ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তিস্তায় পানি নেই, সেচের বাইরে অর্ধলাখ হেক্টর জমি

নজরুল মৃধা || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৯, ২০ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিস্তায় পানি নেই, সেচের বাইরে অর্ধলাখ হেক্টর জমি

নিজস্ব প্রতিবেদক, রংপুর: তিস্তায় প্রতিবারের মত এবারও পানি সংকট ভয়াবহ। ব্যারেজ কর্তৃপক্ষ বলছেন এবার তিস্তার পানি দিয়ে শতভাগ সেচ দেওয়া সম্ভব হবেনা।

পানি স্বল্পতার কারণে রংপুর ও দিনাজপুরের ৬টি উপজেলাকে সেচ সুবিধা থেকে বাদ রেখে সেচ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে এই দুই জেলায় প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমি সেচ সুবধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। চলতি বোরো মৌসুমে অনেক জমিতে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় কৃষকদের সেচ দিতে হবে।

অপরদিকে তিস্তা প্রকল্পের সেচের জন্য ৩৪টি সংযোগ খালের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। দীর্ঘদিন থেকে সংস্কার না হওয়ায় তলদেশে পলি জমে খালগুলো অনেকাংশে ভরাট হয়ে গেছে। সরকার যদি জরুরী ভিত্তিতে খালগুলো সংস্কার না করে তা হলে অচিরেই খালগুলো ভরাট হয়ে অর্কাকর হওয়ার আশঙ্কা করছেন তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, গত মঙ্গলবার হতে চলতি বোরো মৌসুমে দেশের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প তিস্তা ব্যারেজের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে নীলফামারী থেকে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রমতে, সপ্তাহ দুয়েক আগেও  ডালিয়া পয়েন্টে পানি প্রবাহ ছিল দু’হাজার  হাজার কিউসেক।  এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় এক হাজার কিউসেক। ফলে তিস্তা নদী এখন ধূ-ধূ বালুচরে পরিণত হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বোরো মৌসুমে রংপুর ও নীলফামারী জেলার ২৯ হাজার ৫০০ হেক্টর জমি সেচের আওতায় নেওয়া হয়েছে। তিস্তার সেচ কমান্ড এলাকার মাত্র ৪ হাজার কৃষক এই সেচের সুবিধা পাবেন। সেচ কমান্ড এলাকায় ৭৯ হাজার হেক্টরে সেচ সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। কিন্তু সেচ দেওয়া হবে মাত্র ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে। দিনাজপুর ও রংপুরের কমান্ড এলাকার  প্রায় অর্ধলাখ হেক্টর জমি সেচ কার্যক্রম থেকে বাদ দিয়ে শুধু নীলফামারী জেলার ডিমলা, জলঢাকা, নীলফামারী সদর, রংপুরের তারাগঞ্জ বদরগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া উপজেলাকে সেচের আওতায় রাখা হয়েছে। তবে উজানের প্রবাহ পাওয়া গেলে সেচের জমির পরিমাণ রংপুর ও দিনাজপুরে বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্ট সুত্র।

পানি উন্নয়ন বোর্ড ও তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্প সূত্র জানায়, সেচ প্রকল্প এলাকায় সেচ দেওয়া এবং নদীর প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে তিস্তা ব্যারেজ পয়েন্টে স্বাভাবিক প্রবাহমাত্রায় ২০ হাজার কিউসেক পানি থাকা প্রয়োজন। শুধু সেচ প্রকল্প চালাতেই প্রবাহমাত্রা থাকা প্রয়োজন ১৪ হাজার কিউসেক এবং নদীর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজন চার হাজার কিউসেক পানি।

এদিকে তিস্তা অববাহিকার ৫ হাজার ৪২৭টি গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এই নদীর ওপর নির্ভরশীল। তাই তিস্তার পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় এখানকার মানুষের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে চরম অনিশ্চয়তা। তিস্তা অববাহিকার ৮ হাজার ৫১ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্যে পড়েছে। আর সমতল ভূমিতে তিস্তা অববাহিকার পরিমাণ ৪ হাজার ১০৮ বর্গ কিলোমিটার। যার প্রায় অর্ধেক অংশ পড়েছে বাংলাদেশের সীমানায়। দুই দেশই তিস্তার পানির সর্বোত্তম ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন সময়ে নদীর ওপর ও আশপাশে ব্যাপক অবকাঠামো তৈরি করেছে।

ভারত এই মুহূর্তে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ কার্যক্রমের জন্য তিস্তার পানি ব্যবহার করছে।  অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার পানি ব্যবহার করছে শুধু পরিকল্পিত সেচ দেওয়ার কাজে। কিন্তু গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে  বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের একচেটিয়া পানি প্রত্যাহারের কারণে বাংলাদেশ অংশে তিস্তার পানি ক্রমাগত কমে গেছে। তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল এলাকাগুলোকে সেচের আওতার বাইরে রাখায় কৃষি উৎপাদন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, ১৯৯৩-৯৪ শস্যবছর থেকে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের ১২টি উপজেলায় ব্যাপকভাবে আউশ ও আমন উৎপাদনের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষে তিস্তার পানি দিয়ে সেচ কার্যক্রম শুরু হয়। পরে ২০০৬-০৭ শস্যবছর থেকে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষে বোরো মৌসুমেও সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারিত করা হয়। আমন মৌসুমে মোট সেচযোগ্য ৭৯ হাজার ৩৭৯ হেক্টর এলাকার প্রায় সম্পূর্ণটাই সেচের আওতায় আনা সম্ভব হলেও বোরোর ক্ষেত্রে পানির দু দুষ্প্রাপ্যতায় সেচ-সাফল্যের চিত্র একেবারেই হতাশাজনক।

শুকনো মৌসুমে যে সামান্য পরিমাণ পানি ভারতের প্রত্যাহারের পর তিস্তা নদীতে পাওয়া যায় তার সবটুকুই সেচ চাহিদা মেটানোর লক্ষে তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্পের মাধ্যমে ৩৪ সেচ খালের মাধ্যমে কৃষিজমিতে সরবরাহ করা হচ্ছে। এর দরুণ ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তা ব্যারাজের পর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত ৬৫ কিলোমিটার বিস্তৃত তিস্তা নদীতে এক কিউসেক পানিও থাকছে না। এ কারণে তিস্তা অববাহিকার বাংলাদেশ অংশের এই বিশাল পরিমাণ নদীগর্ভ পরিণত হচ্ছে বালুচরে। তিস্তা ব্যারাজ এলাকার পর শুকনো মৌসুমে এভাবেই নদী মারা যাচ্ছে। অপরদিকে দীর্ঘদিন থেকে সেচ খালগুলো সংস্কার না করায় খালগুলোর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অল্প সময়ে খালগুলো অকার্যকর হয়ে পড়বে।

ডিসেম্বর মাসের পর থেকে তিস্তায় পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যায়। শুধু তাই নয়, বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানির কারণে ব্যারেজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকার ফসল ও বাসাবাড়ি ঝুঁকির মুখে পড়ে। ভারত তখন সব গেট খুলে দেয়। এতে ব্যারেজের ৪৪টি গেট ২৪ ঘন্টা খুলে দিয়ে পানি সরানো সম্ভব হয় না।

তিস্তা ব্যারেজ সেচ প্রকল্পের কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী বলেন, ‘আমরা এবার তিস্তা প্রকল্পের ২৯ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার লক্ষমাত্রা নিধারণ করেছি। পানির প্রবাহ বাড়লে সেচের আওতা বাড়ানো হবে।’

তিস্তা পানি ব্যবস্থাপনা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমানও পানি স্বল্পতার কারণে কমান্ড এলাকার পুরো এলাকায় সেচ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না স্বীকার করে জানান, এখন বড় সমস্যা হচ্ছে সেচখালগুলো। দীর্ঘদিন থেকে খালগুলো সংস্কার না করায় এগুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। জরুরী ভিত্তিতে খালগুলো সংস্কার করার দরকার বলে তিনি মনে করেন।




রাইজিংবিডি/রংপুর/২০ জানুয়ারি ২০১৯/নজরুল মৃধা/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়