ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

দার্জিলিংয়ের পথে-০২

পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪১, ১৪ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং

ফুলগিরি টি এস্টেটের সামনে গ্রুপ সেলফি

উদয় হাকিম : দার্জিলিং নামটা শুনলেই সবার আগে আসে চায়ের কথা। চা বাগানের কথা। চোখ বুঁজে দেখতে পাই বিস্তীর্ণ চা বাগান। ছায়া গাছ। শান্ত শীতল প্রকৃতি।

চা বাগান দেখবো বলে মনের ভেতরটা আকুপাকু করছিলো। অবাক হলাম- লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থেকেই চা বাগান দেখছি। অনুমান করছিলাম, সীমান্তবর্তী এলাকার ওই বাগানগুলো হয়তো ভারতীয়দের। সে যারই হোক। বাগান দেখেই আমরা সন্তুষ্ট।

চ্যাংড়াবান্ধা পার হতেই দেখছি রাস্তার দুপাশেই অসংখ্য চা বাগান। ফিরোজ আলম বললেন, এগুলো চা বাগান না। তাহলে কী? এগুলো চা ক্ষেত। কীভাবে? বিশাল এলাকা নিয়ে চা গাছ থাকলে সেটা বাগান। এখানে দ্যাখেন, আমাদের ধান ক্ষেত, কচু ক্ষেতের মতো ছোট ছোট প্লট। সুতরাং এগুলো চা ক্ষেত। কথা সত্য।

আমাদের ঠিক আগে একটি মোটরভ্যান যাচ্ছে। সেটা ভরা চা পাতা। জালে প্যাঁচানো পাতা বাতাসে ছড়িয়ে যাচ্ছে। তার মানে এইসব ছোট ক্ষেত থেকে পাতা তুলে বিক্রি করা হয়। এইসব ভ্যানে করে চলে যায় কারখানায়।

ড্রাইভার মদুল সওদাগর বাংলায় কথা বলে। ভালো লাগলো বিষয়টা। জিজ্ঞেস করলাম, জলপাইগুড়ির ভাষা কি? জানালেন, কুঁচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ির ভাষা বাংলা। আর দার্জিলিংয়ে? ওখানে বাংলাও চলে। আছে হিন্দীর প্রচলন। কেউ কেউ ইংরেজিও পারেন। স্থানীয় একটি ভাষাও আছে। যার নাম তার জানা নেই।

শিলিগুড়ির শ্যামলী কাউন্টারে গিয়ে একজন গাইড পেলাম আমরা। নাম তার পার্থ বাসনেত। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। তিনি বাংলা বলতে পারেন না, কিন্তু বোঝেন। হিন্দীতে ভালো। ইংরেজিতেও চলনসই। শিলিগুড়ি গিয়ে টাটা সুমো জীপে চড়ে প্রথমেই গেলাম হোটেল স্বস্তিকাতে। আগের লেখায় অবশ্য নামটা স্বস্তি লিখেছি। লেট লাঞ্চের পর রওনা হলাম দার্জিলিংয়ের পথে।

শিলিগুড়ি শহরটা পুরনো। ঘিঞ্জি। বাংলাদেশের কোনো উপজেলা শহরের মতো। যে রকম নাম ডাক শুনেছি। সেরকম নয়। সরু রাস্তা। ট্রাফিক জ্যাম। ভালো কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নেই। রাস্তায় ধুলো। রিকশার টুংটাং। সস্তা গাড়ির ভটভট আওয়াজ, কালো ধোয়া . . .। থাক, শিলিগুড়ি নামটার প্রতি যতটা আকর্ষণ ছিলো সেটা আর কমাতে চাই না। না দেখা প্রেমেই বোধহয় আকর্ষণ বেশি।
 

লেখকের ক্যামেরায় ফুলগিরি টি এস্টেটের অপরূপ সৌন্দর্য


শিলিগুড়ি শহরের পশ্চিমে একটি মোড় আছে। যার নামই দার্জিলিং মোড়। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে, বায়ের রাস্তা চলে গেছে কোলকাতা। এই রাস্তা ধরে নেপালও যাওয়া যায়। আমরা চলে গেলাম ডানে। ডানের রাস্তা দার্জিলিং আর গ্যাংটক যাওয়ার। গ্যাংটক হচ্ছে সিকিমের রাজধানী।

শিলিগুড়ির উত্তরে বিশাল পাহাড়। সেটি অবশ্য নিউ জলপাইগুড়ি রোড থেকেই চোখে পড়ে। মদুল সওদাগর বলেছিলেন, ওই পাহাড়গুলোই হচ্ছে দার্জিলিং। এতো কাছে মনে হলেও যেতে সময় লাগে অনেক। আগে শুনেছি শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে দুঘন্টা লাগে। পার্থ বাসনেত বলছেন তিন ঘন্টা লাগবে। এত সময় কেন? কারণ পাহাড়ি রাস্তা। তাছাড়া আমরা যাবো ঘুরপথে। মিরিক সুমেন্দু লেক হয়ে। যাবো একটা পথে, ফিরবো আরেক পথে। তাতে দুটো রাস্তাই দেখা হয়ে যাবে।

দার্জিলিং মোড় পার হতেই রাস্তার ডানে দেখলাম সরু ট্রেনের রাস্তা। দুই লাইনের মাঝখানে ফুট দুয়েক ফাঁক। পার্থকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কি টয় ট্রেনের রাস্তা। বললেন হ্যাঁ। তাহলে টয় ট্রেনে যেতে পারবো না আমরা? না। কেন? এখানে ট্রেন চলে সপ্তাহে মাত্র দুদিন। তবুও নিয়মিত না। সময়ও লাগে অনেক।

মিনিট দশেক পর দেখলাম একটা পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারের মতো। নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রশিক্ষণ চলছে। আরো সামনে গিয়ে একটা মাঠে কিছু লোকের জটলা চোখে পড়ে। সম্ভবত আধার বা রেশনের জন্য এসেছে লোকগুলো।

এতক্ষণ গরমে অস্বস্তি লাগছিলো। দার্জিলিংয়ের কাছিয়ে আসতেই হাওয়া ক্রমশ শীতল হয়ে আসছিলো। জুড়িয়ে যাচ্ছিলো শরীর। উত্তরে এসে পশ্চিমে একটা মোড় নিলো গাড়ি। মিনিট পাঁচেক চলার পর দেখতে পেলাম সেনাবাহিনীর এ্যাক্টিভিটি। বোধহয় ক্যান্টনমেন্ট। সেনানিবাসের ভেতরে ফুটবল খেলা হচ্ছে। রাস্তার দুধারে, চা বাগানে, গাছের আড়ালে সেনা সদস্যরা সতর্ক পাহারায়।

এই পাহাড়ি অঞ্চল মাঝে মাঝেই অশান্ত হয়ে ওঠে। মাওবাদীরাতো আছেই, গোরখা মুভমেন্টের কথাও অনেকেই জানে। গোরখাদের নেতা সুভাষ ঘিষিং ভালোই ফেমাস। পাহাড়ের অশান্তি নিয়ে গায়ক অঞ্জন দত্তের কত আফসোস। তিনি চাইছেন শান্তির পাহাড়। এসব কারণেই সেনাবাহিনীকে সতর্ক থাকতে হয়।

একটা শুকনো নদী পড়লো সামনে। নাম কি? পার্থ জানালেন, বালাসান। ঠিক নদী না, খাল। তাতেও আবার কোনো জল নেই। তবে শুকনো জলরেখা আছে। অতি বৃষ্টি কিংবা পাহাড়ি ঢল হলে এখান দিয়েই জল গড়িয়ে যায়। ইন্টারনেটে দেখেছিলাম, বৃষ্টি হচ্ছিলো; বনভূমির ভেতর থেকে জলধারা ধেয়ে আসছে। যৌবনা সে ধারায় মন ভেসে যায় সুদূরে।

কিছুক্ষণ পর পাহাড়ে ওঠা শুরু হলো। প্রথম জায়গাটির নাম শুকনা। এটি অনেক বিশাল এলাকা। এখান থেকেই মূলত পাহাড় শুরু। রাস্তার দুধারে অনেক বানর। আমাদের দলের সবচেয়ে সিনিয়র এস এম জাহিদ হাসান। তিনি বললেন, সম্ভবত এখানে বানরদের খাবার দেয়া হয়। যে কারণে ওরা রাস্তার ধারে বসে আছে। ফিরোজ আলম বললেন, এরা খুব অলস। না হলে বনে খাবারের অভাব আছে নাকি। ফলমূল কত কিছু আছে। মামুন যোগ করলেন, বানরতো ঘাসও খায়। তাহলে এখানে খাবারের জন্য বসে থাকবে কেন?
 

ফুলগিরি টি এস্টেটের ভিউ পয়েন্টে লেখকের সেলফি


মিলটন আহমেদ জিপের সামনে বসেছিলো। শিলিগুড়ি থেকে দুই জীপে ভাগ হয়ে গেছি ১৫ জন। গাইড পার্থসহ ১৬। মিলটনের অভ্যেস হলো গাড়িতে উঠেই ঘুমিয়ে যাওয়া। কিন্তু দুপাশের অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতি তার ঘুম কেড়ে নিলো। ডিএসএলআর বের করে বসে ছিলো। ভালো শিকারের আশায়।

চা ক্ষেত নয়, এবার বড় বড় চা বাগান চোখের সামনে। আঁকা বাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। জিপগুলো সাপের মতো একেঁবেঁকে চলছিলো। উঠছিলাম বেশি। মাঝে মাঝে নামতে হচ্ছিলো। মাথা চক্কর দিচ্ছিলো। কখনো কখনো বিশাল শাল বাগান। সবচেয়ে বেশি পাইন গাছের সারি। অনেক পুরনো গাছ। শতবর্ষী গাছও আছে অগুনতি।

টিম কোচ জাহিদ আলম। দুপাশের প্রকৃতি আর সবুজ বাগান দেখে তার লোভ হলো ছবি তোলার। ড্রাইভারকে বলা হলো গাড়ি থামাতে। থামছিলো না। গাইডকে বললাম। তার পরামর্শ- এখন না। সামনে আরো সুন্দর জায়গা আছে। সেখানে ছবি তোলার সুযোগ হবে।

আমি দেখছিলাম সূর্য ডুবে যাচ্ছিলো। সূর্য ডুবলে ছবি তোলা যাবে না। ছবি মানেই আলোর খেলা। মিনিট পাঁচেক গেলো। সামনে চোখে পড়লো ফুলগিরি। এটা চমৎকার জায়গা। ফুলগিরি টি এস্টেট খুব বিখ্যাত। অবশেষে একটি সুন্দর ভিউ পয়েন্টে গাড়ি থামলো। কিন্তু পরে গেলাম বাটে। ততক্ষণে সূর্য পাটে। এমনিতেই আমরা কজন দেখতে কালো। তারপর নেই আলো। ছবি আসছিলো আরো কালো। মোবাইল আর ডিএসএলআরের চেয়ে মনের ক্যামেরাই বেশি সচল হলো। আসলে মনের চোখের কাছে পৃথিবীর আর সব চোখ তুচ্ছ।

পেছনের গাড়িতে ছিলো মিজান, সোহাগ, সাহেল, জনি, সাইফুল, আলভি, শাকিল আর জাহিদ। নেমে এলো তারাও। সেলফি ফিভার ভালোই চলছে। সবাই সেলফি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলো।

উত্তর-পূর্ব দিকের সুন্দর শহর নজরে এলো। পাহাড়ের গায়ে অসংখ্য বাড়িঘর। ছবির চেয়েও সুন্দর। ইচ্ছে করছিলো দার্জিলিং বাদ দিয়ে ওই শহরেই কেন আগে যাই না। নুরুল বললো, শহরটা অদ্ভুত সুন্দর। পার্থকে জিজ্ঞেস করলাম পাহাড়ের গায়ের ওই শহরের নাম কি? উত্তর এলো কার্শিয়ান। ফিরোজ আলম বললেন, কেন নাম শোনেন নি? কার্শিয়ানতো অনেক ফেমাস শহর। চুপ রইলাম। কারণ আমি নামটা হয়তো শুনিনি। তবে কোনো মেয়ের রূপে মুগ্ধ হলেই যে তার নাম জানতে হবে তা তো নয়। নামের চেয়ে প্রেমটাই এখানে মূখ্য।

শুকনা থেকে ডানে, অর্থাৎ উত্তরে দার্জিলিং যাওয়ার সহজ রাস্তা। আমরা যাচ্ছিলাম পশ্চিমে। কারণ আমাদের প্ল্যান মিরিক হয়ে যাওয়ার। কিন্তু মিরিকের পাহাড়ে উঠে মাথা চিরিক দেয়ার মতো অবস্থা। এত ওপরে উঠে গিয়েছিলাম! মাই গড! বিমান থেকে নিচে তাকালে যেমন ছোট ছোট বাড়ি-ঘর, নদী-খাল-উপত্যকা দেখা যায় দেখছিলাম সেরকমই। নিচে দেখছিলাম বিস্তীর্ণ উপত্যকা। শুকিয়ে যাওয়া নিচু জমি। ঢালু জমি। ছোট ছোট গাছপালা। জাহিদ হাসান বললেন, ব্রিটিশরা আসার কারণে এত উঁচু পাহাড়ে সুন্দর রাস্তা হয়েছে। না হলে হয়তো সম্ভব হতো না।
 

চা বাগান আর পাইন বনের ভেতর দিয়ে সাজানো গোছানো রাস্তা
 

সন্ধ্যায় পৌঁছলাম মিরিকে। এখানে একটি লেক আছে। দেখার মতো তেমন কিছু নেই। লেকটাও খুব একটা বড় না। তারপরও এত উঁচু পাহাড়ের মাঝখানে বলে এটি দেখতে আসেন অনেকেই। এর নাম সুমেন্দু লেক। জলপাইগুড়ি রোডে একটা নদী দেখেছিলাম। বহমান ক্ষীণ ধারায় কয়েকটা কানি বক বসে ছিলো। বভুক্ষু এবং তীক্ষ্ন দৃষ্টি নিয়ে। সুমেন্দু লেকের পাড়েও আলো আধারিতে বসে ছিলো একটি বক। মনে হচ্ছিলো এই বকের মতো আমরাও দার্জিলিং দেখার লোভে কতদূর থেকে ছুটে এলাম।

অনেকেই মনে করেন হিমালয় একটি পাহাড় বা পর্বত। মোটেও তা নয়। হিমালয় বহুবচন অর্থে ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ অসংখ্য পবর্তের সমারোহ হচ্ছে হিমালয়। পর্বত শ্রেণী বা পর্বত মালা। সেই অর্থে এই মিরিক কিংবা দার্জিলিং সবই হিমালয়ের অংশ।

মিরিক পাহাড় থেকে চোখে পড়লো আলো ঝলমলে আরেকটি শহর। পার্থ জানালেন, ওটাই দার্জিলিং। দূর থেকে দার্জিলিং শহর দেখে মন ভরে গেলো। আহা স্বপ্নের দার্জিলিং! কত সুন্দর! মন ভরে দেখছিলাম জিপের জানালা দিয়ে। পাহাড়ি কোনো শহর দেখতে এলে পাশের কোনো উঁচু জায়গা থেকে দেখাই ভালো। ওই শহরে গিয়ে ওর সৌন্দর্য কিছুই বোঝা যায় না। এটুকু অন্তত বুঝলাম, দার্জিালিং মোটেও সমতল কোনো শহর নয়। বিশাল পাহাড়ের গায়ে হাজার হাজার বাড়ি-ঘর।

চা বাগান আর ঘন পাইন পেরিয়ে যাচ্ছিলাম সামনে। পাইন বনের ভেতর দিয়ে সাজানো গোছানো রাস্তা। ইচ্ছে হচ্ছিলো, একা যদি এমন বনে থাকার সৌভাগ্য হতো!

বলা ছিলো শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং ৩ ঘণ্টার পথ। আমাদের লেগে গেলো ৫ ঘণ্টা। সে যাই হোক, ২৪ ঘণ্টার জার্নিতো শেষ হলো। রাত পৌনে নয়টার দিকে পৌঁছলাম স্বপ্নের দার্জিলিং।


**




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৮/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়