ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ১২ জনই লালমনিরহাটের

মোয়াজ্জেম হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ২৪ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের ১২ জনই লালমনিরহাটের

সাদ্দাম ও আলমগীরের মা এবং দুই ভাইয়ের দুই সন্তান সাথী ও আঁখি

লালমনিরহাট প্রতিনিধি : লতাবর জামে মসজিদে এতেকাফে নিযুক্ত হয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কাজ করে আসছিলেন আইয়ুব আলী। আর মাত্র একদিন পরেই এতেকাফের দায়িত্ব শেষ করে বাড়ি ফিরবেন তিনি। কিন্তু তার আগেই শনিবার সকালে মসজিদে খবর পান সড়ক দুর্ঘটনায় তার দুই ছেলে নিহত হয়েছেন।

ছেলে হারানোর শোকে যেন পাথর হয়ে গেছেন আইয়ুব আলী। শেষে পরিবারের লোকজনকে জানিয়ে দেন আল্লাহ যেহেতু তার দুই ছেলেকে নিয়েই গেছেন তাই তিনি এতেকাফের দায়িত্ব শেষ না করে আর বাড়ি ফিরবেন না।

তিনি তার দুই ছেলের মরদেহের জানাজা শেষে দাফনের অনুমতি দিয়ে পরিবারের সদস্যদের বলেছেন, ‘মুই মোর কইলজার টুকরা দুইটা নাইড়বারওনং (ছুঁয়ে) দেইখপারওনং (দেখা), তোমা মাটি দিয়া দেন। মুই মসজিদ থাকি দোয়া করিম।’

রংপুরের পীরগঞ্জে শনিবার সকালে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন সাদ্দাম হোসেন (২৯) ও তার ছোট ভাই আলমগীর হোসেন (২৬)। নিহত দুই ভাইয়ের বাড়ি লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের লতাবর এলাকায়। দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন সঙ্গে থাকা সাদ্দামের স্ত্রী শরিফা খাতুন ও আলমগীরের স্ত্রী খাদিজা খাতুন। ওই ট্রাকে থাকা শরিফা খাতুনের ভাই দেলোয়ার হোসেনও নিহত হয়েছেন।

নিহতদের বাড়িতে শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, দুই ছেলের শোকে কাতর মা বারবার মুর্ছা যাচ্ছেন। এ সময় তিনি বিলাপ করে বলছিলেন, শুক্রবার বিকেলে তার ছেলে সাদ্দাম ও বউমা শরিফার সঙ্গে শেষবারের মতো কথা হয়। সে সময় তারা তাকে জানিয়েছিলেন, আল্লাহ সহি সালামতে বাড়িতে নিলে শনিবার এক সঙ্গে বসে ইফতার করবেন। কিন্তু তাদের সে আশা আশাই থেকে গেল।

এ সময় দাদির পাশেই ছিলো দুর্ঘটনায় নিহত সাদ্দামের একমাত্র কন্যা শারমিন আক্তার সাথী (৬)। সে কিছু বুঝতে না পারলেও দাদির কান্না দেখে সেও মাঝে মাঝে কেঁদে উঠছে। অন্যদিকে আরেক ছেলে আলমগীরের দুই বছরের অবুঝ শিশু কন্যা আঁখি মনির কান্না কেউ থামাতেই পারছিলেন না।

প্রতিবেশী রবিউল ইসলাম (৪০) বলেন, ‘নিহত দুই ভাইয়ের বাবা মসজিদে এতেকাফে থাকায় তিনি বাড়িতে না আসার কথা জানিয়েছেন। তিনি মসজিদ থেকেই ছেলেদের জন্য দোয়া করবেন।’

এদিকে কালীগঞ্জ উপজেলার চন্দ্রপুর ইউনিয়নের অপর এলাকা উত্তর বত্রিশ হাজারী। এই এলাকায় একই পরিবারের দুই ভাইবোন মারা যান। ছয়জন আহত হয়েছেন। এরমধ্যে উত্তর বত্রিশ হাজারী এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে রবিউল ইসলাম মজনু নিহত হয়েছেন। জাহাঙ্গীরের ভাই ঝন্টু মিয়ার মেয়ে সুবর্ণা বেগম (৯) মারা গেছেন। আহত হয়েছেন নিহত রবিউলের ভাই মতিউল ইসলাম মতি, তার চাচা ঝন্টু মিয়া, ঝন্টু মিয়ার স্ত্রী জামিনা বেগম, ঝন্টুর অপর মেয়ে ঝড়না বেগম। ঝন্টুর মামাতো ভাই নুর নবী।

এই ইউনিয়নের উত্তর বত্রিশ হাজারী এলাকা থেকে কিছুদুর গেলে টাওয়ার মার্কেট। এই এলাকারও নিহত হয়েছেন দুইজন। একই ইউনিয়নের বালাপাড়া এলাকায়ও মারা গেছেন। সবমিলিয়ে এ ইউনিয়নে যেন আসন্ন ঈদের কোনো ছাপ নেই। চারদিকে বিষাদের ছায়া ঢেকে গেছে। লোকজনের মনের মধ্যে শোকের আবহ। নিহত ও আহতদের পরিবারে আহাজারিতে চারদিকের আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কে কাকে সান্ত্বনা দেবে। যেন গোটা চন্দ্রপুর ইউনিয়নের লোকজন শোকাহত।

নিহত রবিউলের বাবা জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘ঢাকায় জুতা ফ্যাক্টরিতে কর্মরত ছিলেন দুই ছেলে। এলাকার অন্যান্যদের সঙ্গে একযোগে ট্রাকে ঈদ করার জন্য বাড়িতে আসছিলেন। এমন ঘটনায় আমার সন্তানরা মারা যাবে বিশ্বাসই করতে পারছি না।’

কালীগঞ্জ উপজেলার চাপারাহাট এলাকার ট্রাক চালক আসাদুজ্জামান জুয়েল বলেন, ‘প্রতিবছর ঈদের সময় ঢাকা থেকে বিভিন্ন শ্রমিক ট্রাকে আসে। ট্রাক চালক পরিচিত হওয়ায় এলাকার লোকজন কথা বলে ওই গাড়িতে আসছিল। কিন্তু দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে তারা মারা গেল।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাপারহাট এলাকার রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ী আব্দুল করিমের মেসার্স রানা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ট্রাক মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর থেকে সিমেন্ট নিয়ে আসছিলো। ওই ট্রাকের চালক নাজিম উদ্দিন উত্তর বত্রিশ হাজারী গ্রামের বাসিন্দা। নিজেদের এলাকার মানুষ এই ট্রাকচালক নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলে গাজীপুরের চৌরাস্তা মোড় থেকে ২৫ জন নারী-পুরুষ ও শিশু ট্রাকে উঠে। যমুনা সেতু পার হয়ে আরো ১৪জন যাত্রীকে ট্রাকে তুলে নেন চালক। বগুড়ায় এসে ট্রাকচালক গাড়ির স্টিয়ারিং তুলে দেন তার সহকারী একই এলাকার বাসিন্দা রাশেদুল ইসলামের হাতে।

ট্রাকের সহকারী রাশেদুল এক পর্যায়ে ট্রাকের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে ট্রাকটি রাস্তা থেকে ছিটকে উল্টে নিচে পড়ে যায়। চালক ও সহকারী চালক পালিয়ে যায়। কিন্তু সিমেন্টের বস্তার নিচে ও ট্রাকের নিচে পড়ে নিহত হন ১৭ জন। এরমধ্যে কালীগঞ্জ উপজেলার ১০ জন ও আদিতমারী উপজেলার দুজন। এরমধ্যে সুবর্ণা বেগম নামে শিশুও রয়েছে।

চাপারহাট এলাকার ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন বলেন, ‘গাড়ি সংকটের কারণে ঢাকায় অবস্থানকারী চন্দ্রপুরের অনেক লোকজন সচরাচর ট্রাকে চড়েই বাড়িতে আসে। কিন্তু এবার এতোবড় ঘটনা ঘটলো। একসাথে এতোগুলো লাশ চন্দ্রপুর ইউনিয়নবাসী কখনোই দেখেনি। এলাকার লোকজন সবাই শোকাহত।’ 

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো. আলাউদ্দিন খান বলেন, ‘কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহীন আলমকে দ্রুত ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। তিনি লাশ নিয়ে রওয়ানা দিয়েছেন। আহতদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ২০ হাজার, লাশ দাফনের খরচ ও আহতদের চিকিৎসার জন্য প্রত্যেককে পাঁচ হাজার করে টাকা দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে লালমনিরহাট জেলা পুলিশ  সুপার এসএম রশিদুল হক বলেন, ‘শোকাহত পরিবারের সদস্যদের বিষয়টি মানবিক বিবেচনায় মরদেহের ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। দুর্ঘটনা এড়াতে জেলা জুড়ে পুলিশকে সতর্ক থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।



রাইজিংবিডি/লালমনিরহাট/২৪ জুন ২০১৭/মোয়াজ্জেম হোসেন/রুহুল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়