ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বিশ্বজিৎ হত্যা

শাকিল গ্রেপ্তার, চাপাতি উদ্ধার, মামলা ডিবিতে

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ১৬ ডিসেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
শাকিল গ্রেপ্তার, চাপাতি উদ্ধার, মামলা ডিবিতে

বিশ্বজিৎ দাস হত্যার অন্যতম প্রধান অভিযুক্ত রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিলকে গতকাল শনিবার ভোরে বরগুনার বেতাগী উপজেলায় তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় শাকিলের খালাতো ভাই রায়হান আলমকেও আটক করা হয়। গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবিতে এই শাকিলকেই দেখা গেছে বিশ্বজিৎকে চাপাতি দিয়ে কোপাতে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল ও বরিশালের বাকেরগঞ্জ থানার পুলিশ যৌথ অভিযান চালিয়ে শাকিলকে গ্রেপ্তার করে। এ নিয়ে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ১০ জন গ্রেপ্তার হলো। এর মধ্যে ৫৪ ধারায় আটক চারজনও আছেন, যাঁদের এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছিল। বাকি ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের নাম-ছবি গণমাধ্যমে এসেছিল হামলাকারী হিসেবে। এঁরা হলেন: রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল, মাহফুজুর রহমান ওরফে নাহিদ, এইচ এম কিবরিয়া, জি এম রাশেদুজ্জামান ওরফে শাওন ও সাইফুল ইসলাম। রাশেদুজ্জামান ও সাইফুল ইসলামকে গতকাল আট দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।
বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার তদন্তভার সূত্রাপুর থানা থেকে ডিবিতে স্থানান্তর করা হয়েছে। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) মোহাম্মদ মোখলেছুর রহমান বলেন, বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার নথিপত্র তাঁরা বুঝে পেয়েছেন। তিনি জানান, গ্রেপ্তার হওয়া শাকিলকে আজ রোববার ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে আবেদন করা হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে শাকিল হরতালবিরোধী সন্দেহে বিশ্বজিতের ওপর হামলার সময় অন্যদের সঙ্গে অংশ নেন বলে স্বীকার করেন।
এদিকে শাকিলের বাবা আনসার মিয়া (৬৫) হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে গতকাল ভোরে বরিশালে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়িতে মারা গেছেন। পারিবারিক সূত্র জানায়, ছেলে শাকিলের ছবি গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর আনসার মিয়া পটুয়াখালীর বাসা ছেড়ে বরিশালে এক আত্মীয়ের বাসায় ওঠেন। গতকাল ভোরে ফজরের আজানের পর তিনি হূদেরাগে আক্রান্ত হন। তাঁকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে ভোর ছয়টার দিকে তিনি মারা যান।
বিশ্বজিতের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে গতকাল বিকেলে শরীয়তপুরের নড়িয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকে অবরোধ চলাকালে ৯ ডিসেম্বর পুরান ঢাকার জজকোর্ট এলাকায় ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে নৃশংসভাবে খুন হন নিরীহ পথচারী বিশ্বজিৎ দাস।
বেতাগী থেকে শাকিল গ্রেপ্তার: বাকেরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. নূরুল ইসলাম গতকাল দুপুরে জানান, শাকিলের মুঠোফোন পর্যবেক্ষণ (ট্র্যাক) করে ঢাকার ডিবি পুলিশ নিশ্চিত হয়, শাকিল বরিশালের বাকেরগঞ্জ এলাকায় অবস্থান করছেন। এরপর সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে ঢাকা মহানগর ডিবির একটি দল শুক্রবার রাতে বাকেরগঞ্জে আসে। এখানে পুনরায় শাকিলের মুঠোফোন ট্র্যাক করে তারা নিশ্চিত হয়, শাকিল বরগুনার বেতাগী উপজেলায় অবস্থান করছেন। এ পর্যায়ে তারা বাকেরগঞ্জ থানার পুলিশ নিয়ে অভিযানে নামে। গতকাল ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে বেতাগীর বিবিচিনি ইউনিয়নের দেশান্তরকাঠি গ্রামের মীর কাঞ্চন আলীর বাড়ি থেকে শাকিলকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় সেখানে অবস্থানরত শাকিলের খালাতো ভাই রায়হান আলমকেও পুলিশ আটক করে।
বাকেরগঞ্জ থানার পুলিশ জানায়, শাকিল দু-তিন দিন আগে তাঁর খালাতো ভাই রায়হানের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় মীর কাঞ্চন আলীর বাড়িতে এসে আত্মগোপন করেন। গতকাল সকালেই শাকিল ও রায়হানকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ঢাকায় চাপাতি উদ্ধার: গতকাল বিকেলে শাকিলকে রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবির কার্যালয়ে আনা হয়। আধঘণ্টা পর হত্যায় ব্যবহূত চাপাতি উদ্ধারের জন্য তাঁকে নিয়ে অভিযানে নামে ডিবি। সন্ধ্যায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক দোকান থেকে ওই চাপাতি উদ্ধার করা হয়।
এর আগে গত শুক্রবার রাতে সিলেটের জাফলংয়ের একটি রেস্টহাউস থেকে বিশ্বজিৎ হত্যায় অভিযুক্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র রাশেদুজ্জামান শাওন ও রাজধানীর উত্তরা থেকে একই বিভাগের ছাত্র সাইফুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। রাশেদুজ্জামানের সঙ্গে উৎপল নামের একজনকে আটক করা হয়। তাঁকে ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে চালান দেওয়া হয়েছে।
গতকাল এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিবির উপকমিশনার (ডিসি) মনিরুল ইসলাম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ ও তদন্ত করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাশেদুজ্জামান জাফলং সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আর সাইফুল উত্তরায় এক বন্ধুর বাসায় আত্মগোপনে ছিলেন।
বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় কতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম কোনো উত্তর দেননি। তিনি বলেন, বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
দুজন আট দিনের রিমান্ডে: ঢাকা মহানগর হাকিম এম এ সালাম গ্রেপ্তার হওয়া জি এম রাশেদুজ্জামান ও সাইফুল ইসলামকে আট দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সূত্রাপুর থানার উপপরিদর্শক মাহবুব-উল-আলম দুই আসামিকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন করেন।
আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে আসামিদের জড়িত থাকার বিষয়ে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তথ্য পাওয়া গেছে। এই আসামিদের গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের অবস্থান জানতে এবং তাঁদের গ্রেপ্তার করতে এঁদের রিমান্ডে নেওয়া প্রয়োজন। শুনানি শেষে আদালত রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
গত শুক্রবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্র মাহফুজুর রহমান নাহিদ, কাইয়ুম মিয়া ওরফে টিপু ও এইচ এম কিবরিয়াকে আট দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দেন আদালত। ওই দিন রাতে রাশেদুজ্জামান ও সাইফুলকে গ্রেপ্তার করা হয়।
বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবি: বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর ইউনিয়নের মশুরা গ্রামে বিশ্বজিতের বাড়ির কাছের রাধাগোবিন্দ মন্দির থেকে বিকেল পাঁচটার দিকে এলাকাবাসী মিছিল বের করে। মিছিলটি বিভিন্ন গ্রাম প্রদক্ষিণ করে ভোজেশ্বর বাজারের দক্ষিণ প্রান্তে গিয়ে শেষ হয়। সেখানে সমাবেশে বক্তব্য দেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলীর ছেলে খালেদ শওকত আলী, ভোজেশ্বর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আলী আহমঞ্চদ শিকদার, মশুরা গ্রামের বাসিন্দা সুধীর ঘোষ, বিশ্বজিতের ভাই রবিন দাস প্রমুখ।
গতকাল বিশ্বজিতের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানাতে এসেছেন অনেকে। ভোজেশ্বর ইউপির চেয়ারম্যান ইসমাইল হক পরিবারটিকে ২০ হাজার টাকা সহায়তা করেছেন।
বিশ্বজিতের ভাই উত্তম দাস বলেন, ‘হত্যাকারীরা গ্রেপ্তার হচ্ছে, এটা ভালো কথা। কোনো অবস্থাতেই তাঁরা যেন আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যেতে না পারে। আমাদের অনুরোধ, এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেউ রাজনীতি করবেন না।’
পালিয়ে বেড়াচ্ছেন উদ্ধারকারী: বিশ্বজিৎকে রাস্তা থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া রিকশাচালক রিপন সরদার শুক্রবার বিশ্বজিতের পরিবারকে সমবেদনা জানাতে মশুরা গ্রামে আসেন। রিপন সরদার স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, ‘যখন হামলা করা হয় তখন আমি শাঁখারীবাজার রাস্তার মুখে ছিলাম। আমাদের চোখের সামনেই ছেলেটিকে মারা হচ্ছে। সে যখন বাঁচার জন্য দৌড় দেয়, আমি তখন রিকশা নিয়ে গিয়ে তাঁকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাই।’
রিকশাচালক রিপন সাংবাদিকদের বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় আমার বক্তব্য প্রকাশ হওয়ার পর থেকেই ভয়ে আছি। আপনারা দেখবেন, আমার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়।’

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়