জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু : একটি রহস্য
অলোক আচার্য || রাইজিংবিডি.কম
অলোক আচার্য : কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জীবনানন্দের কবিতাকে বলেছেন ‘চিত্ররূপময়’। বুদ্ধদেব বসু বলেছেন ‘নির্জনতম কবি’। এছাড়াও ‘রূপসী বাংলার কবি’, ‘তিমির হননের কবি’ উপনামগুলো তাঁর নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তিনি রবীন্দ্র পরবর্তী যুগের আধুনিক কবি। যার কবিতায় রয়েছে শুধুই মুগ্ধতা। তাঁর নামের সঙ্গে ‘আনন্দ’ শব্দটি জড়িত থাকলেও বাস্তবিক জীবন ছিল নিরাশাপূর্ণ। তাঁর কবিতা বর্তমান কবিদের প্রভাবিত করলেও জীবদ্দশায় তিনি তা দেখে যেতে পারেননি। তিনি পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন মৃত্যুর পর। সত্যি বলতে, সময় যত যাচ্ছে তাঁর কবিতার প্রতি এমনকি তাঁর প্রতিও আধুনিককালের কবিদের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্য কবিদের ক্ষেত্রে এতটা লক্ষ্য করা যায়নি।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে রয়েছে রহস্য। কবির মৃত্যু নিছক দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পৃথিবীতে যে কবি-সাহিত্যিকদের মৃত্যু নিয়ে রহস্য ঘনীভূত হয়েছে সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের নাম। মৃত্যুর এতগুলো বছর পরেও এ বিষয়ে বিতর্ক সাক্ষ্য দেয় কবির পাঠকপ্রিয়তা। প্রিয় কবির এমন মৃত্যু আজও কেউ মেনে নিতে পারেননি। তাই বারবার উঠে এসেছে বিতর্ক। অনেকেই রয়েছেন এই সারিতে যারা কবির মৃত্যুকে কেবল আত্মহত্যা মানতে একেবারেই রাজি নন। এর পেছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কবির রচনা, জীবনাচরণ, ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি এবং পারিপার্শ্বিক ঘটনা বিশ্লেষণ করলে কবির মৃত্যুর ঘটনাকে নিছক আত্মহত্যা বলতে দ্বিধা হয়। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সর্বাধিক ছোঁয়া পাওয়া গেছে প্রকৃতি ও প্রেমের। এর সঙ্গে একাকিত্ব কবিকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে। ফলে কবিকে নিয়ে পাঠকের আবেগ দীর্ঘায়িত হয়েছে। জীবনে অসংখ্য মানুষের সাহচর্য পেলেও তিনি নিজেকে নিঃসঙ্গই মনে করতেন। কবিতাতেও ফুটে উঠেছে নিঃসঙ্গতা।
২২ অক্টোবর শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে মারা যাওয়ার পর থেকেই তাঁর মৃত্যু রহস্যময়তা সৃষ্টি হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে এসে সেই জনপ্রিয়তা আকাশ স্পর্শ করে। ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যু সাধারণ কোনো দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা এ নিয়ে শুরু হয় গুঞ্জন। এবার সেই দুর্ঘটনার কথায় আসি। প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্যে জানা যায়, জীবনানন্দ দাশ যখন ট্রাম লাইন পার হচ্ছিলেন তখন তার হাতে ডাব ছিল। একজন মানুষ হাতে ডাব নিয়ে আত্মহত্যা করতে পারেন কি না এ নিয়ে প্রশ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এর পরের প্রশ্নটা হলো, সেই ট্রাম দুর্ঘটনা যদি হয় একশ বছরে একটি এবং দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটি জীবনানন্দ দাশের, তাহলে আবার মনে ভাবনা জাগে। এখন বিষয়টি মানা না মানার ব্যাপার পাঠককুলের ব্যক্তিগত। কবির জীবনযাপন এবং কবিতা তাঁর জাগতিক জীবনে হতাশার সাক্ষ্য বহন করে। রবীন্দ্র, নজরুলের পর জীবনানন্দ দাশই আধুনিক কবিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম একথা আজ স্বীকৃত। অথচ জীবদ্দশায় তিনি স্বীকৃতি পাননি- এটাও কবির জন্য চরমতম হতাশা। সেসময় তাঁর কবিতা যথার্থ মূল্যায়িত হয়নি। লেখকের মূল সম্পদ সৃষ্টি। সব লেখকই চায় লেখার মূল্যায়ন হোক। কিন্তু তা যদি না হয় তবে মনে সঞ্চিত ক্ষোভ থাকে বৈকি। এসব বিষয় কবি মনে গভীর দাগ কেটেছিল। রহস্যময় মৃত্যুর তালিকায় দু’জন কবির নাম উল্লেখযোগ্য। দুজনই তুমুল জনপ্রিয় এবং দুজনের মৃত্যুই প্রশ্নময়। একজন হলো অন্যতম সেরা রোমান্টিক কবি শেলী এবং অন্যজন জন কীটস। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে পানিতে ডুবে প্রথম জনের মৃত্যু হয়। তার মৃত্যু নিয়ে আলোচনা এখনও চলছে। তার পানিতে ডোবা কোনো দুর্ঘটনা না স্বেচ্ছামৃত্যু তা নিয়ে রহস্য আজও আছে। অন্যদিকে কীটসের বিষয় ছিল যে, জীবদ্দশায় তার কবিতা সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।
আব্দুল মান্নান সৈয়দ জীবনানন্দের প্রকাশিত-অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র গ্রন্থে বলেছেন: ‘আমার মনে হয় জীবনানন্দ ঠিক ট্রাম দুর্ঘনটায় মারা যাননি। যদিও এই কথাটাই সর্বত্র বলা হয়ে থাকে এবং আমরা দেখেছি। তথাপি আমার ধারণা তিনি আত্মহত্যা করেছেন’। প্রায় একই রকম মন্তব্য করেছেন কবি ও জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহ। তিনি বলেছেন, ‘কলকাতার ইতিহাসে জীবনানন্দই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। তার লেখাগুলো পড়লেই বোঝা যায়, তিনি মৃত্যুচিন্তায় চিন্তিত ছিলেন। এক্ষেত্রে এটা আত্মহত্যা হলেও হতে পারে।’ আসলে মৃত্যু এমন একটি বিষয় যা কারও আওতাধীন নয়। তাই জীবনানন্দের মৃত্যু বহুকাল ধরে কেবল রহস্যাবৃতই থেকে গেল। বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কবির সহধর্মীণি লাবণ্য দাশের কথায় আত্মহত্যার বিষয়টি সামনে চলে আসে। তার উক্তি ছিল: ‘মৃত্যুর পরপার সম্পর্কে ওর একটা অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। মাঝে মাঝেই ওই কথা বলতেন। বলতেন, মৃত্যুর পরে অনেক প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা হয়। আর খালি বলতেন, আচ্ছা বলতো আমি মারা গেলে তুমি কী করবে?’ (আমার স্বামী জীবনানন্দ দাশ, লাবণ্য দাশ)। জীবনানন্দ দাশের কবিতার সমালোচকের অনেকেই তাঁর কবিতার ধারা বিশ্লেষণ করে আত্মহত্যার বিষয়টি সামনে এনেছেন। কবির অনেক কবিতাই যে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যাওয়ার পর আবার মায়ায় ফিরে আসার। কবি ‘ঝরা ফসলের গান’-এ লিখেছেন: ‘পাই নাই কিছু, ঝরা ফসলের বিদায়ের গান তাই/ গেয়ে যাই আমি, মরণে রে ঘিরে এ মোর সপ্তপদী।’ কবির জীবনের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা এবং আত্মহত্যা স্পৃহা, উদাসী ও জাগতিক নিঃসহায়তা এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা যায়। তাছাড়া ট্রাম দুর্ঘটনায় কবিই কেন একমাত্র ব্যক্তি হবেন?
রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে বাংলা সাহিত্যে যার কবিতা সবচেয়ে বেশি সমাদৃত, অনুসৃত তিনি জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে প্রেম, নারী, রোমান্টিকতা, ভালোবাসা, দেশাত্মবোধ। তবে সবকিছু ছাপিয়ে তাঁর কবিতায় ঘুরে-ফিরে বারবারই মৃত্যুর বিষয়টি উঠে এসেছে। উঠে এসেছে বারবার এই বাংলায় ফিরে আসার তুমুল আকুতি। কবিতায় ভালোবেসেছেন স্বদেশ। প্রিয় জন্মভূমির টান ছিল তার কলমে। ফিরে আসতে চেয়েছেন প্রিয় ধানসিঁড়ি নদীর তীরে। এই বাংলার প্রকৃতিই ছিল তাঁর সবচেয়ে প্রিয়। মায়ায় নিজে জড়িয়েছেন, সেইসঙ্গে পাঠকদের টেনেছেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো। বলা হয় রবীন্দ্র প্রভাব বলয় থেকে মুক্ত করেছে তাঁর কবিতা। আধুনিক কবিতার সাথে পরিচয় ঘটিয়েছেন। সেই ধারায় আজ আধুনিক কবিদের কবিতা রচিত হচ্ছে। তবে কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন উপন্যাস, প্রবন্ধ, গল্প। তবে ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন সমসাময়িক আধুনিক কবিদের মধ্যে ব্যর্থ। তার সৃষ্টির সমাদর তিনি জীবিত থাকা অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। বিষণ্ন, স্বপ্নময়, আশ্চর্য শোভাময় কবিতার মধ্যে ক্লান্তি, হতাশা, বিষাদ সোনার টুকরোর মতো কবিতায় ফুটে উঠেছে। আজীবন দুঃখ-কষ্ট অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করা কবি ব্যক্তিগত জীবনে দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত ছিলেন। অনেক চেষ্টার পরেও যেন আর্থিক সমস্যার সমাধান হচ্ছিল না। অভাব ছিল নিত্যসঙ্গী। তাই এই দুর্ঘটনাকে স্বাভাবিক বলতে নারাজ অনেকে। সবচেয়ে দুঃখের বিষয়, জীবদ্দশায় তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতি দেখে যেতে পারেননি। মৃত্যুর পরও তাঁর কবিতা, গল্প প্রকাশিত হয়েছে। তিনি হয়েছেন অন্যতম প্রধান কবি। তার কবিতার টানে আজও অনেকেই কবিতা লিখে চলেছেন। এমন এক কবির মৃত্যু নিয়ে তাই আলোচনা চলতেই থাকবে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ অক্টোবর ২০১৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন