আকাঙ্ক্ষা যা শুধুমাত্র শারীরিক পরিতৃপ্তি খোঁজে। ইদম নিয়ন্ত্রিত হয় অহংবোধ দ্বারা। সামাজিক আদর্শ, নিয়ম-কানুন, স্বীকৃত আচার-আচরণ ইত্যাদি সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা রাখে। অহংবোধের সাথে যুক্ত থাকে অধ্যহং যা নৈতিকতা ও ভালো-মন্দের পার্থক্যের সাথে সম্পর্কিত। ইদম অবচেতন ক্ষেত্রে বিচরণ করে, সার্বক্ষণিক অহং ও অধ্যহংকে আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা দিয়ে ব্যতিব্যস্ত রাখে। আর তা মেটানোর ক্ষেত্রে অহং ও অধ্যহং নৈতিকতা ও প্রচলিত মূল্যবোধের আলোকে তা মেনে নেওয়া বা বাতিল করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। অবদমিত আকাঙ্ক্ষা ও নিয়ন্ত্রিত আচরণের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তা চেতন ও অবচেতনের মাঝে সাংঘর্ষিক এক অবস্থা নির্মাণ করে। বহির্গমনের কোনো সুযোগ না পেলে অবদমিত অবস্থা থেকে মনস্তাত্ত্বিক জটিলতা তৈরি হয়। শিল্প মানুষের অবদমিত অবস্থা থেকে মুক্তির একটি গঠনমূলক ও অর্থপূর্ণ পথ তৈরি করে দেয়। ফ্রয়েড মনে করতেন যে শিল্প বাস্তবতার খুব কাছাকাছি এবং ইদমকে পরিতৃপ্ত করার স্বল্প কার্যকরী একটি উপায় যে কারণে আকাঙ্ক্ষার চাপ বাড়ার ফলে শিল্পী স্নায়ুবৈকল্যের দিকে ধাবিত হন। তাঁর স্নায়ুবৈকল্য তাঁর শিল্পকর্মে ছাপ ফেলে। মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের বাহ্যিক উপস্থাপনাই সৌন্দর্য এবং একইসাথে চৈতন্যে অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকের প্রকাশ। শিল্পে প্রকৃত অর্থ লুকানো থাকে কিংবা ব্যাখ্যা করা কঠিন হয়ে পড়ে। ফ্রিডা কাহলো’র আত্মপ্রতিকৃতিতে দেখা যাচ্ছে যে সাদাপোশাকে তিনি বনের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন, কালো চুলের উপর সাদা প্রজাপতি বসে আছে, গলায়-বুকে জড়িয়ে আছে লতাগুল্ম, পিছনে একটা কালো বানর লতাগুল্ম তার গলার চারপাশে জড়িয়ে দিচ্ছে, বুকের ওপর একটি কালো পাখি ঝুলন্ত ক্রুশের আদলে বসে আছে, পিছনে একটি বন্য কালোবিড়াল উঁকি দিচ্ছে, ফড়িং উড়ছে, এক চিলতে নীলাকাশ দেখা যাচ্ছে। ফ্রয়েডের শিল্পসূত্র বলে যে এটা শিল্পীর বিশেষ মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ। হতে পারে তিনি অসুখি এবং পালিয়ে প্রকৃতির মাঝে ফিরে যেতে যান। যে গুল্ম তাকে জড়িয়ে আছে তা অবদমিত অনুভূতির প্রকাশ, শিশুসুলভ বানরের মতো তার গলা জড়িয়ে আছে। কালো বন্যবিড়ালের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ভিতর দিয়ে সামাজিক চাপমুক্ত হওয়ার জন্য পাল্টা আক্রমণ করার ইচ্ছা প্রকাশ পেয়েছে। ফ্রয়েড নিশ্চিত বলতেন যে, এই প্রতিকৃতি শিল্পীর প্রকৃত আবেগের বহিঃপ্রকাশ যা হতে পারে কোনো অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা বা মানসিক অসুস্থতা। ফ্রয়েডের শিল্পতত্ত্বের মূল বিষয় ছিল শিল্প কেন সৃষ্টি হয় সে সম্পর্কিত। আর তার ধারণা হলো, মানুষ বাস্তবের রূঢ়তা ও অবদমিত আকাঙ্ক্ষার নির্গমন পথ হিসেবে শিল্পকে বেছে নেয়। তাঁর মতো কান্টও বিশ্বাস করতেন যে, শিল্প সৃষ্টির সাথে মনস্তাত্ত্বিক সম্পর্ক বিদ্যমান। যদিও আধুনিক মনঃবিশ্লেষণ পদ্ধতির সাথে তাঁর পরিচয় ঘটার সুযোগ হয়নি। আবার অ্যারিস্টোটল মনে করতেন যে, শিল্প হলো আত্মার শুদ্ধিকরণ যার সাথেও ফ্রয়েডের ধারণার ঐক্য বিদ্যমান। বস্তুত শিল্পের বহুমাত্রিক ব্যাখ্যার ভিতর ফ্রয়েডের ব্যাখ্যাকে সর্বস্ব হিসেবে না ধরলেও তা গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান জুড়ে আছে একথা অনস্বীকার্য।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়