ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের সংজ্ঞা বিস্তৃত হচ্ছে : শাহাদুজ্জামান

মাসউদ আহমাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪২, ১০ নভেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের সংজ্ঞা বিস্তৃত হচ্ছে : শাহাদুজ্জামান

ছবি: সংগৃহীত



মাসউদ আহমাদ : জীবনানন্দ দাশকে উপজীব্য করে লেখা আপনার উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’। উপন্যাসটি লেখার কতদিন আগে আপনি এর কাহিনি নিয়ে ভেবেছেন এবং লিখলেন কতদিন ধরে?
শাহাদুজ্জামান : জীবনানন্দ আমার ওপর ভর করেছিলেন সেই কৈশরে। আমি যখন ক্যাডেট কলেজে পড়ি- সম্ভবত ক্লাস নাইনে, তখন আমাদের বাংলা শিক্ষক রফিক কায়সার তাঁর ‘আট বছর আগে একদিন’ কবিতাটা ক্লাসে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন। বলা যায়, প্রায় তাৎক্ষণিক ঐ কবিতা আমাকে দখল করে নেয়। স্কুল পাঠ্য নানা যে কবিতা তখন পড়েছি তা থেকে এ যে ভিন্ন একটা ব্যাপার, সেটা টের পাই। ঐ থুত্থুরে অন্ধ প্যাঁচা, বুড়ি চাঁদ আমাকে একটা অন্য জগতে নিয়ে যায়। তার কবিতার জগতের যে মেজাজ তা আমাকে আচ্ছন্ন করে। এমনিতে পারিবারিকভাবেই সাহিত্য-আগ্রহ আমার তৈরি হয়েছিলো। আমি নিজে যখন লিখতে শুরু করি তখন জীবনানন্দের নানা বাক্যবন্ধ, রুপক, উপমা আমার লেখায় চোরাগোপ্তা ঢুকে পড়ে। আমার গল্পের নাম, বইয়ের নামের ভেতরও রয়ে যায় জীবনানন্দের প্রভাব। ১৯৯৯ সালে জীবনানন্দের জন্মশত বর্ষে আমার যে গল্পের বইটা বেরোয় তার নাম ‘পশ্চিমের মেঘে সোনার সিংহ’। এই লাইনটা জীবনানন্দের একটা গল্প থেকে ধার করা। সেই বইয়ের শুরুতে ‘১৮৯৯’ নামে একটা অণুগল্প আছে যা মূলত গল্পকার জীবনানন্দকে স্মরণ করেই। সে বছর জীবনানন্দের অনেক নতুন অপ্রকাশিত লেখাপত্র প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে তাঁর গদ্য। জীবনানন্দকে কবি বলেই জেনেছি এতকাল, সেসময় তাঁর গল্পের, উপন্যাসের সাথে আমার বিশেষভাবে পরিচয় ঘটে। আমি বিস্মিত হই তাঁর কথাসাহিত্য রচনার প্রতিভায়। জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে জীবনানন্দের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও অনেক নতুন তথ্য প্রকাশিত হয়। সত্যি বলতে, তাঁকে নিয়ে একটা উপন্যাস লিখবার ভাবনা আমার সেই সময়েই প্রথম আসে, সেই ১৯৯৯ সালে। কিন্তু সেটা ভাবনা আকারেই ছিলো। জীবনানন্দকে নিয়ে উপন্যাস লিখবার ব্যাপারে সিরিয়াসলি ভাবতে শুরু করি ২০১০ এর দিকে। ইতিমধ্যে আমার ‘ক্রাচের কর্নেল‘ প্রকাশিত হয়েছে। জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখার একটা অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে। আমি ঠিক করি, জীবনানন্দ নিয়ে বইটা এবার লিখতে শুরু করব। আমার প্রিয় একজন লেখককে নিংড়ে জানা এবং আমার উপরে জীবনানন্দ যে ভর করেছেন তা থেকে মুক্ত হবার একটা উপলক্ষ ছিলো এই বই লেখা। তাছাড়া আমি আামর নিজের লেখক সত্তার সাথেও মোকাবেলা করতে চেয়েছি আরেকজন লেখকের মুখোমুখি হয়ে। এই বই লেখা অনেকটা আমার নিজেকে চেনার প্রক্রিয়ারও একটা অংশ। প্রস্ততি হিসেবে আমি তখন জীবনানন্দের সব লেখাপত্র যোগাড় করতে শুরু করি। বিচ্ছিন্নভাবে তার লেখাপত্র তো পড়া ছিলোই এবার তাঁর কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ডায়েরি এবং তাঁকে নিয়ে লেখা যতরকম বই- যতটা সম্ভব যোগাড় করি এবং সিস্টেম্যাটিকভাবে পড়তে শুরু করি। তাঁর বহু লেখা, বই একাধিকবার পড়েছি। তারপর কলকাতা গেছি, বরিশাল গেছি জীবনানন্দের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট জায়গাগুলোর স্পর্শ পেতে। তাঁর জীবন এবং ভাবনাকে নিজের মধ্যে আয়ত্বে আনতে আমার বছর তিন, চারেক লেগেছে। এরপর আমি জীবনানন্দ বিষয়ে আমার নিজের একটা যাত্রা হিসেবে ‘একজন কমলালেবু’ লিখতে শুরু করি। লিখতেও বছর দুয়েক সময় লেগেছে।


শাহাদুজ্জামান : আসলে এই উপন্যাসের বেশ কয়েকটা ভার্সন আমি লিখেছি। যেমন বললেন, আমার অন্য লেখার মতো এই বইটার ক্ষেত্রেও বারবার রিভাইস করতে হয়েছে। সত্যি বলতে, এই বইটা নিয়ে বরং বেশিই টানাপোড়েনে ছিলাম। জীবনানন্দ-বিষয়ে যাবতীয় তথ্য, ভাবনা যোগাড় করার পর কীভাবে তা উপস্থাপন করবো সেটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে। বইয়ের কনটেন্ট আমার জন্য প্রস্তুত ছিলো, কিন্তু এর ফর্মটা নিয়ে আমি বেশ চ্যালেঞ্জে ছিলাম। ফর্ম নিয়ে নানা পরীক্ষা নীরিক্ষা করতে আমি পছন্দ করি। আমার ছোটগল্পগুলোতে লক্ষ্য করবেন আমি ফর্মের নানারকম চর্চা করেছি। উপন্যাসে ফর্মের নিরীক্ষা তুলনামূলকভাবে দুরূহ। এই বইটার যে প্রথম ভার্সন ছিলো সেটা এখনকার ভার্সনের চেয়ে একেবারেই ভিন্ন। সেখানে আমি বেশ কতগুলো কাল্পনিক চরিত্র তৈরি করেছিলাম, যাদের পারস্পরিক আন্তসর্ম্পকের ভেতর দিয়ে জীবনানন্দকে উন্মোচন করার চেষ্টা ছিলো। ফর্মটাও ছিলো ভিন্ন। বইটা শুরু করেছিলাম দুজন কাল্পনিক চরিত্রের ভেতর চিঠি চালাচালি দিয়ে। সেই ফর্মে অনেক দূর লিখেছিলাম। কিন্তু একপর্যায়ে টের পেয়েছি, ঐ সৃষ্ট চরিত্রগুলোর নিজস্ব বিকাশ-পরিণতির জন্য বইটাতে অনেকটুকু স্পেস দিতে হচ্ছে, তাছাড়া তাতে বইয়ের মূল ফোকাসও অনেকটা ব্যাহত হচ্ছে। আমি তারপর সেইসব কাল্পনিক চরিত্রগুলোকে বাদ দেই। শুধুমাত্র জীবনান্দের জীবন এবং তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষজনের ভেতরেই চরিত্রগুলোকে সীমিত রাখি। একসময় আরো একটা ভার্সনে লিখেছিলাম, যেখানে আমি কল্পনা করেছিলাম যে জীবনানন্দের সাথে আমার দেখা হয়েছে; তারপর তাঁর সঙ্গে আলাপ আলোচেনা করেই আমি তাঁকে নিয়ে বইটা লিখছি। এসব ইমাজিনারী ব্যাপারগুলো পরে বাতিল করি। এরপরের ভার্সনে কাল্পনিক চরিত্র বাদ দিলেও ফর্মে খানিকটা নিরীক্ষা করি। আমি লিনিয়ার স্টোরী টেলিং না করে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের ন্যারেশনকে মিলিয়ে ফেলি। আমি তাঁর ট্রাম দুর্ঘটনার দৃশ্য দিয়ে গল্পটা শুরু করে তাঁর শৈশবে ফিরে যাই, আবার শৈশব থেকে ফিরে আসি দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় র্তার অন্তিম মুহূর্তে, সেখান থেকে ফ্ল্যাশব্যাক করে আবার চলে যাই তাঁর যৌবনের দিনে; আবার ফ্লাশ ফরোয়াড করে চলে আসি হাসপাতালে। এভাবে বইটা অনেকদূর লিখেছিলাম। সেই ভার্সনেরই অংশবিশেষ ছাপা হয়েছিলো ঈদসংখ্যায়। তখন নামটাও ছিলো ভিন্ন-‘যে মানুষ কমলালেবু হতে চায়’। কিন্তু পরে এই ফর্মটাও বদলে ফেলি। নামটাও বদলে ফেলি। এই বইটার সম্ভাব্য প্রায় এক ডজন নাম আমি ঠিক করেছিলাম। অনেক ভেবে চিন্তেই আমি ‘একজন কমলালেবু’ নামটা নির্বাচন করি। আসলে লেখা তো একটা অর্গানিক প্রক্রিয়া, লিখতে লিখতেই আমার নিজের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছিলো এই বই নিয়ে আমার যাত্রার পথ। আমার মনে হচ্ছিল, ফর্মের নীরিক্ষা করে একধরনের ইন্টেলিকচুয়াল এক্সারসাইজ হয় বটে, কিন্তু সেটা এই বইয়ের মূল উদ্দেশ্যকে বিশেষ সাহায্য করে না। আমি শেষে গল্প ন্যারেশনের ক্ষেত্রে নীরিক্ষার চিন্তা বাদ দেই। আমি তার দুর্ঘটনা দৃশ্য থেকে গল্প শুরু করে চলে যাই তাঁর শৈশবে এবং তারপর ধারাবাহিকভাবে এক রকম লিনিয়ার ন্যারেটিভের মাধ্যমে তাঁর জীবনের পরিণতির দিকে এগুতে থাকি। এতে করে আরো নিবিড়ভাবে জীবনানন্দের জীবন, তাঁর সত্তার নানা আলোড়নের সাথে ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগ পাই। এই ভার্সনটাই যে সবচেযে ভালো হয়ছে তা হয়তো বলা যাবে না, কিন্তু লিখতে লিখতে এই ধারাকেই তখন আমার যথার্থ মনে হয়েছে। আমি শুরু থেকে একটা ব্যাপার নিশ্চিত ছিলাম যে, আমি জীবনানন্দের জীবনী লিখতে বসিনি। আমি আমার মতো করে জীবনানন্দের জীবনকে পুনর্নিমাণ করেছি। ফলে তাঁর জীবনের যাবতীয় তথ্য সংবলিত ধারাবিররণী দেওয়ার কোনো দায় আমার ছিলো না। এ বই জীবনানন্দকে নিয়ে আমার নিজের ব্যক্তিগত যাত্রা। যেভাবে আমি জীবনানন্দের জীবনকে কম্পোজ করেছি সেখানে লেখক হিসেবে আমার স্টেটমেন্ট আছে। একজন কমলালেবুতে লেখক হিসেবে আমিও হাজির আছি। বিটুইন দ্য লাইন পড়লে হয়তো দেখবেন-এ বই শুধু জীবনানন্দের গল্প না, আমারও গল্প। এই দুই গল্প মেলাতে গিয়ে তাই আমাকে বেশ কয়েকটা ভার্সনে লিখতে হয়েছে।


শাহাদুজ্জামান : জীবনীভিত্তিক উপন্যাস লেখার জন্য গবেষণা তো অনিবার্য। এই বইটা লিখবার জন্য আমার দীর্ঘদিন ধরে পঠন-পাঠন করতে হয়েছে। একাডেমিকভাবে গবেষণা আমার কাজের ক্ষেত্র, ফলে আমি পদ্ধতিগতভাবে গবেষণা করেছি। ইতিহাস বা জীবনীভিত্তিক গবেষণার জন্য অন্তত দুটো সূত্র থেকে তথ্য যাচাই করতে হয়। তথ্যের সত্যতার জন্য আমি যে কারণে যতগুলো সূত্র থেকে সম্ভব তথ্য যাচাই করেছি। খুব শ্রমসাধ্য কাজ এসব; কিন্তু এটা ছিলো আমার জন্য এক চমৎকার খেলার মতো। তো গবেষণা আমি পুরোদস্তুর করেছি। কিন্তু আমি কোনো গবেষণাপত্র লিখতে বসিনি। গবেষণার তথ্য রূপকথার গল্পের সেই ব্যাঙের মতো যাকে রাজকন্যা চুমু দেওয়াতে সে রাজপুত্র হয়ে ওঠে। নেহাত তথ্য তো ব্যাঙের মতোই, তাকে সুদর্শন রাজপুত্র কবে তুলবার জন্য দরকার সাহিত্যিক ছোঁয়া। আমি সে চেষ্টা করেছি। আমি নিজে ফিকশন এবং নন ফিকশন দুরকম লেখাই লিখি এবং এই দুই ধারার লেখাকে ব্লেন্ড করার চেষ্টা করি। যাকে আমি ডকু-ফিকশন বলেছি। আমার এই ব্লেন্ডিং সর্বাংশে সফল হয়েছে সে দাবি আমি করি না। বইটাকে আরো পরিশীলিত করার সুযোগ বরাবরই রয়ে গেছে। কিন্তু একজন কমলালেবু কোনোভাবে গবেষণাপত্র না। গবেষণাপত্রের আবেদন মূলত মানুষের চিন্তার কাছে, আবেগের কাছে না। গবেষণাপত্রের দায় থাকে তাত্বিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর। আমার বইটা কোনো সিদ্ধান্ত দেয় না, বরং তা শেষ হয়েছে প্রশ্নে। ‘একজন কমলালেবু‘ পড়ে আবেগ আক্রান্ত হয়ে অগণিত পাঠক আমাকে মেইল করেছেন। গবেষণাপত্র পাঠ করে কেউ আবেগে বিহ্বল হন না। একজন কমলালেবুর তথ্য, সূত্র, টীকা পাঠকে ভারাক্রান্ত করেছে এমন মন্তব্য অবশ্য আমি পাইনি। তবে বইটি উপন্যাস না জীবনীগ্রন্থ-তা নিয়ে বিতর্ক শুনেছি।


শাহাদুজ্জামান : উপন্যাসজুড়ে শুধু সত্য এবং টেক্সুয়াল বিবরণের উপর নির্ভর করেছি-কথাটা বোধহয় পুরোপুরি ঠিক না। নানা জায়গায় কল্পনা দিয়ে সেতু রচনা করতে হয়েছে আমাকে। তবে যেটা বলছিলাম-একটা বিশেষ ভাবনা থেকেই আমি এ বইটা লিখতে শুরু করি। সেই প্রক্রিয়াতে বইটার ধরন নির্দিষ্ট হয়েছে। আমার কাছে শিল্পের ব্যাপারে সীমাহীন সততা, অসম্ভব নিষ্ঠা, অভূতপূর্ব পরিশ্রমের মূর্তিমান উদাহরণ জীবনানন্দ। তৃতীয় বিশ্বের এমন একজন সাহিত্যিকের সংগ্রামকে বুঝে ওঠা আমার জরুরি মনে হয়েছে। সাহিত্য যে কী গভীর অতলে ডুব দেবার ব্যাপার আমরা যেন তা আজকাল ভুলতে বসেছি নানা বায়বীয় প্রণোদনায়। আমার তাই মনে হয়েছে, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সাহিত্যিক হিসেবে জীবনানন্দকে বোঝা আমাদের দরকার। আমি তাই সবরকম কাল্পনিক চরিত্র বাদ দিয়ে, সব রকম নিরীক্ষা বাদ নিয়ে ডুব দিয়েছি শুধুই জীবনানন্দ নামের ঐ জলাশয়ে। ইচ্ছা করেই তাই সত্যনিষ্ঠ থাকতে চেষ্টা করেছি তাঁর জীবনের ব্যাপারে। কিন্তু আবারও বলছি, সত্য তথ্যনির্ভর কোনো জীবনীগ্রন্থ রচনার ইচ্ছা থেকে এই বই আমি লিখিনি। জীবনানন্দের বস্তুনিষ্ঠ জীবনী লিখেছেন প্রভাতকুমার দাস, সাহিত্যিক জীবনী লিখেছেন ক্লিনটন বুথ সিলি। নতুন করে সে কাজ করবার কোনো দরকার আছে বলে আমি মনে করিনি। সেইসব বইয়ের সাথে মিলিয়ে দেখলেই আমার বইয়ের সাথে পার্থক্যটা ধরা পড়বে। ‘একজন কমলালেবু’ জীবনানন্দকে নিয়ে আমার একান্ত ব্যাক্তিগত একটি যাত্রার বয়ান। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে দেখবেন-‘একজন কমলালেবু’ বইতে যতটা জীবনানন্দ আছেন আমিও আছি তাঁর পাশাপাশি। আমি তাঁর লেখা নিয়ে, ভাবনা নিয়ে প্রশ্ন করেছি আবার আমিই উত্তর দিয়েছি। ডায়েরিতে কেন তিনি একটা কথা লিখছেন, ডায়েরির একটা কথার সাথে কবিতার একটা লাইন কীভাবে মিলে যাচ্ছে, সেখান থেকে কী করে আবার একটা গল্পের জন্ম হচ্ছে এসব খুঁটিয়ে আলাপ করেছি। তাকে নিয়ে কে কী বলছে কেন বলছে সেগুলোর ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি। জীবনানন্দ-বিষয়ক নানা প্রসঙ্গে বিবিধ ব্যাখ্যা হতে পারে, সেখান থেকে একটা নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা আমি নির্বাচন করছি। এ ব্যাখ্যা একান্ত আমার নিজস্ব। এছাড়া আমি আমার অন্যান্য লেখাতে বলেছি যে, সাহিত্যের নানা শাখার দেয়াল ভেঙে ফেলাতে আমার আগ্রহ আছে। গল্পের সাথে কবিতা, নাটক বা প্রবন্ধের চরিত্র মিলিয়ে দিতে আমার আপত্তি নাই। বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও তো সাহিত্যের সংজ্ঞা ক্রমশ বিস্তৃত হচ্ছে। যেমন ধরা যাক, নোবেলজয়ী বাইলোরুশের লেখিকা সলভিয়েনা আলেক্সেভিচ সাংবাদিকতাকেই একটা উৎকৃষ্ট সৃজনশীলতায় নিয়ে গেছেন। গানের গীতিকার বব ডিলানও নোবেল পেলেন সাহিত্যে। আবার ধরেন, উপন্যাসের চরিত্রও তো কালে কালে বদলেছে। কয়েক শতক আগে উপন্যাস বলেই তো কোনো মাধ্যম ছিলো না। আবার একসময় ইউরোপীয় লেখকরা উপন্যাসের প্রধান শর্ত বলে কিছু বিষয়কে দাঁড় করিয়েছিলেন। কিন্তু ল্যাটিন আমেরিকার ঔপন্যাসিকরা উপন্যাসের ইউরোপীয় সেই শর্ত মানেননি। চেক লেখক মিলান কুন্ডেরা বলছেন, নতুন যুগের উপন্যাসের মূল কাজ হচ্ছে ‘Discovery of prose’, গদ্যের নব আবিষ্কার। প্যারিস রিভিউ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলছেন উপন্যাসের আছে : ...tremendous synthetic power, that it could be poetry, fantasy, philosophy, aphorism, and essay all rolled into one. কুন্ডেরা উপন্যাসের কোনো নির্দিষ্ট শর্তের বদলে সেখানে জ্ঞানকাণ্ড, রসকাণ্ডের সব শাখাকে মিলিয়ে ফেলবার কথা বলছেন। উপন্যাসের সংজ্ঞাকে উন্মুক্ত রাখছেন। আমি নিজেও বিশেষ ক্যাটাগরির বদলে আমার লেখাগুলোকে বরং ‘সাহিত্যকর্ম’ হিসেবেই দেখি। সুতরাং আমার এই বইয়ের ক্যাটাগোরাইজেশনের সমস্যা থেকে গেলেও অসুবিধা দেখি না।


শাহাদুজ্জামান : যে প্রেক্ষাপট নিয়ে একজন লেখক লিখছেন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকার গুরুত্ব তো আছেই। তবে তা কোন মাত্রার তার নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম আছে বলে মনে হয় না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় কোনো এক লেখায় লিখেছিলেন-‘পদ্মা নদীর মাঝি’ লেখবার আগে তিনি কিছুদিন মাঝিদের সাথে বিড়ি-সিগারেট খেয়েছেন, গল্পগুজব করেছেন এই যা। এর বেশি কিছু না। মাঝিদের প্রাত্যহিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের খোঁজখবর করতে তাদের মাঝে সময় কাটানো মানিকের কাজে লেগেছে। আবার আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দেখেছি, তাঁর ‘খোয়াবনামা’ উপন্যাসটা লিখবার আগে বহুবার বগুড়া-গাইবান্ধা এলাকায় গেছেন। আমি তখন কাজের সূত্রে গাইবান্ধা এলাকায় থাকতাম। ইলিয়াস ভাইকে নিয়ে ঐসব এলাকায় ঘুরে বেড়িয়েছি। দেখেছি, তিনি কীভাবে মানুষজনের সাথে কথাবার্তা বলে নানা রকম তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ‘একজন কমলালেবু’ লিখবার জন্য আমি সরেজমিনে খুব বেশি ঘোরাঘুরি করিনি। আমি মূলত প্রাপ্য লেখাপত্রের উপর নির্ভর করেছি। তবে সরেজমিন অভিজ্ঞতাও আমার ছিলো। আমার বাবার কাজের সূত্রে আমরা বরিশালে ছিলাম বেশ কয়েক বছর। ফলে বরিশাল শহর, বিএম কলেজ, কীর্তনখোলা, বগুড়া রোড-জীবনানন্দের জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট এসব জায়গাগুলো আমার চেনা। কলকাতা আগে বহুবার গেলেও একজন কমলালেবু লিখবার সময় বিশেষভাবে গিয়েছিলাম জীবনান্দের স্পর্শ-লাগা জায়গাগুলো দেখতে। ঐ জায়গাগুলোর একটা ফিল নিতে। ল্যান্সডাউন রোডের তাঁর বাড়িটা খুঁজে বের করে সেখানে গেছি। জানলাম, এখন তার মালিক কলকাতার একসময়ের চলচ্চিত্র নায়িকা দেবশ্রী। সরু গলির ভেতর যে বাড়িটায় তিনি থাকতেন- দেখলাম, তার দরজা বন্ধ। দরজায় পুরনো কড়া। আমার ধারণা, এই কড়া সেই সময়েরই। আমি দরজার কড়াটা নেড়ে চেড়ে দেখলাম। জীবনানন্দ মাইলের পর মাইল হেঁটে অনেক রাত করে কোনো কোনোদিন বাড়ি ফিরে এই দরজাতেই কড়া নাড়তেন হয়তো, নীচু স্বরে মেয়ে মঞ্জুকে ডাকতেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে- সেসব সময়টাকে ভাববার চেষ্টা করেছি। রাসবিহরী রোডের যে জায়গাটাতে ট্রামের অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিলো সে জায়গার আশপাশটা ঘুরছি। শম্ভুনাথ পণ্ডিত হাসপাতালে গিয়েছি, যেখানে জীবনানন্দ শেষ দিনগুলোতে ছিলেন। যেখানে তিনি মারা গেছেন, সেই হাসপাতালকে এখন তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে। হাসপাতালের এমার্জেন্সি রুমে গেলাম যেখানে জীবনানন্দ এডমিটেড ছিলেন। উঁকি দিয়ে দেখলাম- কাকতালীয়ভাবে ডাক্তাররা কোনো এক অ্যাক্সিডেন্ট রোগীকেই পরীক্ষা করছেন সেদিন। করিডোরে হাঁটলাম-যেখানে জীবনানন্দের বোন সুচরিতা একটা ফলের ঝুড়ি নিয়ে বসে থাকতেন। কলকাতায় সরেজমিনে যাওয়া আমার জন্য ছিলো ‘একজন কমলালেবু’ লেখার একটা মানসিক পরিমণ্ডল তৈরি করার উপলক্ষ্য। একটা বেদনার স্মৃতি অবশ্য আছে এ প্রসঙ্গে। কলকাতায় ভূমেন্দ্র গুহের সাথে আড্ডা দেবার জন্য দিনক্ষণ ঠিক করে রেখেছিলাম-তার সঙ্গে আগে কথা বলে। যেদিন গেলাম, সেদিনই তিনি হঠাৎ গুরুতর অসুস্থ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি হলেন এবং তার পরদিন মারা গেলেন। কী গভীর মমতায় জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপিগুলোকে পুনর্লেখন করেছেন তিনি। জীবনানন্দকে নিয়ে কত গল্প করার ছিলো তার সঙ্গে। একটা বড় সাধ অপূর্ণ রয়ে গেল আমার।


শাহাদুজ্জামান : ‘একজন কমলালেবু’ লিখতে গিয়ে একরকম জীবনানন্দের সান্নিধ্যেই থেকেছি একটা লম্বা সময়। মানুষটাকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। একজন মানুষকে পূর্ণাঙ্গ বোঝা তো দুষ্কর, তার কতরকম ছায়া-সত্তা থাকে; তবু তাঁকে অনেকটা বুঝেছি বলেই মনে হয়ে। তাঁর একটা ছবি তো মনের ভেতর তৈরি হয়েছেই। তাঁর মনের ছবি, দেহের ছবি। তাঁর একটা পরিচিত পোট্রেট ছবি আছে। স্টুডিওতে তোলা একটা ছবি যা ভূমেন্দ্র তাঁর ট্রাঙ্কে পেয়েছিলেন। সেই ছবিতে তাঁর চোখটা বিশেষভাবে টানে আমাকে। চোখের দৃষ্টির ভেতর একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। মনে হয় তিনি যেন পথ ভুলে এই পৃথিবীতে এসেছেন। তাঁর অন্য কোথাও থাকার কথা ছিলো, অন্য কোনো সময়ে। আসলে জীবনানন্দ সময়ের অনেক আগেই যেন পৃথিবীতে এসেছিলেন। কিছু কিছু প্রাণী থাকে তাদের ঘ্রাণশক্তি বা দৃষ্টিশক্তি প্রখর। তারা অনেক দূরের ঘ্রাণ পায়, কিংবা দেখতে পায় বহুদূরের কোনো দৃশ্য। জীবনানন্দকে পড়ে আমার মনে হয়েছে, তিনি যে সময়ে দাঁড়িয়েছিলেন তার থেকে বহুদূরের পৃথিবীর ঘ্রাণ তিনি পেতেন, দৃশ্য তিনি দেখতে পেতেন। বিশ শতকের প্রথম অংশে কেটেছে তাঁর জীবন, কিন্তু সেই সময়ে তাঁর দেশের এবং সারা পৃথিবীর মানবসত্তার নির্যাস তিনি ধারণ করেছিলেন, টের পেয়েছিলেন আগামী শতাব্দীর মানুষ কোন বোধের দোলাচলের ভেতর দিয়ে যাবে। আমাদের কাছে তাই তাঁর লেখা মনে হয় আমাদের সময়েরই একবারে নাড়ির সাথে যুক্ত। অসম্ভব মেধাবী একজন মানুষ। তাঁর প্রবন্ধ, ডায়েরিগুলো পড়লে বোঝা যায়- কী ব্যাপক তাঁর পঠন-পাঠন। সাহিত্য ছাড়াও তাঁর পঠন-পাঠন পদার্থবিদ্যা, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতি নিয়ে। এনসাইক্লোপেডিক তাঁর জ্ঞানজগত। কিন্তু শুধু মনন তাঁকে শাসন করেনি, মানুষের মনের নাজুকতার নিবিড় পর্যবেক্ষক তিনি। সেই মনন, সেই মনকে ধরতে গিয়ে তিনি বাংলা ভাষার গতিপথকে বদলে দিয়েছেন। তৈরি করেছেন একেবারে নিজস্ব এক সাহিত্যভুবন। ভাষায় বিস্ময়কর সব ইমেজ তৈরি করেছেন। তাঁর মতো এমন একজন অনন্য মেধাবী মানুষ তাঁর সমসময়ে বিশেষ ঘনিষ্ঠজন যে কাছে পাননি তাতে অবাক হইনি। যে ‘বোধ’, যে ‘বিপন্ন বিস্ময়’ নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়াতেন তাতে নিঃসঙ্গতা তাঁর অনিবার্য পরিণতিই ছিলো বোধহয়। তিনি ভেতর-গোটানো, মুখচোরা মানুষ ছিলেন বলেই সবাই জানিয়েছেন। এমনকি যে বুদ্ধদেব তাঁর সাহিত্য প্রতিষ্ঠার জন্য প্রাণপাত করছেন তাকেও তিনি এড়িয়ে চলতেন। তাঁর সময়ে যত কথিত স্টার লেখক, তাদের তিনি এড়িয়ে চলতেন, কোনো সাহিত্যপরিমণ্ডলেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন না। তারা যেসব ব্যাপার নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন সেগুলো হয়তো নিরর্থকই মনে হতো তাঁর কাছে। তিনি আরো বহুদূরের ঘ্রাণ নিয়ে তখন ব্যস্ত। তাছাড়া সাধারণভাবে তাঁর যাকে বলে সামাজিকতার দক্ষতা, সেটাও বিশেষ ছিলো না। বেকারত্ব, দারিদ্য, তাঁর দাম্পত্য অসুখ-সব তাঁকে আরো পর্যুদস্ত করে ফেলেছিলো। তিনি দেখতে শুনতেও ছিলেন খুবই সাদামাটা। সঞ্জয় ভট্টাচার্য যখন প্রথম তাঁকে দেখেন তখন তার মনে হয়, এই চেহারার লোক এমন অসাধারণ কবিতা লিখতেই পারেন না। বুদ্ধদেব তাঁকে ঠাট্টা করে বলেছিলেন, উনি যখন কাগজ কলম নিয়ে বসেন তখন তাঁর চেহারা পাল্টে যায়। তবে জীবনানন্দ নানা পাকচক্রে পড়া তাঁর নিজের জীবনযাপনকেই আবার একধরনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে দেখেছেন এবং নিজের সঙ্গেই সাহিত্যিক মোকাবেলা করেছেন। বাইরে লাজুক হলেও ভেতরে ভেতরে তিনি ছিলেন খুব আত্মবিশ্বাসী একজন মানুষ, বিশেষ করে তাঁর সাহিত্যের বেলায়। অবলীলায় দুর্দান্ত সব সাহিত্যিক নীরিক্ষা করেছেন তিনি তাঁর কবিতায়, গল্পে। একাকী মানুষ ছিলেন ঠিকই আবার এও দেখতে পাই, বিশ্বস্ত মানুষ পেলে তিনি আড্ডা দিয়েছেন বিস্তর। ভূমেন্দ্রের সাথে তিনি কলকাতার বাসে বাসে ঘুরে গল্প করেছেন, তরুণ পাঠক প্রভাকর সেনের সাথে বহুবার কফিহাউজে বসে তার নিজের লেখা নিয়ে গল্প করেছেন। তাঁর কৌতুকপ্রিয়তার গল্পও করছেন তাঁর ঘনিষ্ঠজনরা। আমার ধারণা, যদি তাঁকে পেতাম তাঁর সঙ্গে আমি একটা চমৎকার আড্ডায় মেতে উঠতে পারতাম। সেটা তো একেবারে অবিশ্বাস্য কল্পনাও না, কারণ তিনি আমার পরজন্মের চাইতে একেবারে অসম্ভব দূরত্বেও ছিলেন না। অকালে প্রয়াত না হলে আমি যখন লেখালেখি শুরু করেছি সেই আশির দশকে, তাঁর বেঁচে থাকা তো অসম্ভব ব্যাপার ছিলো না। হয়তো বৃদ্ধ হতেন তবু তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ তো থাকতো। কল্পনা করি, হয়তো কলকাতার কফিহাউজে তাঁর সঙ্গে গল্প করছি, তিনি বরিশালে আসতে না পারার আক্ষেপ করছেন। হয়তো বরিশালের ভাষায় আমাকে বলছেন, ‘মোর বাড়ি বরিশাল মোর দাদা চহিদার’ বলে তার সেই বিখ্যাত কাঁধ ঝাকানো হাসি হাসছেন।


শাহাদুজ্জামান : পাঠকের কথা মাথায় রেখে ঠিক লিখি না কখনো। তবে তেমন পাঠক প্রত্যাশা করি, যারা তাদের পাঠের চেনা ভূগোল থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথে হাঁটবার ব্যাপারে আগ্রহী। একজন কমলালেবু বইটার পাঠ-প্রতিক্রিয়া পেয়েছি বিস্তর এবং বেশ অভূতপুর্ব মাত্রাতেই বলবো। এখন তো পাঠকের সাথে যোগাযোগ খুবই সহজ। তারা ইমেইলে, ফেইসবুকে সরাসরি তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। বইটা নিয়ে নানা তর্ক বিতর্ক আমি অনলাইনে, অফলাইনে দেখেছি, শুনেছি। নানা বিচিত্র প্রতিক্রিয়াও পেয়েছি। একজন পাঠক আমাকে জানিয়েছেন, এই বইটা পড়বার পর থেকে তিনি কমলালেবু খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন, কারণ কমলালেবু হাতে নিলেই তার মনে হয় তিনি জীবনানন্দকে হাতে নিয়েছেন। একজন কর্পোরেট ব্যবসায়ী যার অতিব্যস্ত জীবনে সামান্য ফুসরতও নেই, তিনি অফিসে যাওয়া-আসার পথে গাড়িতে বইটা শেষ করে জানিয়েছেন-এই বইটা পড়ে মনে হয়েছে এটা যেন তারই গল্প। এক অর্থে আমাদের সবার ভেতর তো গোপনে একজন জীবনানন্দ বাস করেন যে এইসব প্রতিদিনের গ্রন্থি মাংসের জীবন থেকে ছুটি চায়। আবার অনেক বিরূপ প্রতিক্রিয়াও পেয়েছি। বিশেষ করে যারা মনে করেন জীবনানন্দ-বিষয়ে তারা বিশেষভাবে জ্ঞাত, তাদের কেউ কেউ মনে করেছেন ‘একজন কমলালেবু’ বইতে নতুন কিছু তারা পাননি। তাদের কারো কারো মতামতের ভেতর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দেখেছি, আবার অনেকের মন্তব্য থেকে বুঝেছি তারা বইটা পুরো না পড়েই বা বিশেষ কোনো একটা অংশ পড়েই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন। অনেক আলোচনার ভেতর দু একটা সমৃদ্ধ রিভিউ আমি পেয়েছি যাতে নেহাত উচ্ছ্বাস বা নিন্দার বিপরীতে একটা বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনা আছে যাতে এই বইয়ের শক্তি এবং সীমাবদ্ধতা কথা তারা বলেছেন। অনেকে আবার দেখেছি, আমি যেভাবে জীবনানন্দকে উপস্থাপন করেছি সেটা তাদের ভালো লাগেনি, তারা যেভাবে জীবনানন্দকে বুঝেছেন তার সঙ্গে এই বইয়ের মিল হয়নি বলে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কেউ কেউ আবার বইটার নাম নিয়ে ধন্দে পড়েছেন। ‘একজন কমলালেবু’ নামটা তাদের কাছে অদ্ভুত মনে হয়েছে। কিন্ত আগেই বলেছি, আমি বহু ভেবেই বইটার নামকরণ করেছি। ব্যাপার হচ্ছে একটা বই প্রকাশ হবার পর তা পাঠকপাঠিকার সম্পত্তি। একটা বইয়ের নানা রকম পাঠ থাকে। বই পাঠের পর পাঠকপাঠিকাদের আনন্দ বা আভিযোগ প্রকাশের এই তাড়না থেকে বুঝতে পারি, বইটা একটা অভিঘাত তৈরি করেছে। এই অভিঘাতগুলো আমার পরবর্তী লেখায় কাজে দেয়। আমার এক বন্ধুকে মজা করে বলছিলাম, চার প্রজাতির পাঠকপাঠিকার দেখা পাই। একদল কোকিল প্রজাতির। কোনো বই পাঠে যদি তাদের আনন্দ জাগে তারা সরবে সেই আনন্দের কথা চারদিকে জানায়। একদল আছেন প্রজাপতি প্রজাতির। তারা একটা বইয়ের কাছে আসেন শুধু মধু আহরণে। নীরবে মধু পান করে চলে যান আবার মধু না পেলেও কোনো উচ্চবাচ্য না করে চুপচাপ চলে যান অন্য ফুলে। আরেক ধরনের পাঠকপাঠিকা আছেন মশা প্রজাতির। তারা একটা বইয়ের কাছে আসেন শুধু কামড়বার জন্য। তারা পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টান ফাঁক খুঁজবার জন্য-কোথায় কামড় বসানো যাবে। আবার আছেন মৌমাছি প্রজাতির পাঠকপাঠিকাও, যারা যদিও মধুর খোঁজেই আসেন কিন্তু বিরক্ত হলে হুল ফোটাতেও ছাড়েন না।


শাহাদুজ্জামান : জীবনানন্দ-বিষয়ে বেশ কিছু ভাবনা, তথ্য, ‘একজন কমলালেবু’তে ব্যবহার করিনি। সেসব নিয়ে গল্প, ছোট নিবন্ধ লেখার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে।


শাহাদুজ্জামান : জীবনানন্দকে নিয়ে নানারকম লেখা তো অব্যাহত থাকবেই। একজন লিখেছেন বলে অন্য কেউ লেখা থামিয়ে দেবার তো অর্থ নেই। আমি যখন জীবনানন্দকে নিয়ে লিখতে শুরু করি তখন আমি দেখবার চেষ্টা করেছি অন্য কে তাঁকে নিয়ে কী লিখেছেন, কীভাবে লিখেছেন। আমার মনে হয়েছে, অন্যরা যা লিখেছেন তাতে আমার বলার কথাটা উঠে আসেনি। আমার নতুন কিছু বলার আছে এবং নতুনভাবে বলার আছে। এই ভাবনা থেকেই আমি ‘একজন কমলালেবু’ লিখেছি। নুতন কোনো লেখক যদি মনে করেন জীবনানন্দকে নিয়ে তার আরো নতুন কিছু বলার আছে, এ যাবৎ যা লেখা হয়েছে তাকে ছাপিয়ে আরো নতুন কিছু তিনি লিখবেন, নতুনভাবে লিখবেন, নতুন করে ভাবাবেন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি লিখবেন।




 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ নভেম্বর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়