ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত

জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত

কুমিল্লা সংবাদদাতা : ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র প্রিয় বাড়িটি আজও সংরক্ষিত হয়নি। বাড়িটি এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় চরম অবহেলায় পতিত পড়ে রয়েছে।

স্বাধীন পাকিস্তানের জন্মলগ্নে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতির দাবি তুলেছিলেন কুমিল্লার কৃতিসন্তান শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ছয় মাসের মাথায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নবগঠিত পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নে গঠিত ‘পাকিস্তান গণপরিষদ’ এর অধিবেশনে কোন ভাষা ব্যবহৃত হবে; এ প্রশ্নে তিনি বাংলা ভাষার দাবি উত্থাপন করেন। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে যা চির স্মরণীয় এক অধ্যায়।

শুধু তাই নয়, ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি করাচিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তার সংশোধনী প্রস্তাবটি দাখিলও করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সংশোধনী প্রস্তাবে ২৯ নং বিধির ১ নং উপ-বিধিতে উর্দু ও ইংরেজির পর ‘বাংলা’ শব্দটি যুক্ত করার দাবি জানান।

পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত মুসলিম লীগ সদস্যরা সেদিন বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। ১১মার্চ পাকিস্তান গনপরিষদে রাষ্ট্রভাষা উর্দু বিল পাশ হয়ে যায়। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত করাচির অধিবেশন থেকে ঢাকায় ফিরে এলে বিমান বন্দরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা তাকে বিপুল সম্বর্ধনা জানান। বলা হয়, ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত মূলত: সেখান থেকেই।

এরপরও থেমে থাকেননি এই বরেণ্য মানুষটি।১৯৫০ সালে গণপরিষদে আরবি হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করা হলে তিনি তীব্র প্রতিবাদ করেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মিছিলে গুলির প্রতিবাদে ২২ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করেন, তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

দেশপ্রেমিক এই মহান মানুষটির জন্ম ১৮৮৬ সালের ২ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে। আইন বিষয়ে পড়াশুনা করলেও প্রথমে শিক্ষকতায়, পরে রাজনীতিতে জড়ান। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম পাকিস্তান আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তিনি পাকিস্তান মন্ত্রীসভার সদস্য হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
 


তার পেশা, রাজনীতি এবং আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে শুরু করে সবই ছিলো কুমিল্লা কেন্দ্রিক। আমৃত্যু তিনি ছিলেন কুমিল্লার ধর্মসাগরের পশ্চিম পাড় তার নিজহাতে গড়া বাড়িতেই। এই বাড়ি থেকেই ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে পাক হানাদাররা তাকে ধরে নিয়ে যায়। হানাদারদের হাতে নির্মম মৃত্যু হয় তার।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব থাকা সত্ত্বেও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’র প্রিয় বাড়িটি আজও সংরক্ষিত হয়নি। যে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে পাক হানাদাররা হত্যা করেছিলো, সেই ঐতিহাসিক বাড়িটি এখন রিকশার গ্যারেজ, ঝোপঝাড় আর পরিত্যক্ত বাড়িতে পরিণত হয়েছে। বাড়িটিতে রয়েছে পৃথক তিনটি ভবন। পশ্চিম-উত্তর এবং পূর্ব পাশে তিনটি পাকা ভবনের ৬টি কক্ষেরই অত্যন্ত জরাজীর্ণ অবস্থা। পানি জমে এমন হয়েছে যে, দেখে মনে হবে ছোটখাট পুকুর আর নর্দমা।

মহান মানুষটির স্মৃতিচিহ্ন এমনকি বাস্তুভিটাও অযত্নে অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে। বর্তমানে বাড়িটির অত্যন্ত করুণ দশা। বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে একটি দরিদ্র মুসলিম পরিবার। তারা বাড়িটিকে রিকশা গ্যারেজে পরিণত করেছেন।

এই বাড়ির সামনের সড়ক এবং কুমিল্লা স্টেডিয়ামের নামকরণ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে করা হয়েছে। স্টেডিয়ামটির নামকরণ হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য আলহাজ্ব আ.ক.ম. বাহাউদ্দিন বাহারের প্রচেষ্টায়। ইতিহাস বিস্মৃত হলে জাতির দেশপ্রেমে ভাটা পড়ে। তাই আজ বাড়িটি সংরক্ষিত করে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে আরও স্মরণযোগ্য করে তোলার প্রয়াস গ্রহণ জরুরী।

এ বাড়িটির যথাযথ সংরক্ষণে সরকারের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন কুমিল্লাবাসী। নজরুল গবেষক অধ্যাপক ড. আলী হোসেন চৌধুরী, গল্পকার ও উপন্যাসিক প্রফেসর এহতেশাম হায়দার চৌধূরী, মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল এর সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল আহসান পাখি, নারীনেত্রী পাপড়ী বসু, শহীদ  ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি রক্ষা পরিষদের আহবায়ক অ্যাডভোকেট নাজমুল বারী চৌধুরী, মুরাদনগর যুবসমিতির আহবায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ তানভীর আহাম্মদ ফয়সালসহ কুমিল্লার সচেতন নাগরিকরা তার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি এভাবে অযত্নে ফেলে না রেখে এখানে একটি সমৃদ্ধ যাদুঘর স্থাপন জরুরী মনে করছেন।

কুমিল্লার প্রথম প্রশাসক ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভাষা আন্দোলন যদি স্বাধীনতার মূল হয় তাহলে কুমিল্লার অবদান সবচাইতে বেশি। একদিকে ধীরেন বাবু (ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত) অন্যদিকে রফিকুল ইসলাম। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা আন্দোলনে প্রথম বীজ বপন করেছেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রথম রক্ত ঝরেছিল কুমিল্লায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতির প্রথম দাবি তুলেছিলেন কুমিল্লার রফিকুল ইসলাম।’

অ্যাডভোকেট আহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমি যখন প্রশাসক ছিলাম তখন ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম মালাটা (ফুল) দিয়েছিলাম ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বাড়িতে, তার প্রতিকৃতিতে। তারপর শহীদ মিনারে গিয়েছি। আহারে সেই ঐতিহাসিক বাড়িটির আজ কি দশা! দেখে মায়া লাগে।’

দৃষ্টির নির্বাহী পরিচালক নারীনেত্রী পাপড়ী বসু বলেন, ‘৫২’র সেই ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা অর্জিত হয়। এ অর্জনের জন্যে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু গণপরিষদে কিংবা রাজপথেই আন্দোলন করেননি, একাধিকবার কারাবরণও করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যুদ্ধ চলাকালে কনিষ্ঠ ছেলে দীলিপ দত্তসহ ২৯ মার্চ রাত দু’টোয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি এবং পরে কুমিল্লা সেনানিবাসের অন্ধকার বন্দিশিবিরে নির্মম হত্যার শিকার হন হন তিনি।’



রাইজিংবিডি/কুমিল্লা/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়