ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ইশারা ভাষার এক ব্যতিক্রম যোদ্ধা

রেজাউল করিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৫৯, ২৫ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ইশারা ভাষার এক ব্যতিক্রম যোদ্ধা

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম: বাবা-মা-ভাই ৩ জনই বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। এই পরিবারের একমাত্র কথা বলতে পারা ও শুনতে পারা সদস্য মুক্তা।

এমন একটি পরিবারে বড় হয়ে উঠছেন মুক্তা, যেখানে কেবল নিঃশব্দ ইশারা ভাষাতেই শৈশব থেকে কৈশোর, তারুণ্য।

মজার ব্যাপার, বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী পরিবারে বড় হয়ে ওঠা মুক্তা এখন ‘ইশারা’ ভাষাকেই ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন। ‘ইশারা’ ভাষা দিয়েই তিনি অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে চান।

ইতোমধ্যে সফল হওয়ার অনেকটা পথ এগিয়েও গেছেন। এই ভাষা নিয়ে পৌঁছে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান পর্যন্ত। তার সুযোগ হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাথে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইশারা ভাষায় উপস্থাপনের। প্রধানমন্ত্রীর পাশে থেকে অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সরাসরি ইশারা ভাষাতে অনুবাদ করেছেন অজস্র অতিথির সামনে।

২০১৮ সালের ২৭ অক্টোবর পটুয়াখালীতে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ইশারা ভাষায় উপস্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠান এবং বিটিভি ছাড়া অন্য কোথাও ইশারা ভাষার ব্যবহার ও প্রয়োগ না থাকায় পরবর্তীতে আর কোথাও ডাক পাননি মুক্তা।

পুরো নাম আফরোজা খাতুন মুক্তা। বড় হয়ে উঠতে উঠতে এইটুকু জীবনে অনেক যুদ্ধ দেখেছেন । চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার কুয়াইশ ভরাপুকুর গ্রামের আফজল তালুকদার বাড়িতে মুক্তাদের পরিবারের বসবাস। এটি মুক্তার নানা বাড়ি। এখানেই জন্মেছেন। এখানেই বেড়ে উঠেছেন।

বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বাবা মোঃ মনজুরুল আলম নিজের বাসায় দর্জির কাজ করে কোনমতে সংসার সামাল দেন। মা আরেফা খাতুন এবং একমাত্র ছোট ভাই মামুনুর রশিদ ইফতিও বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী। ইফতি ঢাকার মিরপুরে প্রতিবন্ধী স্কুলে নবম শ্রেণিতে অধ্যয়ন করছে।

বাবা মা ও ভাইয়ের সাথে মুক্তা

এমন প্রতিকুল অবস্থার মধ্যেই মুক্তা কুয়াইশ সম্মিলনি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং চট্টগ্রাম হাজেরা তজু বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি সম্পন্ন করেছেন । বর্তমানে চট্টগ্রামের হাজী মহসিন কলেজে বিবিএস দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। গ্রাম থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শহরে আসা যাওয়া করে নিজের উচ্চশিক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন মুক্তা।

চমৎকার এবং সুকণ্ঠের অধিকারি মুক্তা শুধুমাত্র পড়ালেখায় নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে উপস্থাপনা এবং ইশারা ভাষা নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন ইশারা ভাষাকে নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি এই ভাষাকেই পেশা হিসেবে নিয়ে বাবা মায়ের আজন্মের দুঃখ ঘুচাবেন। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামে দুটি প্রতিবন্ধী সংগঠনে দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন।

রাইজিংবিডি’র সাথে আলাপকালে আফরোজা খাতুন মুক্তা বলেন, ‘দেশের সব টেলিভিশন মাধ্যমে ইশারা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত না হওয়ার দেশের সব মানুষের তথ্য অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না। দেশের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা তাদের নিজেদের তথ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’

মুক্তা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে ইশারা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে তার বড় বড় জনসমাবেশ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেওয়ার সময় ইশারা ভাষায় দোভাষী রাখছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনেও খবর পরিবেশনে ইশারা ভাষার প্রয়োগ রয়েছে। কিন্তু দেশের বেসরকারি কোন টেলিভিশন চ্যানেলে কিংবা বেসরকারী কোন আয়োজনেও ইশারা ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ রাখা হয়নি। এর ফলে দেশের বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী বড় একটি জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম বধির উন্নয়ন সংঘ এবং চট্টগ্রাম বিভাগীয় বধির ক্রিকেট এসোসিয়েশনের দোভাষী হিসেবে থাকা আফরোজা আক্তার মুক্তা বলেন, ‘গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে ইশারা ভাষা নিয়ে গবেষণা করার ইচ্ছে আছে। এ ছাড়া এই ভাষাকে মাধ্যম করেই আমি নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চাই।’

মুক্তা বলেন, ‘আমার বাবা মা বাক ও শ্রবণ প্রতিবন্ধী হয়েও আমাকে এবং আমার ছোট ভাইকে মানুষ করতে যে অমানবিক যুদ্ধ করেছেন আমি তাদের সেই দুঃখ দূর করার স্বপ্ন দেখছি।’



রাইজিংবিডি/চট্টগ্রাম/২৫ মে ২০১৯/রেজাউল/টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়