ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

বিতর্কের মুখে আইসিটির বিচারপতি নিজামুলের পদত্যাগ

সেন্ট্রাল ডেস্ক: || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৬, ১২ ডিসেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বিতর্কের মুখে আইসিটির বিচারপতি নিজামুলের পদত্যাগ

বিতর্কের মুখে মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন বিচারপতি নিজামুল হক। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে তিনি আইন মন্ত্রণালয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন। বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, ‘ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যানের পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। রাষ্ট্রপতি বরাবর তাঁর পদত্যাগপত্র আইন মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। তবে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি হিসেবে থাকছেন।’


বিচারপতি নিজামুল হক এমন এক সময় ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যানের পদ থেকে পদত্যাগ করলেন, যখন এই ট্রাইব্যুনালে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম শেষ হয়েছে। সবাই রায়ের জন্য অপেক্ষা করছে। যে কোনো সময় রায় হতে পারে বলে আদালত জানিয়েছে। অন্য মামলাগুলো সাক্ষ্য গ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।


আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের কারণ ‘ব্যক্তিগত’। তবে বিচারপতির ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো বলছে, সম্প্রতি বেলজিয়াম-প্রবাসী আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞ আহমেদ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যানের দীর্ঘ কথোপকথন আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। স্কাইপের মাধ্যমে তাঁদের প্রায় ১৭ ঘণ্টার এই কথোপকথনে এমন কিছু বিষয় উঠে আসে, যা তাঁর জন্য বিব্রতকর ছিল। এ জন্য তিনি পদত্যাগ করেছেন। বিএনপি ও জামায়াতপন্থী আইনজীবীরাও তাঁর পদত্যাগের দাবি করেছিলেন। দু-এক দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল-১-এ নতুন বিচারপতি নিয়োগ করা হবে উল্লেখ করে আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, বিচারপতির পদত্যাগের ফলে বিচারের প্রক্রিয়া বিলম্বিত বা প্রভাবিত হবে না। গতকাল সন্ধ্যায় আইন প্রতিমন্ত্রী তাঁর বেইলি রোডের বাসায় সাংবাদিকদের আরও বলেন, আমার দেশ-এর প্রতিবেদন ভিত্তিহীন, বানোয়াট ও অতিরঞ্জিত। বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও বাধাগ্রস্ত করতে এটি প্রকাশিত হয়েছে। সরকার শিগগিরই আমার দেশ পত্রিকার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে। একজন ব্যক্তির কথা হ্যাকিং করা কতটা আইনসিদ্ধ, তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তবে চেয়ারম্যানের পদত্যাগের কারণে ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিচারাধীন মামলাগুলোতে কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। যে মামলা যে পর্যায়ে আছে, সে পর্যায় থেকেই শুরু হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মন্তব্য করেছেন। সরকারি সূত্রে জানা গেছে, ট্রাইবুনাল-২ এর চেয়ারম্যান এ টি এম ফজলে কবীরকে ট্রাইবুনাল-১ এর নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হতে পারে।

সকালেই আভাস ছিল: গতকাল সকাল থেকেই ট্রাইব্যুনালে বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। সকাল ১০টার দিকে পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপিত ট্রাইব্যুনালে গিয়ে জানা যায়, ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্য বিচারপতি আনোয়ারুল হক কার্যালয়ে পৌঁছালেও চেয়ারম্যান ও আরেক সদস্য বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন তখনো কার্যালয়ে পৌঁছাননি। দুপুর ১২টার দিকে রেজিস্ট্রারের কার্যালয় থেকে সাংবাদিকদের জানানো হয়, বেলা দুইটার পরে চেয়ারম্যানকে ছাড়াই ট্রাইব্যুনাল এজলাসে বসবেন। শারীরিক অসুস্থতার জন্য চেয়ারম্যান উপস্থিত থাকবেন না। এতে ট্রাইব্যুনালের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি ও তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে আরও সন্দেহের সৃষ্টি হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ট্রাইব্যুনালের এক কর্মকর্তা বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক গত দেড় বছরে এক দিনের জন্যও ট্রাইব্যুনালে অনুপস্থিত ছিলেন না। বিরোধী দলের হরতাল বা অন্যান্য কর্মসূচি থাকলেও তিনি যথাসময়ে কার্যালয়ে উপস্থিত থাকেন। চেয়ারম্যানের অনুপস্থিতিতে বেলা দুইটার দিকে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম শুরু হয়। আমার দেশ পত্রিকার বিষয়ে আদেশের দিন গতকাল ধার্য থাকলেও তা পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এ সময় বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন আমার দেশ পত্রিকায় ছাপা হওয়া স্কাইপের কথোপকথনে নিজের প্রসঙ্গ উঠে আসা নিয়ে বক্তব্য দেন। সহকর্মীকে নিয়ে চেয়ারম্যানের কিছু ‘বিব্রতকর’ মন্তব্য সম্পর্কে তিনি কয়েকটি ব্যাখ্যা দেন। পরে আদেশের জন্য ১৩ ডিসেম্বর দিন পুনর্নির্ধারণ করেন।

বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বক্তব্য: বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘আমার দেশ পড়ে মনে হলো, আমার সম্পর্কে কারও স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই। তবে আমি বিশ্বাস করি, কারও সম্পর্কে কিছু বলতে বা লিখতে হলে জেনে বলা ও লেখা উচিত। এটা ধর্মেও বলা আছে। কিন্তু জ্ঞানী-গুণীরা এই নিষিদ্ধ কাজটি করতেন, এটা একটা সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। আপনাদের দোয়ায় আমি যত দূর এসেছি, কঠিন সংগ্রাম করে এসেছি। মনে হচ্ছে, বাকি জীবনটাও আমার এর মধ্য দিয়ে যাবে। ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে আমি মিথ্যাকে কখনো স্থান দিইনি। বিচারপতি হিসেবে শপথ নেওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কখনো কোনো ব্যক্তির সঙ্গে খারাপ আচরণ করিনি। কারও কাছ থেকে সুযোগ-সুবিধা নিয়েছি বলে আমার জানা নেই। নিন্দুকের শতভাগ নির্জলা মিথ্যা এই মন্তব্যে আমি মাঝে মাঝে একটু বিচলিত হই, কিন্তু হতাশ হই না। কারণ মিথ্যা তো মিথ্যাই।’


বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন আরও বলেন, ‘এই মহান পেশায় দায়িত্ব নিয়ে আমি যা অর্জন করেছি, তা পরম করুণাময়ের ইচ্ছা। আমি সৎ ছিলাম, এখনো আছি, ভবিষ্যতেও সৎ থাকব। আমার যত দূর মনে পড়ে, আমি তখন হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারক। আমার দেশ-এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের একটি মামলা আমার কোর্টে এসেছিল। আমার মধ্যে যদি অসততা ও পক্ষপাতিত্ব থাকত, তবে আমি ওই মামলায় বিভক্ত আদেশ দিতে পারতাম। কিন্তু তা না দিয়ে আমি ওনার পক্ষে স্টে দিয়েছিলাম। তিনি ইচ্ছা করলে আমার নামে এত বড় হেডলাইনটা না দিলেও পারতেন। তার পরও তাঁকে ধন্যবাদ জানাই, প্রতিবেদককে ধন্যবাদ জানাই। নিন্দুকের মুখে কালো ছাই দিয়ে আমি বলতে চাই, আমার নাম জাহাঙ্গীর হোসেন, সনদপত্রের নাম জাহাঙ্গীর হোসেন, নিয়োগ হয়েছে যে পত্রে, তাতেও নাম বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন।’


পর্যবেক্ষকেরা বলেন, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের এই বক্তব্যের পর বিচারপতি নিজামুল হকের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হওয়ার বিষয়টি স্পষ্ট। ফাঁস হওয়া কথোপকথনের মধ্য দিয়ে বিচারপতি নিজামুল হক তাঁর সহকর্মী সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তা তিনি সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি।

বিচারাধীন মামলায় প্রভাব পড়বে ন: আইন বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, ট্রাইব্যুনাল-১-এর মামলাগুলো যে পর্যায়ে বিচারাধীন আছে, সে পর্যায় থেকেই বিচারকাজ চলবে। এটাই মামলা পরিচালনার স্বাভাবিক আইনসিদ্ধ পদ্ধতি। জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নিম্ন আদালতে মামলার শুনানি চলা অবস্থায় বিচারক বদলি হয়ে যান। তখন মামলাটি যে পর্যায়ে ছিল, সেখান থেকে নতুন বিচারক বিচারিক কার্যক্রম শুরু করেন। নতুন করে কখনো মামলার কার্যক্রম শুরু হয় না। এ ক্ষেত্রেও একইভাবে সর্বশেষ পর্যায় থেকে মামলার কার্যক্রম শুরু হবে।


তবে ট্রাইব্যুনালে জামায়াতের নেতাদের আইনজীবী তাজুল ইসলাম জানান, নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের পর তাঁরা বিচারপতি নিজামুল হকের অধীনে পরিচালিত মামলাগুলোর কার্যক্রম বাতিলের আবেদন করবেন। তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলো সত্য বলেই তিনি পদত্যাগ করেছেন। আর এ কারণে তাঁর অধীনে এই ট্রাইব্যুনালে যেসব মামলার কার্যক্রম চলেছে, তা বাতিল হতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আনিসুল হক বলেন, ‘তাঁদের (আসামিপক্ষের আইনজীবীদের) এসব গাঁজাখুরি গপ্পো আর আইনি ব্যাখ্যা শুনতে শুনতে দেশের মানুষের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। মামলার কার্যক্রম যেটি যে পর্যায়ে আছে, নতুন চেয়ারম্যান এসে সেই পর্যায় থেকে বিচার কার্যক্রম শুরু করবেন। এটাই আইন, এটাই বিধি।’


বিএনপির প্রতিক্রিয়া : এদিকে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হকের পদত্যাগের বিষয়েও প্রতিক্রিয়া জানান। তিনি বলেন, বিচারপতি নিজামুল হক গোটা বিচারব্যবস্থাকে কলঙ্কিত করেছেন। তাঁর পদতাগ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। তাঁর সম্পর্কে যেসব বিষয় পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, এর প্রতিটি ফৌজদারি অপরাধ।

২০১০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তিযুদ্ধকালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য সরকার বিচারপতি নিজামুল হককে চেয়ারম্যান করে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীর ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ এ কে এম জহির আহমেদ। চলতি বছরের ২২ মার্চ বিচার গতিশীল করতে সরকার আরেকটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এ সময় ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্য বিচারপতি এ টি এম ফজলে কবীরকে ট্রাইব্যুনাল-২-এর চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ করা হলে বিচারপতি আনোয়ারুল হক ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্যপদে স্থলাভিষিক্ত হন। গত ২৮ আগস্ট ট্রাইব্যুনাল-১-এর আরেক সদস্য বিচারক এ কে এম জহির আহমেদ ‘স্বাস্থ্যগত’ কারণ দেখিয়ে পদত্যাগ করলে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনকে ট্রাইব্যুনাল-১-এর সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়