ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘লোকমোটিফ আমি আমার মতো তুলে এনেছি’

মোহাম্মদ আসাদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ১০ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘লোকমোটিফ আমি আমার মতো তুলে এনেছি’

আবদুস শাকুর শাহ দীর্ঘদিন ধরে লোকজ ধারায় অবগাহনের মধ্য দিয়ে অমূল্য চিত্রভাষা নির্মাণে সক্ষম হয়েছেন। তিনি আমাদের লোকঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। এই আধুনিকীকরণের ফলে আমাদের লোককলা নানাভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে। তাঁর এই বিরতিহীন প্রয়াস; যা কেবল ঐতিহ্যের পুনর্নির্মাণ নয়, আমাদের হাজার বছরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত জীবনবোধের কথাও স্মরণ করিয়ে দেয়। তিনি নিজস্ব নকশায় ফ্রেমে তুলে এনেছেন মৈমনসিংহ গীতিকার বিভিন্ন চরিত্র এবং আখ্যান। তাঁর এমন অসংখ্য চিত্রকর্মের মাধ্যমে আমাদের লোককথা দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পৌঁছে গেছে বহির্বিশ্বে। এই শিল্পী জানিয়েছেন ক্যানভাসে তাঁর লোকমটিফ প্রসঙ্গে। কথোপকথনে ছিলেন আলোকচিত্রী মোহাম্মদ আসাদ।

মোহাম্মদ আসাদ: আপনার ক্যানভাসে যে নারী-পুরুষ দেখা যায় সেগুলো কোথা থেকে নেয়া?

আবদুস শাকুর শাহ: ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র সাতটি গীতিনাট্য থেকে আমি এই চরিত্রগুলো নিয়েছি। ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে এই কাব্যকাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন। এগুলো লিখেছিলেন গ্রামীণ কবিরা। তার মধ্যে অন্যতম গীতিনাট্য ‘মহুয়া ও নদেরচাঁদ’। মহুয়াকে বেদে সম্প্রদায়ের লোকেরা চুরি করে নিয়ে আসে। তাদের মতো করে মহুয়াকে বড়ো করে। এটা বড়ো একটি ঘটনা। সংক্ষেপে বলতে গেলে মহুয়া যখন বড়ো হয় তখন বেদেদের কলাকৌশলগুলো শেখে। সাপের খেলা দেখাতে গিয়ে এক বনেদি ব্রাহ্মণের সঙ্গে পরিচয় হয়। সেই ব্রাহ্মণের নাম নদেরচাঁদ। ব্রাহ্মণ তাদের বসবাসের জায়গা দেয়। একদিন নদীর ঘাটে তাদের সম্পর্ক হয়। প্রথম যখন কাহিনিটা পড়লাম সেখানে চরিত্রটার অনেকগুলো ভাগ। ছোটবেলা থেকে যৌবন পর্যন্ত। আমি কল্পনা করেছি মহুয়া গ্রামের একটি মেয়ে। কাহিনির বর্ণনা থেকে পেয়েছি সে দেখতে এরকম, পোষাক এরকম। আমি সহজ করে তাকে আমার ক্যানভাসে নিয়ে এলাম। যে কারণে পুরো ফিগারে না গিয়ে মহুয়ার ফেসটাকে প্রধান করেছি। কখনও মহুয়া-নদেরচাঁদ একসঙ্গে কম্পোজ করেছি। কখনও শুধুই মহুয়াকে সখীদের সঙ্গে এঁকেছি। কখনও মহুয়ার পেছনে প্রকৃতি, কখনও সে নদীর ঘাটে, কখনও কলসি নিয়ে; কখনও শুধুই মহুয়ার পোর্ট্রেট।

বর্ণনাতে দেখলাম সেই সময় রুপার অলঙ্কার ছিল বেশি। ফলের বীজ দিয়ে তারা গহনা তৈরি করত। কোচ ফলের বিচি দিয়ে। অনেক সময় ফুল গহনার মতো ব্যবহার করত। ছোট ছোট শামুক তারা মালা বানিয়ে ব্যবহার করেছে। এটা সহজ করে ক্যানভাসে আনার চেষ্টা করেছি। রুপার গহনার যে আদল সেটা ফুটিয়ে তুলেছি। অনেক সময় ডেকরেটিভ করেছি, কখনও আবার রুপালি রং দিয়েছি। বর্ণনায় শাড়ি যেভাবে এসেছে- আটপৌরে শাড়ি; তখন ব্লাউজ ছাড়া শাড়ি পরত। শাড়ির বুনন ছিল একটা পাড় আর একরঙা জমিন। তখন নকশা তেমন আসেনি। এক রঙের শাড়িই দেখা যেত।

মোহাম্মদ আসাদ: নদেরচাঁদকে আঁকলেন কীভাবে?

আবদুস শাকুর শাহ: মহুয়ার সঙ্গে নদেরচাঁদের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সে ছিল ব্যবসায়ী। সহজ-সরল প্রেমিকপুরুষ। পাঞ্জাবি-ধুতি পরত। পাঞ্জাবির ওপর একপাশে কাঁধে একটি গামছা বা চাদর ফেলে রাখত। মহুয়াকে শত শত একেছি। নানাভাবে একেছি। নদেরচাঁদকে একেছি দু’একবার। নদীর ঘাটে তাদের দেখা হতো। সেই রকম কল্পনা করে আঁকা। তার কপালে সাদা তিলক চিহ্ন দিয়েছি। যেখানেই বেদে বহর থামত, সেখানেই নদেরচাঁদ যেত মহুয়ার সঙ্গে দেখা করতে। নদেরচাঁদের কাছ থেকে দূরে সরার জন্য বেদেরা আবার অন্য কোথাও চলে যেত। যাতে দু’জনের দেখা না হয়। পরে দু’জনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে কাহিনির সমাপ্তি ঘটে।

মোহাম্মদ আসাদ: মহুয়ার পর মৈমনসিংহ গীতিকার কোন কাহিনিটি বেশি এঁকেছেন?

আবদুস শাকুর শাহ: আমার ফ্রেমে বেশি এসেছে চন্দ্রাবতী। এটিও একটি প্রেমকাহিনি। চন্দ্রাবতী ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম নারী কবি। রূপে-গুণে অনন্য হয়ে ওঠেন শৈশব থেকেই। ব্রাহ্মণের ছেলে জয়ানন্দ বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। সে প্রস্তাবে রাজি হয়ে জয়ানন্দকে মনে তুলে নেন। জয়ানন্দ ছিলেন নরম স্বভাবের মানুষ। কাজীর মেয়ে প্রেম নিবেদন করলে সে মজে যায়। ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম মেয়েকে বিয়ে করে। এই ঘটনায় আহত হয়ে সারা জীবন চন্দ্রাবতী একা ছিলেন। মন্দিরে ধর্মাচার ও লিখে জীবন কাটিয়েছেন। তার মন্দিরটি এখনও টিকে আছে। এই কবির আখ্যানটি লিখেছেন মধ্যযুগের আরেক কবি নয়নচাঁদ ঘোষ। আমি আমার ফ্রেমে চন্দ্রাবতীকে এনেছি বিরহকাতর এক বিজ্ঞ নারী হিসেবে। আমি যখন লোকজ ঐতিহ্যের দিকে ফিরে তাকালাম, তখন ভাবলাম লোককাহিনিগুলোর চরিত্রগুলোকে কীভাবে পোস্টমর্ডান করা যায়। যখন আমি সেই জায়গায় আসার চেষ্টা করলাম তখন আমি যে হাতি, ঘোড়া, বাঘ আঁকতাম সেখান থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলাম। তারপর এই পুরাতন বিষয় নিয়ে আধুনিক রং-রেখা ও কম্পোজিশনে আঁকলাম। প্রতিটি কাহিনিতেই বিরাট বিরাট ঘটনা। আমার ফ্রেমে সে ঘটনার সবকিছু নিয়ে আসি নি।
 

শিল্পীর তুলিতে আঁকা মহুয়া


মোহাম্মদ আসাদ: মহুয়া ও চন্দ্রাবতীকে কীভাবে আলাদা করে চিনব?

আবদুস শাকুর শাহ: এই চরিত্র দু’টিকে দু’রকমভাবে আঁকার চেষ্টা করেছি। চন্দ্রাবতী আঁকার সময় সাদা বা কমলা রং ব্যবহার করেছি; ক্রিমসনের সঙ্গে সাদা মেশালে যে রং হয়। মহুয়াকে আঁকার সময় একটু ব্লাকিস রং ব্যবহার করেছি। রঙের পার্থক্য থাকলেও আদলগুলো অনেকটা কাছাকাছি রেখেছি। কোনোটা চিকন ফেইস করেছি। কোনোটা মোটা। বাঙালি নারীর আদল আনার চেষ্টা করেছি সবসময়।

মোহাম্মদ আসাদ: তারপর কোন চরিত্রটির কথা বলবেন?

আবদুস শাকুর শাহ: মলুয়া। এটিও প্রেমকাহিনি। লিখেছেন চন্দ্রাবতী। মলুয়ার প্রেমিক চাঁদবিনোদ। তাদের বিয়ের পর কাজীর চক্রান্তে অন্য এক বাড়িতে অবস্থান করে। পরে সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আমার ক্যানভাসে মলুয়ার ছবি বেশি এঁকেছি। এটি বিরহের কাহিনি। সেভাবেই আমি মলুয়াকে সাজিয়েছি। এভাবে রূপবতীও আরেকটি প্রেমকাহিনি। সেখানে রূপবতী চরিত্রটিই এঁকেছি। কমলাও একটি প্রেমকাহিনি। কমলার রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পরে কারকুন। সে প্রেমের বার্তা দিয়ে পাঠায় এক গোয়ালিনীকে। কমলা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে গোয়ালিনীর মুখে চুনকালি মেখে বিদায় করে। কারকুন ক্ষিপ্ত হয়ে রাজার কাছে বিচার দিয়ে কমলার বাবাকে ধরে নেয়। এভাবে তারা সর্বশান্ত হয়। এখানেও আমি শুধু কমলাকেই এঁকেছি। আমি বড়ো করে বেশ কয়েকটা কমলার ফেইস এঁকেছিলাম। বড়ো বড়ো চোখ, গহনা দিয়ে সাজিয়ে এঁকেছিলাম।

তারপর কাজলরেখা। কাজলরেখার বিয়ে হচ্ছিল না। সুখপাখি বলে দিলো তার স্বামী আছে বনে, এক মন্দিরে। বাবা তাকে সেখানে বনবাস দিলেন। মন্দিরে ছিল সুচ রাজা। রাজার শরীর থেকে এক এক করে সব সুচ তুলতে পারলেই সে স্ত্রীরূপে গ্রহণ করবে। কাজলরেখা এক এক করে রাজার শরীর থেকে সব সুচ তুললেন। বাকি রইল দুই চোখে দু’টি সুচ। এই দু’টি সুচ গোসল শেষে তুলে চোখে পাতার রস দিলেই সুচ রাজা পুনরায় দেখতে পাবে। কাজলরেখাকে সে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করবে। দাসীকে রেখে কাজলরেখা গোসল করতে গেল। দাসী এই সুযোগে সুচ দু’টি তুলে নিজেই রানি হয়ে গেল। কাজলরেখা তখন উল্টো দাসী হয়ে রইলেন রাজার কাছে। তারপর অনেক ঘটনার পর সুখপাখির মুখে সব শুনে রাজা তাকে রানীরূপে গ্রহণ করলেন। এখানেও আমি কাজলরেখাইে এঁকেছি বেশি। অন্যসব ঘটনায় যাই নি।

মোহাম্মদ আসাদ: আপনি শুরু করেছিলেন লোকঐতিহ্যের মোটিফগুলো নিয়ে, সেসব নিলেন কোথা থেকে? 

আবদুস শাকুর শাহ: আমি লোকমোটিফগুলোকে আধুনিক ফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। শীতলপাটি থেকে এনেছি। সিলেটের যে শীতলপাটি; নোয়াখালির দিকে এক ধরনের শীতলপাটি আছে। এই পাটিতে কতগুলো লোকজ ফর্ম আছে। এখানে এক ধরনের ময়ূর পেলাম। সেটাকে আমি মর্ডান পেইন্টিংয়ে আনলাম। প্রথমে যেটা আঁকলাম তার সাইজ ছিল চার ইঞ্চি বাই ছয় ইঞ্চি। আমার মতো করে আঁকলাম। পাখি এঁকেছি গাজীর পট থেকে। এই পাখিটি আমি বিভিন্ন পেইন্টিংয়ে ব্যবহার করলাম। কোথাও স্পেস পূরণ করার জন্য, কোথাও বর্ডারে ব্যবহার করেছি। আরেকটা পাখি আঁকলাম কাকাতুয়া। এটাও এক ধরনের কাপড়ের ডিজাইন থেকে নেয়া।

এরপর আঁকলাম কয়েকটি হাঁস। কাকের একটা ফর্ম ব্যবহার করেছি। কবুতর এঁকেছি নকশিকাঁথা থেকে। বাঘ এঁকেছি শীতলপাটি থেকে। বিড়াল এঁকেছি। হাতি এঁকেছি বিভিন্ন রকম- জংলী হাতি, পোষা হাতি, রাজার হাতি। এই হাতিগুলো শখের হাঁড়ি থেকে নিয়েছি। শীতলপাটির ফর্ম জ্যামিতিক। দেখবে হাত-পা কেমন সোজা হয়ে থাকে। নকশিকাঁথারটা আবার এবরো-থেবরো। শখের হাঁড়িতে সার্ফলাইন। তারপর এলো গরু। গরুর ফর্মটা নিয়েছি মাটির খেলনা থেকে। তার মধ্যে ময়মনসিংহ অঞ্চলে এক রকম, বরিশাল অঞ্চলে আরেক রকম। তারপর সাপ। সাপের ফর্ম নিয়েছি নকশিকাঁথা এবং গ্রামের মাটির দেয়ালচিত্র থেকে। পটচিত্র থেকে নিয়েছি প্রজাপতি। অর্থাৎ নানা লোকমোটিফ আমি আমার মতো করে তুলে এনেছি। সেগুলো কখনও ব্যবহার করেছি কম্পোজিশনের স্বার্থে। কম্পোজিশনে কবিতাও তুলে দিয়েছি। ফুল এঁকেছি অনেক। কখনও ফুলদানিতে। কখনও খোপায়। আমি রিয়েলিস্টিক ফুল আঁকি নি। আমার ফরমেটে এঁকেছি। রং, শেফ, কম্পোজিশন, লাইন সবই এসেছে আমার মতো করে। আমি এখানে আসার আগে অনেক কিছু চর্চা করেছি বিভিন্ন বিষয়ের ওপর। দেখেছি কি রেজাল্ট হয়। গন্তব্যে পৌঁছে এখন শক্তভাবে ধরে আছি।

মোহাম্মদ আসাদ: এগুলো আঁকার শক্তিটা পেলেন কোথা থেকে?

আবদুস শাকুর শাহ: আমার কাজ দেখলেই মনে হয় এটা বাঙালি কাজ। এটা শাকুরের কাজ। দেখে থাকবেন আবহমান বাংলা বুঝাতে অনেক জায়গায় আমার আঁকা ছবি ব্যবহার করা হয়। এটাই আমার প্রাপ্তি। এটাই আমার এগিয়ে যাওয়ার শক্তি।  




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ জুন ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়