ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঈদ সাহিত্যের সামাজিক সংস্কৃতি || সাখাওয়াত টিপু

সাখাওয়াত টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৩, ২ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদ সাহিত্যের সামাজিক সংস্কৃতি || সাখাওয়াত টিপু

মুসলমানের বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। কিন্তু বাঙালির জীবনে ঈদ শুধু মুসলমান সমাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আনন্দের এই মহাসম্মিলন মুসলমানদের পাচিল ডিঙিয়ে নানা ধর্মীয় সম্প্রদায় আর মানুষের ভেতর উৎসবমুখর সংস্কৃতির সৃষ্টি করে। ঈদ নিছক পোষাকি ব্যাপার নয়। এটা জনসংস্কৃতিকে একীভূত করার প্রথা। একথা সত্য, প্রথাগত এই সংস্কৃতির বাতাবরণ সম্প্রদায়গত সম্প্রীতির অর্গল খুলে দেয়। তাই ঈদ মহামিলনের এক ঐতিহাসিক সংস্কৃতি। ঈদের সংস্কৃতির দুটো প্রধান দিক আছে। একদিকে একমাস সিয়াম বা সংযম সাধনার ভেতর আত্মিক শুদ্ধির ধর্মীয় সংস্কৃতি। আরেকদিকে ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে। দুটো প্রধান সংস্কৃতির দিকের বাইরে ঈদ বাঙালি মুসলমান সংস্কৃতির অপর দুয়ার খুলেছে। সেটা কী? শিল্প-সাহিত্যকে ঈদের সংস্কৃতির অঙ্গ করে তুলেছে।

এখনকার ঈদে নতুন পোষাকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দৈনিক পত্রিকাগুলোর ঢাউস ঢাউস ঈদ সংখ্যা। ঈদুল ফিতরের আগে সারাদেশে অসংখ্য ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বিগত তিনদশক ধরে নতুন এই সংস্কৃতি বাড়তি সাহিত্যানন্দের যোগান দিয়েছে। দৈনিক পত্রিকাগুলোর তত্ত্বাবধানে সাহিত্য-শিল্প-সংস্কৃতি বিষয়ক বিশেষ ঈদ সংখ্যা চোখে পড়ার মতো। এটার প্রধান কারণ ভিন্ন। দৈনিকের শুধু বিজ্ঞাপন-নির্ভর অর্থনীতি প্রধান কারণ নয়। এমনিতেই সারাবছর কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ আর শিল্পের নানা ছোট ছোট রসদ ছাপা হয়। তারপরও কেন ঈদ সংখ্যা? দৈনিকের সাময়িকীগুলোর প্রধান সমস্যা উপন্যাস, আত্মজীবনী, দীর্ঘ প্রবন্ধ, দীর্ঘ ভ্রমণ কাহিনী আরও দীর্ঘ দীর্ঘ অপর ভাব-সম্প্রসারণ ছাপার সঙ্গতি করতে না পারা। দৈনিকের এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টাই হলো ঈদ সংখ্যা।

সত্যিকার অর্থে আমাদের দেশে ভালো সাহিত্য পত্রিকা নেই। নেই এই অর্থে, যেটাকে কেন্দ্র করে সাহিত্যের বিশেষ প্রবণতার প্রসার কিংবা লক্ষণগুণ পরিলক্ষিত হয়। আর যাকে কেন্দ্র করে শিল্প-সাহিত্যের বিস্তার ঘটবে। প্রায় সতেরো কোটি মানুষের দেশে শিল্প-সাহিত্যের অনেক পত্রিকা থাকা দরকার ছিল। কিন্তু সেটা নেই। দুয়েকটা যা আছে, কদাচিৎ ভালো লেখা দেখা যায়। আমরা সাহিত্যের উপযোগহীন সময়ে বাস করছি। তদুপরি আছে শ্রেণী বিভক্ত সমাজ। সম্পদের বৈষম্য তো আছেই। আমরা যে পুজিবাদী সমাজ কাঠামোর উন্নতির কথা বলি তাতেও মস্ত একটা ফাঁকি আছে। কারণ আমাদের সংস্কৃতির পাটাতন কোথায় প্রস্ফূটিত হবে, সে ব্যাপারে কর্ণপাত করতে পারিনি। না পেরেছে বুর্জোয়া শ্রেণী, না পেরেছে মধ্যবিত্ত সমাজ! আমরা হয়তো দাবি করতে পারি, আমাদের সাহিত্য বিশ্বমানের। সে দাবি কতটুকু সত্য? কিন্তু বিশ্ব চরাচরে আমাদের সাহিত্যে পরিসর নাই বললেই চলে। মানুষের বস্তুগত জীবনের বাইরে সাহিত্য আমাদের আত্মীক আর বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসর সৃষ্টি করে। আমাদের সেই পরিসর খুবই ক্ষীণ। নিছক জাতীয় বুর্জোয়া সমাজ ব্যবস্থার কথা চিন্তা করলেও সেই দৃশ্যমান চেহারা দেখা যায় না।  আমাদের আর্থিক প্রবৃদ্ধি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু বাড়েনি শিল্প-সাহিত্যের সাংস্কৃতিক মান। অথবা এমন হতে পারে, সমকালীন ভালো বা মহৎ সাহিত্যকে বিশেষভাবে পারিনি। অথচ প্রবৃদ্ধির সূচকে আর্থিক সমৃদ্ধির সমান্তরালে থাকার কথা মানসসম্পদের সাহিত্যের সংস্কৃতিও। সেটা কি আছে?

প্রথাগতভাবে দৈনিকের সাময়িকীগুলো গৎবাঁধা তিন-চারটে কবিতা, একটি গল্প আর এক কিংবা দুটি প্রবন্ধ ছেপে দায়িত্ব পালন করে। কদাচিৎ দুয়েকটা ভালো লেখার সন্ধান মেলে। যাও চোখে না পড়ার মতো। এমন নয় যে আমাদের সাহিত্যের চিন্তাশীল লেখকের সংকট। যদি সংকট থেকেও থাকে, তাতে সম্পাদকের লেখক আবিষ্কারের যে আনন্দ সেটা থেকে বঞ্চিত হন বৈকি! আর সাহিত্য সমালোচনা তো একদম নেই বললেই চলে। পত্রিকার সাময়িকীগুলো এই সংকট কাটিয়ে উঠবে কিনা বলা মুশকিল! কিন্তু রোজার ঈদকে কেন্দ্র করে বড় আকারে বিশেষ ঈদ সংখ্যায় নানা লেখকের সন্নিবেশের গুণগত বৈশিষ্ট্য লক্ষ্যণীয়। সংখ্যাগুলো উপন্যাসসহ দীর্ঘ লেখা প্রকাশের সুযোগ করে দেয়। এমন কি আমাদের প্রকাশনা শিল্প পাণ্ডুলিপি সরবরাহের প্রাক-প্রস্তুতিও বলা যেতে পারে ঈদ সংখ্যাগুলো। সেই দিক থেকে বই আকারে প্রকাশের আগে বোঝা যায় আগামী বইমেলায় কি ধরনের প্রকাশনা সামনে আসছে। এমন নয় যে, ঈদ সংখ্যায় যা ছাপা হয়, তা দিয়েই প্রকাশনা শিল্প টিকে আছে! অনেক লেখক আছেন যারা ঈদ সংখ্যায় লিখেন না। তবে ঈদ সংখ্যায় সাহিত্যের নানা ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলোর দৃশ্যপটের দেখা মেলে!     

ঈদ সংখ্যা কি সাহিত্যের সমষ্টিগত চেহারা? না, তা নয়! কারণ বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যার দিক থেকে ঈদ সংখ্যায় যা ছাপা হয় তা বড়ই অপ্রতুল! এবং পরিমানগত দিক থেকে ক্ষুদ্রতম বটে। সত্য এই, অতো বড় আকার আর সামর্থ পত্রিকাগুলোর নেই। কিংবা পত্রিকাগুলোর কাজ সেটাও নয়। অন্যকিছু! বইমেলায় প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যার তুলনায় তা সামান্যই বটে। এতো গেল সংখ্যার দিক! কিন্তু গুণগত দিক থেকেও বইমেলায় প্রকাশিত ভালো বইয়ের সংখ্যা অধিক হবে। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়। ভালো কি অর্থে? গত কয়েক বছরে দেখা গেছে, বইমেলায় গুণগতমানের আলোচিত বই ঈদ সংখ্যাগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে খুবই কম। কিংবা বেশির ভাগ আলোচিত বই ঈদ সংখ্যায় ছাপাও হয়নি। তাহলে প্রশ্ন আসে, ঈদ সংখ্যাগুলোতে কি বিশেষ সাহিত্য ছাপা হয়? তার ভেতর দিয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রবণতাকে সনাক্ত করা যায়? কিংবা সংখ্যাগুলো সাহিত্যের সামগ্রিক চেহারা স্পষ্ট করে কিনা?

আমরা মোটাদাগে কিছু সংকট চিহ্নিত করতে চাই। সংকটের কারণ খতিয়ে দেখলে উত্তরণের পথও পাওয়া যাবে। প্রথমত, প্রতিটা ঈদ সংখ্যা দেখলে মনে হবে, দৈনিকের সাময়িকীর মতো ঈদ সংখ্যাগুলো নানা কোটারিতে ভাগ হয়ে আছে। এমন নয় যে, এমন বিভাজনের ভেতর উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো কোনো লেখক মহাসমারোহে পাঠকের সামনে হাজির হচ্ছেন। কিংবা লেখাটাই লেখকের নতুন আইডেন্টিটি তৈরি করছে। অথবা সম্পাদনার উপস্থাপনায় প্রকাশিত একটা ভালো লেখা পাঠকের নজর কাড়ছে। ছাপা হওয়া কোনো লেখা তুমুল আলোড়ন তুলছে। আমাদের পাঠক সমাজে তা কস্মিনকালে দেখা পাওয়া বিরল ঘটনা। বরং দৈনিক পত্রিকার সাপ্তাহিকের পাতার মতোই লেখাগুলো মিইয়ে যাচ্ছে। ভালো লেখার চেয়ে পরিচিত বা মোটামুটি চলনসই একটা লেখক তালিকা হাজির করা। লেখার মানের চেয়ে লেখক তালিকা হাজির করাই যেন ঈদ সংখ্যার মূল উদ্দেশ্য! উদ্দেশ্য হয়তো নিঃসন্দেহে ভালো। তবে একই লেখক বছরের পর বছর ভালো লিখবেন, এমন নজির দুনিয়াতে বিরল। আবার এও দেখা যায়, কোনো লেখকের একটা উপন্যাস ভাগ ভাগ করে নানা পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, কেন প্রকাশিত ঈদ সংখ্যাগুলোতে সাহিত্যের বিশেষ প্রবণতাগুলোকে সনাক্ত করা যায় না? সাহিত্যের প্রবণতা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে নৈর্ব্যক্তিক অবস্থায় থাকে না। সাহিত্য কোনো নিরহ ভাব বা বস্তু নয়। তার নন্দনতাত্ত্বিক সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে। আছে বর্তমান আর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। সেটা উপস্থাপনেরও রাজনীতি আছে। সেটা কেমন? সাহিত্যে ব্যক্তির চিহ্নায়ন ঘটে বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতার ভেতর দিয়ে। মূর্ত কিংবা বিমূর্ত যাই হোক না কেন, সাহিত্য তার অন্তর্গত জগৎ দিয়ে পাঠক, সমাজ, রাজনীতি কিংবা ভাষার বদল ঘটায়। কিন্তু ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত লেখা সেটাতে কতটুকু বদল ঘটাতে পারে, সে ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়। গত তিরিশ বছরের ঈদ সংখ্যাগুলো একটু পরখ করলে দেখা যাবে, প্রায় প্রতিটি ঈদ সংখ্যায় ১৫ থেকে ৩০ জন কবির একটা কবিতা ছাপা হয়। সম্পাদনার এই পদ্ধতি দেখলে মনে হবে, বিভিন্নজন থেকে লেখা নিয়ে ঈদ সংখ্যা সাজানো হয়েছে। প্রবণতা চিহ্নিত করনের যে সম্পাদনা পদ্ধতি সেটা দেখা হয় না। গল্প, উপন্যাস কিংবা অন্য বিষয়াবলীর ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য।

তৃতীয়ত, ঈদ সংখ্যাগুলো সাহিত্যের সামগ্রিক চেহারা স্পষ্ট করে কিনা? আপাত চোখে লেখক তালিকা দেখলে মনে হতে পারে সাহিত্যের সামগ্রিক একটা চেহারার দেখা মেলে। শিল্প-সাহিত্যের সামগ্রিক দৃশ্যমান চেহারা এতে নেইও হয়তো। সামগ্রিকতা নির্ভর করে নৈর্ব্যক্তিক সম্পাদনার ভেতর দিয়ে। এটা কারো কারো মধ্যে থাকলেও হয়তো পত্রিকার সীমাবদ্ধতার কারণে তা সম্পাদন করা সম্ভব হয় না। একটা প্রশ্ন সামনে আনা প্রয়োজন, সামগ্রিক সাহিত্য কী ধরনের? বলা যায়, সম্পাদনার ভেতর দিয়ে নানা প্রবণতার সাহিত্যকে চিহ্নিত করা। তার সমালোচনা বা  বিশ্লেষণ হাজির করা।  সেটা আমাদের এখানে একদম নেই বললেই চলে। কিন্তু ঈদ সংখ্যার পরিসরে সেটা করাও সম্ভব। সাহিত্য ছাড়া যে কোনো সমাজই অপূর্ণ সমাজ। মানুষের মনের সুকুমার বৃত্তির অভাব পূরণ করে সাহিত্য। এই সত্যাসত্য অনুধাবন করা ছাড়া জাতি হিসেবে আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।

আমাদের আলোচনায় উল্লেখিত প্রশ্নগুলো খানিকটা সংকটকে চিহ্নিত করবে। কিন্তু সংকট থেকে উত্তরণের চিন্তাই আসল পাথেয়। সবচে বড় কথা, ঈদ সংখ্যাগুলো আমাদের সাহিত্যের পরিসর বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, নতুন সাহিত্য কিংবা নতুন চিন্তা সামনে এনেছে? হয়তো অনেক লেখক বড় পরিসরে তাদের লেখার ফুরসত পেয়েছেন। আরো বেশি বেশি ঈদ সংখ্যা আমাদের এখানে হওয়া দরকার। ছোট কাগজগুলো এই ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যায়, শুধু দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কি পরিমাণ ছোট কাগজ প্রকাশিত হয়! কথা উদাহরণ আকারে বললাম। তবে সবচেয়ে দরকার, নতুন চিন্তা আর নতুন সাহিত্যকে সামনে আনা। নতুনভাবে চিহ্নিত করা আমাদের বাংলা সাহিত্য কোন পথে উঁকি দিচ্ছে। সকল লেখক, পাঠক, ঈদ সংখ্যার সম্পাদকদের শুভেচ্ছা।

লেখক: কবি, তাত্ত্বিক ও শিল্প সমালোচক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়