ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার রোহিঙ্গারা

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার শিকার রোহিঙ্গারা

কক্সবাজার প্রতিনিধি : মিয়ানমার সেনাবাহিনী যখন আগুন দিচ্ছিল তখন ঘরে ঘুমিয়ে ছিল ১৮ মাসের ছোট্ট শিশু হারেছ।

সন্তানকে উদ্ধারে মায়ের দৌড় ঝাঁপের আগেই ছনের ছাউনি থেকে আগুনের ফুলকি গিয়ে পড়ে ঘুমন্ত হারেছ-এর শরীরে। আগুনে ঝলসে যায় নিষ্পাপ হারেছের নরম শরীর। এখন হারেছ কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
 
সোমবার সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, স্পেশাল রোহিঙ্গা ইউনিটের ২২২ নম্বর কক্ষে বিছানায় শুয়ে আছে হারেছ। পুরো শরীর সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো। পাশেই তার মা খুরশিদা বেগম।
 
খুরশিদা জানান, তাদের বাড়ি মিয়ানমারের বুচিডং এলাকায়। তার স্বামী আব্দুল হামিদ ছিলেন একজন দিনমজুর। গত ২০দিন আগে টেকনাফের লম্বাবিল সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অগ্নিদগ্ধ সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে আসেন খুরশিদা।
 
খুরশিদা বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী ওপর থেকে বোমা মারছে, গুলি করছে। আমাদের ঘরটি ছিল ছনের ছাউনির। এক পর্যায়ে ঘরের ছাউনিতে আগুন ধরে যায়। ঘরে ঘুমিয়ে ছিল হারেছ। আমি দৌড়ে হারেছকে বের করতে যাই। কিন্তু ততক্ষণে আগুনের শিখা ঘুমন্ত হারেছের গায়ের ওপর পড়ে। আগুনে ঝলসে যায় হারেছের শরীর। বুকের ওপর থেকে নিচের দিকে পুড়ে গেছে। পোড়া ছেলেকে নিয়ে পাহাড়-পর্বত, খাল-বিল পেরিয়ে অনেক কষ্টে আমরা বাংলাদেশে আসি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডাক্তার দেখা মাত্র আমাদের এই হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। এখানে আছি আজ ১৬ দিন হয়েছে।

স্পেশাল রোহিঙ্গা ইউনিটে কর্তব্যরত সিনিয়র স্টাফ নার্স শামসুর নাহার জানান, হারেছের শরীরের ১৫ ভাগ পুড়ে গেছে। শরীরের পোড়া ক্ষত শুকিয়ে আসছে।শিশুটি এখন অনেকটা শংকামুক্ত।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের স্পেশাল রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিটের ১২১ নম্বর কক্ষে চিকিৎসাধীন শাহাজানের নিজের দেশ ছেড়ে আসার গল্প আরো নির্মম। আগুনে মুখমণ্ডলসহ শরীরের পুরোটাই পুড়ে গেছে তার। আগুনে পুড়ে নিজেকে বাঁচাতে পারলেও মিয়ানমার সেনাদের ছোড়া গুলি থেকে স্বামী ও ছেলেকে বাঁচাতে পারেননি শাহাজান।

শাহাজান বলেন, ওইদিন দুপুর আড়াইটা হবে। সেনাবাহিনী পাড়ার বাড়ি-ঘর পুড়ে দিচ্ছে। আমার ঘরেও আগুন ধরিয়ে দেয়। আমি স্বামী আর ছেলেকে খুঁজতে দ্রুত ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়ি। এ সময় আমার পরনের কাপড়ে আগুন ধরে যায়। পাশে একটি ধানখেত ছিল। আমি দৌড়ে ধানখেতে গিয়ে গড়াগড়ি করি, কিন্তু ততক্ষণে আমার পুরো শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে জানতে পারি ঘর থেকে দৌড়ে পালানোর সময় আমার স্বামী (শফি উল্লা) ও ছেলেকে ওরা মেরে ফেলেছে। আমার মেয়ের জামাই আমাকে ধানখেত থেকে উদ্ধার করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এখন এখানে চিকিৎসা নিয়ে কিছুটা সুস্থ আছি।

নিজের শরীর পুড়িয়ে প্রাণে বাঁচতে পারলেও শাহাজান বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বামী ও সন্তান হারানোর বেদনা। গত ১২ সেপ্টেম্বর মিয়ানমারের রাচিদং এলাকা থেকে বাংলাদেশে আসেন শাহাজান। ওই দিন রাতে তিনি কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন।

কিশোরী আলকামার বাড়ি ছিল মিয়ানমারের মংডু এলাকায়। চারদিন আগে টেকনাফের নাইট্যং পাড়া সীমান্ত দিয়ে মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে আসে কিশোরী আলকামা। বাবা ও বোনের মৃত্যু দেখেছে খুব কাছ থেকে। গুলিবিদ্ধ বাবাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের পায়ের গোড়ালিতে গুলি লাগে তার। এখন তার ঠিকানাও এই হাসপাতাল।

আলকামা বলেন, ওরা আমার বাবাকে গুলি মেরেছে, আমি বাবাকে ধরতে গেছি। আমাকেও গুলি মেরেছে। আমার পায়ে গুলি লাগে। আমার বোন গেছে, বোনকেও গুলি মেরেছে। আমার বাবা মারা গেছে। আমার বাবা ও বোন দুজনই গুলিতে মারা গেছে।

 


শুধু এরা নন, মিয়ানমার বাহিনীর নির্যাতনের শিকার এ রকম অসংখ্য নারী-পুরুষ ও শিশুর ঠিকানা কক্সবাজার সদর হাসপাতাল। শতভাগ সরকারি খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে এই হাসপাতালে। অগ্নিদগ্ধ, গুলিবিদ্ধ, ধর্ষিতাসহ নানাভাবে নৃশংসতার শিকার অনেকেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

রোহিঙ্গাদের সেবা নিশ্চিত করতেই কক্সবাজার সদর হাসপাতালে খোলা হয়েছে স্পেশাল রোহিঙ্গা সার্জারি ইউনিট। বাড়ানো হয়েছে চিকিৎসকসহ সব ধরনের সাপোর্ট। তবে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতালে রোগীর চাপ সামলাতে চিকিৎসকদের বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান এই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. শাহীন মোহাম্মদ আব্দুর রহমান।

তিনি বলেন, ২৫০ শয্যার হাসপাতালে আগে থেকেই প্রতিদিন পাঁচশ’রও বেশি রোগীকে চিকিৎসা সেবা দিতে হতো। এর মধ্যে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আমাদের চাপের মধ্যে আরো বাড়তি চাপ হয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হচ্ছে ইনজুরি, গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ, দুর্ঘটনা কবলিত রোগীদের নিয়ে। তবে রোহিঙ্গা রোগীদের শতভাগ সরকারি খরচে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।

কক্সবাজার সিভিল সার্জন মো. আব্দুস সালাম জানান, রোহিঙ্গাদের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে রোহিঙ্গাদের জন্য স্পেশাল ইউনিট খোলা হয়েছে। রোহিঙ্গারা যেখানে অবস্থান করছে, সেখানে মাঠ পর্যায়ে ৩৬টি মেডিক্যাল টিম কাজ করছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন আইওএম, ইউএনএইচসিআর, ইউনিসেফ, এসিএফসহ বিভিন্ন সংস্থা আমাদের কর্মীদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়াও রোহিঙ্গাদের এই চাপ সামলাতে কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, এমন কি জেলা সদর হাপাতালেও জনবলসহ সব ধরনের লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়ানো হয়েছে।

সিভিল সার্জন আরো জানান, গত ৯দিনে প্রায় সাড়ে ১১হাজার রোগীকে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়েছে। যেখানে আছে গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ, ডায়রিয়া, নিউমোনিয়া ও চর্মরোগসহ বিভিন্ন ধরনের রোগী।

 

 

রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭/সুজাউদ্দিন রুবেল/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়