ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ছোটগল্প || যে আলোয় আঁধার অধিক

নাহিদা নাহিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৩০ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ছোটগল্প || যে আলোয় আঁধার অধিক

|| নাহিদা নাহিদ ||

টিচার্স লাউঞ্জে মিটিং হওয়ার কথা, সন্ধ্যে শেষ হতেই এখানে চলছে জটলা। ডানে একদল, বাঁয়ে আরেকদল। চলতি সিন্ডিকেট সিলেকশন নিয়ে কথা হচ্ছে। এন্টিভিসি প্যানেল আটকাতে পারেনি নিয়োগ বোর্ড। আমি খেয়াল করে শুনলাম ওদের কারো কথায় নোমানের লাশ হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা নেই। ইকোনোমিক্সের দুজন মনের সুখে ক্যারাম খেলছে, আরেক পাশে এক অকৃতদার সহকর্মী অপর এক অনুঢ়া সহকর্মীর সাথে ভাববাচ্যে কথা চালাচ্ছে। তাদের চোখমুখ উজ্জ্বল, আমি বুঝতে পারছি মিটিংয়ের অ্যাজেন্ডা যাই থাকুক সহকর্মীদের বুদ্ধিজীবী সুলভ কর্মচাঞ্চল্য সন্তোষজনক। কে বলবে ক্যাম্পাসে বিশেষ জরুরি অবস্থা চলছে এখন। আমাকে দেখে চুপ হয়ে যায় ডান বাঁয়ের উভয় দল। ব্যাচেলর দুজন হাওয়া। আমি অন্ধকার সরিয়ে পা বাড়াই মাঠের দিকে। আসন্ন মিটিং আর টানছে না। রাস্তাঘাট ফাঁকা। শিক্ষক নিবাসের সাথেই লাগানো ছাত্রী হলটার পাশ দিয়ে হাঁটার সময় গা ছমছম করে। এই হলের ৪১৮ নম্বর কক্ষে ছিল জুঁই।

মাঠের দিকে হেঁটে যাবার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলি, রাস্তার পাশের বড় আম গাছটার গোড়ায় বসে থাকি। ভাল্লাগে না কিছু। সৃজির কচকচানি মুখটা মনে পড়ে, সৃজি আমার মেয়ে। খেতে বসলে সে কোথা থেকে যেন জ্যান্ত পোকা ধরে এনে মুখে পুড়ে দেয়, চিবিয়ে খায় কচকচ। ওসময় ওকে দেখলে যে কারো মনে হবে রাক্ষুসি হিড়িম্বা। তানিয়া মারে খুব, সেসব মারের দৃশ্য মাথায় গেঁথে থাকে অনেকক্ষণ। কেমন কেমন বিদঘুটে অনুভূতি। মনকে চিয়ার আপ করা জরুরি। তবলার বোলে ঠুমরি কনসেন্ট্রেট করি। এসব রাগাশ্রয়ী সুর ভুলিয়ে দেয় প্রহাররত তানিয়া, কচকচ করা সৃজি আর আধ হাত জিহ্বা বেড়িয়ে পড়া জুঁইয়ের মুখ। সময় সময় আইনস্টাইনের ভেংচিকাটা জিভ আর জুঁইয়ের ঝুলে পড়া জিভ কেমন একটা যৌথ অ্যালিগোরিক্যাল সিচুয়েশন তৈরি করে রাখে আমার মাথায়। দুটো ছবিই মিনিংফুল। বউ বাচ্চা বা প্রেমিকার এইসকল অস্বাভাবিক মিনিংফুল চিন্তার পাশাপাশি নতুন যুক্ত হয়েছে নোমান। কে বলেছিল ওকে এত সেনসেটিভ হতে। গত শীতে ছেলেটাকে একটা চাদর কিনে দিতে চেয়েছিলাম, দেব দেব করেও দেয়া হয়নি। আমি আলতো করে নিজের গায়ের কাশ্মিরি শালটায় হাত বোলাই। কী উষ্ণ, আরাম!।আচ্ছা মৃতদের কী শীত গরম আছে? নাই হয়তো। কাকে জিজ্ঞেস করা যায় শীতের প্রসঙ্গ! কিছুদিন পর হলে বাবাকে করা যেতো। ওনার এখন আটানব্বই চলছে । বেঁচে থাকলে আসছে ভাদ্রে আরো এক যোগ হবে। আমার ঘনিষ্ঠ মৃতদের মধ্যে বলতে গেলে জুঁই আর নোমান। ওরা নিশ্চয় বলবে না কিছু। এক সময় হাড়-হাভাতের মতো কবিতা লিখতাম, গান গাইতাম। ঈশ্বর-আল্লাহ, জীবন- মরণ এগুলো নিয়ে খুব ভাবতাম সেসময়। নিজেকে কেমন উচ্চ দার্শনিক মনে হতো, স্রষ্টাকে মনে হতো খুব কাছের কেউ। সেই যে পুলিশের ডলা খেলাম কেমন সুরসুর করে ছেড়ে দিলাম সব। ঠুমরির সাথে সাথে ডলাগুলোও রিক্যাপ করি মাঝে মাঝে।

- বান্ধবী নিয়া গল্প লেখা হইছে?

- না।

- উপন্যাস?

- না।

- কবিতা?

- না।

এরপর শক্ত ডান্ডার পোক্ত আঘাতের ঠান্ডা অনুভব। সাদা কাগজ আর রং পেন্সিলসমেত কুর্তি পরা লোকের পুনঃ আগমন।

- ছবি আঁকতে পারস হারামজাদা?

- না, পারি না।

- নে কাগজ, নে রং।

- ছবি আঁকতে পারি না।

- প্রবন্ধ পারস, ফিচার, কলাম, আইনস্টাইনের অংক?

- পারি না।

পেটের দু-ইঞ্চি নিচে লাথি-কি পারস তুই? লাগাইতে?

- লাগাইতেও পারি না।

- তাইলে মেয়েটা মরলো ক্যান ক?

তাইতো জুঁই কেন মরেছিল? কেন? আমি না জুঁইয়ের ছাঁ-পোষা তৃতীয় শ্রেণির প্রেমিক, ওর নোট পড়েই তো আমি ফার্স্ট ক্লাস সেকেন্ড হয়েছিলাম; তাহলে আমি কেন জানিনি জুঁই কেন মরলো!

- ওহ গড আপনি এখানে, যাক বাঁচা গেলো। আমি হোসাইন রায়হান ইনচার্জ ইন দিস লোকাল থানা। অফিসার তার হাতের কনুই পর্যন্ত বাড়িয়ে ধরে আমার দিকে।

হ্যান্ডশেক করি আমরা। সাদা পোশাকের পুলিশের দল ক্যাম্পাস টহল দেবে আজ, এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু কখন তারা আমার পাঁশে এসে দাঁড়ালো তা টের পাইনি কেন আজব!

- আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম। আপনি রশীদের জামিন চেয়ে এপ্লিকেশন করছিলেন। জাস্ট ফর ফরমাল এনকোয়ারি আমরা কথা বলতে এসেছি।

- ওহ ছেলেটার জামিন হয়েছে?

-এখনি দেয়া যাচ্ছে না স্যার। কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে ফোন এসেছে, বিষয়টা গুরুতর। শত হলেও আনোয়ার স্যার সরকার দলীয় শীর্ষ বুদ্ধিজীবীদের একজন। পলেটিক্যাল প্রেসার তো থাকেই।

- ও আচ্ছা। সমস্যা নেই, চলুন যাই আপনাদের সাথে। ছেলেটাকে দেখে আসি।

- থানায় যাবেন?

- হু চলুন।

আমি অসংকোচে অফিসারের পিছু নেই। আমি জানি নোমানকে নিয়ে তারা আমায় তেমন প্রশ্ন করবে না, করবে রশীদকে নিয়ে। নোমানের অতিরিক্ত আহ্লাদীপনায় অনেকেই জানে আমিই নাকি ওদের অলিখিত গড ফাদার। ওদের উজবুকি অথবা সাহসী আচরণের দায়ভার তো আমাকেই নিতে হবে। আমি অবশ্য জানি আমার কতটা বলা উচিৎ কতটা উচিৎ নয়।

ক্যাম্পাস সংক্রান্ত কঠিন ব্যাপারটাকে হাল্কা চালে নেয়ার চেষ্টা করি। ব্যাপারটা আমার ব্যক্তিত্বের সাথে সাংঘর্ষিক তবুও ইজি হওয়াটা জরুরি। সময় খারাপ। অফিসার আমার বয়সী প্রায়। আমি আলাপ জুড়ে দেই।

- জানেন অফিসার আমি কিন্তু একবার আপনাদের রিমান্ডেও ছিলাম তিনদিন-তিনরাত। হাজতেও কিছুদিন।

- ওহ তাই নাকি, ভুলে যান স্যার। বড় বড় ব্যক্তিত্বদের ওসব হয়ই, পলেটিক্যাল ইস্যু নিশ্চয়?

অফিসারের না-জানা অভিব্যক্তিতে আমি মুগ্ধ, হাসি একটু। এরা আমার বিষয়ে পূর্বকার হোমওয়ার্ক না করেই এখানে এসেছে-এও হয়।

- না না শুধু পলেটিক্যাল নয়, প্রেমঘটিত ব্যাপার-স্যাপার।

- হা হা হা তাই নাকি, ভালো ভালো।

কথা আর এগোয় না।


আচ্ছা পুলিশের সাথে এসব হালকা প্রসঙ্গের আলাপ- সালাপ ওপার থেকে খেয়াল করে হাসছে না তো জুঁই? একসময় মেয়েটা যথেষ্ট রসিক ছিল। অনার্স পর্যন্ত ক্লাসে ফার্স্ট, আমি সেকেন্ড। ভাগ্যিস ও মরেছিল, না হয় এ ক্যাম্পাসে হয়তো আমার এসকল বিদ্যাদানের চাষবাস কিছুই হতো না৷ আমি কৃতজ্ঞ। নোমানের মৃত্যুর পর আজকে কেন যেন বারবার জানতে ইচ্ছে করছে কেমন আছে জুঁই? বেঁচে থাকলে ও কী আমার প্রিয়তমা স্ত্রী তানিয়ার মত মুগডাল রাঁধতো প্রতিদিন। আমি জানি না আমার মেয়ে সৃজি বড় হলে কার মতো হবে তানিয়া নাকি জুঁই! আমার প্রতি তার কি এখনো খুব রাগ- ‘চাকরিটা আমার খুব প্রয়োজন ছিল জুঁই, খুব, মাপ করে দিও কিছু মনে করো না।’

- স্যার ছেলেটা বলছে ছাড়া পেলেই সে আনোয়ার স্যারের চ্যালা পলাশ মাহবুবকে খুন করবে।

- তো, করুক না, এমনিতেও তো পলাশ কোনো না কোনোদিন মরবেই, তো রশীদের হাতেই মরুক। নোমানতো মরে গেলো নিজে নিজেই। উঠতে বসতে ওকে আর যন্ত্রণা করার সুযোগ নেই পলাশদের। এমন পানসে জীবন নিয়ে বেঁচে থেকে কী লাভ!

- ঠাট্টা করছেন স্যার? ছেলেটার কিন্তু একটা ইমেজ আছে। এই অপমানকর পরিস্থিতির কারণে তাকে হাজার রকম টিটকিরি, টিপ্পনি সইতে হচ্ছে, বিষয়টা ভালো দেখাচ্ছে না। পলাশ চাইলে ওকে ক্যাম্পাসের মাটিতে স্রেফ হাওয়া করে দিতে পারতো, স্রেফ হাওয়া।

-দেয় নি কেন? না করেছে কে?

- কেউ করেনি। এমনি মিডিয়ার যে লেজেগোবরে অবস্থা, পত্রিকা পলাশের বিরুদ্ধে লিখছে তো, কোনো কোনো পত্রিকা অবশ্য রশিদের।

- হু এর মাঝে নোমান ইস্যু ধামাচাপা পড়ে যাক অফিসার কি বলেন, ভালোই হয়, রশীদ আর মাহবুবের আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ পর্বটা বাদ দিলে পানসে একটা সুইসাইড কেস পাবলিক তেমন একটা খাবে না।

- যাই বলেন স্যার আপনার ছেলে কিন্তু বামদের সিমপ্যাথি পাচ্ছে খুব। পলাশ হসপিটালে ছিল দুদিন।

- পলাশওতো আপনাদের সিমপ্যাথি পাচ্ছে খুব, নোমানের চেয়ে পলাশ ইস্যু আপনাদের কাছেওতো কম না দেখছি। বামদের চেয়ে পুলিশের সিমপ্যাথি অনেক কাজের অফিসার। শুনেছেন হয়তো এর মধ্যে হল দখলে নেমেছে আন্ডারগ্রাউন্ড! আমার ছেলেরা মাঠেই নামতে পারে না। লাশ পড়বে বলে।

আমার শক্ত কথায় কর্তব্যরত অফিসার একটু ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। এই তো কিছুক্ষণ আগেই কেমন ইজি মুডে ছিলাম। প্রেম সক্রান্ত হাসাহাসিও চলছিল।

আমি সেধে সেধেই কথা বাড়াই-একটা কাজ করুন না অফিসার, আমার ছেলেটাকে আপনারা রিমান্ডেই রেখে দিন। ভালো মত কড়কে দিতে পারলে অনেক কিছু হবে। ওর মুখ বন্ধ হয়ে যাবে চিরতরে, হাত চলবে না, পা চলবে না, বেশ ভালো হবে।

পুলিশের উপর পুরনো রাগটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কেন যে আমার স্মৃতিশক্তি এত প্রখর! লোকে এখন আমায় এমনিতেই একটু অন্যরকম ভাবে। ভাবে প্রতিশোধপরায়ণ ক্রিমিনাল মাস্টার মাইন্ডেড, অথচ আমি এমন না। এক পলাশ মাহবুব গ্যাং আর তার গড ফাদারেরা আমাকে কেমন পলিটিকাল এন্টি হিরো বানিয়ে দিচ্ছে। আমার অনুষদের ডিন আমাকে যমের মত ভয় পান, তার ধারণা গতবারের জনবল নিয়োগের সময় নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগে জিওগ্রাফির বিভাগীয় প্রধান সাবেত মনোয়ারের চাকরি যাওয়ার পেছনে আমার একটা গোপন হাত আছে। অথচ আমি মানুষটা নিরীহ, যথেষ্ট সহনশীল, মিষ্টভাষী এবং শান্ত। তবে কথা সত্য ক্যাম্পাসে বলতে গেলে ভিসির পরে আমিই এখন অলিখিত সংবিধান। সে হিসেব আলাদা। সমস্যা ঐ একটাই আমার ম্মৃতিশক্তি ভালো, আমার ভুলে যাওয়া রোগ নেই একদম। আমার হাসি পায় একটু। আনোয়ার কবীর লোকটার এলেম আছে তার চেলা চামুন্ডাদের জন্য আমি মানুষটাও রাজনীতিতে ভালোই ফুটেজ পাচ্ছি । তৎকালীন প্রোক্টরের কোলের কাছের মানুষ হয়েও সাবেত মনোয়ার কিছুই করতে পারেনি। হারামজাদা সাবেত! আমি আজো জানি না জুঁই আর সরওয়ার স্যারের গোপন ঘনিষ্ঠ দৃশ্য কেমন করে পৌঁছে গিয়েছিল ইউজিসির চেয়ামম্যান অব্দী। আর কী না দোষ পড়লো আমার ঘাড়ে! আহা আমি কেমন করে অস্বীকার করবো সেই সাবেত মনোয়ারের দান। তার কল্যাণে পাওয়া গারদে কাটানো তিন তিনটা মাস! জুঁইয়ের ঝুলে পড়া লাশ, তার আধ হাত জিহ্বা। আমি অদৃশ্যে কোথাও থুতু ফেলি চিবিয়ে। পারলি হারামজাদা তোরা শেষকুল রক্ষা করতে? পারলি না। আমি নিজেকেও একটা গালি দেই জোরসে ‘কুলাঙ্গার তুইও কেন কিছু করতে পারিস নাই, নাকি তুই চাসই নাই কিছু হোক। জুঁই মরে গেলো মুহিত সরোয়ারের চাকরি গেলো, সেই কতবছর পর আবার নোমান! এরপর, এরপর কে? কুলাঙ্গার তুইই মৃত্যুর ফেরিওয়ালা।’

একথা সত্য সাবেত ভায়ের পেয়ারের প্রক্টর ভবিষ্যতে যে আমার শ্বশুর হবে একথা উনি নিজেও বুঝতে পারেননি। আমার চেহারা যথেষ্ট নির্বোধ এবং কেবলাকান্ত সদৃশ। আমার দুর্দান্ত চেহারা অনুমান করা এত সহজ নয়। এই চেহারায় জুঁইয়ের মত সুন্দরী মেধাবী ছাত্রীর পার্ট টাইম প্রেমিক হওয়া যায়, দালাল হওয়া যায়, জুইয়ের গোপন ভিডিও পকেটে নিয়ে হা হুতাশ করা যায়, ডাকসাইটে বুদ্ধিজীবী? অসম্ভব।

সৃজার জেদ কিছুটা জুঁইয়ের মত। বয়স কত হলো ওর? সাড়ে সাত নাকি আট নাকি আরো বেশি। আমি প্রায়ই ভাবি এই গিরগিটির মতো চড়ে খাওয়া জীবন থেকে সৃজাকে সরিয়ে নেব দূরে। তানিয়া কি পারবে না গ্রামের পরিবেশে একটু মানিয়ে নিতে। ক্যাম্পাসের আন্তঃবিভাগীয় কোন্দল বনাম আন্তঃপারিবারিক ভিলেজ পলেটিক্স! কোনটা কঠিন? নাহ নিজের অস্তিত্ব লুকানোর জন্য আরো দুটো অপশন বেশি থাকলে ভালো হতো। এক্ষেত্রে আত্মহত্যা কোন সমাধান নয়, জুঁই বোঝেনি আমিতো বুঝি।

থানার দরজায় পৌঁছে দেখি এখানেও আমার প্রিয় সেই আনোয়ারের স্যারের ডানহাত মঈনুদ্দিন সরকার চেয়ারে বসে আছেন। এই লোকটা ফেডারেশনের সিলেকশনে পরপর দুবার পদ পেয়েছেন আনোয়ার স্যারের দয়ায়। নাহ এদের এলেম আছে দেখছি। এরা ল্যাং খাওয়া মানুষ না, ল্যাং দেয়া মানুষ। সব জায়গায় আগেই প্রস্তুত হয়ে থাকে। আমার ভেতরটা ফেটে যায়। ক্রোধ না কি যেন এক অনুভূতি । তবুও আমি তার দিকে তাকিয়ে আন্তরিক হাসি বিনিময় করি। আমি জানি আমার অবচেতন মন এখুনি আমাকে খেকিয়ে উঠবে ‘শালা তুই একটা পোলিশড কুত্তা। একটা আস্ত হারামজাদা। তোরই হাঁ করা জিহ্বার জন্য এদের দেখলেও তোর মুখে হাসি ফোটে।’

নোমান আমার প্রিয় ছাত্র ছিল, আমি রাজনীতি বুঝি কম তবু ক্যাম্পাসে আমার দাপট বা সাপোর্টের জায়গা অন্য দিকের। জুঁই মরে যাওয়ার পর হঠাৎ কী হলো আমার বর্তমান শ্বশুর যার জন্য তার অপজিট প্যানেলের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী সরওয়ার স্যারের চাকরি গিয়েছিল তিনি আমার কাঁধে হাত রাখলেন, স্নেহের হাত, আমি তখনও বুঝিনি শত্রু কেমন করে মিত্র হয়ে যায়, মিত্র হয়ে যায় শত্রু। ক্যাম্পাস রাজনীতিতে হয়তো সবই সম্ভব। যাই হোক আমি উঠে দাঁড়ানোর সিঁড়িটা কাজে লাগিয়েছি। যত্ন করে লবিং শিখেছি। তানিয়াকে বিয়ে করে মুগডাল দিয়ে ভাত খাই রোজ, ভুলে যেতে চেয়েছি আমার পিঠে হাত রাখা মানুষগুলোর জন্যই জুঁই আজ ছবি হয়ে গেছে, স্মৃতি হয়ে গেছে। আমি জুঁইয়ের চিন্তা মাথা থেকে সরাই। ওই যে দাঁড়িয়ে আছে মঈন সরকার- ও কি চায় আমার? নোমানের জীবনের দুই দুইটা সেমিস্টার নষ্টের পেছনে এই লোকটার ভূমিকা অসীম। লোকটা জায়গামত বাঁশ দিতে দিতে ছেলেটাকে ওপাড়েই পাঠিয়ে দিলো। প্রতিটা কোর্সে টপ স্কোরার নোমান শুধু তার এবং তার সংশ্লিষ্ট বিশেষ দুই একজন দ্বারা লোয়েস্ট পেতে পেতে হাঁপিয়ে উঠেছিল ছেলেটা। মঈনের ভাবটাই এমন কত বাঘা বাঘা প্রফেসর গেলো তল, তোর মত পুচকে ঘাড়ত্যাড়া নোমানের আর কত জল! আর ঘুরবি লবিংবাজ কালসাপ প্রফেসরদের পিছু? এরা সামনে থেকে আমায় আঘাত করার ক্ষমতা রাখে না বলেই এত কূটকৌশল। যাক সেসব! যেদিন নোমান হত্যার বিচারে এদের সব কয়টার কোমর ভাঙবো সেদিন বুঝবে কে আমি। হ্যা আমি কাল সাপ। একযুগ মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকবে না তোদের এই আমি বলে রাখলাম। এখন আর আমি সেই আল বাল ছাল লেখা রোমান্টিক কবি নই, প্রফেসর, একজন ফুল প্রফেসর। আমার মুখে থুতু জমে ওঠে। সরকার ভাই আমার ঠোঁটের ঝুলিয়ে রাখা দ্বৈতয়িক হাসিকে উপেক্ষা করে ওপাশে মাথা গুঁজে বসে থাকা ছেলেটার ঘাড়ে হাত রাখেন, ওর চোখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন- রশিদ ভালো আছো?

ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম ওর জামিনের জন্যই এসেছিলাম আমি। এই তো আমার সেই হারুনুর রশিদ, বাগদাদের পঞ্চম আব্বাসীয় খলিফা!

রশিদ নোমানের রুমমেট। আমাকে ওর লোকাল গার্ডিয়ান বানাতে নিয়ে এসেছিল ওকে। রশিদ ছাত্র রাজনীতি করা শক্ত নেতা, আনোয়ার স্যারেরও প্রিয়। আমাকে প্রথম প্রথম তেমন একটা পছন্দ করতো না ও। রশিদই নোমানকে বলেছিল-ও যেন আমার সঙ্গ ছেড়ে দেয় তাহলেই ফ্যাকাল্টি টপার হওয়া ওর জন্য কোনো ব্যাপার না৷ নোমান শোনেনি। এমনকি রশীদকেও টেনে এনেছিল এদিকে। কোন একটা বিচিত্র কারণে রশীদ নোমান নোমান করে পাগল হয়ে থাকতো, পলাশ মাহবুব গ্যাং যখন নোমানকে ফাইনাল পরীক্ষার আগের রাতে হলে স্টেপ করলো, আমজনতার সামনে চোর অপবাদে পেটালো সেদিন আর রশীদ সহ্য করতে পারেনি। তারপরের রক্তারক্তি কাণ্ড সকলের জানা, পলেটিক্যাল হ্যারাসমেন্ট, থ্রেট থেকে বাঁচতে শঙ্কিত, আতঙ্কিত নোমান আনাড়ির মতো ঝুলে পড়লো ফ্যানে। নোমানের সেই শঙ্কিত মুখ মনে করে এই শীতের রাতে রশীদকে দেখি আরেকবার। ছেলেটা এই শীতের রাতে কাঁপছে না ঘামছে বুঝতে পারি না।

- প্লিজ ছেলেটাকে একটা গামছা বা তোয়ালে টাইপের কিছু একটা দিন। ছেলেটা কাঁপছে ঠান্ডায়।

অফিসার অথবা গারদের দুটো কনেস্টেবল কেউ নড়ে না। সকলের চোখই নির্লিপ্ত, গুরুত্বহীন। আমি আমার নিজের গায়ের চাদরটা জড়িয়ে দেই রশীদের কাঁধে। ওর কেটে যাওয়া ছড়ে যাওয়া হাতে পায়ে ক্ষতে আঙুলে মমতার হাত বুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করি একটু, রশীদ তাকায় আমার দিকে গাঢ় চোখে। কেন জানি না আমার বুকের ভেতরটা শিরশির করে, আমি তৎক্ষণাৎ চোখ সরিয়ে নেই ! আমি জানি রশীদের খুনের ইচ্ছে প্রবল, এবং কোন না কোন একদিন এ ইচ্ছেয় সে সফল হবে, আমি চুপ করে ওর পাশ থেকে সরে আসি সম্ভ্রম বাঁচিয়ে। জেল থেকে বের হয়ে প্রথম কী সে আমাকেই ধরবে? নোমানকে তো যেতে হলো আমার দলীয় কোরাম করার অপরাধেই।

নোমানের মুখে আমি রশীদের গল্প শুনে আৎকে উঠতাম। ছেলেটা যেন কেমন! ক্যাম্পাসে কয়েক জনকে সে নাকি খুনের হুমকি দিয়ে রেখেছিল অযথাই। ও নাকি পাওয়ার পলেটিক্সও করতে চায় কটা লাশ ফেলার গোপন ইচ্ছা পূরণের আশায়। বলে কী! এই খুনে ছেলের প্রসঙ্গে আমি কতবার যে বোঝাতাম নোমানকে তার ইয়াত্তা নেই। বলতাম, ওকে ডাক্তার দেখাও না কেন নোমান?

আমার শঙ্কায় নোমান হাসতো, বলতো স্যার কজনকে ডাক্তার দেখাবেন আপনি। ধরতে গেলে ক্যাম্পাসের আশিভাগ ছাত্র ছাত্রীই এমন অসুস্থ, কত কত খুনে ইচ্ছে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা । পড়ালেখায় ভালো হলে অসুখ করে, খারাপ হলেও। এখানকার সিস্টেম ওদের শিখিয়ে দেয় ক্ষমতার আত্মীকরণ অথবা অসহায় আত্মসমর্পণ। পরীক্ষায় পাশের মাধ্যমে যারা একটু প্রথম সারির ছাত্র হয়ে ওঠে তারা রং চড়িয়ে শিক্ষক হবার স্বপ্ন দেখতে দেখতে হয়ে যায় অসুস্থ। বোঝেই না তারা কেমন করে হয়ে উঠছে তাদের নিয়ে করা ব্যক্তি রাজনীতির অংশ। নির্দিষ্ট ব্যক্তি কর্তৃক ক্রীতদাসত্বেও তারা খুশি। কিছু কিছু অযৌক্তিক প্রশ্রয়ে শুরু হয় অপ্রকৃতিস্থ দাম্ভিকতা চর্চা, একেকজন হয়ে ওঠে ঈশ্বরের মতো অহঙ্কারী। আর বাদ বাকীরা মগজে করে ওই বিশেষ সুবিধাপুষ্টদের খুনের ইচ্ছে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় অসহায়ের মতো। তাদের দাঁত নেই, চোখ নেই, মাথাও নেই। তবু তারা মগজে খুনী। কাকে আপনি ডাক্তার দেখাবেন স্যার!

এত কথার মাঝে আমার অপরাধী মন ভুলেও মনে করতে চাইতো না জুঁইয়ের মুখ। আমি কি করেছি কিছু? জুঁই আর সরওয়ার স্যারের ভিডিও আমি ফাঁস করিনি, আমার কাছে ছিল এটা সত্য। তবে ক্যাম্পাসে থেকে সরওয়ার স্যারের বিতাড়িত হওয়ার ঘটনায় পলেটিক্যালি লাভবান হয়েছিলেন আমার বর্তমান শ্বশুর তৎকালীন প্রক্টর শহীদ আকন্দ। তিনিই এখন ক্যাম্পাসের লিখিত ঈশ্বর, আর আমি অলিখিত। জুঁইকে আমি নিশ্চই ব্যবহার করিনি। তবু কেমন হয়ে গেলো ব্যাপারটা। আচ্ছা জুঁইকে কী আমি অসম্ভব রকম ভালোবাসতাম! কী জানি হয়তো হ্যাঁ, হয়তো না।

- স্যার ছেলেটা বলছে জামিন চায় না সে, কেমন ঘাড়ত্যাড়া দেখেন। এখন ওর বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানাটা জরুরি। যেহেতু আপনিই ওর লিগ্যাল অথরিটি।

- ওর অথরিটি হওয়ার মতো আর কেউতো নেই অফিসার। ওকে বরং আপনারা ভূয়া নাম পরিচয়ে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেন, ল্যাঠা চুকে যাক। এসব সৎ ছেলেপুলে বেঁচে থাকা রিস্ক। ও মরে গেলে আপনারা বাঁচবেন, আমিও।

- আপনি আবেগে রেগে যাচ্ছেন স্যার! আর পাশার দানে যখন কারসাজি থাকে তখন কোন পক্ষ সৎ, কোন পক্ষ অসৎ বিচার করা মুশকিল ।

- হা হা হা হাসালেন ওসি সাহেব হাসালেন, আমার কমিউনিটির সকলে জানে আমি ঠান্ডা মাথার মানুষ, রাগি কম। কারসাজি কী তাই তো বুঝি না! যাক ওসব ঘোরপ্যাঁচের কথা। তিনদিন আগে মধ্যরাতে যখন ওদের হলে নোমানের উপর নির্যাতন হলো নোমান লজ্জায় ভয়ে ঝুলে পড়লো ফ্যানে তখনো আপনারা কোথায় ছিলেন? যখন মৃত নোমানের দম আছে এই বিশ্বাসে ছেলেটা চিৎকার করছিল, এম্বুলেন্স এম্বুলেন্স বলে তখনও আপনারা যাননি কেন আসামী খুঁজতে? আপনাদের চোখের সামনে পলাশের দল তাণ্ডব চালালে আপনারা কিছুই দেখেন না, কিন্তু ঠিক যখন এই অর্ধ উন্মাদ ঘাড়ত্যাড়া ছেলেটা প্রিয় বন্ধু, একমাত্র সুহৃদ রুমমেটের জান বাঁচানোর জন্য কামড়ে ধরলো ছাত্র নেতার পা তখনই আপনারা তুরুপের তাসের মত অপরাধী পেয়ে গেলেন, বিরোধী দলের এজেন্ট পেয়ে গেলেন। কী করেছিল রশীদ তখন?

কষে একটা লাত্থিইতো দিয়েছিল পাতিনেতার অণ্ডকোষ বরাবর, ওসব সোনার ছেলেদের যৌনাঙ্গ সুস্থ থাকলে লোকে ভয় পাবে, অসুস্থ থাকলেও। মাঝখানে আমার ছেলেটা লাথিমারার মতো শখটুকুও পূরণ করতে পারবে না! আশ্চর্য!

- স্যার আপনি পুরোপুরি ইমোশনাল হয়ে গেছেন। রশিদ গোয়েন্দাদের অবজারভেশনে আছে তদন্ত শেষের পথে, কমপ্লেইন উইথড্র হলেই ওকে নিয়ে যেতে পারবেন।

- নাহ তার দরকার নেই, আমি বরং আপনাদের কাছে আরও একটা অনুরোধ করে রাখছি, রাখবেন?

- বলুন?

- ওকে আপনারা জেলেই রাখুন প্লিজ, কারণ না পেলে নোমানের আত্মহত্যার প্ররোচক হিসেবেই রাখুন। ছেলেটার বড় শখ ছিল খুন করার। নোমানের আত্মহত্যা তো খুনের মতই। প্লিজ ওসি সাহেব আপনি ওর একটা শখ পূরণ করুণ। কী করবেন তো? আমি অফিসারের হাত চেপে ধরি।

অফিসার কথা বলে না, চোখ নামিয়ে রাখে ৷ আমি চোখে মুখে পরাজয়ের হতাশা নিয়ে উঠে দাঁড়াই। এই রাত করে আমাকে আবার ক্যাম্পাসে ফিরতে হবে। পুলিশের গাড়ি পৌঁছে দিতে চায়। আমি রাজি হই না। এখন আমার একা থাকা জরুরি। এ ক'দিনে আমার অনেক কাজ! ঘরের মিউট করা টিভির চ্যানেল পাল্টাতে পাল্টাতে সব গোছাতে হবে। সামনে পরিষদের নির্বাচন। পরিষদ এবার আমায় সেধেই সভাপতির নমিনেশন দেবে হয়তো। ঠিকঠাক চাল দিতে পারলে নোমানের আত্মহত্যায় আনোয়ার স্যারের গ্রুপ ফেঁসে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তিনিই গোপনে গোপনে ভবিষ্যৎ ভিসি হওয়ার সুখ স্বপ্নে বিভোর। এখনকার এক্টিভিটিজ ঠিক করবে পরবর্তী সময়ের হাল হকিকত। ঘোলা জলের মাছ কোন দিকে যায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। আমার ভাল্লাগে না এসব ভাবতে। আমার বুকের ভেতরে কোথায় যেন বাজে দীর্ঘশ্বাস, অন্ধকারে হাঁটছি একা। দীর্ঘপথ হেঁটে এসে আমি মেয়েদের হলটা আবার দেখতে পাই। চাঁদ হেলে আছে। চাঁদটাকে কেমন যেন রোগা লাগে একটু, এর অসুখী মুখ ঘোলা আয়নার মতো। কেমন দুঃখ জাগে মনে। নোমানকে একটা কাশ্মিরী শাল কিনে দিতে চেয়েছিলাম। দেয়া হয়নি। আমার ভালো লাগে না চাঁদ। বহুবছর পর আবার বিড়বিড় করে আওড়াই স্মৃতির কবিতা-

‘গভীর অন্ধকারের ঘুমের আস্বাদে আমার আত্মা লালিত;

আমাকে কেন জাগাতে চাও?

হে সময়গ্রন্থি, হে সূর্য, হে মাঘনিশীথের কোকিল, হে স্মৃতি,

হে হিম হাওয়া,

আমাকে জাগাতে চাও কেন?’

নাহ জেগে ওঠাটা কাজের কিছু না৷ জেগে থাকার পথ কঠিন। বৈতরণীর থেকে তার অর্ধেক ছায়া যদি সরে যায় তো যাক। আমার পাণ্ডুর গায়ে আর কোনো আঁচ নেই, কলঙ্ক নেই, আমি পরাজিত নই। মানুষ জনম একবারই আসে৷ আমি ভুল করেও দেখতে চাই না আমার ক্ষয়ে যাওয়া অসুখী মুখ। আমি সুখী, আমার সেই সুখের বিষাদী মুখে তবু কেন অনুভব করি জিভের নোনতা স্বাদ!

আমার তো ভাগ্যই বলা যায়, ক্যাম্পাসে এক একটা আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে আর আমার কপাল ফিরে যায়, কেন এমন হয়? কি জানি জানি না। চাঁদের আলোয় আমার ছায়া পড়েছে। আমি ছায়া দেখি। ছায়ার আমিটাকে মনে হচ্ছে আস্ত হাঙর, একে একে গিলে খেয়েছি জুঁই আর নোমানের মতো কত প্রিয় মুখ। বাঁচাতে পারিনি কাউকে। কীভাবে বাঁচাবো আমি, আমার কী বা ক্ষমতা! মনে পড়ে গত সকালে সৃজির জীবন্ত পোকা চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য, কচকচ। আমি জানি, আমি নিশ্চিত জানি সৃজি আমারই ঔরসজাত সন্তান। যা-ই পায় বা খায় হজম হয়ে যায় সব।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়