ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

কেমন আছে যশোরের হরিজনরা

বিএম ফারুক || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২১, ১৭ মার্চ ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কেমন আছে যশোরের হরিজনরা

বি এম ফারুক, যশোর : নিচু জাতের লোকজনকেই বলা হয় হরিজন। কেউ বলেন দলিত। আরো সহজ করে বললে মেথর, সুইপার, ঝাড়ুদার, ডোম ইত্যাদি। কেমন আছেন যশোরের হরিজনরা?

ভারতের অহিংস আন্দোলনের জনক মহাত্মা গান্ধী দলিতদের ‘হরিজন’ করে গেলেও ওরা এখনো অচ্ছ্যুৎ-ই রয়ে গেছে। হরিজনদের হাতের খাবার-দাবার এখনো অস্পৃশ্য যশোরে।

‘সমাজের ময়লা-আবর্জনা আমরা পরিস্কার করি। আর আমরাই থাকি অবহেলিত’ বলেন যশোর শহরের চিত্রা মোড়ের ডোম পট্টির বাসিন্দা মতিলাল।

মতিলাল ‘মেথর’ এর কাজ করেন। চিত্রা মোড়ের এই ডোম পট্টিতে মানবেতর জীবনযাপন তাদের। খুপড়ির মতো একেকটি ছাপড়া ঘরে মাথা গোঁজার ঠাঁই কম করে হলেও একসঙ্গে পাঁচজনের। অনেকটা খোঁয়াড়ের মতো। ঠিক একই অবস্থা যশোরের আরও আটটি হরিজন পল্লীর।

স্বদেশে থেকেও যেন পরদেশী। চারপাশের সমাজের কাছে অস্পৃশ্য। শুধু সামাজিক ভাবেই নয়, ধর্মীয় ভাবেও অবহেলিত। তাদের করুণ জীবনের গল্প শোনেনা কেউ। অথচ তারাই দেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজে নিয়োজিত থেকে সহজ-স্বাভাবিক করে তুলছেন আমাদের জীবন।

মতিলাল যশোর পৌরসভার একজন কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত তার লেখাপড়া। প্রতিদিন সকালে পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে বের হন। তার অধীনে এ সম্প্রদায়েরই অন্তত ৫০০ শ্রমিক কাজ করেন।

প্রতিদিন টয়লেট থেকে শুরু করে শহরের সকল আবর্জনা সরিয়ে পরিচ্ছন্ন করে তুললেও নিজেদের বসবাসের স্যানিটেশন ব্যবস্থার যাচ্ছে তাই অবস্থা। সময়ে-অসময়ে জলে-কাদায়-বন্যায় ভেসে যাওয়া, পঁচা-বাসি খাবার খাওয়া, সভ্য জগতের কাছে একেবারেই অকল্পনীয় একটি জীবনের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া- এটাই যেন এদের জীবনের চরম সত্য।

চিত্রা মোড়ের এই ডোম পট্টির আরেক ক্ষুদে সদস্য সুমিত যশোর মুসলিম একাডেমির ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। সুমিত জানায়, তার বাবা মাসিক ১১০০ টাকা মাসিক বেতনে পৌরসভার কর্মচারী। এ টাকা দিয়ে তাদের কিছুই হয়না। কোচিং, স্কুলের বেতন, প্রাইভেট পড়া, ভর্তি, স্কুলের টিফিন- কোন কিছুই জোগাতে সক্ষম নয় তার বাবা।

কথা হয় এখানের সোমারাণির সাথে। জানান, বস্তির ঘিঞ্জি ঘরে দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। ছেলেরা বড় হয়েছে। এক ঘরের মধ্যে লজ্জা নিয়ে থাকতে হয়। আমাদের লজ্জার শেষ নেই। 

যশোর পৌর এলাকার সিটি কলেজপাড়া, টালিখোলা, গোরাপাড়া, ঢাকা রোড, আরবপুর মাঠপাড়া ও রেলবাজার- সব পল্লীরই একই অবস্থা। শহরের চিত্রা মোড়ের পল্লীটি ১৯ শতক জমির উপর গড়ে উঠেছে। এখানে ৩০টি পরিবারের বসবাস। এই পল্লীতে বসবাস করে দেড় শতাধিক মানুষ।

কথা হয় এ পল্লীর আরেক সদস্য পান্না লালের সাথে। জানালেন, সমাজে তারা খুবই অবহেলিত। অনেক মানুষই এখানে আসেন। তাদের খোঁজ-খবর নেন। কিন্তু তাদের জীবনের কোন পরিবর্তন হয়না। সবাই শুনে চলে যান।

কথা হলো এ পল্লীর ডাব্লু’র সাথে। মনে হলো সে একটু প্রতিবাদী। জানালেন তার ক্ষোভের কথা। ক্ষোভ প্রকাশ করে বললেন, ‘আমরা রাস্তাঘাটে চায়ের দোকানে চা খেতে পারি না। আমাদেরকে দোকানের কাপে চা দেওয়া হয় না। বাড়ি থেকে কাপ-গ্লাস নিয়ে যেতে হয়। তারপর চা দেওয়া হয়। তা না হলে দোকারদাররা চা দেয় না।’

কথা হয় চিত্রা মোড়ের চা দোকানি হোসেন আলীর সাথে। বলেন, ‘হরিজনরা বাড়ি থেকে কাপ-গ্লাস নিয়ে আসলে তাদের চা দেওয়া হয়। এছাড়া তার দোকানে হরিজনদের জন্য আলাদা করে কাপ রাখা আছে।’

উন্নয়ন সংস্থা ‘ধারা’ হরিজনদের নিয়ে কাজ করে। ধারা’র নির্বাহী পরিচালক লিপিকা দাসগুপ্তা জানান, যশোরের ছয়টি হরিজন পল্লীতে প্রকল্প চালু আছে। এই প্রকল্পে ১ হাজার ৮৩৪জনকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

হরিজনদের নিয়ে কাজ করা যশোরের বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘এডাব’ এর সেক্রেটারি শাহজাহান নান্নু বললেন, যশোরের হরিজনদের মানবাধিকার বিষয়ে এডাব কাজ করছে। এছাড়া শিশুদেরকে শিক্ষা নিয়েও করা করা হচ্ছে। সামাজিক কিছু বিষয়ে উন্নয়নমূলক কাজ করা হয়েছে। তবে খুব বেশি কাজ হয়নি।

যশোর জেলা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, ‘হরিজনদের নিয়ে সরকারের কোন কার্যক্রম নেই। কিছু এনজিও আছে যারা ব্যুরোর মাধ্যমে হরিজনদেরকে নিয়ে কাজ করে। তবে সরকার ২০২২ সালের মধ্যে ৩ কোটি ২৫ লাখ নিরক্ষরের কাছে শিক্ষা নিয়ে যাবে। সে সময় হরিজনদেরকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হবে।’

যশোরের হরিজনদের কি অবস্থা? এমন প্রশ্নে যশোর সমাজ সেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক অসিত কুমার সাহা বলেন, ‘হরিজনদের নিয়ে আমাদের কোন কার্যক্রম নেই। তবে দলিতদের নিয়ে একটা প্রকল্প আছে। ওই প্রকল্পে জেলা থেকে সাত জন ভাতা পায়।’



রাইজিংবিডি/যশোর/১৭ মার্চ ২০১৮/বি এম ফারুক/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়