ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

অবাক চোখের চাওয়ায় একটুখানি আলো

আঁখি সিদ্দিকা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ৩ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অবাক চোখের চাওয়ায় একটুখানি আলো

আঁখি সিদ্দিকা :

‘‘তুমি ভালো না বাসলেই বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।
তুমি ভালো না বাসলেই ভালোবাসা জীবনের নাম
ভালোবাসা ভালোবাসা বলে
দাঁড়ালে দু’হাত পেতে
ফিরিয়ে দিলেই
বুঝতে পারি ভালোবাসা আছে।’’

- আহসান হাবীব


ত্রিশের কবিরা নবতর বিকল্প তথা অন্যমাত্রার আধুনিকতার গান শোনাতে চাইলেন রবীন্দ্র-কবিতা-পাঠে-শ্রবণে বিমোহিত পাঠক-শ্রোতাদের। রবীন্দ্র বিশ্বের শাশ্বত মঙ্গলবোধ বিচূর্ণ করে তারা চাইলেন নতুন পথ-চলার আলো। কিন্তু সে ছিলো অন্ধকার; ‘যে আঁধার আলোর অধিক’। এলিয়ট আশ্রয়ী উষরতা পরবর্তী কবিদের মধ্যে চল্লিশ দশকের বাংলা কবিতার একজন প্রধান পুরুষ আহসান হাবীবও এড়াতে পারেননি নেতি-নৈরাশ্যের ছায়া। অবশ্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তার কাব্যজীবনের শুরুতে শেষ হয়েছিলো- সে যুদ্ধ ইউরোপের মতো এশিয়া তথা ভারতবর্ষকেও নাড়া দিয়েছিলো। সেই যুদ্ধের প্রতিক্রিয়া তার কাব্য স্পর্শ করেছে, এ কথা বলাবাহুল্য; তাছাড়া ত্রিশের উত্তরাধিকারী তিনি তো ছিলেনই।

আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুরের শঙ্করপাশা গ্রামে। পিতার নাম হামিজুদ্দীন হাওলাদার। মাতা জমিলা খাতুন। তাঁর পাঁচ ভাই চার বোন। অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল পিতা-মাতার প্রথম সন্তান তিনি। বিবাহিত জীবনে ছিলেন চার সন্তানের জনক। শ্বশুরবাড়ি বগুড়া সদর থানার নামাজগড়। স্ত্রীর নাম খাতুন সুফিয়া। সন্তানদের মধ্যে বড় মেয়ে কেয়া চৌধুরী বর্তমান বাংলাদেশের সংস্কৃতি অঙ্গনের উজ্জ্বল মুখ। দ্বিতীয় মেয়ে জোহরা নাসরিন গৃহিণী। ছেলে মঈনুল আহসান সাবের পেশায় সাংবাদিক। তিনি বাংলা মূলধারার কথাসাহিত্যের পাঠকপ্রিয় কথাশিল্পী। এছাড়া প্রকাশক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। ছোট ছেলে মঞ্জুরুল আহসান জাবেদ যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী।

পারিবারিকভাবে আহসান হাবীব সাহিত্য-সংস্কৃতির আবহের মধ্যে বড় হয়েছেন৷ সেই সূত্রে বাল্যকাল থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত৷ সেইসময় তার বাড়িতে ছিল আধুনিক সাহিত্যের বইপত্র ও কিছু পুঁথি৷ যেমন আনোয়ারা, মনোয়ারা, মিলন মন্দির প্রভৃতি৷ এসব পড়তে পড়তে একসময় নিজেই কিছু লেখার তাগিদ অনুভব করেন৷ সাহিত্যের অনুকূল পরিবেশ নিয়ে পিরোজপুর গভর্নমেন্ট স্কুল থেকে ১৯৩৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন৷ এরপর তিনি চলে আসেন৷ ভর্তি হন বিখ্যাত বজ্রমহোন কলেজে৷ কিন্তু অর্থনৈতিক সংকটের কারণে কলেজের পড়াশোনার পাঠ শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত রাখতে হয় তাকে৷ বিএম কলেজে দেড় বছর পড়ার পর ১৯৩৬ সালের শেষার্ধে কাজের খোঁজে তিনি কলকাতা পাড়ি জমান৷ এভাবেই কবি আহসান হাবীবের বরিশাল থেকে কলকাতায় পদার্পণ। কলকাতা গিয়ে শুরু হয় আহসান হাবীবের সংগ্রামমুখর জীবনের পথচলা। সেখানে গিয়ে ১৯৩৭ সালে তিনি প্রথমে চাকরি নেন ফজলুল হক সেলবর্ষী সম্পাদিত 'দৈনিক তকবীর' পত্রিকায়। বেতন মাত্র ১৭ টাকা। পরবর্তীতে তিনি ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার 'বুলবুল' পত্রিকা ও ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মাসিক 'সওগাত' পত্রিকায় কাজ করেন। এছাড়া তিনি আকাশবাণীতে কলকাতা কেন্দ্রের স্টাফ আর্টিস্ট পদে ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত কাজ করেছেন। ততদিনে অবশ্য 'দেশ', 'মোহাম্মদী', 'বিচিত্রা'র মতো নামী- দামি পত্রপত্রিকায় তাঁর বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়ে গেছে।

আত্মপ্রচারণামুখর হৈচৈয়ের সময়ে আহসান হাবীব অন্তর্গত জগতেই নিজেকে আড়াল করে রেখেছেন। তার লেখা গল্প, উপন্যাস, ছড়াগান ও অনুবাদকার্য ছড়িয়ে থাকলেও আহসান হাবীব মূলত কবি। সময়ের প্রয়োজনে সাহিত্যের অন্যান্য শাখাগুলোয় আগ্রহী হয়ে উঠলেও কবিতা ছিল তার মূল আগ্রহের জায়গা। শৈশবে, কৈশোরে ও পারিবারিক অনুকূল আবহে সাহিত্যের প্রতি অগাধ ভালোবাসা ছিল এবং এই ভালবাসা ছিল মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত। তার প্রথম কবিতার বই 'রাত্রি শেষে' প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কমরেড পাবলিশার্স থেকে। প্রকাশক ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথাশিল্পী সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ।

সাহিত্যের বিষয় হিসেবে তিনি বেছে নিয়েছেন দেশ, মাটি, মানুষ, নিসর্গ ও প্রেম। শৈশবে বেড়ে ওঠা জন্মগ্রাম শঙ্করপাশা আর পারিবারিক অর্থনৈতিক দুরবস্থার প্রভাব তার সাহিত্যে ছাপ ফেলেছে। মানুষের জীবনের সঙ্গে নিজের জীবন মিলিয়ে দেখেছেন তিনি। নিরীহ মানুষের জীবন, বৈষম্য, বণ্টন, পরাধীনতা এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের দায় প্রভৃতি বিষয় ফুটে উঠেছে তার 'রাত্রি শেষে' নামক প্রথম কাব্যগ্রন্থে। পরবর্তী সময়ে 'ছায়া হরিণ', 'সারা দুপুর', 'আশায় বসতি', 'মেঘ বলে চৈত্রে যাবো', 'দুই হাতে দুই আদিম পাথর' এবং 'প্রেমের কবিতা'সহ বিভিন্ন গ্রন্থে তিনি তার কবিতা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। এসব গ্রন্থে ঐতিহ্য, চেতনা, দেশপ্রেম ও মধ্যবিত্ত সুলভ আশাবাদের বিশ্বাস রয়েছে। বিষয়গত বৈশিষ্ট্য ছাড়া কবিতায় শব্দের নিজস্ব ভঙ্গি লক্ষণীয়। নদীমাতৃক গ্রাম বাংলার নিসর্গ সৌন্দর্য তিনি শব্দের ব্যবহারে চিত্রময় করে তুলেছেন। প্রকৃতি ও মানবজীবন ঘিরে যে বৈপরীত্য রয়েছে তা চমৎকারভাবে তার কবিতায় প্রকাশিত হয়েছে।

শিশুতোষ লেখায়ও আহসান হাবীবের সাবলীল বিচরণ ছিলো। সত্তর দশকে শিশুসাহিত্য রচনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। শিশুকিশোর রচনার ঢং, বক্তব্য ও চিন্তা-চেতনায় তিনি নিয়ে আসেন নতুন ব্যঞ্জনা। 'ছুটির দিনদুপুরে', 'পাখিরা ফিরে আসে' এ দুটি বাংলা শিশু সাহিত্যে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। এছাড়া শিশুকিশোরদের জন্য লেখা তার অন্য গ্রন্থগুলি হলো 'বিষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর', 'রেলগাড়ি ঝমাঝম', 'রাণীখালের সাঁকো', 'জোস্না রাতের গল্প', 'ছোট মামা দি গ্রেট' ইত্যাদি।

সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ আহসান হাবীব ১৯৬১ সালে ইউনেস্কো সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৭৮ সালে লাভ করেন একুশে পদক। এর বাইরেও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। অবাক চোখে চাওয়া তার পরমোজ্জ্বল মানস আর চরম জীবনবাদী দৃষ্টি আর তারুণ্যের প্রখর উত্তাপে ঋদ্ধ হবার কারণেই সাফল্য লাভ করেছে বাংলা কবিতার আবহমান ধারায় স্বজনদের ঠিকানা নির্মাণে, আর এরই এক চমৎকার অনাড়ম্বর অথচ ঐশ্বর্যশালী উদ্ভাসের ফলে কালের পরিক্রমায় তা হয়তো আরও বেশি পাঠক-প্রিয়তা ও পাঠক-ঘনিষ্ঠতার আস্বাদ পাবে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়