ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে

সুজাউদ্দিন রুবেল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ২২ জানুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিলম্বিত হচ্ছে

সুজাউদ্দিন রুবেল, কক্সবাজার : বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার চুক্তিমতে মঙ্গলবার থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন করা সম্ভব হচ্ছে না, এখনো প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াগত কাজ চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন না হওয়ায় তা শুরু করতে আরো সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে দুই দেশের মধ্যকার চুক্তিমতে প্রক্রিয়াগত দ্বিতীয় পর্যায়ের অবকাঠামোত ও ভৌত কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

মঙ্গলবার সন্ধ্যায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন কক্সবাজারস্থ ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম।

তবে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ে যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তাতে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু হবে উল্লেখ ছিল বলে জানান এ কর্মকর্তা।

আবুল কালাম বলেন, চুক্তির আলোকেই বলা যায় এখনো দুই দেশ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। চুক্তিমতে, গত ১৯ ডিসেম্বর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের কাঠামো তৈরি করে কার্যাদিও নির্ধারণ করা হয়েছে। এরপরে গত ১৫ ও ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

“প্রথম বৈঠকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য যে ভৌত ব্যবস্থাদি দরকার সেগুলোর রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছে। এখন সেই রূপরেখা মতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রয়েছে।”

প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়ের কাঠামোগত ও ভৌত ব্যবস্থাদি বাস্তবায়নের কাজ অব্যাহত রয়েছে বলে জানিয়েছেন ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার।

তিনি বলেন, “প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার তিনটি ধাপের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের পদ্ধতিগত বিষয়াদি চূড়ান্ত করে ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায়ে কাঠামোগত ও ভৌত ব্যবস্থাদি তৈরি করা। এর মধ্যে প্রত্যাবাসনের জন্য রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরি, যাচাই-বাছাই এবং ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন। এখন আমরা এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের মধ্যে আছি।”

আবুল কালাম বলেন, ‘‘ইতিমধ্যে আমরা প্রত্যাবাসনের জন্য প্রথম পর্যায়ের কাজ বেশ সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছি। এখন দ্বিতীয় পর্যায়ে কাঠামোগত ও ভৌত ব্যবস্থাদি তৈরি করে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক কাজ অব্যাহত রয়েছে।

“এ জন্য পাঁচটি ট্রানজিট ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। ইতিমধ্যে সেগুলোর জায়গাও প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করেছি। এখন কাঠামোগুলো নির্মাণ ও রোহিঙ্গা তালিকা তৈরি করতে হবে। এ লক্ষ্যে প্রথম ধাপে প্রত্যাবাসনে জন্য রোহিঙ্গাদের পরিবারভিত্তিক তালিকা তৈরির কাজও চলছে। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের জন্য ইচ্ছুক, তাদের মধ্যে সচেতনতা তৈরির কাজও দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রক্রিয়ায় চলছে।”

মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের পর সেখানে কী অবস্থায় থাকবে সেই সম্পর্কে রোহিঙ্গাদের ধারণা দেওয়া প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার।

তিনি বলেন, “এটি মিয়ানমার পক্ষের কাজ। এই ব্যাপারে যথাসময়ে প্রস্তুতি এবং ব্যবস্থা সম্পর্কে মিয়ানমারের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া যাবে বলে আশা করি। এসব তথ্য পেলে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে ধারণা দেওয়া সম্ভব হবে। এ কাজ এখন অব্যাহত রয়েছে। এগুলো সম্পন্ন হলেই মূল প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারব।”

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের মূল কাজ শুরু করতে কিছুটা সময় লাগবে বলে মন্তব্য করে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান মো. আবুল কালাম।

তিনি বলেন, “চুক্তিমতে প্রত্যাবাসনের জন্য অনেকগুলো পূর্বশর্ত বা প্রস্তুতি গ্রহণের বিষয় আছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ‘সেইফ এন্ড ভলেন্টেয়ারি রিপাট্রেশন’ বা নিরাপদ ও স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসনের কথা বলেছি। কারণ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটাকে স্বেচ্ছামূলক করতে হলে এবং প্রত্যাবাসন উত্তর তাদের সেখানকার অবস্থান নিরাপদ করতে হলে অনেক কিছু করণীয় আছে। সেগুলো মিয়ানমার পক্ষে যেমন এবং আমাদের পক্ষেও কিছু রয়েছে।”

তবে এসব কাজ কতদিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে তা দিনক্ষণ ঠিক বলা কঠিন এবং এগুলো সম্পন্নের পরই প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ার কাজ শুরু যাবে বলে মন্তব্য করেন টেকনিক্যাল কমিটির প্রধান।

জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক আলোচনায় উঠে আসা ‘সীমান্তের শূণ্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া এবং হিন্দু নাগরিকদের’ প্রত্যাবাসনের প্রথম দফায় ফেরত পাঠানো হবে কি জানতে চাইলে ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কমিশনার কালাম বলেন, এ ব্যাপারে এখনো কোন ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি।

“সীমান্তের শূন্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যেহেতু বাংলাদেশের মূল-ভূখণ্ডে প্রবেশ করেনি, সেহেতু মিয়ানমার আন্তরিক হলেই প্রত্যাবাসনের প্রথমধাপেই এসব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে পুনর্বাসন করতে পারে। পাওয়া তথ্যমতে, এসব রোহিঙ্গাদের বাড়ি-ঘরও সীমান্তের খুব কাছাকাছি।”

প্রত্যাবাসনের প্রথমদিকেই সীমান্তের শূণ্যরেখায় আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে অন্যদের মাঝেও একটা আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন প্রত্যাবাসন সংশ্লিষ্ট এ কর্মকর্তা।

মিয়ানমারের হিন্দু নাগরিকদের প্রত্যাবাসনের প্রথমধাপে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান তিনি।

কালাম বলেন, প্রত্যাবাসনটা হবে পরিবার ভিত্তিক এবং গ্রাম ভিত্তিক। সেই প্রক্রিয়ায় অন্যদের মতো হিন্দুদেরও প্রত্যাবাসনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যাবাসনের সুযোগ নেই।

অন্তত দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা পরিবার বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার তথ্য জানান ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা।

কালাম বলেন, রোহিঙ্গাদের তালিকা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এবং এটি চলছে। এটি পুরোপুরি শেষ করতে আরেকটু সময় লাবে। প্রত্যাবাসনের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক কোনো পরিবারের লক্ষ্যমাত্রা নেই। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দুই লাখ রোহিঙ্গা পরিবারের মধ্যে অন্তত দেড় লাখের বেশি পরিবার এসেছে গত ২৫ আগষ্টের পর। বর্তমানে যে চুক্তি আছে, এ চুক্তির আওতায় তাদের সকলকে ফেরত পাঠাতে চাই। তালিকা তৈরি করা হচ্ছে সকলকে ফেরত পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে। কোনো নির্দিষ্ট একটা অংশকে নয়।

“পুরো তালিকাটি তৈরি হয়ে গেলে পরিবার ও গ্রামভিত্তিতে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করা হবে। যাতে তারা নিজেদের মধ্যে সংঘবদ্ধ থাকতে পারে। প্রত্যাবর্তন করেও যেন তারা আস্থা নিয়ে সেখানে থাকতে পারে। এটা শুধু ৫/১০ হাজার বা ২০ হাজারের বিষয় না। গত ২৫ আগষ্টের পর যে ৬/৭ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, তাদের সকলের জন্য প্রযোজ্য হবে।”

প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা কালাম বলেন, এ লক্ষ্যে তালিকা তৈরির কাজই বাংলাদেশ করে যাচ্ছে। মিয়ানমার থেকে যারাই এসেছে তারা সকলেই তালিকাভুক্ত হবে। এ তালিকা তৈরির পর মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এরপর মিয়ানমার তাদের তৈরি  করা ভেরিফিকেশন ফরমের তথ্য অনুযায়ী তালিকার ব্যাপারে যাচাই-বাছাই করবে।

“পাঠানো তালিকা চূড়ান্ত করে আমাদের (বাংলাদেশ) পাঠানোর পর জানা যাবে তারা কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে ইচ্ছুক। এটি পাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের মধ্যে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি যাচাই করতে মাঠ পর্যায়ে কাজ করা হবে।”

এখনো রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের বিষয়টি নিয়ে যাচাই করার সময় আসেনি বলে জানান তিনি।

চুক্তির কথা উল্লেখ করে ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা আবুল কালাম বলেন, প্রত্যাবাসনের চূড়ান্ত প্রক্রিয়ায় সপ্তাহে দেড় হাজার রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানো হবে।

“বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রস্তাব ছিল সপ্তাহে ১৫ হাজার করে রোহিঙ্গা ফেরত নেওয়ার। কিন্তু মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের প্রথমদিকে সপ্তাহে দেড় হাজার করে ফেরত নিতে সম্মত হয়েছে; তা আবার দুটি ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে প্রতিদিন তিনশত জন করে।”

কালাম বলেন, প্রথমদিকে প্রত্যাবাসনটা এভাবেই শুরু হবে। তবে মিয়ানমার এটিও বলেছে, সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে ফেরত পাঠানোর এই সংখ্যাটা পুননির্ধারণ করা হবে। এতে তারা সম্মত আছে।

এ বিষয়টি বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার সম্পাদিত চুক্তিতে রয়েছে বলে উল্লেখ করে ত্রাণ ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন কর্মকর্তা।



রাইজিংবিডি/কক্সবাজার/২২ জানুয়ারি ২০১৮/সুজাউদ্দিন রুবেল/বকুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়