ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মাদারীপুরের ২৮ জন লিবিয়ায় জিম্মি, মুক্তিপণ দাবি

বেলাল রিজভী || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৬:০৪, ২২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাদারীপুরের ২৮ জন লিবিয়ায় জিম্মি, মুক্তিপণ দাবি

র‌্যাবের হাতে গ্রেপ্তার সিরাজ মাতুব্বর

মাদারীপুর প্রতিনিধি : মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মহিষমারী গ্রামের দিনমজুর বিজ্ঞান সরকার। সংসারের সমৃদ্ধির আশায় পাড়ি জমিয়েছিলেন বিদেশ। একই উপজেলার জাহিদুল ইসলাম সহায়-সম্বল বিক্রি করে সুখের আশায় সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন দালালের হাতে। দালালরা তাদের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যান লিবিয়ায়। সেখানে চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। নির্যাতনের সেই দৃশ্য মোবাইল ফোনের ইন্টারনেটের মাধ্যমে দেখান হতো এদেশে তাদের স্বজনদের। দাবি করা হয় মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে কিংবা দিতে না পারলে চালান হতো আরো বেশি নির্যাতন। এভাবে এই চক্রটি বিদেশে নিয়ে মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতো। এই চক্রের হাতে জিম্মি রয়েছে মাদারীপুরের ২৮ জন।  

মাদারীপুরে এমনই এক মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাবের সদস্যরা। আটকের পরে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর তথ্য। র‌্যাব-৮ এর মাদারীপুর ক্যাম্প কমান্ডার মেজর রাকিব জানান, দীর্ঘ দিন যাবৎ একটি আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারী চক্র ইতালি, স্পেন ও গ্রিসসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরির লোভ দেখিয়ে মানবপাচার করে আসছে। এই চক্রের সদস্যরা বাংলাদেশ, লিবিয়া ও ইতালিতে সমভাবে সক্রিয় এবং এদের শিকার মূলত মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের উঠতি বয়সের বেকার যুবকরা। চক্রটি বাংলাদেশ থেকে প্রাথমিকভাবে যুবকদের লিবিয়ায় পাচার করে থাকে। পরে লিবিয়ায় অবস্থানরত চক্রের সদস্যরা সেখানকার বন্দিশালায় তাদের আটক রেখে বিভিন্নভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে এবং বন্দিদের আত্মীয়দের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ দাবি করে।

এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২১ আগস্ট শিবচরের দত্তপাড়া ইউনিয়নের ধুয়াটি গ্রাম থেকে সিরাজ মাতুব্বরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি প্রাথমিকভাবে মানবপাচার চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। এ সময় তার নিকট থেকে মানবপাচারের মাধ্যমে অর্জিত টাকা ব্যাংকে জমার রশিদ, স্ট্যাম্পে লিখিত চুক্তিনামাসহ বিভিন্ন দালিলিক প্রমাণও উদ্ধার করে র‌্যাব।

মেজর রাকিব বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছি, পাচারকারী চক্রের লিবিয়া অংশের অন্যতম প্রধান মো. শহিদুল মাতুব্বর। তার নেতৃত্বে লিবিয়ার বন্দিশালায় বাংলাদেশি যুবকদের অর্ধাহারে-অনাহারে রেখে নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেন। সিরাজ মাতুব্বরসহ বাংলাদেশে অবস্থানরত সদস্যরা  পাচারের শিকার যুবকদের নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করেন।’

তিনি আরো বলেন, ‘গত ৬ মার্চ হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ২৮ যুবককে পাচারের করে এ চক্র। এদের মধ্যে আটজন শহিদুল মাতুব্বরের অধীনে লিবিয়ার বন্দিশালায় জিম্মি আছে। এই আটজনকে লিবিয়া পাঠানোর সময় পাচার চক্রটি প্রায় ৩৫ লাখ টাকা এবং লিবিয়ায় পাঠানোর পর মুক্তিপণ বাবদ আসামি  সিরাজ মাতুব্বর বিভিন্ন সময় প্রায় ২০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে- এমন প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে, আরো অনেক বেশি মুক্তিপণ আদায় করেছে এই চক্রটি।’

বিদেশের পাচারের শিকার লিটু মন্ডলের মা ফনিমালা মন্ডল বলেন, ‘আমার ছেলে মিস্ত্রীর কাজ করত। সংসারে অভাব ছিল। সুখের আশায় দালালের কাছে পাঁচ লাখ  টাকা দিয়ে বিদেশ পাঠাই। তাকে লিবিয়ায় আটকে রেখে নির্যাতন চালান হতো। এরপরে মোবাইলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই নির্যাতনে চিত্র দেখান হতো। দাবি করা হয় মুক্তিপণ। টাকা না দিলে নির্যাতনের মাত্র বাড়িয়ে দেওয়া হতো। এভাবে প্রায় ১১ লাখ টাকা দিয়েছি দালাল চক্রের কাছে। এরপরও আরো টাকার জন্য আমার ছেলেকে জিম্মি করে রেখেছে। আমি সরকারের কাছে ওদের উদ্ধারের সহযোগিতা চাই।’

মানবপাচারের শিকার বিজ্ঞান সরকারের মা রেবা সরকার বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। সংসারে সুখের আশায় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছিলাম। ভাবছিলাম বিদেশ থেকে অনেক টাকা পাঠাবে। আমাদের সংসারের দুঃখ ঘুচে যাবে। কিন্তু উল্টো এখন জমিজমা বিক্রি করে এবং সুদের উপর টাকা এনে দালালদের দিতে হচ্ছে।’

আরেক পাচারের শিকার পিন্টু মালোর ছোট ভাই ঝন্টু মালো বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মতো আরো অনেকে লিবিয়ার বন্দিশালায় জিম্মি রয়েছেন, তাদের সবাইকে মুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি সরকারের কাছে।’

মাদারীপুর র‌্যাব-৮ এর কমান্ডার রাকিব জানান, গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি এবং পলাতক আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে পাচার চক্রের অন্য সদস্যদেরও গ্রেপ্তার করা হবে। তদন্তের স্বার্থে অনেকের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না।



রাইজিংবিডি/মাদারীপুর/২২ আগস্ট ২০১৭/বেলাল রিজভী/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়