‘বিশ্বকাপ তারকার জন্ম দেয়’
বেশিদিন আগের কথা নয়, দুবাইয়ের বিরুদ্ধ কন্ডিশনে বাংলাদেশকে পরপর দুটি ম্যাচে বাঁচিয়েছেন তিনি। এরপর সবকিছুই তার পক্ষে যাচ্ছে। থিতু হয়েছেন জাতীয় দলে। এবার প্রথমবারের মতো পেতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপের স্বাদ।
বয়স বাড়ছে। বাড়ছে দায়িত্ব। ব্যাটিংয়ের মধ্যভাগে দলের স্কোরবোর্ড সচল রাখার দায়িত্বটা তার। সেটাও বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। সামর্থ্য নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই। নিজের দিনে তিনি সেরা। এবার বিশ্বমঞ্চে সবকটি দিন নিজের মতো করে রাঙাতে চান। উজার করে দিতে চান সবকিছু। হতে চান বিশ্বমঞ্চে বড় ধ্রুবতারা। হতে চান বাংলাদেশের তারকা। ধুমকেতু হয়ে আসা সেই তারার নাম মোহাম্মদ মিথুন। মিরপুরের একাডেমির সবুজ ঘাসে বসে মিথুনের সঙ্গে বিশ্বকাপ নিয়ে কথা বলেছেন রাইজিংবিডির ক্রীড়া প্রতিবেদক ইয়াসিন হাসান।
যখন বিশ্বকাপ দলে নিজের নাম দেখলেন সর্বপ্রথম কার কথা অনুভূত হয়েছিল?
মিথুন: ওভাবে তো মনে নেই। তবে সৃষ্টিকর্তার প্রতি শুকরিয়া আদায় করেছি। বাবা-মার কথা তো মনে পড়েছে। আমার স্ত্রী নিগার সুলতানা ও সন্তান আব্রাহামের কথা তো মনে করেছি। ওদের জন্যই তো আমি আজ এখানে।
আপনার ক্যারিয়ার গড়ার পেছনে আপনার জীবনসঙ্গিনীর অবদান সবথেকে বড় বলেই শুনেছি?
মিথুন: ঠিক শুনেছেন। ও আমার জীবন গুছিয়েছে। আমাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কখন কি করতে হবে। কখন কি ভাবতে হবে। কিভাবে ইতিবাচক থাকা যায়। কিভাবে আত্মবিশ্বাস রাখা যায়। নিজের লক্ষ্যে স্থির থাকা যায়…এগুলো সব বুঝিয়েছে। ওর অনুপ্রেরণা আমার অনেক কাজে দিয়েছে।
আপনি তো ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন। বাজে ফর্মের কারণে বাদ পড়লেন। ওই সময়টায় পরিবার কিভাবে সমর্থন করল। যদি ভেঙে বলি আপনার স্ত্রীর সমর্থন…
মিথুন: ওই সময়টা আসলেও খুব খারাপ কেটেছিল। আমি হতাশায় ভুগছিলাম। এমনিতেই আমি দীর্ঘদিন পর জাতীয় দলে ঢুকেছি। এরপর ঢুকেই আবার বাদ! মনে হচ্ছিল আমার সুযোগগুলো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার স্ত্রী বুঝিয়েছে আমার পেশার প্রতি অবহেলা না করতে। আমার লক্ষ্যে স্থির থেকে এগিয়ে যেতে। পরিবারের দায়িত্ব সে সামলেছে। বাইরের সবকিছু আমি দেখেছি।
এবারের বিশ্বকাপের আগে কখন থেকে মনে হচ্ছিল আপনি বিশ্বকাপ দলে সুযোগ পাবেন?
মিথুন: এশিয়া কাপের পরপরই আমার মনে হচ্ছিল দল আমার ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারছে। জিম্বাবুয়ে ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ মোটামুটি কেটেছিল। নিউজিল্যান্ডে দুটি ফিফটি ছিল। ভাবনায় ছিল যে বিশ্বকাপে টিকে যাব।
আপনার পজিশনে প্রতিযোগীতা কম বলে কি টিকে গেলেন? নাকি পারফরম্যান্স বিবেচনায় আসল। আমাদের ফিফটি পারফরম্যান্সগুলো বেশি মূল্যায়ন হচ্ছে নাকি?
মিথুন: মোটেও না। আমি যেসব পারফরম্যান্স করেছি সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ সময়ে। দলের অবদান রাখতে পেরেছি। হ্যাঁ আরো বড় করার সুযোগ ছিল। সেগুলো করতে পারিনি। কিন্তু প্রতিযোগীতা কম সেটা বিশ্বাস করি না। কারণ জাতীয় দলে এক পজিশনে এখন অনেক খেলোয়াড়। সাইডবেঞ্চও স্ট্রং। একজন খারাপ করলে আরেকজন অটোমেটিক রেডি আছে।
মিথুনের প্রথম বিশ্বকাপ স্মৃতি?
মিথুন: ১৯৯৯ বিশ্বকাপ প্রথম দেখেছি। বসয় তখন ৯-১০ হবে। ক্রিকেট তো বুঝি না সেভাবে। পরিবারের সবাই, আশেপাশের বাড়ির সবাই মিলে একসঙ্গে খেলা দেখেছি ওটাই। ২০০৭ সালে আসলে বিশ্বকাপ কি জিনিস, কত বড় টুর্নামেন্ট সেটা বুঝেছি। প্রথম ম্যাচে ভারতকে হারানোর স্মৃতি এখনও মনে আছে।
যদি এক কথায় বলতে বলি, মিথুনের কাছে বিশ্বকাপের মানে কি?
মিথুন: এটা ক্রিকেটের সবথেকে বড় আয়োজন। বড় বড় ক্রিকেটারা এখানে ভালো খেলেই তারকা হয়েছে। বিশ্বকাপ তারকার জন্ম দেয়।
আপনি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলেছেন ২০১৬ সালে, কিন্তু পরে বাদ পড়েছিলেন। এরপর ব্যাটিংয়ে কোন জায়গায় ইমপ্রুভ করেছেন যে আপনি আবার জাতীয় দলে ফিরলেন?
মিথুন: ব্যাটিংয়ে আমার শটস বেড়েছে। কিন্তু যেখানে আমার সবথেকে বেশি উন্নতি হয়েছে সেটা হলো মানসিকতা। আমার হাতে শটস আছে। সেটা যদি মাঠে প্রয়োগ করতে না পারি তাহলে কোনো লাভ নেই। আমার মানসিকতা পাল্টেছে অনেক বেশি। মাঠে গিয়ে নার্ভারনেস কাজ করে না। আত্মবিশ্বাস থাকে প্রচুর। বোলারদের আক্রমণ যেমনই হোক আমি নিজের জায়গায় স্থির থাকি। বাড়তি কিছু করার থেকে নিজের সামর্থ্যে ভরসা রাখি। এটা আমাকে অনেক এগিয়ে নিয়েছে।
কোন ইনিংসটার কথা বলবেন যেটা দিয়ে আপনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন ভালোভাবে?
মিথুন: এশিয়া কাপে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সাথে দুটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলাম। সেগুলো আমাকে লাইমলাইটে নিয়ে আসে। পাকিস্তানের বিপক্ষে ৬০ রানের ইনিংসটি আমার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্টও বলা যেতে পারে।
অধিনায়ক মাশরাফির কোনো ভূমিকা, ক্যারিয়ার গড়তে?
মিথুন: মাশরাফি ভাই খুব ভালো একজন মোটিভেটর। উনি খুব ভালো মোটিভেট করতে পারে। গত দুই বছর উনার সঙ্গে একই দলে বিপিএল ও প্রিমিয়ার লিগে খেলার কারণে প্রচুর কথা হয়েছে। ওনার কিছু কিছু কথা সত্যিকার অর্থেই আমাকে মোটিভেট করেছে। আমার আত্মবিশ্বাসের লেভেলকে সমৃদ্ধ করতে ভূমিকা রেখেছে মাশরাফি ভাই।
ন্যাচরাল স্ট্রোক মেকার আপনি। ইংল্যান্ডে ট্রু উইকেটে ব্যাটসম্যানদের হেল্প করে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে তামিম, মুশফিক, মাহমুদউল্লাহ, সাকিব ভালো করেছিল। সেই ম্যাচগুলো হয়তো দেখা হয়েছে। এতোটুকু বিশ্বাস কি আছে আপনার সুযোগ এলে আপনিও সেরকম পারফর্ম করতে পারবেন।
মিথুন: দল এমন ব্যাটসম্যানই চায়, যারা দ্রুত রান করতে পারবে। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাটিং করাটা জরুরি। আমি যদি হাইরিস্ক নিয়ে স্কোর গড়তে চাই, তাহলে আমি দ্রুত আউট হয়ে যাবো। চেষ্টা থাকবে রিস্ক মিনিমাইজ করে স্কোরবোর্ডের রানকে সচল রাখার। আমি সব সময়ই দলের চাহিদা অনুযায়ী খেলার চেষ্টা করি। কখনো সফল হই, কখনো হই না। বিশ্বকাপেও এই চেষ্টা অব্যহত থাকবে।
এশিয়া কাপে আপনার গুরুত্বপূর্ণ ইনিংসগুলো আটকে গিয়েছিল হাফ সেঞ্চুরিতে। বিশ্বকাপে আপনার হাফ সেঞ্চুরিগুলো কি সেঞ্চুরিতে রূপ পাবে এবার?
মিথুন: স্বপ্নতো অবশ্যই দেখি। তবে চাইব আমাদের টপ অর্ডারই যেন সব রান করে। মিডল অর্ডারে দায়িত্ব পেলে চেষ্টা করব এই আক্ষেপ দূর করতে। বিদেশের মাটিতে প্রথম সেঞ্চুরি পেলে মন্দ হয় না। মিডল অর্ডারে রিয়াদ ভাই নেমে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করেছেন, তিনি এক্ষেত্রে বড় মোটিভেটর হতে পারেন।
সেখানে ভালো করার মন্ত্র কি হতে পারে?
মিথুন: প্রত্যেক খেলোয়াড়ের নিজস্ব একটা গাইডলাইন থাকে। সেটাই সবাই ফলো করে। ইংল্যান্ডের মতো কন্ডিশনে ভালো করতে হলে সাহস ও আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন। এইটুকু থাকলেই যে কোন বোলারের বিপক্ষেই ভালো করা সম্ভব।
মিথুনের সবথেকে শক্তির জায়গা?
মিথুন: স্ট্রোক প্লে। আমি বাজে বল পেলে স্ট্রোক খেলতে পছন্দ করি।
মিথুনের দূর্বল জায়গা?
মিথুন: এটা আমি কিভাবে বলবো … (হাসি)
মিথুনের পছন্দের পজিশন?
মিথুন: এখন যেখানে ব্যাটিং করছি সেখানেই খেলতে পছন্দ করি। এতে বড় ইনিংস খেলার সম্ভাবনাও থাকে আবার ফিনিশিংয়ের সম্ভাবনা থাকে।
বিশ্বকাপে আপনার স্বপ্নের পারফরম্যান্স কেমন হতে পারে?
মিথুন: বড় কোনো দলের বিপক্ষে বাংলাদেশকে ম্যাচ জেতাতে পারলে খুব ভালো লাগবে।
এমন কোনো পারফরম্যান্স মনে পড়ে, যেটা দেখে ইচ্ছা হয় ওরকম ব্যাটিং যদি করতে পারতাম?
মিথুন: সেভাবে অনেক পারফরম্যান্সের কথাই তো মনে পড়ছে। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ ভাইয়ের সেঞ্চুরি।
মাঝ বয়সে আপনার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু হয়েছে। এ বিশ্বকাপ কি আপনার ক্যারিয়ারের সবথেকে টার্নিং পয়েন্ট হতে পারে?
মিথুন: সত্যি কথা বলতে, আমার বিশ্বকাপ নিয়ে কোন স্বপ্ন ছিল না। বিশ্বকাপ খেলব তাও ভাবিনি। আমার স্বপ্ন ছিল জাতীয় দলের হয়ে খেলা। জানতাম জাতীয় দলের হয়ে ভালো খেলতে থাকলে একদিন বিশ্বকাপও খেলব। তাই বিশ্বকাপ নিয়ে বাড়তি চিন্তা করিনি।
আরেকটি বিশ্বকাপ খেলার ইচ্ছা আছে?
মিথুন: সেটা এখনই বলা কঠিন। আমাকে জাতীয় দলে থিতু হতে হবে। তাহলে বাকি কাজগুলো অবলীলায় হয়ে যাবে।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ মে ২০১৯/ইয়াসিন/আমিনুল
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন