ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

দার্জিলিংয়ের পথে-০৪

দার্জিলিংয়ের চা বাগান আর জুলজিক্যাল পার্ক

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:১৩, ১৭ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দার্জিলিংয়ের চা বাগান আর জুলজিক্যাল পার্ক

জুলজিক্যাল পার্কে পাহাড়ি সাজে সজ্জিত দুই তরুণীর সঙ্গে লেখক। ছবি : মিলটন আহমেদ

উদয় হাকিম : দার্জিলিং ভ্রমণ করব অথচ চা বাগানে যাব না! তাই কি হয়!

রক গার্ডেন থেকে ফিরছিলাম। তখনই প্রশ্নটা করলাম। গাইড পার্থ বাসনেত জানালেন, অপেক্ষা করুন। অবশ্যই যাব। ট্যুরের দ্বিতীয় দিনের আইটেনারিতে অবশ্য এটা ছিল।

এক পথ দিয়ে গিয়েছি। ফিরছিলাম অন্য পথে। এই বিষয়টি সবসময় উপভোগ করি- এক পথ দিয়ে যাওয়া, অন্যপথ দিয়ে আসা। কিন্তু ফেরার পথটা ছিল বেশি  বিপজ্জনক। অনেক খাঁড়া। কোনো কারণে জিপ যদি স্লিপ খায়, একেবারে সব শেষ।

ভয়ংকর সব বাঁক পাড়ি দিয়ে ওপরে উঠছিল জিপ। ভয়ে অন্তরাত্মা পিপ পিপ। অবশ্য রাস্তার দুপাশে চায়ের বাগান। বাগানের সৌন্দর্য্যও দেখছিলাম। আবার ভয়ও পাচ্ছিলাম। ওই পাহাড়ের ঢালুতে অনেকেই চায়ের পাতা তুলছিলেন। একটা জায়গায় দেখলাম বেশ কয়েকজন মহিলা। রাস্তার পাশে স্তুপ করে রাখা চায়ের পাতা। ব্যাপার কি? আর কিছুই না, বাগানের বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করা পাতা সেখানে ওজন করা হচ্ছিল। কে কতটুকু পাতা তুলল। সেখান থেকে যাওয়ার কথা কারখানায়।

ড্রাইভারকে বললাম গাড়ি থামাতে। এর একটা ছবি চাই-ই চাই। কিন্তু জায়গাটা বেশ ঢালু। তাই চালক গাড়ি থামাল না। কি আর করা। মিলটনকে বললাম গাড়ি থেকেই ছবি তুলতে। তার ক্যামেরা রেডি না। ফিরোজ আলমকে বললাম। ক্যামেরা রেডি করতে করতে অনেকটা ওপরে চলে গেলাম। বাঁক ঘুরে ওই জায়গাটির ওপরে যেতেই আবারো সুযোগ এলো ওপর থেকে স্ন্যাপ নেয়ার। শেষ পর্যস্ত গাড়িও থামল না; চলমান গাড়ির জানালা  দিয়েও ছবি তোলা হলো না। মিস! অন্যরা বললেন, এরকম আরো বহু পাবেন। আমি জানতাম পাব না। সত্যিই আর পাইনি। কোনো সুযোগই হাতছাড়া করতে হয় না।

 


দার্জিলিং শহরের ভেতরে পাহাড়ি ঢালে বিস্তীর্ণ চা বাগান

 

চা বাগান প্রসঙ্গে পরে আবার আসছি। রক গার্ডেন থেকে গেলাম পদ্মাজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিক্যাল পার্কে। শহরের মাঝখানে এটি। বিশাল একটা পাহাড়ের ওপরে। টিমের সবাই ছিলাম, ‘ওরা ১৫ জন’। গাইড পার্থ সবার আগে। চিড়িয়াখানা দেখে আমি মজা পাই না। বাঘ, ভাল্লুক, শেয়াল, কুকুর, বানর, সাপ এসব আমাকে টানে না। খাঁচার ভেতর প্রাণী রেখে সেগুলো দেখা মোটেও ভাল্লাগেনা। তবে রেপটাইল জোনে গিয়ে সাপ দেখলাম বেশ কিছু প্রজাতির। এই একটা জিনিস আমি একেবারেই অপছন্দ করি, সেটা সাপ। (ছোটবেলায় একবার সাপে কামড়েছিল আমাকে। ভাগ্য ভালো এখনো বেঁচে আছি)। শুধুমাত্র রাসেল ভাইপার ভালো করে দেখলাম। এই প্রজাতির সাপ দেখা যায় রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে। খুব বিষাক্ত এবং ধূর্ত সাপ এটি। চলেও খুব দ্রুত। কয়েকদিন আগে রাজশাহীর দুই সাংবাদিক তানজিমুল হক আর মেহেদীকে নিয়ে গিয়েছিলাম বাবু ডাইং নামে এক বরেন্দ্রভূমিতে। স্থানীয় ভাষায় ডাইং মানে উঁচু জায়গা। এটি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল এবং গোদাগাড়ি এলাকায় অবস্থিত। মেহেদী বলেছিলেন, সেখানে ওই সাপের দেখা মেলে।

দার্জিলিংয়ে অবশ্য একটা বিষয় খুব উপভোগ করছিলাম। হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট। এভারেস্ট, কাঞ্চনজঙ্গা, অন্নপূর্ণা এসবের চূড়ায় যারা উঠতে চান তাদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মনে রাখা দরকার, ওইসব উঁচু এবং বরফঢাকা বৈরি পর্বতে উঠতে প্রশিক্ষণ লাগবেই। সেই প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে এই প্রতিষ্ঠান। নাম শুনেছিলাম আগেই। জানতাম না সেটা এই পার্ক বা চিড়িয়াখানার ভেতরে।

পার্কের দক্ষিণে নিরিবিলি এক প্রান্তে এই ইনস্টিটিউট। সামনে একজন পর্বতারোহীর ভাস্কর্য। যেটির উদ্বোধন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু। এর পেছনেই পর্বতারোহণের আধুনিক পদ্ধতির একটি বিশাল দেয়ালচিত্র। মূল ক্যাম্পাসে প্রবেশের পরই খোলা চত্বরে সবার নজর কাড়ে রশি দিয়ে পর্বতে ওঠার আরেকটি দেয়ালচিত্র। সবগুলোর সামনেই ছবি তুললাম। বিশেষ করে রশি বেয়ে ওঠার দেয়ালচিত্রে এমনভাবে দাঁড়ালাম, যা দেখে মনে হচ্ছিল আমিই রশি বেয়ে ওপরে উঠছিলাম। প্রিন্সিপালের কক্ষ, অফিস কক্ষ সব ঘুরে ঘুরে দেখলাম।

অন্যরা চলে গেল অন্যদিকে। আমি একা। কিছুটা দূরে ক্যামেরা হাতে মামুনকে দেখলাম। আসতে বললাম। চলে গেলাম পেছনের অংশে। ক্লাসরুম, লাইব্রেরি, মিউজিয়াম সামনের দিকটায়। পেছনের অংশে ছেলে এবং মেয়েদের হোস্টেল। এখানকার পরিবেশ একেবারেই শান্ত, ছিমছাম। পর্বতের মতোই নিরিবিলি, নিস্তব্ধ।

ছেলেদের হোস্টেলের দেয়ালে একটি চিত্র নজর কাড়ল। মোবাইলে ছবি নিলাম। পরে যখন মামুন আসলেন, বললাম ভালো করে ছবিটা নিতে। যেখানে নয়জন পর্বতারোহী সার বেঁধে হেঁটে চলছিলেন। ছবিটার মধ্যে অন্যরকম রিদম, প্যাসন আর মোটিভ খুঁজে পেলাম। মানুষের জীবনের সঙ্গেও এর অনেক মিল। জীবন মানেই সংগ্রাম। জীবন মানেই লড়াই। জীবন মানেই অনবরত চলা, জীবনের কথা বলা।

 


জুলজিক্যাল পার্কের চিরিয়াখানায় গ্রুপ সেলফি

 

এরপর গেলাম মিউজিয়ামে। দোতলা মিউজিয়ামের বিশাল খোলা চত্বরে রয়েছে বেশকিছু ভাস্কর্য। এর মধ্যে আছেন প্রথম এভারেস্টজয়ী স্যার অ্যাডমন্ড হিলারি এবং শেরপা তেনজিং নোরগে। সময় কম। সবাই চলে গেছে। রয়ে গেছি একা। তাই বলে কি মিউজিয়াম হবে না দেখা? দৌড়ে চলে গেলাম দোতলা মিউজিয়ামের নিচ তলায়। সেখানে পর্বতারোহণের নানা রকমের পোশাক ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী স্থান পেয়েছে। প্রদর্শন করা হয়েছে পর্বতে ওঠার, সারভাইব করার কলাকৌশল। ওঠে গেলাম দোতলায়। সেখানে স্কাল্পচারের মাধ্যমে হিমালয় পর্বত শ্রেণির উল্লেখযোগ্য সবগুলো চূড়া দেখানো হয়েছে। মনে পড়ল আমিও একবার এভারেস্ট দেখেছিলাম। কাঠমান্ডু থেকে ছোট বিমানে করে। এভারেস্ট দেখার পর ওরা একটা সার্টিফিকেট দিয়েছিল। একশ ডলার দিয়ে একটা বই কিনেছিলাম বিমানের ভেতর থেকেই। সেখানে এই চূড়াগুলোর নাম এবং উচ্চতাসহ দেখানো হয়েছিল। সবগুলো উচুঁ চুড়া প্রায় একই লাইনে। পশ্চিম থেকে পূবে বিস্তৃত। এই স্কাল্পচার দেখে হিমালয়ের বিশালত্ব বোঝা যায়। দেখানো হয়েছে এভারেস্টের বিভিন্ন দিক। ডেমোনেস্ট্রেশন রয়েছে সামিট বিষয়ে।

মাউন্টেনেয়ারিং ইনস্টিটিউটের প্রধান ফটকের কাছে অন্যরা বসে ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন আমার জন্য। সবাই মিলে চললাম মূল গেটের দিকে। সামনের দিকটাতেই ছিল পাখি আর বানরের খাঁচা। সেদিকে চলে গেলাম সবাই। ওখানকার ঢালু রাস্তায় গ্রুপ সেলফি নেয়া হলো।

গেট দিয়ে বেরিয়ে যাব এমন সময় দেখলাম তিনটি মেয়ে অদ্ভূত সুন্দর পোশাকে ছবি তুলছে। একজন ত্রিশোর্ধ। বাকি দুজন টিনএজার। চিড়িয়াখানার ভেতর থেকে তারা ওই পোশাক ভাড়া করেছিলেন। ছবি তোলার জন্য। চায়ের পাতা তুলনীর সাজ। রঙিন পোশাক। সঙ্গে পাতা রাখার ঝূঁড়ি। এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলতে চাইলাম। রাজি হলেন। এর মধ্যে মিলটন এসে বললেন, এদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে যান। আমি ছবি তুলে দিচ্ছি। ফিরোজ আলমের দিকে তাকালাম। হাসে। বয়সী মহিলা সরে গেলেন পাশে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। মিলটনের ক্যামেরায় ক্লিক, ক্লিক। মিল্টন বলল, পাশে না, আপনি মাঝখানে দাঁড়ান। টিন এজার দুজন মডেলদের মতো পোঁজ নিয়ে আমার দুপাশে। দেখলাম, আমার দিকে তাকিয়ে গ্রুপের অন্যরাও হাঁসে।

জুলজিক্যাল পার্ক থেকে বেরিয়ে আবার উঠলাম জিপে। খানিকটা সামনে গিয়েই গাড়ি থামে। পার্থ বললেন, এটাও আইটেনারির একটি স্পট। নাম তেনজিং রক। রাস্তার পাশে বিশালাকার একটি পাথর। এভারেস্টজয়ী প্রথম শেরপার নামানুসারে পাথরটির নাম- তেনজিং রক।

আরেকটু সামনে টি গার্ডেন ভিউতে চলে গেলাম। এখানে পর্যটকদের প্রচুর গাড়ি। পার্কিং পাওয়াই মুশকিল। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে রাস্তা। রাস্তার ঢালুতেই মাথাছাঁটা চায়ের গাছ। পূর্বদিকে কোনো বাড়ি ঘর নেই। অনেকটা দূরে পাহাড়। দীর্ঘ ঢাল নেমে গেছে তিনদিকে- সামনে, ডানে, বায়ে। চোখের সামনে সুখজাগানিয়া সবুজ। সেখান থেকে চা বাগানের ভিউ চমৎকার। জনি আর সাইফুলের ছবি তুলে দিলাম। একটু পর মিলটন আসলে মোবাইলটা তুলে দিলাম তার হাতে। ছবি তোলার যেন নেশায় পেয়ে বসেছিল পুরো টিমকে। ঢাল বেয়ে নিচে নেমে বাগান দেখলাম। সাইনবোর্ডে সতর্কবাণী। চা পাতা ছেঁড়া যাবে না। ছিঁড়লে জরিমানা।

 


হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ছেলেদের হোস্টেলের দেয়ালে পর্বতারোহীদের অভিযানের চিত্র

 

রাস্তার পাশে বাগানের ঠিক ওপরে কয়েকটি দোকান। যেখান থেকে বিনে পয়সায় চা খাওয়ানো হচ্ছিল। কেন? বিনে পয়সায় কেন? চা পান করে সেখান থেকেই চা পাতা কিনবেন সেই আশায়। ব্যবসার পলিসি হিসেবে এটা বেশ কাজে দিচ্ছিল। চা সাধল আমাকেও। কিন্তু আমি চা পান করি না। দোকানি বলছিলেন, এটা অর্গানিক টি দাদা। কোনো কেমিক্যাল নেই। বাইরে দাম অনেক বেশি। এখানকার চা-ও পিওর, দামও কম শিওর।

কেজি দুয়েক চা নিলাম। আমার কেনা দেখে শুরু হুলো হুজুগে বাঙালি। টিমের প্রায় সবাই চা কেনা শুরু করলেন। দোকানি মেপে, প্যাকেট করে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। অবশেষে দোকানের প্রায় সব চা শেষ।
 

**




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ মে ২০১৮/অগাস্টিন সুজন/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়