ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

জামাইকে জঙ্গি বানালেন শ্বশুর, আটক শাশুড়ি

রাজিব হাসান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জামাইকে জঙ্গি বানালেন শ্বশুর, আটক শাশুড়ি

পুলিশ সদস্যদের পেছনে থাকা ভাঙা বাড়িটিই আব্দুল্লাহ’র বাড়ি

রাজিব হাসান, ঝিনাইদহ থেকে : ছয় বছর আগেও তার নাম ছিল ‘প্রভাত বিশ্বাস’। বাবা চৈতন্য বিশ্বাসের তিন ছেলের মধ্যে প্রভাত সবার ছোট। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করা  প্রভাত পারিবারিকভাবেই কনিকা রানীকে বিয়ে করেন। ছয় বছরের সংসার জীবন আলোকিত করে পৃথিবীতে চোখ মেলে তাদের দুই পুত্র সন্তান।

প্রভাত কাজ করতেন একটি ফিলিং স্টেশনে পাইপ ম্যানেজার হিসেবে। জীবন নদীর এ কূল ও কূল- দুকূল মাড়িয়ে, জোয়ার-ভাটার আবর্তনে প্রভাত বদলাতে থাকলেন। বদলাতে বদলাতে ছয় বছর আগের সেই প্রভাত বিশ্বাস ধর্ম বদল করে হয়ে যান ‘আব্দুল্লাহ’। এরপর তিনি স্ত্রী সন্তান ফেলে নতুন করে নতুন নামে কালিমা পড়ে ঘর বাঁধেন রুবিনার সঙ্গে। এভাবেই তিনি সংস্পর্শে আসেন নব্য জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের  (জেএমবি)। অভিযোগ এর পেছনে প্রধান হলেন তার শ্বশুর লতিফ হোসেন। এই শ্বশুরের সহযোগিতায় তার তৈরি বাড়ি এক সময় হয়ে ওঠে জঙ্গি আস্তানা। 

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঝিনাইদহ জেলার সদর উপজেলার পোড়াহাটি গ্রামের মৃত চৈতন্য বিশ্বাসের ছেলে প্রভাত বিশ্বাস। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। স্থানীয় শরিফুল ফিলিং স্টেশনে কাজ করার সময় পার্শ্ববর্তী চুয়াডাঙ্গা গ্রামের লতিফ হোসেনের সঙ্গে তার সখ্য গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে ২০০৬ সালের দিকে প্রভাত পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিতে শুরু করেন।  ২০১১ সালের দিকে তিনি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ‘আব্দুল্লাহ’ নাম ধারণ করেন। এ সময় তিনি পুরোপুরি পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। এর কিছুদিন পর লতিফুর হোসেনের মেয়ে রুবিনাকে বিয়ে করেন আব্দুল্লাহ। বিয়ের পর শুরুতে তিনি শ্বশুর বাড়িতেই থাকতেন। ফিলিং স্টেশনে চাকরি করার সময় স্টেশনের ক্যাশিয়ার ফারুকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক হয়।

পরবর্তীতে শ্বশুরের সহযোগিতায় গত পাঁচ বছর আগে একই গ্রামের ঠনঠনিয়ায়  দুই কক্ষবিশিষ্ট টিনসেড বাড়ি তৈরি করেন আব্দুল্লাহ। বাড়ির চারপাশে ছিল টিনের বেড়া। এ সময় তাদের সংসারে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। ততদিনে আব্দুল্লাহ ফিলিং স্টেশনের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। শ্বশুরের টাকায় কিনেছেন আলমসাধু (ভটভটি)। জীবনের এই বাঁকে তিনি শ্বশুরের হাত ধরে যোগ দেন নব্য জেএমবিতে। এরপর থেকেই তার বাড়িতে বিভিন্ন মানুষ আত্মীয় পরিচয় দিয়ে যাতায়াত করতে শুরু করে। রাতে সেই বাড়িতে হতো বৈঠক। এভাবেই তার বাড়িটি জঙ্গি ও বোমা তৈরির আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে।

উল্লিখিত ওই বাড়িতে গত শনিবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে সাড়ে ৫ ঘণ্টাব্যাপী শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক দ্রব্য, বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। অভিযানে কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, পুলিশ ও র‌্যাব অংশ নেয়।

এ প্রসঙ্গে পুলিশ রোববার বাদি হয়ে আব্দুল্লাহ ও তার স্ত্রী রুবিনাকে আসামি করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ আইনে মামলা করেছে। একই দিন পুলিশ রুবিনার মা মাজেদা বেগমকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে। বাকি আসামিরা পলাতক রয়েছে।



আব্দুল্লাহ’র প্রথম স্ত্রী কনিকা রানী ও তার মা সন্ধ্যা রানী বিশ্বাস অভিযোগ করেন, মুসলমান হওয়ার পর তার শ্বশুরের মাধ্যমেই প্রভাত (আব্দুল্লাহ) জেএমবিতে নাম লিখিয়েছে। তার শ্বশুর লতিফ ও সহযোগীরাই মূলত এ জন্য দায়ী। যদিও তারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তাদের আটক করা হলেই এর সঙ্গে অন্য কারা জড়িত তা বের হয়ে আসবে।

স্ত্রী কনিকা রানী বলেন, ‘আমার স্বামী প্রভাত বিশ্বাস খুবই ভালো মানুষ ছিল। সে মুসলিম হওয়ার পর আরেকটি বিয়ে করে। এরপর থেকেই আমাদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই। সে যদি দোষী হয়ে থাকে তবে তার শাস্তি হোক।’

মা সন্ধ্যা রানী বিশ্বাস বলেন, ‘আমার ছেলে মুসলিম হওয়ার পরেই তার শ্বশুর লতিফের মাধ্যমে সে জঙ্গির খাতায় নাম লিখিয়েছে। আমাদের বাড়িতে গত মাসে এসে জমি দাবি করে হুমকিও দিয়েছে সে।’

রহিম মোল্লা নামে স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, কয়েক বছর ধরে আব্দুল্লাহ এই বাড়িতে বসবাস করে আসছে। তার বাড়িতে এলাকার কোনো মানুষ যেত না। কারণ তারা পর্দাশীল হয়ে চলাফেরা করত। রাতে অপরিচিত লোকজন তার বাড়িতে যাতায়াত করত। অভিযানের পর রহিম মোল্লা জানতে পেরেছেন, সে বাড়ি জঙ্গিদের বোমা তেরির কারখানা হিসেবে ব্যবহার হতো।

প্রতিবেশী ফেরদৌসি নামের এক নারী জানান, রুবিনা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে। আরবি শিক্ষাও জানত। সে হাতে-পায়ে মোজা দিয়ে বোরকা পরে চলাফেরা করত। তবে গত কয়েক বছর আগেও সে এমন পর্দাশীল ছিল না ।

এলাকাবাসী আরো জানিয়েছে, গত দুই মাস আগে পূর্ব পরিচিত ফিলিং স্টেশনের ক্যাশিয়ার ফারুক হোসেনের গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার কংশী গ্রামে ১০ শতক জমি এক লাখ টাকায় কেনেন আব্দুল্লাহ। ওই জমিতে চার কক্ষবিশিষ্ট একটি দালান বাড়ি তৈরি করার জন্য মিস্ত্রীরা নির্মাণ কাজ শুরু করেছিল। কাজ দ্রুত গতিতে চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পর থেকে সে কাজ বন্ধ রয়েছে।


আব্দুল্লাহর নতুন বাড়ির কাজ থেমে আছে


জমি বিক্রেতা ফারুক হোসেন বলেন, ‘২০০৩ সালে প্রভাত বিশ্বাসের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। আমরা শরিফুল ফিলিং স্টেশনে একই সঙ্গে চাকরি করতাম। গত দেড়মাস আগে আমার গ্রাম কংশীতে ১০ শতক জমি বিক্রি করেছি। সেই জমিতে সে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেছিল। গত তিনদিন আগে শুনি সে জেএমবির সদস্য ও তার বাড়ি থেকে অনেক বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে। আমিও তার শাস্তির দাবি জানাই।’

শনিবারের অভিযানের পরই আব্দুল্লাহ ও তার শ্বশুরসহ সহযোগীরা গা ঢাকা দিয়েছে। তবে অভিযানের পর এখনো এলাকাবাসীর আতঙ্ক কাটছে না। এলাকাবাসী মনে করছেন, বোমার কারখানা করার জন্য নতুন করে আরও একটি বাড়ির কাজ শুরু করেছিল আব্দুল্লাহ। জড়িতদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।

পোড়াহাটি ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম হিরন বলেন, ‘সে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করার পর কোথায় বসবাস করত জানতাম না। তবে তার কথা বার্তা ও আচরণ ছিল রুক্ষ। আমাদের ইউনিয়নে এত বড় ভয়ংকর জঙ্গি আস্তানা করে বসবাস করছে সেটা শুনে আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। অচিরেই প্রশাসন যেন জড়িতদের আটক করে শাস্তি দেয়।’

খুলনা রেঞ্চের ডিআইজি দিদার আহমেদ জানান, জঙ্গি আব্দুল্লাহর বাড়ির এ আস্তানায় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উচ্চ পর্যায়ের জঙ্গিরা আসা যাওয়া করতো। কারা এ বাড়িতে আসতো তাদের নাম ঠিকানা জানা গেলেও তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না।

এ প্রসঙ্গে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানান, ইতিমধ্যে আমরা জঙ্গি আব্দুল্লাহর শ্বাশুরি মাজেদা বেগমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছি। বাকি জড়িতদের আটকের জন্য বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হচ্ছে।



রাইজিংবিডি/ঝিনাইদহ/২৪ এপ্রিল ২০১৭/রাজিব হাসান/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়