ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

টেকনাফের ইয়াবা সাম্রাজ্যে পিতা-পুত্র সিন্ডিকেট!

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৪, ২২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
টেকনাফের ইয়াবা সাম্রাজ্যে পিতা-পুত্র সিন্ডিকেট!

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : টেকনাফের ইয়াবা সাম্রাজ্যে জনপ্রতিধিদের নাম ঘুরে-ফিরে নানাভাবেই এসে যাচ্ছে। গোয়েন্দা প্রতিবেদন ও তথ্যে এখানের পিতা-পুত্র সিন্ডিকেটকে অত্যন্ত শক্তিশালী বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

এখানে পিতা হিসাবে যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার নাম হচ্ছে জাফর আহমদ। তিনি বর্তমানে টেকনাফের উপজেলা চেয়ারম্যান।অন্যদিকে তিনি টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগেরও সহ-সভাপতি।

২০০৭ সালের শুরুতে টেকনাফে ১৪ দলের জোটের একটি সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি মহিউদ্দিন চৌধুরী। এ উপলক্ষ্যে মঞ্চ-তোরণে সাজানো হয়েছিল টেকনাফ। কিন্তু ওই মঞ্চ-তোরণের দেখা পাননি মহিউদ্দিন চৌধুরী। মঞ্চের পরিবর্তে গাড়িতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি। তার টেকনাফে পৌঁছার আগেই চালানো হয় তান্ডব। গুড়িয়ে দেওয়া হয় মঞ্চ ও সকল তোরণ।এই তান্ডবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাফর আহমদ।তখন তিনি ছিলেন টেকনাফের পৌর বিএনপির সভাপতি।

সময় বদলে যায়, ১/১১ এর পরে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় আসলে স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির আশ্রয়ে রাতারাতি আওয়ামী লীগের নেতা বনে যান সাবেক বিএনপি নেতা জাফর আহমদ। আর পিতার সঙ্গে তার যুবদল-ছাত্রদল করা পুত্ররাও হয়ে যান আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতা।

রাতারাতি এ দল বদলের নেপথ্য কারণ ‘ইয়াবা ব্যবসার নিরাপত্তা’, বলা হয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে । স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায় ঘুরে-ফিরে নাম এসেছে জাফর আহমদ ও তার ৩ পুত্রের। সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাদকদ্রব্য পাচার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে ইয়াবার গডফাদার হিসেবে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে ১১ নম্বরে স্থান পেয়েছেন জাফর আহমদ। তারপর পর্যায়ক্রমে নাম এসেছে তার পুত্র মোস্তাক আহমদ, দিদার আহমদ ও বর্তমান টেকনাফ সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের ।

গোয়েন্দা তথ্য, পুলিশের প্রতিবেদন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর তালিকাসহ প্রধানমন্ত্রী দপ্তরের তালিকায় এটাই স্পষ্ট যে, টেকনাফে ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে পিতা-পুত্রের সিন্ডিকেটটি অত্যন্ত শক্তিশালী।

নেপথ্যে অবস্থান করে  নির্ধারিত বিশ্বস্ত লোক দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে ইয়াবা ব্যবসা। যাদের অনেকেই ইয়াবা তালিকাভূক্ত হয়েও জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিশ্বস্ত তালিকায় স্থান পেয়েছেন নাজিরপাড়া এলাকার মৃত মোজাহের মিয়ার পুত্র এনামুল হক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ৭৬৪ জনের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ৬ নম্বরে রয়েছেন এনামুল হক । যিনি মাদক মামলায় কারাগারে থেকেও ইউপি সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল এনামুল হকের ইয়াবার আস্তানায় অভিযান চালাতে গিয়ে সিন্ডিকেট সদস্যদের হামলার মুখে পড়ে । এব্যাপারে টেকনাফ থানায় মামলাও হয়েছে।  পিতা-পুত্রের সিন্ডিকেটের আরেক শক্তিশালী ও বিশ্বস্ত প্রতিনিধি টেকনাফ সদর ইউপি সদস্য  ও প্যানেল চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি টেকনাফের লেঙ্গুরবিল এলাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকাভূক্ত।

অবশ্য আলাপকালে প্যানেল চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জানিয়েছেন,  তিনি কোনভাবেই ইয়াবা ব্যবসার সাথে জড়িত নন।

পিতা-পুত্রের সিন্ডিকেটে আরো রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভূক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী নাজিরপাড়ার বহুল আলোচিত এজাহার মিয়ার পুত্র নুরুল হক ভূট্টোও। যার বিরুদ্ধে কক্সবাজারের ৬ সাংবাদিকের উপর হামলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লোকজনের উপর হামলা, চোখ উপড়ে নেওয়া, কান কেটে দেওয়াসহ নানা অপরাধে মামলা রয়েছে।

পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নেতৃত্বে টেকনাফে রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী ইয়াবা সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটটি কৌশলে ইয়াবার রাম রাজত্ব পরিচালনা করছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কক্সবাজার সফরে এসে ইয়াবা রোধে কঠোর হুঁশিয়ারি এবং এরপর পুলিশের মহাপরিদর্শক ( আইজিপি ) টেকনাফ সফরে গিয়ে কঠোর নির্দেশের পর মাঠপর্যায়ে ইয়াবা রোধে অভিযান শুরু করে পুলিশ। এ অভিযানের অংশ হিসেবে শীর্ষ ৫০ জনের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের ধরতে মাঠেও নেমেছে পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, এ ৫০ জন মূলত: বিভিন্ন সিন্ডিকেটের প্রতিনিধি হয়ে সীমান্তে ইয়াবার চালান গ্রহণ করে থাকেন। আর এ শীর্ষ ৫০ জনের মধ্যে এক নম্বরে যে নাম রয়েছে তিনি হলেন, টেকনাফ পৌরসভার পুরাতন পল্লানপাড়ার কালা মিয়ার পুত্র ফিরোজ আহমদ। গত ১৩ আগস্ট ডিবি পুলিশের একদল এ ফিরোজ আহমদকে আটক করলেও তাকে ফিল্মি স্টাইলে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাকে ছিনিয়ে নেয় কোস্টগার্ড। এব্যাপারে ডিবি পুলিশের এসআই আলমগীর হোসেন বাদি হয়ে টেকনাফ থানায় সাধারণ ডায়েরিও করেছেন। যার নম্বর - ৫৫৭।

সংশ্লিষ্ট সংস্থার তথ্য মতে, ফিরোজ এক সময়ের তালিকাভূক্ত চিহ্নিত ডাকাত। বর্তমানে জাফর আহমদ চেয়ারম্যানের ভাড়া বাসায় অবস্থান করেন তিনি। কৌশলে কোস্টগার্ডের সোর্স হিসেবে কাজ করলেও তার মূল কাজ পিতা-পুত্র সিন্ডিকেটের নাফনদীর একটি অংশ দিয়ে আসা ইয়াবা চালান আদান-প্রদান করা।

সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো মাদকদ্রব্য পাচার সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে ইয়াবার গডফাদার জাফর আহমদ ও তার তিন পুত্রের নাম আসলেও তার বড় পুত্র মোস্তাক আহমদ নিখোঁজ রয়েছেন দেড় বছরের বেশি সময় ধরে। তিনি কোথায় তা নিশ্চিত করা যায়নি বা কেন নিখোঁজ তাও নিশ্চিত নয়।

মোস্তাক আহমদ কোথায় এমন প্রশ্নের উত্তরে পিতা জাফর আহমদ বলেন, ‘একজন সন্তান দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকার কষ্টের বিষয়টি একমাত্র পিতা-মাতারাই অনুভব করতে পারেন। আমার বড় পুত্র মোস্তাককে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ধরে নিয়ে গেছে, এমনটা জনশ্রুতি আছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তারপরও প্রিয় সন্তানের খোঁজ পেতে টেকনাফ থানায় একটি মামলা করেছি।’

জাফর আহমদের অপর পুত্র দিদার আহমদকে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সিন্ডিকেটের ইয়াবা নিয়ন্ত্রক হিসেবে বলা হয়েছে।  দিদার আহমদ দীর্ঘ সময় মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন শহরে অবস্থান করে সিন্ডিকেটটি শক্তিশালী করেন। মিয়ানমারের থাকা অবস্থায় দিদার ইয়াবা কারখানা পরিদর্শনসহ মিয়ানমারের শীর্ষ ইয়াবা ডিলারদের সাথে সখ্যতা তৈরি করেন বলেও উল্লেখ্য রয়েছে গোয়েন্দা প্রতিবেদনে।

তিন পুত্র সহ নিজের নাম তালিকায় থাকা প্রসঙ্গে জাফর আহমদ বলেন, ‘ঘুরে ফিরে ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার  প্রশাসনের বিভিন্ন সংস্থার তালিকায় আমার নাম থাকার বিষয়টি নিয়ে আমি নিজেও বিস্মিত। অথচ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার লোকজনকে তথ্য দিয়ে আমি নানাভাবে সহায়তা করেছি।’

রাজনৈতিক ও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীদের ষড়যন্ত্রের শিকার দাবি করে জাফর বলেন, ‘সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে নাম থাকলেও ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত থাকার ব্যাপারে দেশের কোন থানায় আমার বিরুদ্ধে মামলা নেই। এমনকি ইয়াবাসহ কখনো কোন দিন আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছি এমন কোন নজিরও নেই। তাছাড়া কোন ইয়াবা ব্যবসায়ীকে আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা করেছি তাও কেউ বলতে পারবে না। তারপরও কেন ঘুরে-ফিরে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে আমার এবং পুত্রদের নাম উঠে আসে তা নিয়ে আমি চরমভাবে বিব্রত।’

একই সিন্ডিকেটভূক্ত না হলেও  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালের তালিকায় ইয়াবা ব্যবসায়ী আরো অনেকেই টেকনাফের ৬টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের তালিকায় সাবরাং ইউনিয়নের মন্ডলপাড়ার ১ নম্বরে রয়েছেন সাবরাং ইউনিয়নের আলীর ডেইল এলাকার ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য আকতার কামাল। একই তালিকায় রয়েছেন তার আরেক ভাই। ইয়াবা তালিকায় পানছড়িপাড়ার ৩ নম্বরে রয়েছেন ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য শামসুল আলম । এ তালিকায় রয়েছেন তার পিতাসহ আরো ৩ ভাই । নয়াপাড়ার অংশের ১০ নম্বরে রয়েছে ৬নং ওয়ার্ডের সদস্য নির্বাচিত মোহাম্মদুর রহমান।

এছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অপর এক ইয়াবা ও মানবপাচারকারির তালিকায় রয়েছেন, সাবরাং ১ নং ওয়ার্ডের সদস্য মোয়াজ্জেম হোসেন দানু। বাহারছড়ার ইউনিয়নের পুরানপাড়া এলাকার তালিকায় রয়েছেন বাহারছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আজিজ উদ্দিন। তার নাম মানব পাচারকারী ও রোহিঙ্গা মদদদাতার তালিকায়ও রয়েছে। ইয়াবা তালিকায় রয়েছেন হ্নীলা ইউনিয়নের ৭ নং ওয়ার্ডে জামাল হোছাইন । ইয়াবাসহ আটক হয়ে জামাল হোসেন এখন কারাগারে । ইয়াবার তালিকায় ৮নং ওয়ার্ডের নুরুল হুদা, ৯নং ওয়ার্ডের মোহাম্মদ আলীর নামও রয়েছে। টেকনাফ পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডে সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাই মুজিবুর রহমানের নাম ইয়াবা তালিকায় ৭ প্রভাবশালীর একজন হিসেবে উল্লেখ্য রয়েছে। একই তালিকায় ৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর একরামুল হক, ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শাহ আলমের নাম রয়েছে। এই তালিকায় রয়েছেন তার ৩  ভাই ১ ভাবীও। টেকনাফ সদর ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ডের সদস্য আজিম উল্লাহও রয়েছেন। আর এসব জনপ্রতিনিধির নেতৃত্বে পৃথক সিন্ডিকেটে ইয়াবা পাচারের বিষয়টিও পুলিশের পক্ষে নিশ্চিত করা হয়েছে।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আফরুজুল হক টুটুল জানান, অনেক জনপ্রতিনিধি, প্রভাবশালী ব্যক্তি ইয়াবার সাথে সংশ্লিষ্ট- এটা সকলেই জানেন। এর মধ্যে অনেকের নামে মামলা না থাকলেও ইতিমধ্যে পুলিশের কাছে পর্যাপ্ত প্রমাণ এসে পৌঁছেছে। যাদের বিষয় তথ্য প্রমাণ হাতে এসেছে তাদের ধরতে চেষ্টা করা হচ্ছে। অন্যান্যদের বিষয়েও তথ্য-প্রমাণ হাজির করার চেষ্টা চলছে। এটা ইয়াবা রোধে পুলিশের কৌশলও বলা যাবে। যতটা প্রভাবশালী হোক আর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হোক কেউ রেহাই পাবে না। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই তার কিছু প্রমাণ সাধারণ মানুষ দেখতে পাবেন।

তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশ যে কোনভাবেই ভয়াবহ মাদক ইয়াবা রোধ করতে হবে। আর এটা করতে পুলিশ এখন প্রস্তুত।’



রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২২ আগস্ট ২০১৭/সুজাউদ্দিন রুবেল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়