ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঐতিহ্যে ভরা দিঘাপাতিয়া রাজপ্রাসাদ

কামরুজ্জামান শাহীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ৯ ডিসেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঐতিহ্যে ভরা দিঘাপাতিয়া রাজপ্রাসাদ

নাটোর বলতেই মনের পর্দায় ভেসে ওঠে ইতিহাস আর ঐতিহ্যে ভরা প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন এক নগরীর কথা। দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি প্রাচীন স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন এক নির্দশন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সৌন্দর্যমন্ডিত এই রাজবাড়িটি শহরতলির দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে আজও কালের সাক্ষী হয়ে উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে দেশব্যাপী পরিচিতি লাভ করেছে। দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। দয়ারাম রায় ১৭০৬ সালে রাজা রামজীবনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে বাস করার জন্য যে জমি পেয়েছিলেন ১৭৩৪ সালে তার ওপরই স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন। রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায়ের সময় ১৮৯৭ সালের ১০ জুন নাটোরের ডোমপাড়া মাঠে তিন দিনব্যাপী বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের এক অধিবেশনের আয়োজন করা হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি এ অধিবেশনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

১৮৯৭ সালে ভূমিকম্পে প্রাসাদটি প্রায় ধ্বংস হয়ে গেলে রাজা প্রমদানাথ রায় রাজবাড়িটি পুনঃনির্মাণ করেন। দিঘাপতিয়া রাজবংশের রাজারা ১৭১০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত রাজ্য শাসন করেন। ইতিহাসের পাতায় এখনো যারা অমর হয়ে রয়েছেন তাদের মধ্যে রাজা দয়ারাম রায়, জগন্নাথ রায়, প্রাণনাথ রায়, প্রসন্ননাথ রায়, প্রমথনাথ রায়, প্রমদানাথ রায়, প্রতিভানাথ রায় এবং অষ্টম ও বংশের শেষ রাজা কুমার প্রভাতনাথ রায়।

রাজবাড়িতে মোট ১২টি ভবন রয়েছে। এগুলো হচ্ছে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারি ভবন, তিনটি কর্তারাণী বাড়ি, প্রধান ফটক রান্নাঘর, মোটর গ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স্। মূল ভবনসহ অন্যান্য ভবনের দরজা-জানালা সব মূল্যবান কাঠের নির্মিত। প্যালেসের দক্ষিণে রয়েছে পাথর এবং মার্বেল পাথরে কারুকাজ করা ফুলের বাগান। বাগানটি ইতালি গার্ডেন নামে পরিচিত। এ বাগানে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের দুর্লভ ফুলের গাছ। বাগানে ইতালি থেকে আনা শ্বেত পাথরের ৪টি নারী ভাস্কর্য এখনো পর্যটকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাজবাড়ির মূল প্রাসাদটি একতলা। এতে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলঘর। রয়েছে ১৮৫৪ সালে ব্রিটিশদের তৈরি করা দুটি কামান। মূল প্যালেসের মাঠের পূর্বপাশে রয়েছে রাজার দোল মঞ্চ। পাশেই রয়েছে কুমার প্যালেস। এর সামনে বসানো চার চাকাবিশিষ্ট একটি কালো কামান আজও শোভা পাচ্ছে।

মূল রাজপ্রাসাদের প্রবেশের পথে সিঁড়ির দুই পাশে দুটি কালো কৃষ্ণমূর্তি। এর পরেই রয়েছে ধাতব বর্ম। এটি পরেই নাকি রাজা যুদ্ধে যেতেন। এ কারণে পিতলের তৈরি এ বর্মটি আজও দর্শনার্থীদের বিশেষভাবে নজর কাড়ে। রাজপ্রাসাদের উত্তর পাশে ছিল রাজার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। অষ্টাদশ শতকে সেখান থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতে রাজবাড়ি আলো ঝলমল করত। রাজবাড়ির মূল ফটকে রয়েছে একটি বড় ঘড়ি। এর দুই পাশে দুটি ডায়াল রয়েছে। ঘড়িটি এখনো সঠিক সময় দিচ্ছে। এ ঘড়িটি ইতালির ফ্লোরেন্স থেকে আনা হয়েছিল। মূল ফটকের ওপরের এ বিশালাকার ঘড়ির ঘণ্টাধ্বনি আগে ১০-১২ মাইল দূর থেকে শোনা যেত। এখন তা মাত্র এক-দুই মাইল দূর থেকে শোনা যায়। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি পাকবাহিনীর ক্যাম্প হওয়ায় ঘড়িসহ অন্যান্য মূলবান সম্পদ তারা নিয়ে যায়। ১৯১৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দিঘাপতিয়া রাজ্যের সাতজন রাজা বংশানুক্রমিকভাবে রাজ্য শাসন ও উন্নয়নমূলক কাজ করে ইতিহাসে অমর হয়ে রয়েছেন। এ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা রাজা দয়ারামের সময় এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়। চতুর্থ রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আমলে ১৮২৯ সালে নাটোর মহকুমা হয়। রাজশাহী থেকে নাটোর পর্যন্ত রাজপথকে দিঘাপতিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত করেন এবং বগুড়াগামী রাস্তার সঙ্গে সংযুক্ত করেন। ১৯৫০ সালে এ রাস্তার সংস্কার বাবদ সরকারকে ৩৫ হাজার টাকা দান করেন। ১৮৫১ সালে স্থাপন করেন সর্বপ্রথম নাটোরের দাতব্য হাসপাতাল, যা আজকের আধুনিক সদর হাসপাতালে রূপান্তরিত। সে সময় এখানে ইউরোপের ওষুধপত্র ও যন্ত্রপাতি বিনামূল্যে দেওয়া হতো। ১৮৫৩ সালে রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের মৃত্যুর পর তার দানের অর্থে রাজশাহী দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তীতে এটিই হয় রাজশাহী সদর হাসপাতাল। ১৮৫২ সালে নাটোররাজ নির্মিত করে প্রসন্ননাথ একাডেমী। এটিই নাটোরের সর্বপ্রথম হাইস্কুল। এ ছাড়া দিঘাপতিয়া হাইস্কুল, নাটোর ও রাজশাহী হাসপাতালের জন্য রাজা প্রসন্ননাথ রায় ১৮৫২ সালে এক লাখ টাকা দেন। দিঘাপতিয়া রাজবাড়িটি তিনি আধুনিকভাবে গড়ে তোলেন। পঞ্চম রাজা প্রসন্ননাথ রায়ের আমলে রাজ্যের বিস্তৃৃতি ঘটে। তিনি রাজশাহী জেলার সর্বাপেক্ষা ধনী জমিদার ছিলেন। ১৮৬৮ সালে রাজশাহী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বগুড়ার নওখিলাতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় এবং একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৮৮২ সালে তা উচ্চ বিদ্যালয়ে পরিণত হয়। ১৮৭৭ সালে প্রসন্ননাথ রায় বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য মনোনীত হন। তার চেষ্টায় অনেক আইন পাস হয়। এ রাজবংশের ষষ্ঠ রাজা প্রমদানাথ রায় ১৮৯৪ সালের ২৯ জানুয়ারি ক্ষমতা গ্রহণের পর বিভিন্ন জনকল্যাণকর কাজ করেন। এর মধ্যে রাজশাহী চিকিৎসালয়ে ৭ হাজার টাকা এবং লেডি ডাফুরিন ফান্ডে ২০ হাজার টাকা দান করেন। নওখিলাতে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর দিঘাপতিয়া রাজা দেশত্যাগ করে ভারতে চলে যান। ১৯৫০ সালে জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন পাস হওয়ার পর দিঘাপতিয়ার রাজপ্রাসাদটির রক্ষণাবেক্ষণে বেশ সমস্যা দেখা দেয়। সমস্যা সমাধানে ১৯৬৬ সালে এ রাজভবন ইস্ট পাকিস্তান হাউসে পরিণত হয়। ১৯৬৭ সালের ২৪ জুলাই তৎকালীন গভর্র্নর মোনায়েম খান এটিকে গভর্নর হাউসে রূপান্তরিত করেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এটিকে উত্তরা গণভবন হিসেবে ঘোষণা দেন। জিয়াউর রহমান, বেগম খালেদা জিয়া, এরশাদ ও শেখ হাসিনা সে ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এই রাজবাড়িতে মন্ত্রিসভার বৈঠক করেছেন। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ির আগের সেই গৌরব আর নেই। গণভবন হলেও রাজবাড়িটি এখন শুধুই মুকুটহীনভাবে রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা হিসেবে পড়ে রয়েছে।

রাইজিংবিডি২৪.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়