ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

সপ্তাজিজ্ঞাসে—

কবি সাখাওয়াত টিপু

|| রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৭:৫৮, ১৮ নভেম্বর ২০১২   আপডেট: ০৮:৪৫, ১১ আগস্ট ২০২০
কবি সাখাওয়াত টিপু

রাইজিংবিডি২৪.কম:

(কবিতাসংশ্লিষ্ট সাতটি নির্ধারিত প্রশ্ন নিয়ে ‘সপ্তজিজ্ঞাস’ নামের এ আয়োজন। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কমের পক্ষ থেকে তানিম কবিরের করা প্রশ্নগুলোর জবাব দিয়েছেন কবি সাখাওয়াত টিপু...)

কবিতা কেন লিখেন— একজন কবি এই প্রশ্নটির উত্তর দিতে বাধ্য কি না? যদি বাধ্য নন— তো কেন? আর হোন যদি— আপনার প্রতিও একই প্রশ্ন; কেন লিখেন কবিতা?

‘কবিতা কেন লিখেন’— এই জিজ্ঞাসার মুখে পড়িবার পর মনে হয় ‘ভাত কেন খান’ কিংবা ‘কাপড় কেন পড়েন’ এমন বাড়া বাড়া কথা। আপাতত মনে মনে হইতেছে সব জিজ্ঞাসার জবাব সমান। আগের দিনে দেখিতাম, মহাকাব্য বাঁধিবার আগে কবিরা ভনিতা করিতেন। মানে ভনিতার পর কবি কবিতা গাহিবেন। এখন তো কেহ কবিতা গাহেন না, লেখেন। অন্য সাহিত্যের কথা বলিতে পারিবো না, তবে তথাকথিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ভনিতাবাজীর বেশ দাপট। ভনিতাও এক ধরনের কবিতা বটে। তো সাহিত্যের বিচারে যে কবিতা বেশি গাওয়া হয় তাহা বেশি বাচে। কবির দেহ অবশেষ হইলেও তাহা দীর্ঘায়ু। চিনা সাধু লাওৎসে একখানা কথা মারিয়াছেন, মরিবার পর যিনি বাচিয়া থাকেন তিনি দীর্ঘায়ু। পরখ করিলে দেখিবো, কবি চার পদে থাকেন। যথা নাম সর্বনাম অব্যয় ক্রিয়ায়। শুদ্ধ কবি নহে, এই পদার্থের ভিতরই মানুষকে থাকিতে হয়। কেননা কাহাকে মানুষ সাব্যস্ত করিলে তাহার বিশেষণের দরকার নাই। কেন কবিতা পাড়া?

কবিতা কি পদার্থ তাহা লইয়া তর্ক ফাদা অর্থহীন। কারণ ইহা ঘোড়ার ডিমের মতো কার্যকর। কেননা ঘোড়ার ডিম ঘোড়ার উপস্থিতিকে প্রমাণ করে না। ঘোড়ার উপস্থিতি ডিমনামক পদার্থ ভাবের উপস্থিতিকে হাজির করিয়া তোলে। মানে ডিম নামক পদার্থের বাহিরে ঘোড়ার উপস্থিতি সত্য। বাস্তবে ঘোড়ার ডিমের হাজিরানা অবাস্তব। অবাস্তবকে বাস্তবে হাজির করিলে ভেদই সত্য হইয়া যায়। কোন কোন কলাকৈবল্যবাদী এহেন ভেদ বুঝিতে না পারিয়া কহেন, কবিতা নামক ভাষার বটিকা অপার রহস্য! আমরা সহাস্য হাসিয়া কহি, হায় ব্র‏‏‏হ্মা। হায় আম্মা!

আজিকালি যাহা কবিতা কহিয়া এস্তেমাল একদা তাহার নামডাক পদ। পদের গায়ে পদ লাগিলে বলা হইত পদাবলী। এই কলিকালে কোনও কোনও পাড় আধুনিক আদমি কহেন, এখন আর পদাবলীর কাল নাই। এখন এহাকে কবিতা নামে ডাকি। এই রকম ডাকাডাকির মস্ত ফাঁকি আমি বুঝিতে পারিয়াছি। ফাঁকি মালটাও ভাষার কারসাজি। ভাষায় আজি আছি তো আমি অভাবে আছি। ভাষায় আমি নাই তো বস্তু বা দেহও নাই হইয়া খাড়ায়।

এখন প্রশ্ন জাগিলো, আছি ভাবের ভিতরে নাই ভাবের খেলা কেন? কারণ আদমির পক্ষে শূন্যভাব পূরণ অসম্ভব ব্যাপার। শূন্যের অভাবই মানুষের ভাব। নিছক বস্তুর পক্ষে সাফাই গাওয়া কবির কাজ নয়। কবি আদতে বস্তুর ভাবের সাফাই গায়। তাহাতে যাহা কবিতা নাম বটে, তাহা তো গান নামে রটে। আমি যদি কবি হই ভাষা আমারে নিয়া খেলে। খেলতে খেলতে আমি ভাষা হইয়া উঠি। এই আমি বিশেষ্য হইতে আলাহিদা হইয়া সর্বনাম। ইহাই তো ভাষার সহজ মানুষ। ইহা কেমন?
 
মানুষ ভাবের ভিতর দিয়াই তো সহজ হইয়া ওঠে। মানে ভাষা মানুষকে সহজ করিয়া ছাড়ে। কারণ কবি সবকিছুর ভাষা বুঝিতে পারেন। নিরাকার আকারের শিবলিঙ্গ হইতে মশার গান নাগাদ কবির কানে ধরা দেয়। অবশ্য তাহাতে কান খাড়া রাখিতে হয়। এহেন ইন্দ্রিয় অনুভূতির বাহিরে কবিতার কাজ কী? ইহকাল আর পরকালের ভিতরে কবি খাঁটি দারোয়ান। সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতা কবির কানও ভেদ না করিয়া যাইতে পারে না। ফলে এই ধরা আর অধরা রাজনীতির ভাব জগতে কবিই রাষ্ট্র প্রধান। আপাতত জানায়া রাখি, শুদ্ধ কবিতার ভাষা নহে, নতুন চিন্তা, নতুন প্রশ্নে— বাংলা ভাষাকে নতুন করিয়া ভাবা।

‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— এই ‘কেউ কেউ’ বা ‘কারও কারও’ কবি হয়ে ওঠায় ঐশীপ্রাপ্তির কোনও ঘটনা থাকে কি? নাকি পুরো ব্যাপারটাই রেওয়াজ নির্ভর? আপনার কী মনে হয়?

কবিকে ভাষার ভিতরে বাস করিতে হয়। ভাষার বাইরে সমাজে কবির স্থান কোথায়? এইটা ঐশী পাইবার কিছু নাই। রেওয়াজতো ঐশীরই অংশ। পূজা এবাদত বন্দেগী ইহার বেহতর দৃষ্টান্ত। কবিতাকে যদি ভাব বা ভাষা জ্ঞান ধরা হয় তাহা হইলে বলা যায়, ভাষার বাহিরে কোনও জ্ঞান লুকানো থাকিলে সেটা ভাষা দিয়াই ধরিতে হয়। এই অধরাকে ধরাই কবির ধর্ম। সেই অর্থে ভাষার ধরাকে অধরা করিতে পারেন কবি। ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’— ইহা মহান কবি জীবনানন্দ দাশের ছেলেমানুষি রাজনীতির কথা। মহান ব্যক্তিরও নানা কিসিমের ছেলে ভোলানো রাজনৈতিক মনোরতি ঘটে। এরকমভাবে তিনি ‘কবিতা অনেক রকম’ একথাও পাড়িয়াছেন। পরের কথা যদি সত্য হয়তো তবে আগের কথার মানে কী?  উনি আমার গুরু। গুরু বিদ্যার বিচারে কহি, ওনার কবিতার ভাব-বাচ্যে যতো না মোক্ষম, গদ্য চিন্তা ততটাই অক্ষম। সবাই সব কাজ সমান পারিবে এমন কোনও কথা নাই। ব্যক্তির অক্ষমতার কারণে অপর গণ বা রাষ্ট্র কিংবা সমাজের সৃষ্টি। কারো অক্ষমতাকে নোটিশ করার মানে যাহাতে অন্যরা সক্ষম হইয়া ওঠেন। তাই গুরু ভক্তির এহনে বিভক্তি চাউর হইয়া উঠিতেছে। সমাজতাত্ত্বিক দিয়া এই চিন্তা খানিকটা বর্ণবাদী বা শ্রেণীবিদ্বেষী নহে কি! কেন বর্ণবাদী বা শ্রেণীবিদ্বেষী? ‘সকলেই নয়’ আর ‘কেউ কেউ হয়’ এই শ্রেণী বিভাজনের মধ্যে একটা জাতি বা গোষ্ঠীগত রক্তপাত আছে। রক্তপাত কেমন? ধরেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ গদ্যের কথা। সেইখানে তিনি জ্ঞানগতভাবে তিন সম্প্রদায়কে লইতেছেন। যথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় আর বৈশ্য। অদ্ভুত, শুদ্র নাই। এইখানে জাতিগত-শ্রেণীগত কারণ শুদ্র! কেননা ঠাকুরজী শুদ্রের জ্ঞানকে ধর্মীয় শ্রেণীগত জায়গা থেকে লইতেছেন না। শুদ্রের রক্তপাত না দেখিয়া এড়াইয়া যাওয়া একজন কবির কাজ না। অথচ এই শ্রেণী বৈষম্যবাদী সমাজে শুদ্রেরা সংখ্যায় বেশি। কিন্তু এই শ্রেণীগত রক্তপাতের কারণে কতো কবি খুন হইতেছে তাহা কি আমরা পরখ করিয়াছি?

এখনকার কবিদের ছন্দবিমুখতার কারণ কী বলে মনে হয় আপনার? কবিতার জন্য ছন্দের প্রয়োজনীয়তা কতোটুকু? কবিতার স্বতঃস্ফূর্ত বিস্তারে ছন্দ আপনার কাছে সহায়ক নাকি প্রতিবন্ধক?

‘এখনকার’ মানে ‘কখনকার’? সেটা স্পষ্ট নহে। ছন্দাসীন আর ছন্দহীন, যার যেইভাবে খুশি লেখিবেন তাহাতে সমস্যা কী? কে কী লিখিতেছেন সেই অর্থ গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার স্বতঃস্ফূর্ততা দুইভাবেই কবি ঘটাইতে পারেন। তবে যদি ভাষা বা শব্দ প্রয়োগের কলা কৌশল কবির কলমে খেলে সে কবি নিজের রাস্তা নিজেই তৈয়ার করেন। কবিতা লিখিতে আসিয়া ছন্দ জানা মন্দ না। জানিয়া না মানিলে দোষ নাই। কিন্তু কবির হাতে ভাষা-ভাব-ছন্দ-দেহ সবইতো দোলে। আপনার প্রশ্নের ‘সহায়ক’ বা ‘প্রতিবন্ধক’ দুই ভাবই অক্ষমের স্তবকের মতো। কবিতার ছন্দতো গাইড বই না, ‘সহায়ক’ বা ‘প্রতিবন্ধক’ হবে।

দশকওয়ারী কবিতা মূল্যায়নের প্রবণতাটিকে কিভাবে দেখেন? আপনার দশকের অন্যান্য কবিদের কবিতা থেকে নিজের কবিতাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার উপাদানসমূহ কী বলে মনে হয় আপনার?

এইরকম প্রশ্নের জবাব আমি ২/৩ খানা কথোপকথনে পাড়িয়াছিলাম। প্রশ্নের ঢঙ দেখিলে মনে হয়, আমাদের জিজ্ঞাসার করিবার মতো কোনও নতুন চিন্তা নাই। অতীতে তাকাইলে দেখা যাইবে ইতিহাসে বহু দশকের কবি বা কবিতা নাই হইয়াও আছে। আমাদের পাঠে যাহা নাই, সে কিন্তু ইতিহাসে আছে। এই অর্থে ইতিহাস আমার কাছে অতীত নহে, মানে বর্তমান। আমি যা নিয়া আছি শুধু তাই আছে তা কিন্তু না। আমার বাইরেও জগত আছে। তাহার নাম ‘সময়’। দর্শনের ভাবগত প্রশ্নে ‘সময়’ মানে সমভাবে যা আসে বা আছে বা নাই হইয়া আছে। সাধারণত ‘দশক’ বলিতে আমরা ‘কালখণ্ড’ বুঝি। এই ‘কাল’ খণ্ডিত। দশককে ধরা যাইতে পারে খণ্ডিত কালের পরিচয় বা ইতিহাস বা সময়। ধরেন, বাংলা বর্ণমালার জন্মের পর হইতে একই বর্ণমালা আছে। বিদ্যাসাগর যেই বর্ণমালায় লিখিয়াছেন আমরাও একই বর্ণমালায় লিখিতেছি। তবে কি আমরা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যুগে আছি? আলবৎ, না। কিন্তু ভাষার ভিতর নতুন চিন্তা নতুন ভাব নতুন প্রশ্ন আসিয়াছে কতো! ভাষার ভিতর দিয়াইতো সবকিছুর রূপ প্রকৃতি অর্থ কখনো বদলায় বা কখনোবা একই থাকে। এই বদল বা না বদলের ইতিহাস বেশ অম্ল-মধুর। দর্শনশাস্ত্র মানিলে বলিতে হইবে, সামান্য আর বিশেষের দ্বান্দিক প্রক্রিয়ার খেলা। নিছক এক দশকে এই খেলা কম, বেশি দশকে দশকে।

নিজের কবিতা লইয়া নিজে বলার চাহিতে আমি পাঠক-সমালোচক মহাশয়দিগের সময় দিবার চাই। যার যেই ভাবে খুশি পড়ুক বলুক হাসুক নাচুক দুলুক কাঁদুক খেলুক ছিঁড়ুক ফেলুক। তাহাতেই জমিবে খেলার মজা।

তিরিশের দশক থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত— প্রত্যেকটি দশক থেকে যদি তিনজনের নাম করতে বলা হয় আপনাকে— কারা আসবেন? উল্লিখিত কালখণ্ডে কোন দশকটিকে আপনার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়?

‘তিরিশের দশক’ থেকে কেন বলতে হবে? তিনজনের নাম কেন বলতে হবে? তিনজনের নাম বলিয়া আমি বা আমরা অন্যদের খাটো করিবো কেন? এইভাবে তিরিশের দশক হইতে উত্তর পাড়া ঔপনিবেশিক মানসিকতার পরিচায়ক। আমরা নানা ব্যক্তি বিশেষের সমালোচনা করিতে পারি, যুক্তি-তর্ক করিতে পারি, নানা প্রশ্ন উত্থাপন করিতে পারি, নানা তাফসির করিতে পারি— তাহা হইলে তিনের তিরিক্ষি রটাইবো কেন? এইভাবে তিনজনের মহত্ব দিয়া অন্যদের নাই করিবার ব্যবসায়ি মনোভাব সাহিত্য বা কবিতায় ফলদায়ক না। আমি মনে করি, দুনিয়ায় কোনও শব্দ যেমন ফেল না, তেমনি সব ব্যক্তি মানুষ কবির নানাদিক থেকে গুরুত্ব আলাদা আলাদা। খালি তিনজনের নাম বলিবার ভিতর একটা সংকোচনবাদী কায়দা আছে। সাহিত্য বিচারে অচল। আলাপ-তাফসির ছাড়া কে কারে লইল না লইলো তাহাতে গুণগত বদল ঘটে না। পরিমাণগত বদলও কি ঘটে? আর সাহিত্য বিচারে পদ্ধতিগতভাবে তিন নাম লওয়া খণ্ডিত কাণ্ড ছাড়া আর কিছুই নয়। এইটার জবাব যাহারা দেন, তাহারা আমার ‘আমিত্ব’ ওই শুধু ওই তিনজনের ভিতর দেখিতে পান। অথবা ওই তিনজনের ‘আমিত্ব’ দিয়া তাহার ক্রিয়া চলে। আর কোন কিছুকে বাদ দিবার মানে আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে চান না। অথবা বলা যায়, আমরা ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে ভয় পাই। অথবা এমনও হইবার পারে, ঐতিহাসিক অনেক প্রশ্নের মীমাংসা করিবার তাগৎ নাই আমাদের!

দেশভাগোত্তর দুই বাংলার কবিতায় মৌলিক কোনও পার্থক্য রচিত হয়েছে কি? এ-বাংলায় ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন। ওপার বাংলায়ও নকশালবাড়ি আন্দোলনসহ উল্লেখযোগ্য কিছু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন— এসমস্ত কিছুর আলাদা আলাদা প্রভাব কবিতায় কতোটা পড়েছে বলে মনে করেন?

এই ধরনের প্রশ্নের একটা সংকট আছে। সেইটা হইল ‘দুইবাংলা’। অল্পবিদ্যায় যতদূর বুঝিয়াছি, দুই বাংলা বলিতে বাংলাদেশ আর পশ্চিমবঙ্গ। কিন্তু ইহাতে সংকট হইলো আসাম, ত্রিপুরা, আরাকানের বাঙালিদের বাদ দিয়া আমরা বাংলা সাহিত্যের কথা বলিতেছি। এইটা দুঃখজনক! ক্ষমতা আর ভাষাগত প্রশ্নে— পশ্চিমবঙ্গের আলাদা অস্তিত্ব দেখিবার পরও বলিতে চাই তাহারা ভারতীয় বাঙালি। ভারতীয় বাঙালি বলিলে সুবিধা এই— আসাম, ত্রিপুরাসহ অপরাপর বাংলাভাসি ইহাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েন। পাকি আমলে বাংলাদেশে যেই রূপ ভাষা আন্দোলন হইয়াছে, আসামে ভাষার প্রশ্নে কম রক্তপাত হয় নাই। দেশভাগোত্তর মানে কোন দেশভাগ? সাতচল্লিশের ভারত-পাকিস্তান বিভাজন নাকি একাত্তরের পাকিস্তান-বাংলাদেশ বিভাজন? ঐতিহাসিক কারণে ভারতীয় বাঙালিদের বাংলাদেশী বাঙালিদের চেয়ে অভিজ্ঞতা ন্যূন। রাজনৈতিক উত্তাপও সমান নহে। তদুপরি বাংলা ভাষাভাসি মানুষের সংখ্যা বাংলাদেশেই বেশি। বাংলা সাহিত্যে রাজনৈতিক বেশ প্রভাব রহিয়াছে সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের। উর্দু কিংবা হিন্দি সাহিত্যে দেশ ভাগের ইতিহাস যেইভাবে আসিয়াছে বাংলা সাহিত্যে সে তুলনায় কম। তবে নকশাল বাড়ির আন্দোলনের প্রভাব ভারতীয় বাংলা সাহিত্যে বা কবিতায় বেশি। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে নতুন ভাষা আর জাতি চিন্তার জন্ম দিয়াছে, ভারতীয় বাংলা সাহিত্যে তাহার প্রভাব বিলকুল কম। কম হওনই স্বাভাবিক। পশ্চিমবঙ্গের কমবেশ সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবী স্বীকার করিয়াছেন, ভারতের অপর রাজ্যের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক আর ক্ষমতা কাঠামোর ফলে বাংলাভাষার বিকাশ খানিকটা পড়তির দিকে। আর বাংলাদেশে উঠতির দিকে। বাংলাদেশের কবিতাও তাই!

কবিতার বিরুদ্ধে জনবিচ্ছিন্নতা ও দুর্বোধ্যতার অভিযোগ বিষয়ে কিছু বলুন। কবির কি পাঠকের রুচির সাথে আপোষ করে কবিতা লেখা উচিৎ? বর্তমানে বাংলা কবিতার পাঠক কারা?

শুদ্ধ কবিতায় কেন, সাহিত্যের নানা মাধ্যমেই দুই ধরনের অভিযোগ আছে। কিন্তু এই অভিযোগের পিছনের কারণ অন্য, মানে প্রথায়। প্রথাবদ্ধ ধারণা মাত্রই সরল। এই সরলকে সহজে রূপান্তর কবিতার কাজ। সহজ মানে সোজা নয়। কেননা সাহিত্য বা কবিতা মাত্রই অপর বা পরকে ভাবায়, নতুন জিজ্ঞাসার জন্ম দেয়, নতুন চিন্তার আবির্ভাব ঘটায়। তবে চলিত মার্কসবাদী ধারণা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সমাজের উপরি কাঠামোর বিষয়। আসলে কি তাই? এই সাধারণীকরণের ভিতর সমাজের বেদনা আছে। দায় আছে। স্বপ্ন আছে। একনাগাড়ে দেখিবেন, দুনিয়ায় জনবিচ্ছিন্ন সাহিত্য বলিয়া কিছু নাই। সব ধরনের সাহিত্যের কোনও না কোনও পাঠক-পাঠিকা রহিয়াছে। ‘জনবিচ্ছিন্ন’ বা ‘দুর্বোধ্যতা’ ভাব দিক দিয়া দুই আলাদা জিনিস। কথিত ‘জনবিচ্ছিন্ন’ সেই, যে কবি নিছক ছকে বাধা। যে কবি ‘ব্যক্তি’ বা ‘আমির আমিত্ব’ নিয়া অন্ধ থাকে। তাত্ত্বিক দিক দিয়া বলা যায়, ইহা আধুনিকতার এক ধরনের বালাই। পর আর অপর ছাড়া ব্যক্তির অস্তিত্ব আছে কি? আর ‘দুর্বোধ্যতা’ মানে বোধের অতীত। ব্যক্তির ‘বোধ’ যদি সহজ প্রকাশের ভাষা পায়, তাহাতে ভাব বা ভাষা বোধের দূরে থাকিতে পারে না। মানে অপরকে ভাবাইতে বাধ্য করিবে।
 
বাংলা কবিতার ‘পাঠক’ উভয় লিঙ্গের থাকিলে ভালো, না হইলে ‘পাঠিকা’ বাদ পড়িবে কেন? যে পাঠক জন্ম নেয় নাই, তারা যেন বাংলা কবিতার কবরের উপর সবুজ ঘাস দেখতে পায়।

।।
সাখাওয়াত টিপু
কবি, প্রাবন্ধিক ও সমালোচক
জন্ম : ১৯৭১
জন্মস্থান : সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম
বর্তমান পেশা : নির্বাহী সম্পাদক, নতুনধারা এবং এডিটোরিয়াল কন্সালটেন্ট, ডেপার্ট
কাব্যগ্রন্থ : এলা হি বরষা, যাহ বে এই বাক্য পরকালে হবে, শ্রী চরণে সু, বুদ্ধিজীবী দেখ সবে, কার্ল মার্কসের ধর্ম
সম্পাদনা ও গবেষণা : জাতীয় সাহিত্য (ভাষা ও দর্শনের কাগজ), চাড়ালনামা (নাসির আলী মামুনসহ যৌথ)

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়