ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

শাহরিয়ার কবির || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৩৮, ১২ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা

|| শাহরিয়ার কবির ||

 

সর্বস্তরের মানুষের অপরিসীম ত্যাগ ও জীবনের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে বিশ্ব-মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। ত্রিশ লক্ষ  মানুষের জীবনদানসহ এ দেশের স্বাধীনতার জন্য সরকারি হিসেবে দুই লক্ষ, বেসরকারি হিসেবে প্রায় পাঁচ লক্ষ নারী সম্ভ্রম হারিয়েছেন, পনেরো লক্ষেরও বেশি মানুষ পাকিস্তানি সামরিক জান্তা এবং তাদের সহযোগী জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলাম প্রভৃতি দলের বিভিন্ন ঘাতক বাহিনীর হাতে নানাবিধ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এক কোটি মানুষ সর্বস্ব হারিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে গিয়ে শরণার্থীর বিড়ম্বিত জীবন গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন। দেশের অভ্যন্তরে বাস্তুচ্যুত ছিলেন প্রায় তিন কোটি মানুষ। স্বাধীনতার জন্য বিশ্বের অন্য কোনো দেশের মানুষ এতো জীবনদান, নির্যাতন ও ত্যাগ স্বীকার করেননি।

১৯৭১-এর ২৬ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। এরই ভিত্তিতে এক পক্ষকাল সময়ের ভেতর ’৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, যা ছিল নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক, সামাজিক ও আইনগত ভিত্তি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিছক একটি ভূ-খণ্ড লাভ কিংবা পতাকা বদলের জন্য হয়নি। নয় মাসব্যাপী এই যুদ্ধ ছিল প্রকৃত অর্থেই মুক্তিযুদ্ধ। দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন সার্বিক মুক্তির আশায়। জনগণের এই আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়েছিল ’৭২-এর সংবিধানে।

পাকিস্তানি শাসকচক্র ২৪ বছরের শাসনকালে বাঙালির যে কোনো ন্যায়সঙ্গত দাবি ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন কঠোরভাবে দমন করেছে ধর্মের দোহাই দিয়ে।  এদেশের মানুষের সকল প্রকার গণতান্ত্রিক আন্দোলন, স্বায়ত্তশাসন অথবা স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল পাকিস্তানের বিবেচনায় ইসলামবিরোধী ও ভারতের চক্রান্ত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম হয়েছিল পাকিস্তানের। জন্মলগ্নেই এই কৃত্রিম অস্বাভাবিক রাষ্ট্রটির মৃত্যুঘণ্টা বেজেছিল যখন ’৪৮-এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান আইনসভার সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছিলেন। কারণ বাংলা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের মাতৃভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের দাবির ভেতর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি বিচ্ছিন্নতা ও ভারতের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে তাঁকে কঠোরভাবে সমালোচনা করেছিল। ধর্মভিত্তিক কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তান সম্পর্কে বাঙালির মোহভঙ্গ হতে সময় লেগেছিল মাত্র সাত মাস। ’৪৮-এর মার্চে পাকিস্তানের জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন ঢাকা সফরে আসেন, তখন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্ব থেকে বঙ্গবন্ধু কীভাবে এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, কীভাবে তিনি বাঙালি জাতীয়তাবাদের রাজনৈতিক ভিত নির্মাণ করেছেন তার কিছু বয়ান পাওয়া যাবে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’য়।

১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে যে আন্দোলনের সূচনা হয় ’৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে তার চূড়ান্ত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি রফিক, জব্বর ও বরকতসহ অগণিত ভাষা শহীদের আত্মদানে। এই ভাষা আন্দোলনের পলল জমিতে বেড়ে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নব আঙ্গিকে বাঙালি জাতীয়তাবাদ। বাঙালিত্বের পরিচয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে অবলম্বন করে বেড়ে উঠলেও অচিরেই বাংলার রাজনীতিও এই চেতনার আলোয় উদ্ভাসিত হয়।

ইউরোপে জাতীয়তাবাদকে মূল্যায়ন করা হয় সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক চেতনা হিসেবে। ইউরোপ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছে। হিটলারের নাৎসিবাদের জন্ম হয়েছিল জার্মান জাতীয়তাবাদের উগ্রতা থেকে। এই জাতীয়তাবাদের প্রধান প্রতিপক্ষ সেমেটিক ইহুদিরা হলেও যা কিছু প্রগতি ও উদারনৈতিকতার সমার্থক সবই নাৎসিদের আক্রমণের লক্ষ্যে পরিণত হয়।

আধুনিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক উন্মেষ ঘটেছিল ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে। বাঙালিত্বের চেতনা মূর্ত হয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানে ও অন্যান্য রচনায়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি,’ ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল’, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘স্বার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে’- প্রভৃতি গানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা নানারূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। নাৎসি জাতীয়তাবাদের বিপরীতে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সব সময় বিদ্বেষ নয় সম্প্রীতির কথা বলেছে। সাতশ বছর আগে বাংলার কবি চণ্ডিদাস লিখেছিলেন- ‘শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ দেড়শ বছর আগে বাংলার আরেক মরমী কবি লালন শাহ লিখেছেন- ‘এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে/ যেদিন হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ আর খৃস্টান/ জাতিগোত্র নাহি রবে।’ প্রায় একশ বছর আগে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন- ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম জিজ্ঞাসে কোনজন/ কাণ্ডারী বলে ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মার।’ বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল ভিত্তি ছিল এই অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী বাঙালি জাতীয়তাবাদ।

পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক পাঞ্জাবি শোষক চক্র বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক শোষণের উর্বর ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। ২৩ বছরের সীমাহীন শোষণে পশ্চিম পাকিস্তানের উষর মরুভূমি হয়েছে শস্য শ্যামল এবং সোনার বাংলা পরিণত হয়েছিল শ্মশানে। সোনার বাংলা শ্মশান কেন?- এই প্রশ্নের উত্তর বাঙালি খুঁজে পেয়েছে মধ্য ষাটে আওয়ামী লীগের ছয় দফায়। বাঙালির জাতিরাষ্ট্রের আকাঙ্ক্ষা মূর্ত হয়েছে ’৭০-এর নির্বাচনে। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার সকল হিসাব ও চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছিল।

’৭০-এর নির্বাচনের আগেই আওয়ামী লীগ ধর্মনিরপেক্ষতাকে দলের অন্যতম নীতি হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ষাটের দশকে ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনে বামপন্থীদের ব্যাপক প্রভাব সমাজতন্ত্রের ধারণা জনপ্রিয় করেছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও বিশ্বাস করতেন শোষিতের গণতন্ত্র এবং শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থায়। পাকিস্তানকেন্দ্রিক বাইশ পরিবারের নির্মম শোষণ থেকেই সাধারণ বাঙালির চেতনায় শোষণহীন সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন বিকশিত হয়েছে।

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে অনীহা, বাঙালি জাতিসত্তার বিরুদ্ধে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র এবং বাংলাদেশে গণহত্যার প্রস্তুতির প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে যখন বঙ্গবন্ধু ’৭১-এর ৭ মার্চের অবিস্মরণীয় ভাষণে ঘরে ঘরে দুর্গ তৈরি করে যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করবার আহ্বান জানান। ৭ মার্চের এই ভাষণে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব।’ তারপরই বলেছিলেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই একটি আহ্বান সমগ্র জাতির চেতনায় স্বাধীনতা ও শোষণ-পীড়ন মুক্তির যে বোধ সঞ্চারিত করে তা মূর্ত হয়েছে পরবর্তী নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে, যা ছিল সার্বিক অর্থে একটি গণযুদ্ধ।

বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই নিয়েছিলেন এবং সমগ্র বাঙালিকে জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ করেছেন। জন্মের পর থেকেই পাকিস্তান প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শাসিত হয়েছে উর্দিপরা জেনারেলদের দ্বারা, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বার বার প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যূত করা হয়েছে। যে কারণে গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এ দেশের মানুষের মনে তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ’৭০-এর নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জয়ী হওয়ার পরও যখন পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি তখন এটা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল- পাকিস্তানে কখনও গণতন্ত্র সম্ভব নয়।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা। হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃস্টান-আস্তিক-নাস্তিক নির্বিশেষে সকল বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এই জাতীয়তাবাদকে অবলম্বন করে একজোট হয়েছে। এভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার বোধ নতুন মাত্রায় বাঙালিকে উজ্জীবিত করেছে। সমাজতন্ত্রের চেতনা এসেছে শোষণমুক্তির চিরন্তন আকাঙ্ক্ষা থেকে। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক প্রেরণা হিসেবে যে সব মূল্যবোধ ও স্বপ্ন যুদ্ধরত বাঙালিকে তাড়িত করেছে ’৭২-এর সংবিধানে তা মূর্ত হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত রাখবার জন্য নৃশংসতম গণহত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ, নির্যাতন ও জনপদ ধ্বংসসহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তাদের এই নৃশংসতার প্রধান দোসর ছিল জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলাম নামক উগ্র মৌলবাদী ও ধর্মব্যবসায়ীদের দল। ইসলামের দোহাই দিয়ে এই সব দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে যেভাবে গণহত্যা ও নারী নির্যাতনসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞে প্ররোচিত করেছে- নিজেরাও উদ্যোগী হয়ে গঠন করেছে রাজাকার, আলবদর, আলশামস প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী। এই সব ঘাতক দলের নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ কীভাবে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বাঙালিদের হত্যা করতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং দলের কর্মীদের প্ররোচিত করেছে তার প্রমাণ পাওয়া যাবে সেই সময় প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র ‘দৈনিক সংগ্রাম’-এর প্রতিদিনের পাতায়। জামায়াতের তৎকালীন আমীর গোলাম আযম পাকিস্তানকে ইসলামের সমার্থক বানিয়ে বলেছিলেন, পাকিস্তান না থাকলে দুনিয়ার বুকে ইসলামের নাম নিশানা থাকবে না। পাকিস্তান রক্ষার দোহাই দিয়ে জামায়াতীরা তখন যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করেছে ইসলামের নামে। এভাবেই তারা ইসলামকে হত্যা, ধর্ষণ নির্যাতন ও ধ্বংসের সমার্থক শব্দে পরিণত করতে চেয়েছে।

কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মুসলমান যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, রোজা রাখেন তারা জামায়াতের গণহত্যা ও নারী নির্যাতনের ইসলাম ঘৃণার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছেন। রণক্ষেত্রে বহু মুক্তিযোদ্ধা ‘জয় বাংলা’ ও ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ রণধ্বনির সঙ্গে ‘আল্লাহু আকবর’ও বলেছেন। কিন্তু তারাও ইয়াহিয়া-গোলাম আযমদের ইসলামের নামে আহাজারির প্রতি কর্ণপাত করেননি। পাকিস্তানের ৯০ হাজারেরও বেশি নৃশংস সেনাবাহিনীকে সঙ্গে নিয়েও জামায়াতীরা তাদের প্রাণপ্রিয় পাকিস্তান রক্ষা করতে পারে নি। পরাজয় নিশ্চিত জেনে তারা তালিকা তৈরি করে হত্যা করেছে। ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের নিকট পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগেই জামাতের শীর্ষ নেতারা- যারা সুযোগ পেয়েছিলেন পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়েছিলেন অন্যরা দেশের ভেতর আত্মগোপন করেছিলেন। এভাবেই বাংলাদেশে ধর্মব্যবসায়ী জামায়াতীদের ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এবং ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কবর রচিত হয়েছিল।

’৭২-এর ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফিরে আসেন। বাংলাদেশে ফেরার পথে দিল্লীতে যাত্রাবিরতিকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার জন্য এক বিশাল গণসংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। এই সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু এবং ইন্দিরা গান্ধী- দুজনের ভাষণই ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। সংক্ষিপ্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মহান বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় জনগণের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- আমি আপনাদের তিনটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আমার প্রথম প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের আমি সসম্মানে ফেরত পাঠাব। আমার দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীকে আমি সবরকম সহযোগিতা করব। আমার তৃতীয় প্রতিশ্রুতি ছিল শেখ মুজিবকে আমি পাকিস্তানের কারাগার থেকে বের করে আনব। আমি আমার তিনটি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি। শেখ সাহেব তাঁর দেশের জনগণকে একটিই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন- তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দেবেন। তিনি তাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।

এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমাকে বলা হয়েছে ভারতের সঙ্গে আপনার কীসের এতো মিল? আমি বলেছি ভারতের সঙ্গে আমার মিল হচ্ছে নীতির মিল। আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায়। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীও তাই বিশ্বাস করেন। আমাদের এই মিল হচ্ছে আদর্শের মিল, বিশ্বশান্তির জন্য...। সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু একই দিনে দেশে ফিরে রমনার বিশাল জনসমুদ্রে আবারও বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।’

১৯৭২-এর ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের গণপরিষদের প্রস্তাবক্রমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ী জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যবৃন্দের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল গণপরিষদ, যাদের দায়িত্ব ছিল সংবিধান প্রণয়ন। বিশিষ্ট আইনজ্ঞ, তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট এই খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা ছিলেন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর ন্যাপ) থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন।

খসড়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্টিত হয় ’৭২-এর ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর দিবসের প্রথম বার্ষিকীর দিন। ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান গণপরিষদে উত্থাপন করা হয় এবং বিস্তারিত আলোচনার পর ৪ নভেম্বর তা গৃহীত হয়। ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের সদস্যবৃন্দ এই সংবিধানে স্বাক্ষর প্রদান করেন।

’৭২-এর সংবিধানে রাষ্ট্রের চার মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয় জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে ধর্মপালন ও প্রচারের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। বাংলাদেশের মতো অনগ্রসর মুসলমানপ্রধান দেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক আদর্শের এই স্বীকৃতি নিঃসন্দেহে ছিল একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যাঁদের ’৭২-এর সংবিধান যাঁরা রচনার দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন তাঁদের সামনে ছিল যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, তুরস্ক, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের সংবিধান। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সংবিধানসমূহ তাঁরা অধ্যয়ন করেছেন। তাঁরা পর্যালোচনা করেছেন এই সব সংবিধানের সবলতা ও দুর্বলতা। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের জন্য শ্রেষ্ঠতম সংবিধানটি তাঁরা রচনা করবেন।

শুধু বিভিন্ন দেশের সংবিধান পর্যালোচনা নয়, জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাসহ মানবাধিকার সংক্রান্ত অন্যান্য দলিলসমূহের আলোকে আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে ‘মৌলিক অধিকার’ শীর্ষক অধ্যায়ে ২১টি অনুচ্ছেদ রয়েছে একাধিক উপচ্ছেদসহ।

সংবিধানের দ্বিতীয় ভাগে ‘রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি’ শীর্ষক অধ্যায়ে চার রাষ্ট্রীয় মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ব্যাখ্যাসহ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মালিকানার নীতি, কৃষক শ্রমিকের মুক্তি, মৌলিক প্রয়োজনের ব্যবস্থা, গ্রামীণ উন্নয়ন ও কৃষি বিপ্লব, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য ও নৈতিকতা, সুযোগের সমতা, নাগরিক ও সরকারী কর্মচারীদের কর্তব্য, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, জাতীয় সংস্কৃতি এবং আন্তর্জাতিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সংহতির উন্নয়ন বিষয়ক বিধিমালায় একটি প্রগতি ও শান্তিকামী আধুনিক রাষ্ট্রের যাবতীয় অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থনদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন, শোষণ ও পীড়নের বিরুদ্ধে অব্যাহত সংগ্রাম ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোন দেশ মর্যাদার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে না এ বিষয়েও ’৭২-এর সংবিধান প্রণেতারা সচেতন ছিলেন।

ষাটের দশক থেকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনায় সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধিতার পাশাপাশি বিশ্বশান্তির প্রতি সুচিন্তিত বক্তব্য পাওয়া যাবে তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ দুটিতে।

’৭২-এর ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের এই সংবিধান যে সমগ্র বিশ্বের যাবতীয় সংবিধানের ভেতর অনন্য স্থান অধিকার করে আছে এ কথা পশ্চিমের সংবিধান বিশেষজ্ঞরাও স্বীকার করেছন। বিশ্বের কোন দেশ কতটুকু সভ্য ও আধুনিক তা বিচার করবার অন্যতম মানদণ্ড হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ-গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি সেই দেশটির সাংবিধানিক অঙ্গীকার এবং তার প্রয়োগ। বিশ্বের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংবিধানের জনক হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র- যে সংবিধান গৃহীত হয়েছিল ১৭৭৬ সালে। মানবাধিকার শব্দটিরও জন্মদাতাও  যুক্তরাষ্ট্র। এই যুক্তরাষ্ট্রের একজন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ‘সেন্টার ফর ইনক্যয়ারি’র পরিচালক ড. অস্টিন ডেসি বলেছেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে বাংলাদেশের ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনের উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে তা যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানেও নেই। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মীয় মৌলবাদীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষতার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে।’

শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষাকবচ হিসেবে ধর্মের নামে রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বাইরে অন্য কোনো দেশ নিষিদ্ধ করতে পারেনি। এমনকি বিশ্বের বৃহত্তম ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিবেশী ভারতের সংবিধানেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা নেই। আমাদের দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু এবং চার জাতীয় নেতার নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় এসে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ মুছে ফেলার পাশাপাশি ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে আলোকাভিসারী একটি জাতিকে মধ্যযুগীয় তামসিকতার কৃষ্ণগহ্বরে নিক্ষেপ করেছেন। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত ’৭২-এর মহান সংবিধানের উপর এই নিষ্ঠুর বলাৎকার বাংলাদেশে পাকিস্তানি ধারার সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। আত্মগোপনকারী মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক জামায়াতীরা আবার মাথাচাড়া দেয়ার সুযোগ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা না করলে বাংলাদেশের সমাজ ও রাজনীতির এই তথাকথিত ‘ইসলামিকরণ’ বা ‘পাকিস্তানিকরণ’ সম্ভব হতো না।

জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার বিএনপি এবং তাদের প্রধান দোসর ’৭১-এর ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলন করতে গিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা ও ইসলামবিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করে সব সময় বলে- ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ধার করেছে। ধর্মব্যবসায়ীদের এই মিথ্যাপ্রচারণা তরুণ প্রজন্মের একটি বড় অংশকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়েছে, কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চিহ্নিত শত্রুরাই অধিককাল ক্ষমতায় ছিল। ক্ষমতায় থাকাকালীন তারা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জঘণ্যভাবে বিকৃত করেছে। তারা সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধ্বংস করে দিতে চেয়েছে। খালেদা-নিজামীরা এবং তাদের তল্পিবাহক বুদ্ধিজীবীরা অহরহ বলেন, ’৭২-এর সংবিধান রচিত হয়েছে ভারতের সংবিধানের মডেলে, ধর্মনিরপেক্ষতা নেয়া হয়েছে ভারতের সংবিধান থেকে। এই সব জ্ঞানপাপীরা জানেন না যে, ভারতের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র সংযুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের সংবিধান রচিত হওয়ার চার বছর পর ১৯৭৬ সালে ৪২তম সংশোধনীর মাধ্যমে।

বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা সংযোজন করার সময় বঙ্গবন্ধু এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বহুবার বলেছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়। প্রত্যেক মানুষের নিজ নিজ ধর্ম পালন ও প্রচারের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকবে। শুধু রাষ্ট্র ও রাজনীতি ধর্মের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকবে, কোনো বিশেষ ধর্মকে প্রশ্রয় দেবে না। ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ধর্মের পবিত্রতা রক্ষা এবং ধর্মের নামে হানাহানি এবং ধর্মব্যবসা বন্ধের জন্যই এই নিষেধাজ্ঞা প্রয়োজন। এতে ধর্ম ও রাষ্ট্র দুই-ই নিরাপদ থাকবে।

সেই সময় অনেক বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর এই ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁদের বক্তব্য ছিল সেক্যুলারিজমের প্রকৃত অর্থ হচ্ছে- ‘ইহজাগতিকতা’। ধর্মের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের নিরপেক্ষতা যথেষ্ট নয়। সব ধর্মের প্রতি সমান আচরণ প্রদর্শন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে কোরাআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক পাঠ, ওআইসির সদস্যপদ গ্রহণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন গঠন এবং বিজ্ঞানভিত্তিক সেক্যুলার শিক্ষানীতি প্রণয়নে ব্যর্থতারও অনেক সমলোচনা তখন হয়েছে। পশ্চিমে সেক্যুলারিজম যে অর্থে ইহজাগতিক- বঙ্গবন্ধুর সংজ্ঞা অনুসারে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা সেরকম ছিল না। তাঁর সেক্যুলারিজম ছিল তুলনামূলক নমনীয়, কারণ তিনি মনে করেছেন ধর্মের প্রতি ইউরোপীয়দের মনোভাব এবং বাংলাদেশসহ অধিকাংশ এশীয় দেশের মনোভাব এক রকম নয়। বঙ্গবন্ধুর সেক্যুলারিজমের সংজ্ঞায় ধর্মের যথেষ্ট স্পেস ছিল।

ইউরোপে যারা নিজেদের সেক্যুলার বলে দাবি করে তারা ঈশ্বর-ভূত-পরলোক কিংবা কোনো সংস্কারে বিশ্বাস করে না। বঙ্গবন্ধু কখনও সে ধরনের সেক্যুলারিজম প্রচার করতে চাননি বাংলাদেশে। ধর্মব্যবসায়ী রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে বাংলাদেশের মানুষ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার সম্পর্কে সচেতন ও অনীহ কিন্তু একই সঙ্গে এদেশের অধিকাংশ মানুষ ধর্মপরায়ণ। শুধু ঈশ্বর ও পরকাল নয়, পীর-ফকির ও পানিপড়াসহ বহু কুসংস্কারও মানে এদেশের অনেক মানুষ। এ কারণেই বঙ্গবন্ধুকে বলতে হয়েছে- ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ ধর্মহীনতা নয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশের প্রতিটি মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের বদৌলতে ধর্ম কীভাবে গণহত্যা ও ধর্ষণসহ যাবতীয় ধ্বংসযজ্ঞের সমার্থক হতে পারে। যে কারণে ’৭২-এর সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি কারও মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি। এভাবেই অনন্য হয়ে উঠেছিল ’৭২-এর সংবিধান।

মুক্তিযুদ্ধকালে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বহুবার বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক পরিচয়ের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। মুজিবনগর থেকে যে সব পোস্টার বা ইশতেহার যুদ্ধের সময় বিলি করা হয়েছে সেখানেও অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা বলা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি অবিস্মরণীয় পোস্টারের লেখা ছিল, ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার খৃস্টান, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার মুসলমান- আমরা সবাই বাঙালী।’ ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ অস্বীকার করার অর্থ হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করা, ৩০ লাখ শহীদের আত্মদানকে অস্বীকার করা এবং মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশকে অস্বীকার করা।

জেনারেল জিয়া সংবিধানের ৫ম সংশোধনী জারি করে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ বাতিল করেছেন, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গঠনের উপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছেন, সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহ...’ এবং প্রস্তাবনাসহ একাধিক স্থানে ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেছেন। এরপর তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে আরেক উর্দিধারী জেনারেল এরশাদ সংবিধানের ৮ম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করেছেন। এসবের সঙ্গে প্রকৃত ইসলামের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংবিধানের এসব সংশোধনী করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ যদি একটি ইসলামিক দেশ হবে তবে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের কী প্রয়োজন ছিল- এর জবাব এই দুই জেনারেলের অনুসারীদের দিতে হবে। ৩০ লাখ মানুষের জীবনদান, কয়েক কোটি মানুষের অপরিসীম দুঃখ দুর্দশা ও আত্মত্যাগের কি কোনো প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশে যদি ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালি জাতীয়তাবাদ না থাকে? পাকিস্তান তো একটি ইসলামিক রাষ্ট্রই ছিল। পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ স্বাধীন করার প্রয়োজন হয়েছিল এদেশের মানুষ ইসলামের নামে শোষণ-পীড়ন-নির্যাতন-হত্যার রাজনীতি প্রত্যাখ্যান করে একটি অসাম্প্রদায়িক কল্যাণ রাষ্ট্র গঠন করতে চেয়েছিল বলে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সংবিধানকে গলা টিপে হত্যা করে সংবিধানঘাতক জিয়া-এরশাদ বাংলাদেশকে জঙ্গী মৌলবাদীদের অভয়ারণ্যে পরিণত করেছিলেন। কোরাআন ও সুন্নাহর আইন চালু করার জন্য এখনও হত্যা করা হচ্ছে এখনও মুক্তচিন্তার লেখক, অধ্যাপক, পেশাজীবী এমনকি ইসলামী চিন্তবিদদেরও। যে জামায়াতীদের হাতে লেগে আছে ৩০ লাখ বাঙালির রক্ত তারা এখন ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়ে নিজেদের গণতন্ত্রী, সন্ত্রাসবিরোধী ও শান্তিবাদী বলে দাবি করছে। বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী বার্মা, ভারত, পাকিস্তান, আফ্রিকা, ইউরোপ ও আমেরিকা পর্যন্ত যাদের জেহাদী নেটওয়ার্কে বিস্তৃত তাদের উদারনৈতিক ইসলামিক দল হিসেবে সার্টিফিকেট দিচ্ছে আমেরিকা, যে আমেরিকা ছিল ’৭১-এ পাকিস্তানি সামরিক জান্তার প্রধান মুরুব্বি।

বর্তমানে বিশ্বে মুসলিম জনসংখ্যা দেড়শ কোটিরও বেশি। ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান ও বাংলাদেশসহ ৫৭টি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান। মুসলমান প্রধান দেশসমূহে বঙ্গবন্ধু ছাড়াও ধর্মনিরপেক্ষ সরকার ও রাষ্ট্রগঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তুরস্কের মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক, আফগানিস্তানের বাদশাহ আমানউল্লা ও ড. নজিবুল্লাহ, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিশরের গেমাল আবদুল নাসের, তিউনিসিয়ার হাবিব বরগুই বা ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ, আলজেরিয়ার আহমেদ বেনবেল্লা, সিরিয়ার হাফিজ আল আসাদ, ইরাকের সাদ্দাম হোসেন ও প্যালেস্টাইনের ইয়াসির আরাফাত। এসব দেশের ভেতর সিরিয়া ও বাংলাদেশ ছাড়া মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশে ইসলামী বা রাজনৈতিক ইসলামের সমর্থক দলগুলো সরকার পরিচালনা করছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরকে মোকাবেলার জন্য আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্ব লাল বলয়ের বাইরে সবুজ বলয় সৃষ্টির পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মুসলমানপ্রধান অঞ্চল ও দেশসমূহে হাসান আল বান্না ও আবুল আলা মওদুদির রাজনৈতিক ইসলামকে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে, যার ফলে বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিমপ্রধান দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ উত্থানের পথ সুগম হয়েছে।

পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতবর্ষ ভেঙে পাকিস্তান সৃষ্টি করতে পারতেন না যদি না ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ সরকার তাকে সমর্থন না করত। রাজনৈতিক বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত জীবনেও জিন্নাহ সেক্যুলার ছিলেন। তিনি পাকিস্তানকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৪৮ সালে তার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সেই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটে। প্রায় একই সময়ে ১৯৫০ সালে আমেরিকার চাপে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ককে মাদ্রাসা চালুসহ ধর্মীয় রাজনৈতিক শক্তির অবস্থান মেনে নিতে হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষ মুসলিমপ্রধান দেশে আমেরিকা যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই মোল্লাতন্ত্র ও সমরতন্ত্রকে উস্কে দিয়েছে। আফগানিস্তানে এবং ইরাকে আমেরিকার হস্তক্ষেপের ফলে এ দুটি দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান রূপান্তরিত হয়েছে ইসলামী সংবিধানে। আফগানিস্তানে নজিবুল্লাহ সরকারকে উৎখাতের জন্য আমেরিকা যে আলকায়দা ও তালেবানদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল তারা এখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব হয়ে শুধু আমেরিকা নয় বিশ্বসভ্যতার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যে আমেরিকার ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সে দেশের গবেষকরাও লিখেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র ধর্মনিরপেক্ষ দেশ সিরিয়ার আসাদ সরকারকে উৎখাতের জন্য আবারও আমেরিকা আলকায়দার সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর জঙ্গী সম্পৃক্ততা সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানা সত্ত্বেও আমেরিকা এখনও মানে জামায়াত একটি মডারেট মুসলিম দল এবং বাংলাদেশে জামায়াতকে রাজনীতি করতে দিতে হবে।

যে কারণে আমেরিকা ১৯৭১ সালে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় প্রতিহত করার জন্য পাকিস্তানের ইসলামপন্থী সামরিক জান্তার পাশে দাঁড়িয়েছিল একই কারণে আমেরিকা এখনও ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে বাংলাদেশকে ‘মডারেট’ ইসলামী দেশ হিসেবে দেখতে চায়, যে দেশ পরিচালনার জন্য তারা উপযুক্ত মনে করে জামায়াত-বিএনপি জোটকে, আওয়ামী লীগকে নয়। যেভাবে আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার জনগণ ও গণমাধ্যমকে আমাদের পাশে পেয়েছিলাম একইভাবে তাদের এখন আমাদের বলতে হবে, বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সরকার না থাকলে এখনে জঙ্গী মৌলবাদের যে উত্থান ঘটবে তার হামলা ও আক্রমণ থেকে আমেরিকা ও পশ্চিমা বিশ্বও নিরাপদ থাকবে না। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে মৌলবাদী অসাংবিধানিক শক্তিসমূহকে পৃষ্ঠপোষকতা থেকে আমেরিকাকে যদি বিরত রাখা না যায় মানবসভ্যতার যাবতীয় অর্জন ধ্বংস হয়ে যাবে।

বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতা আর কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা এক নয়। ১৯২৮ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক ধর্মনিরপেক্ষতাকে তুরস্কের রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে গিয়ে সকল ধর্মীয় দল, প্রতিষ্ঠান এমনকি সুফীদের মাজারও বন্ধ করে দিয়েছিলেন। মসজিদের সংখ্যা সীমিত করে আরবির বদলে তুর্কি ভাষায় আজান চালু করেছিলেন। আমেরিকার হস্তক্ষেপ ছাড়াও এ নিয়ে তুরস্কের ভেতরও যথেষ্ট ক্ষোভ ছিল, বিশেষভাবে গ্রামাঞ্চলে। কামাল আতাতুর্কের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল ফ্রান্সের অনুরূপ, যেখানে সরকার ও রাজনীতির সঙ্গে ধর্মের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণা ছিল বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিনির্ভর, যেখানে রাষ্ট্র ধর্মের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করবে না, সকল ধর্মকে সমান মর্যাদা দেয়া হবে। মুসলিম বিশ্বে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে পশ্চিমা জগৎ কামাল আতাতুর্কের কট্টর মতবাদ সম্পর্কে যতটা জানে বঙ্গবন্ধুর উদার মতবাদ সম্পর্কে সে তুলনায় কিছুই জানে না। জামায়াত যেমন বলে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা, আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্টে জামাতের সুহৃদরাও বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাই মনে করেন।

বঙ্গবন্ধুর সংবিধান কার্যকর থাকলে বাংলাদেশে আজ ধর্মের নামে এতো নির্যাতন, হানাহানি, সন্ত্রাস, বোমাবাজি, রক্তপাত হতো না। বাংলাদেশের ৪৪ বছর এবং পাকিস্তানের ৬৮ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যাবতীয় গণহত্যা, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের জন্য দায়ী জামায়াতে ইসলামী, যা তারা করেছে ইসলামের দোহাই দিয়ে।

বাংলাদেশ যদি একটি আধুনিক ও সভ্য রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, যদি আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি নিশ্চিত করতে চায়, যদি যুদ্ধ-জেহাদ বিধ্বস্ত বিশ্বে মানবকল্যাণ ও শান্তির আলোকবর্তিকা জ্বালাতে চায় তাহলে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করে রাজনীতি, সমাজ ও জীবনের সর্বক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শুধু ধারণ নয়, বাস্তবায়নের জন্য লড়ে যেতে হবে নিরন্তর।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ আগস্ট ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়