ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ভাষার ব্যবহার ও গালির মারপ্যাঁচ

মোজাফ্‌ফর হোসেন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২৮, ২০ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাষার ব্যবহার ও গালির মারপ্যাঁচ

|| মোজাফ্‌ফর হোসেন ||

মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ আবিষ্কার হলো ভাষা বা ভাষার ব্যবহার। মানুষ অন্যসব প্রাণীদের থেকে এগিয়ে তার প্রধান কারণ মানুষের ভাষা-জ্ঞান। ভাষার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সভ্যতার প্রকাশ ও বিকাশ ঘটেছে। ভাষার ব্যবহার করেই মানুষ হয়েছেন বিখ্যাত, জাতিগতভাবে উন্নত। সক্রেটিস যদি ভাষাহীন হতেন, গ্যালিলিও যদি তাঁর বিশ্বাসের কথা না বলতে পারতেন তাহলে তাঁদের ঐভাবে মৃত্যু হতো না। ভাষা না থাকলে জন্ম হতো না কোনো ধর্মগ্রন্থ কিংবা দর্শনশাস্ত্রের। ভাষা না থাকলে বিখ্যাত হতেন না শেক্সপিয়র, হোমার, মিল্টন, রবীন্দ্রনাথ, গ্যেতে, হেমিংওয়ে, তলস্তয়সহ পৃথিবীর তাবৎ কবি-সাহিত্যিক। ভাষা না থাকলে আমরা চিনতাম না প্লেটো, ফ্রয়েড, ডারউইন, কার্ল মার্ক্সদের। ভাষার মধ্য দিয়েই আন্দোলন করেছেন লেলিন, গোর্কি, গান্ধী, ম্যান্ডেলা, ফিদেল কাস্ত্রো, চে গুয়েভারাসহ পৃথিবীর তাবৎ যোদ্ধা। আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে- মার্টিন লুথার কিংয়ের ইতিহাস সৃষ্টিকারী ভাষণ- ‘I have a Dream’; কিংবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসকোর্স ময়দানের সেই ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ- ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মানব মুক্তির পথ বাতলে দিয়েছে কেবলমাত্র ভাষার নিপূণ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই। আবার এই ভাষা ব্যবহার করে হিটলার পরিচালনা করেছেন পৃথিবীর জঘণ্যতম হত্যাযজ্ঞ। ঘটে গেছে অসংখ্য যুদ্ধ। কাজেই দেখা যাচ্ছে- ভাষায় হলো মানুষের প্রধান হাতিয়ার, আবার প্রধান ঢালও। বলাই বাহুল্য, মানুষ ভাষাহীন হলে পৃথিবীর ইতিহাস ভিন্নতর হতো।

গালিগালাজ বা গালমন্দ হলো ভাষার অন্যতম ব্যবহার। গালির সমার্থক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে- খিস্তি করা, অপভাষা, কটু কথা, অশ্লীল শব্দ, কাজি করা, মুখ খারাপ করা; যাকে ইংরেজিতে বলা হয়-  slang, slanguage, informal words, verbal violence/war. The Historical Dictionary of American-তে গালির সজ্ঞা দিতে গিয়ে বলা হচ্ছে, ‘Slang is lexical innovation within a particular cultural context.’ Microsoft Encarta 97 Encyclopedia- তে বলা হয়েছে, ‘slang can be described as informal, nonstandard words or phrases (lexical innovations) which tend to originate in subcultures within a society.’ Wikipedia-র মতে, ‘Slang is the use of informal words and expressions that are not considered standard in the speaker's dialect or language. The Columbia Encyclopedia-এর মতে গালি হচ্ছে প্রায়ই- ‘well developed in the speaking vocabularies of cultured, sophisticated, linguistically rich languages.’

গালিগালাজ মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে বটে তবে ক্ষেত্রবিশেষ এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। মানুষ যেদিন থেকে ভাষার ব্যবহার শিখেছে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছে গালিগালাজ করা। তবে গালিগালাজ ভাষা-নির্ভর নয়, সংস্কৃতি-নির্ভর। এবং ভাষা সবসময় Contextualized বা প্রয়োগ-সম্পর্কিত, এক্ষেত্রে গালিগালাজ ভাষার Intensifier হিসেবে কাজ করে থাকে। যে কারণে এই গালিগালাজের প্রকার ও ধরণ সমাজ, স্থান ও সময়ভেদে ভিন্নতর হয়। এক স্থানের স্তুতি কথা অন্যস্থানে গালি হিসেবে ব্যবহারের নজির দেখা যায়। যেমন, যুক্তরাজ্যে ‘fag’ মানে সিগারেট, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ‘fag’ বলতে হোমোসেক্সুয়াল পুরুষ বোঝায়। আবার আমেরিকানদের কাছে ‘ব্লাডি’ গালি না হলেও ব্রিটিশদের কাছে গালি হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে মেহেরপুরের গ্রামাঞ্চলে ‘খাসি’ শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বন্ধুদের মাঝে বা ইনফর্মাল আড্ডায় ‘শালা’, ‘গাধা’, ‘কুত্তা’ এ-জাতিয় শব্দ গালি মনে না হলেও বড়দের মাঝে বা ফর্মাল বৈঠকে তা ব্যবহার করা হলে গালি হিসেবে গণ্য করা হবে। আবার সমাজের অশিক্ষিত মানুষের কাছে যা বুলি তা অনেকসময় শিক্ষিত মানুষের কাছে গালি হিসেবে চিহ্নিত হয়। যেমন, নিম্নশ্রেণির মানুষেরা ‘মাগি’, ‘ভাতার’, ‘মিনসে’ শব্দগুলো সাধারণ অর্থেই হরহামেশা ব্যবহার করে কিন্তু এই শব্দগুলো শিক্ষিত সমাজে বা মান-ভাষায় (Standard variety of language) গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। জেন্ডারভেদেও গালির ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। পুরুষদের সাধারণ আড্ডায় অনেক শব্দ ব্যবহার করা হয় যা নারী মহলে গালি হিসেবে চিহ্নিত। যেমন- হুদায়, চোঁদনা, বাড়া, বকচোদ ইত্যাদি।

গালি হিসেবে যে শব্দগুলো ব্যবহার করা হয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেগুলোর অধিকাংশ এসেছে জীবজন্তু বা যাকে আমরা নিম্নশ্রেণির জীব বলে থাকি সেসব থেকে; যেমন- উল্লুক, কুত্তা, গাধা, ছাগল, পাঁঠা, শুয়োর, ছুঁচো, পেঁচা, মষ (মহিষ), ভাম, বান্দর ইত্যাদি। কিছু এসেছে নেতিবাচক বা তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত শব্দ থেকে; যেমন- ফাল্তু, রোগা, মূর্খ, বোকা, হাঁদা, মরণ, পচা, পাজি ইত্যাদি। কিছু এসেছে রোগের নাম এবং শারীরিক ত্রুটি থেকে; যেমন- পাগল, কলেরা, যক্ষ্মা, বসন্ত, মৃগী, জিনেধরা, কানা, খোড়া, কালা ইত্যাদি। কিছু এসেছে নিম্নশ্রেণির বা অস্বীকৃত পেশা থেকে; যেমন- চোর, ডাকাত, কুলি, মুটে, মুচি, মেথর ইত্যাদি। কিছু এসেছে সম্পর্ক থেকে; যেমন- শালা, শালী, সুমুন্দি, সতীন, মাগ, ভাতার, শালার/হালার পোত/পুত, নাঙ, ভাই-ভাতারি ইত্যাদি। কিছু এসেছে মানুষের যৌনাঙ্গ থেকে; যেমন- বাল, বাড়া, ভোদা ইত্যাদি। বাংলা ভাষায় অন্য ভাষার শব্দ থেকেও বেশ কিছু গালি এসেছে; যেমন- মাদার-ফাকার, হেল, বাস্টার্ড, ফ্রড, ড্যাম্, হারাম, কাফের, শয়তান, কামিনে প্রভৃতি। ইতিহাস, সাহিত্য কিংবা মিথের অনেক নেতিবাচক বা খলচরিত্রের নাম গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়; যেমন- মীরজাফর, গোলাম আজম, হিটলার ইত্যাদি। অনেক সময় নাম বিকৃত করে বা মূল ধ্বনির রূপান্তর ঘটিয়ে গালি তৈরি করা হয়, যেমন- রত্ না (রত্মা), পট্ লা (পটল), খগা (খগেন)। আবার নতুন শব্দ তৈরি (coinage)’র মাধ্যমে কোনো কোনো সাহিত্যিক গালি নিয়ে আসেন; যেমনটি শেক্সপিয়ার করেছেন। আবার অনেক শব্দ ব্যুৎপত্তিগত অর্থে অশালীন না হলেও প্রয়োগের কারণে গালি হিসেবে গণ্য করা হয়; যেমন, মাগী, চাষা ইত্যাদি। ‘মাগী’ শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে নারী। কিন্তু ব্যবহারিক অর্থে বা মানভাষাতে খারাপ স্বভাবের নারী বা বেশ্যার সমার্থক হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘চাষা’ শব্দটির অর্থ যারা চাষ করে, অর্থাৎ কৃষক, কিন্তু শব্দটি মূর্খ অর্থে গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাক্যে শব্দগঠনের মধ্য দিয়ে গালি তৈরি করা হয়; যেমন, আমি তোর টাকায় পেচ্ছাব করবো, তোর টাকায় লাথি মারি/ নিকুচি করি। আবার অভিশাপ দিতে কোনো কোনো শব্দ গালি হিসেবে ব্যবহৃত হয়; যেমন- তুই নির্বংশ হ’, তোর ভিটেয় ঘুঘু চরুক, তুই আমার মরণ। মহিলারা এ ধরনের গালিগালাজ বেশি করে থাকেন।

গালি বলতে যে সবসময় অশালীন শব্দ বোঝান হয় বিষয়টি তা নয়। এটা নির্ভর করে শব্দটাকে কীভাবে, কোন উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে। অশালীন শব্দ প্রয়োগভেদে গালি হিসেবে গণ্য নাও হতে পারে, আবার শালীন শব্দ ব্যবহারের মারপ্যাঁচে গালি হিসেবে গণ্য হতে পারে। যেমন- যখন বলা হচ্ছে, ‘বেশ্যালয় গমনে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ’। তখন ‘বেশ্যা’ শব্দটি গালি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। কিন্তু যখন বলা হচ্ছে, ‘তুই একটা বেশ্যার জাত’, তখন ‘বেশ্যা’ শব্দটি গালি হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। শিক্ষিত সমাজে কথার মারপ্যাঁচে গালি দেওয়ার প্রবণতা বেশি। এজন্যে ভাষাজ্ঞান ভাল হওয়া চাই। যেমন, ক্রিকেট মাঠে রড মার্শ একবার ইয়ান বোথামকে বলেছিলেন, ‘হায় ইয়ান, তোমার বউ আর আমার বাচ্চারা কেমন আছে?’ জবাবে বোথাম বলেছিলেন, ‘বউ ভালোই আছে কিন্তু বাচ্চারা সব বিকলাঙ্গ হয়ে জন্মেছে দেখছি!’ এটাকে গালিগালাজ না বলে বাক-যুদ্ধ বা verbal war বললে বোধহয় ভালো শোনায়।

গালি হিসেবে এসব শব্দের ব্যবহারের অন্যতম কারণ মানুষের ভাষার সীমাবদ্ধতা। মানুষকে তার বৈচিত্র্যময় অনুভূতির প্রকাশ ঘটাতে বিভিন্ন প্রকারের রূপকের (image) আশ্রয় নিতে হয়। গালি হচ্ছে মূলত ভাষার মেটাফরিক উপস্থাপন। যেমন- সে আস্ত একটা গাঁধা (simile), লোকটি কুত্তার মতো ঘেউ ঘেউ করছে (metaphor)। বিষয়টিকে আরও পরিষ্কার করে ভাষাবিদ পবিত্র সরকার বলেছেন, ‘প্যাঁচা যদি শারীরিক সাদৃশ্যের মেটাফর হয়, গাঁধা হবে মানসিক লক্ষণের মেটাফর’। [বাংলা গালাগালের ভাষাতত্ত্ব : পবিত্র সরকার] পেট হাগস-এর মতে, ‘Slang is a non-standard language composed of exaggerated metaphors’. [Slang and Politics : Pat Hughes] কে.জি. চেস্টারসন বলেছেন, ‘all slung is metaphor and all metaphor is poetry’| [Why People Use Slang : Kelly Fox]

ভাষাতাত্ত্বিকরা গালাগাল ও কাব্যভাষার মধ্যে যে পার্থক্য খুঁজে পেয়েছেন তার কারণ উভয়স্থানে মেটাফরের চরিত্র এক ও অভিন্ন।

সাহিত্যে গালির ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। কারো কারো উপন্যাস অত্যাধিক গালির কারণে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সাহিত্যিকদের হাত ধরে আমদানি হয়েছে হরেক রকমের গালি। যেমন, গ্রীক ড্রামা ‘লিসিসট্রাটা’ আলোচিত হয়েছিল অতিরিক্ত খোলামেলা ভাষা বা bawdy language ব্যবহারের কারণে। বাংলা সাহিত্যে গালিগালাজের জন্যে অভিযুক্ত হয়েছেন তসলিমা নাসরিন, হুমায়ুন আজাদসহ অনেকেই। লক্ষ্য করা যাক- ‘হারামজাদার চাকুরিটা ফিরিয়ে দেব যদি পঞ্চাশ লাখ দেয়; মাদারচোতটা দেবে, বাঞ্চতটা কয়েক বছরে কয়েক কোটি জমিয়েছে...।’ [পাক সার জমিন বাদ সাদ : হুমায়ুন আজাদ]

বর্তমান চলচ্চিত্রে গালির ব্যবহার চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। ইংরেজি সিনেমা এই দিক দিয়ে সবার থেকে এগিয়ে। ‘মাদার ফাকার’, ‘ফাক্’, ‘ফাকড আপ’, ‘সান অব-আ বিচ’, ‘সাকার’, ‘ব্ল্যাডি হেল’, ‘ডিক’, ‘এজ-হোল’- শব্দগুলো গালি হিসেবে হরহামেশাই ব্যবহৃত হচ্ছে। যেমন-  ‘mother fucker snakes in the mother fucker plain!’ বাংলা চলচ্চিত্রে একসময় অশ্লীল শব্দের ব্যবহার চুড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। বর্তমানে সেন্সর বোর্ড-এর তৎপরতার কারণে বেশ কমে গেছে। বাংলা সিনেমায় ইংরেজি সিনেমার মতো যে কোনো চরিত্র যখন তখন গালি ব্যবহার করে না। সাধারণত, শুধুমাত্র ভিলেনদের মুখেই গালি শোনা যায়। বাংলা সিনেমায় বহুল ব্যবহৃত কিছু গালি হচ্ছে- হারামজাদা, হারামখোর, শুয়ারের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা, নটির মেয়ে/ছাওয়াল। যেমন, ‘এই শুয়ারের বাচ্চারা, ঐ খানকির পোলারে উচিৎ শিক্ষা দিইয়া আইবি। হালার পো’ আমার ঘুম হারাম করি দিচে!’১০

বর্তমানে খেলাধুলাতেও গালির ব্যবহার লক্ষণীয়। বিপরীত খেলোয়াড়দের মধ্যে মনস্তাত্বিক অস্থিরতা বা মনোযোগের বিঘ্ন ঘটানোর জন্যে এই গালি দেওয়া হয়। সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল থেকে শুরু করে, হালে ভদ্রলোকের খেলা বলে খ্যাত ক্রিকেট খেলাতেও গালির ব্যবহার লক্ষ্য করার মতো। একে খেলার ভাষায় স্লেজিং বলা হয়। যেমন, একবার এক বোলার ব্যাটসম্যানকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ‘এই বলেও যদি তুমি ছক্কা মারতে পার, তাহলে তুমি যা চাও তাই পাবে!’ জবাবে ঐ ব্যাটসম্যান বলেছিলেন, ‘যাও তোমার বউকে বিছানায় রেডি হতে বল’গে!’ সাইমন্ডস আর হরভজন একে অপরকে ‘মানকি’ বলে গালিগালাজ করার বিষয়টা তো সকলেরই জানা।

ভাষা ‘ক্লাস এজেন্ট’ হিসেবে কাজ করে। তাই তো সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থার তারতম্যের কারণে গালির পার্থক্য ঘটে থাকে। অবশ্যই, অর্থনীতি অন্যসব কিছু নির্ধারণের পাশাপাশি মানুষের ভাষা নির্ধারণ করে থাকে। যারা সমাজে উঁচু স্থানে অধিষ্ঠিত বা যাদেরকে আমরা উচ্চবিত্ত বলছি তারা নিম্নমধ্যবিত্ত বা শ্রমিকশ্রেণিকে তুচ্ছার্থে নানাবিধ গালি ব্যবহার করে থাকে। বাংলাদেশে শ্রমিকশ্রেণিদের সাথে মালিকশ্রেণি খুব বাজে ভাষায় কথা বলে। এমনকি রিকশাচালক, মুটে, কুলি-মজুর সবাই এই ভাষা-বৈষম্যের স্বীকার হয়। এটা এক ধরনের সামাজিক অপরাধও বটে।

ভাষা ‘জেন্ডার এজেন্ট’ হিসেবেও কাজ করে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত গালিগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখতে পাবো, গালিগুলো সুস্পষ্টভাবে পুরুষত্বের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। সমাজে ‘সান অব-অ্যা বিচ’, ‘মাদার ফাকার’, ‘মাদারচোত’, ‘বেশ্যা’, ‘নটী’, ‘খানকি’, ‘মাগি’, ‘হারামজাদি’, ‘ছিনাল’, ‘নচ্ছড়,’ ‘নাঙ-কুড়ানি’, ‘ভুদাই’ প্রভৃতি গালিগুলো সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়। মা ও বোন তুলে গালি দেওয়াটা একটা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।

গালি নিয়ে সমাজের শিক্ষিত মহলে বেশ অসন্তোষ দেখা যায়। কেউ কেউ মনে করেন, আইন করে পাবলিক প্লেইসে গালি নিষিদ্ধ করা উচিৎ। কারো কারো ধারণা, গালি ভাষায় সৌন্দর্য ও পবিত্রতা নষ্ট করে সুতরাং তা ভাষা থেকে ছেঁটে দেওয়া উচিৎ। গালি অবশ্যই সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে; কিন্তু ভাববার বিষয় হলো, মানুষ অনেক সভ্য হয়েছে, সভ্যতা বেশ ভাবনা-চিন্তা করে আজকের অবস্থায় এসেছে। অথচ গালির বিলুপ্তি ঘটানো সম্ভব হয়নি, বরং ক্ষেত্রবিশেষ যুগে যুগে এর নতুন উপযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন গালি। তাহলে স্বীকার করতেই হচ্ছে, গালির প্রয়োজনীয় দিকটাই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, গালি ভাষার সৌন্দর্য নষ্ট করে না বরং তা ভাষাকে আরও  picturesque করে তোলে। ভাষাকে ক্ষেত্রবিশেষ করে তোলে প্রাণবন্ত-অ্যাকটিভ। গালি না থাকলে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হতো তা হলো, মানুষে মানুষে দৈহিক হাঙ্গামা বা শারীরিক সংঘর্ষ  বেড়ে যেত বহুগুণে। মানুষ ভাষা বা অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে রাগ মেটাতে না পেরে একে অন্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তো। ‘হারামখোর, শুয়োরের বাচ্চা’ বলে যে কাজটি অনায়াসে হয়ে যায়, সেই কাজটি করতে লাঠি চালাচালি হতো। বিশৃঙ্খলা বেড়ে যেত কয়েকগুণে। তবে গালিও যে অনেক সময় বিশৃঙ্খলা ও দৈহিক আক্রোশের কারণ হতে পারে সে সম্ভাবনার কথা নাকচ করে দেওয়া হচ্ছে না।

মানুষের রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের অন্যতম কার্যকরী মাধ্যম হলো গালি। কারো ওপর রাগ হলে মানুষ গালিগালাজ করে মনকে হালকা করে বা মানসিক উত্তেজনা প্রশমন করে। এক্ষেত্রে গালি মেডিসিনের কাজ করে। কারণ, মানুষ তার রাগ বা চরম অনুভূতিকে প্রকাশ করতে না পারলে, ফ্রয়েডীয় তত্ত্ব মতে, সেগুলি মনের অবচেতন স্থানে জমাট হবে এবং একসময় পূর্ণশক্তি সঞ্চয় করে মনের ওপর আক্রমণ করে বসবে। এতে করে মানুষের মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। শুধু রাগ না, ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষেত্রেও গালির জুড়ি নেই। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষই যৌনমিলনের চরম মুহূর্তে নারী-পুরুষ একে অপরের উদ্দেশ্যে প্রচুর অশালীন শব্দ বা গালি ছুড়ে মারে এবং এতে তাদের উত্তেজনা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়। বিশ্বসাহিত্যের প্রধানতম লেখকদের একজন জেমস জয়েস। জয়েস ও তাঁর স্ত্রীর মধ্যেকার পত্রগুলো পড়লে বোঝা যায় যে তাঁদের ভালোবাসা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্ল্যাং বা গালিভাষা। জয়েস একটি চিঠিতে তাঁর স্ত্রী নোরাকে লেখেন:

‘My sweet little whorish Nora I did as you told me, you dirty little girl, and pulled myself off twice when I read your letter. I am delighted to see that you do like being fucked arseways…Goodnight, my little farting Nora, my dirty little fuckbird! There is one lovely word, darling, you have underlined to make me pull myself off better. Write me more about that and yourself, sweetly, dirtier, dirtier.

JIM’১১

অনেক সময় নানা কিংবা দাদা সম্পর্কের মুরুব্বিরা নাতি সম্পর্কের ছোকরাদের গালি দিয়ে মজা পান। বাচ্চাদের আদর করে ডাকা হয়- বান্দর, পাজি, শয়তান, বিচ্ছু, বুদ্ধু, বোকা ইত্যাদি। ইংরেজিতে বাচ্চাদের আদর করে ডাকা হয়- Little rascal, little scamp, little devil. অনেকে মজা করার জন্যে সচেতনভাবেই পরিবার বা বন্ধু মহলে গালিগালাজ করে। এ জন্যেই বোধকরি বলা হয়-‘humors are nothing but slang’|

 

টীকা ও তথ্যনির্দেশ

১.         স্বামী ছাড়া অন্যকারও সাথে দহরমমহরম থাকলে গ্রামাঞ্চলে তাকে ‘নাঙ’ বলা হয়।
২.         Incest সম্পর্ক বোঝাতে।
৩.        ড. জেকিল এন্ড মি. হাইড উপন্যাসের চরিত্র। এখানে মানুষের দ্বৈত সত্তার মধ্যে খারাপ সত্তাটির নামকরণ করা হয়েছে ‘হাইড’।
৪.         ‘গালি যখন শিল্প’- রাজীব হাসান।
৫.         ‘বাংলা গালাগালের ভাষাতত্ত্ব’- পবিত্র সরকার।
৬.        Slang and Politics : Pat Hughes.
৭.         Why People Use Slang : Kelly Fox.
৮.        পাক সার জমিন বাদ সাদ : হুমায়ুন আজাদ।
৯.        Parody Movie of Snakes in the Plain.
১০.      মহিলা হোস্টেল : মিজু আহমেদ
১১.       ইন্টারনেট: http://loveletters.tribe.net/thread/fce...



 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২০ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়