ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৭, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
খালেদা জিয়ার ৫ বছরের কারাদণ্ড

নিজস্ব প্রতিবেদক : জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অর্থ আত্মসাতের দুর্নীতির মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

এ ছাড়া দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অন্য পাঁচ আসামির ১০ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের প্রত্যেককে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

বৃহস্পতিবার বেলা আড়াইটার দিকে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫ এর বিচারক ড. মো. আখতারুজ্জামান পুরান ঢাকার বকশীবাজারস্থ অস্থায়ী আদালতে এ রায় ঘোষণা করেন।

এর আগে গত ২৫ জানুয়ারি ১৬ কার্যদিবসে আসামিপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য আজকের দিন ঠিক করেন আদালত।

রায় ঘোষণার সময় মামলার প্রধান আসামি খালেদা জিয়া উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া গ্রেপ্তার প্রাক্তন এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদকে আদালতে হাজির করা হয়।

মামলায় ১০ বছর করে যাদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে তারা হলেন- খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান, প্রাক্তন এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ওরফে ইকোনো কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রাক্তন সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।

এদিকে রায় ঘোষণার পর বেলা ২ টা ৫০ মিনিটের দিকে কড়া পুলিশি পাহারায় খালেদা জিয়াকে একটি পাজারো গাড়িতে করে ঢাকার নাজিম উদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আসামিদের বাচ্চাদের জন্য একসময় ব্যবহৃত কিডস ডে কেয়ার সেন্টারের তিনতলা ভবনের নিচতলায় দুটি রুমে তার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এদিকে খালেদা জিয়ার গৃহপরিচারিকা ফাতেমা বেগমকে তার সঙ্গে গাড়িতে যেতে দেখা গেছে।

রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়াকে যখন জেলগেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য গাড়িতে তোলা হয়। তার পরপরই তার ব্যক্তিগত সহকারী শিমুল বিশ্বাসকে আটক করে নিয়ে যায় গোয়েন্দা পুলিশ। আদালত সূত্র জানা গেছে, তার বিরুদ্ধে ২০টি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে।

রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, এই মামলায় সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সাজা হয়েছে তাতেই আমরা খুশি।

প্রধান আসামি হওয়ার পরও খালেদা জিয়ার সামাজিক মর্যাদা ও বয়স বিবেচনায় তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, জানিয়ে এই আইনজীবী বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে আসামিরা পরস্পর যোগসাজসের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং দুদকের পক্ষ থেকে আমরা অনেক পরিশ্রমের পর সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি। বাংলাদেশে আর কোনো প্রধানমন্ত্রী বা তার সহযোগীরা এভাবে যেন আর কোনো এতিমের টাকা আত্মসাৎ করতে না পারেন এটা প্রার্থনা করছি।

মোশাররফ হোসেন কাজল আরো বলেন, বিশেষ করে দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ অনেক পরিশম করেছেন। অপরাধী যত ক্ষমতাবানই হোক না কেন কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। খালেদা জিয়া নির্বাচন করতে পারবেন কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সংবিধান অনুযায়ী তিনি নির্বাচন করতে পারবেন না।

এদিকে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এবং ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, খালেদা জিয়া কোনো দোষ করেননি। বেকসুর খালাস হওয়ার মামলা ছিল ওনার। তাকে দুদক এবং সরকার যোগসাজশ করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে এ মামলায় তাকে সাজা দিয়েছে। এটা রাজনৈতিক প্রতিহিংসার একটা দৃষ্টান্ত আজকে আমরা পেলাম। এটা একটা মিথ্যা, জালিয়াতি মামলা ।

ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এটা কি বিশ্বাসযোগ্য যে, কেউ কারো বাবার নামে বা স্বামীর নামে এতিমখানা করবে, মসজিদ, মাদ্রাসা করবে আর সেই টাকা কেউ আত্মসাৎ করবে। তিনি বলেন, এর আগে তারেক রহমানকে একটি মামলায় খালাস দেওয়ায় বিচারককে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে হয়েছে। আর সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ষোড়শ সংশোধনীর রায় দিয়েছিলেন। তাকে জোর করে ক্যান্সার রোগী বানিয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।

মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে বলেন, আমরা উচ্চ আদালতে আপিল করব এবং তার জামিন চাইব। উচ্চ আদালতে তারা ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা প্রকাশ করেছেন।

এর আগে বেলা পৌনে বারোটার দিকে গুলশানের ফিরোজা বাসা থেকে আদালতের উদ্দেশ্যে বের হন খালেদা জিয়া। ১টা ৫২ মিনিটে ক্রিম কালারের একটি শাড়ি আর কালো চশমা পড়ে আদালতে এসে পৌঁছান খালেদা জিয়া। এজলাসে তার জন্য একটি চেয়ার এবং দুটি ছোট টেবিল রাখা ছিল। চেবিলে একটি পানির বোতল এবং টিস্যুর বক্স রাখা ছিল। আদালতে প্রবেশ করে বিচারকের সামনে রাখা নির্দিষ্ট আসনে বসেন খালেদা জিয়া।

আদালতে ঢুকে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ কয়েকজন নেতা এবং সিনিয়র আইনজীবীদের কথা বলেন খালেদা জিয়া। এরপর বেলা ২টায় একটা ছোট রুমে খালেদা জিয়া প্রবেশ করেন। ৬ মিনিট অবস্থান করে তিনি আবার বেরিয়ে আসেন।

দুপুর ২টা ১১ মিনিটে রায় পড়তে আদালতে ওঠেন বিচারক। তিনি সকাল ১০টা ২০ মিনিটে আদালতে প্রবেশ করেন। মোট ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়ের বিশেষ অংশ পাঠ করেন বিচারক। প্রথমেই তিনি খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষীদের আদালত থেকে বের করে দেন। এরপর প্রায় ১৫ মিনিট বিচারক মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণী তুলে ধরেন। এ সময় খালেদা জিয়াকে বিমর্ষ দেখা যাচ্ছিল এবং তিনি চেয়ারের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে রায় পড়া শুনছিলেন। এরপর ২টা ২৫ মিনিটের দিকে বিচারক রায় ঘোষনা করেন।

রায় ঘোষণার পর পুলিশ খালেদা জিয়াকে ঘিরে ফেলে। এসময় তার কাছে কাউকে যেতে দেওয়া হয়নি। তবে পরবর্তীতে খালেদা জিয়া আব্দুর রেজ্জাক খান, এজে মোহাম্মদ আলী এবং জমির উদ্দিন সরকারকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। এরপর তাকে জেলহাজতে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদিকে খালেদা জিয়ার রায় শুনে অনেক আইনজীবী কেঁদে ফেলেন। কাউকে আবার খুবই বিমর্ষ দেখা গেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সিমকি ইমাম খান, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহম্মেদকে কান্নাকাটি করতে দেখা গেছে।

এদিন রায় ঘিরে আদালত প্রাঙ্গনে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়। র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। চানখারপুল এলাকা থেকে বকশীবাজার পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ রাখা হয়। জনগণের চলাফেরাও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। অনেক আইনজীবী আদালতে প্রবেশ করতে পারেননি বলে অভিযোগ করেন। আর আদালত প্রাঙ্গণে দুটি আর্চওয়ে রাখা হয়। 

আদালতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ, নজরুল ইসলাম খান, সৈয়দা আশিফা আশরাফি পাপিয়া উপস্থিত ছিলেন। আইনজীবীদের মধ্যে ছিলেন, খন্দকার মাহবুব হোসেন, মীর নাসির উদ্দিন, নিতাই রায় চৌধুরী, সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, জাকির হোসেন ভূঁইয়া, জয়নুল আবেদীন মেজবা প্রমুখ।

প্রসঙ্গত, এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলাটি দায়ের করেন দুদক কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট ওই কর্মকর্তাই খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ওই বছরের ১২ আগস্ট মামলাটি বিচারিক আদালতে যায়।

চার্জশিট দাখিল হওয়ার পর ওই বছর ৭ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার সদরঘাটস্থ মহানগর দায়রা জজ আদালতে প্রাক্তন এ প্রধানমন্ত্রী প্রথম মামলাটিতে হাজিরা দেন। ২০১০ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে মামলাটি বিচার শুরুর জন্য পাঠানো হয়। এরপর ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ সকল আসামির বিরুদ্ধে ওই আদালতের তৎকালীন বিচারক বাসুদেব রায় চার্জ গঠন করেন। একইসঙ্গে খালেদা জিয়ার অব্যাহতির আবেদন নাকচ করেন।

ওই বছরের ৫ মে মামলাটি পুরান ঢাকার সদরঘাটের আদালত থেকে বকশীবাজারস্থ আলিয়া মাদ্রাসার মাঠের অস্থায়ী আদালতে স্থানান্তর করা হয়। ২০১৪ সালের ২২ সেপ্টেম্বর মামলাটিতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়ে ২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়।

একই বছরের ১৯ অক্টোবর থেকে ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সাতটি ধার্য তারিখে খালেদা জিয়া আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রায় নয় ঘণ্টা বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন। সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর তিনি নিজেকে নির্দোষ ও খালাস পাওয়ার যোগ্য বলে দাবি করেন।

২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর মামলাটিতে যুক্তিতর্ক শুরু হয়। ওই দিন দুদকের পক্ষে দুই ঘণ্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে তা শেষ করা হয়। এরপর খালেদা জিয়ার পক্ষে ওই বছরের ২০ ডিসেম্বর থেকে ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০টি ধার্য তারিখে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়। কারাগারে থাকা আসামি শরফুদ্দিন আহমেদ ও সলিমুল হক কামালের পক্ষে ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচটি ধার্য তারিখে যুক্তি উপস্থাপন শেষে ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণার দিন ঠিক করা হয়।

আদালতের নথির হিসেবে অনুযায়ী, মামলাটি বিচারিক আদালতে আট বছর পাঁচ মাস ২৬ দিনে মোট ২৩৬টি ধার্য তারিখ পর রায় হলো।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/মামুন খান/সাইফ/ইভা/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়