ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

ঠাকুরগাঁওয়ের বিধবারা আজও কাঁদছে

তানভীর হাসান তানু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ২৩ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঠাকুরগাঁওয়ের বিধবারা আজও কাঁদছে

জাঠিভাঙ্গা গণহত্যায় শহীদদের বিধবা স্ত্রীরা

তানভীর হাসান তানু, ঠাকুরগাঁও : এপ্রিল মাস এলেই সাংবাদিকরা আমাদের খোঁজ নিতে আসে, সারা বছর চলে যায় কেউ খোঁজ খবর রাখে না। বলছিলেন, ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা শুখানপুকুরী এলাকায় গণহত্যার শিকার স্বামী গাঠু রামসহ স্বজন হারা শুসিলা বেওয়া।

শুসিলা বেওয়ার মনে অনেক কষ্ট।তার অনুযোগ- “সরকার নতুন করে মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করছে, কত সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে অনেকে। ৭১’ সালে পাক হানাদারের হাতে আমার স্বামী প্রাণ হারালো। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পার হয়েও এখনো মানুষের জমিতে দিন মজুরের কাজ করতে হচ্ছে। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জোটেনি বিধবা ভাতাসহ কোন সুবিধা।”

ঠাকুরগাঁওয়ের জাঠিভাঙ্গা গণহত্যা দিবস আজ। একাত্তর সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তার এদেশীয় দোসররা এখানে তিন হাজারেরও বেশি নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।

ট্র্যাজেডি এই যে, পাকিস্তানি বাহিনী চারদিকে মানুষ মারছে শুনতে পেয়ে জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিঙ্গিয়া, চন্ডিপুর, আলমপুর, বাসুদেবপুর, গৌরিপুর, মিলনপুর, খামারভোপলা, শুকানপুকুরীসহ বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার বাঙালি নর-নারী ও শিশু ২৩ এপ্রিল ভোরে ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়। পথিমধ্যে তারা ওঠে জাঠিভাঙ্গা এলাকায়।

এদেশীয় দোসররা সব পুরুষকে মিছিল করার কথা বলে নিয়ে যায় জাঠিভাঙ্গা মাঠে। পাকবাহিনী সেখানে লাইন করে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করে সব পুরুষকে। হত্যাযজ্ঞ চলে বিকাল পর্যন্ত। বিকালে পাকবাহিনী চলে গেলে এদেশীয় দোসররা নদীর পাড়ে লাশ ফেলে কোনমতে মাটি চাপা দেয়।

গণহত্যায় আত্মদানকারি যুবকদের ৩ শতাধিক স্ত্রীর অনেকেই এখনও খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন। বয়সের ভারে নুয়ে পড়লেও আজো অনেকেই বয়স্ক বা বিধবা ভাতার বাইরেই রয়ে গেছেন। তারা আজো ভোলেননি সেই নারকীয় গণহত্যার কথা। প্রিয়জনকে হারানোর সেই বেদনা।

ওই সকল শহীদদের বিধবারা আজও কাঁদছে। কিন্তু তারা পায়নি তাদের স্বামী হত্যার বিচার ও স্বীকৃতি। এই কান্না বুকের মধ্যে চেপে রেখে টেনে নিয়ে যাচ্ছে জীবনের দুঃসহ বোঝাকে। একদিকে স্বামী হারানোর বেদনা আর অন্যদিকে জীবন যাপনের যন্ত্রণা- এমনি দুঃসহ কষ্টে তারা দিন পার করছে ।

এদের মধ্যে অনেক বিধবা চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন। আর জীবিতরা দারিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে আছেন অর্ধাহারে অনাহারে। কর্মক্ষমতা হারিয়ে সেই সব বিধবাদের অনেকেই অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে না পেরে বিছানায় শুয়ে কাঁতরাচ্ছেন। যারা বেঁচে আছেন তারা কেউ ভিক্ষা করে, কেউ বা দিন মজুরের কাজ করে নিজের জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

মৃত্যু পথযাত্রী কান্দরি বেওয়া বলেন, “স্বামী হারিয়ে সন্তান নিয়ে সহ্য করেছি অনেক কষ্ট। দু’চোখে জল ঝরতে ঝরতে আজ অন্ধ হয়ে গেছি। খেয়ে না খেয়ে কোনো মতে দিন পার করছি। তবু সেই রাজাকারদের বিচার চাই। দু’চোখে দেখতে না পারলেও রাজাকারদের বিচার হলে শান্তি পাবো।”

জগন্নাথপুরের আশামনি বেওয়া ও জাঠিভাঙ্গা বুড়াশিব গ্রামের ভুটরী বেওয়া অভিযোগ করে বলেন, “একটি বিধবা ভাতার কার্ডে ৩ মাস পরপর মাত্র ৯০০ টাকা পাই। এ দিয়ে কি সংসার চলে? আর শীতের মৌসুম এলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে পাই একটি কম্বল। সারা বছর আর কেউ কোনো খবর রাখে না। আমরা শেষ বয়সে একটু সরকারি সুযোগ সুবিধা পেলে মরেও শান্তি পাবো।”

ঠাকুরগাঁওয়ের ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বদিউদ্দৌজা বদর বলেন, “গণহত্যায় সকল শহীদদের বিধবাদের স্বীকৃতির জন্য অনেক আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। কিন্তু স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সরকার বিষয়টি নজরে নেননি। আমরা সকলে চাই ওই সকল বিধবাদের স্বীকৃতি ও তাদের স্বামী হত্যার বিচার।”

“এই পরিবারগুলোকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সব সুযোগ সুবিধা দেওয়া হোক” সরকারের কাছে এমন অনুরোধ করেন ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান সুলতান উল ফেরদৌস নম্র চৌধুরী।

ঠাকুরগাঁও জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলায় জাঠিভাঙ্গা গণহত্যার শহীদের পরিবারগুলোর স্বীকৃতি ও সরকারি সুযোগ সুবিধার বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয়ে সুপারিশ করবো।”




রাইজিংবিডি/ঠাকুরগাঁও/২৩ এপ্রিল ২০১৭/তানভীর হাসান তানু/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়