ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

দার্জিলিংয়ের পথে-৭

দার্জিলিংয়ের বাতাসিয়া লুপ

উদয় হাকিম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:২৫, ২২ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দার্জিলিংয়ের বাতাসিয়া লুপ

বাতাসিয়া লুপ। ছবিটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া

উদয় হাকিম : বৃষ্টি পড়ছিলো। আমরা ফিরছিলাম টাইগার হিলের পাশের ডাক বাংলো পয়েন্ট থেকে। বুঝতেই পারছেন, মেঘ বৃষ্টির দাপটে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের সঙ্গে দেখা করে নি। এটা একটা দুর্ভাগ্যই বলা চলে। তবে একটা পরিসংখ্যান শুনলে তেমনটা মনে না-ও হতে পারে। বছরে ৩৬০ দিন। এর ৩০০ দিনই নাকি বৃষ্টি থাকে দার্জিলিংয়ে। সুতরাং কাঞ্চনজঙ্ঘার দেখা পাওয়া এখানে অমাবস্যার চাঁদের মতোই।

তবে নেপাল থেকেই অন্নপূর্ণা, মাউন্ট এভারেস্ট এমনকি কাঞ্চনজঙ্ঘা ভালো দেখা যায়। যদিও দার্জিলিং কিংবা কালিম্পং-এর খুব কাছে এই হিমালয় চূড়া।

গাইড পার্থ বাসনেত। বসেছিলেন জিপের সামনে। পরবর্তী সিডিউল কি?

জানালেন- বাতাসিয়া লুপ, ঘুম রেল স্টেশন, ঘুম মনেস্ট্রি।

প্রথমেই বলতে হয় ‘বাতাসিয়া লুপ’ এর কথা। জায়গাটা একটা পাহাড়ের মাথায়। চারদিকটা খোলা। হতে পারে প্রচুর বাতাস রয়েছে বলেই এরকম নাম এর। প্রশ্ন জাগতে পারে দার্জিলিংয়ের ভাষা কি? ওরা কি বাতাস বোঝে? দার্জিলিং হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা। এর পাশেই কার্শিয়াং, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি। শিলিগুড়ি এবং জলপাইগুড়িতে বাংলাতেই কথা বলেন সবাই। দার্জিলিংয়ে অর্ধেক মানুষ বাংলায় কথা বলেন। বাকিরা হিন্দি কিংবা নেপালি ভাষায় কথা বলেন। একেবারে স্থানীয় যারা, বহু বছর ধরে এখানে বাস করছেন, তারা নেপালি ভাষাতেই কথা বলেন। নেপাল সীমান্ত এখান থেকে খুব কাছে। প্রথম যে সন্ধ্যায় দার্জিলিং আসি তখন গাইড পার্থ দেখিয়েছিলেন নেপাল-ভারত দার্জিলিং বর্ডার লাইন। বলেছিলেন, দিনের বেলা হলে আমরা পাঁয়ে হেটে যেতেও পারতাম কিছুটা ভেতরে। যাক সেসব। আর হ্যাঁ, লুপ শব্দটা অপরিচিত লাগছে তো? লুপ হচ্ছে বক্রাকার বা বৃত্তাকার কোনো জায়গা। গ্রামে আমরা ঘোপনা বলে থাকি। একদিকে ঢালু বা নিচু।

বাতাসিয়ার বিশাল চত্বর। পরিকল্পিতভাবে সাজানো হয়েছে। ফুলের বাগান। সবুজে ছাওয়া ঘাস। পাতাবাহার-লতাবাহার ইত্যাদি। বাঁধানো পথ। চত্বরের মাঝখানে বিশাল উঁচু কালচে গোলাকার স্তম্ভ। ১৯৮৭ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহতদের স্মরণে তৈরি হয়েছে এটি।

এই বাতাসিয়া পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু শেষ মাথা ছুঁয়ে ঘুরে এসেছে রেল লাইন। ২ ফুটি শর্ট গেজের রাস্তা। অনেকটা খেলনা রেল লাইনের মতো। নাম যে এর টয় ট্রেন! যেহেতু এই লুপ লাইনটি গন্তব্যে পৌঁছার জন্য নয়, বিনোদন দেয়ার জন্য; আর তাই হয়তো এরকম লুপ তৈরি করা হয়েছে। বাচ্চাদের খেলনা রেল লাইনে সাধারণত এরকম বাঁক থাকে। কে জানে, খেলনা রেলের ধারণা হয়তো এখান থেকেও আসতে পারে।

এই লুপের বিশেষত্ব হলো এটি একটি পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত। অনেকটা মালভূমির মতো। উপর থেকে নিচে ক্রমশ সুষম ঢালু। এখান থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়। অবশ্যই আকাশ পরিষ্কার থাকা সাপেক্ষে।

মাঝখানের মিনার বা স্তম্ভকে ঘিরে রয়েছে শ্বেতপাথরে বাঁধানো চত্বর। বৃষ্টি থেকে রক্ষা কিংবা বিশ্রাম নেয়ার জন্য কিছু ছাউনিও রয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে পুরো চত্বরটি কাত হয়ে আছে। একদিকে হেলে পড়ে যেতে পারে। এই ট্রয় ট্রেনে ওঠার প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে এর মধ্যে চেপে বাতাসিয়া লুপ পার হওয়া।

বাতাসিয়া লুপ এবং ঘুম রেল স্টেশন এখন ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অংশ। দার্জিলিং শহরটি সমুদ্ররেখা থেকে ৬ হাজার ৭০০ ফুট উচ্চতায়। সুতরাং এই বাতাসিয়া লুপ এবং রেল স্ট্রেশন বা রেল লাইনও অনেক উপরে। যে কারণে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে এগুলো। ইন্টারনেটে অনেকেই দার্জিলিংয়ের এই টয় ট্রেনের মনোরম ছবি দেখে থাকবেন। ওটা এই বাতাসিয়া লুপ থেকেই নেয়া।

ঘুম রেল স্টেশন রাস্তার পাশেই। অনেকবার এর সামনে দিয়ে গেলাম এলাম। বৃষ্টি হচ্ছিলো বলে আর নামার আগ্রহ ছিলো না। পরিকল্পনার মধ্যে রইলো। পরে স্টেশনে নামব। সবাই মিলে এখানে গ্রুপ ছবি তুলব।

জিপ গিয়ে থামলো ঘুম মনেস্ট্রির সামনে। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়। একটা বিষয় খেয়াল করছিলাম- ভারত, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া এই অঞ্চলে এই মন্দির কালচার পর্যটনের মধ্যে একেবারে গেঁথে গেছে। আমি বরাবরই উপাসনালয়ের প্রতি বিতৃষ্ণ। আমার ভালো লাগে প্রকৃতি এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র। টিমের সবাই একমত হলেন, মনেস্ট্রিতে যাওয়ার দরকার নেই। ভুটানে এই টিমের সবাই এরকম মনেস্ট্রি দেখে ক্লান্ত।

ড্রাইভারকে বললাম সরাসরি হোটেলে যেতে। রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে সবাই ব্রেকফাস্ট টেবিলে। সারা দিনতো পরে থাকছে। কি করা যায়? কেউ একজন প্রস্তাব দিলো, আজকেও সিনেমা দেখতে পারি। আগের দিন অ্যাভেঞ্জার্সের টিকিট পাওয়া যায় নি। সকাল সকাল গেলে টিকিট মিলতে পারে। দার্জিলিং যাওয়ার আগে দেখে গিয়েছিলাম, ঢাকায় অ্যাভেঞ্জার্সের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। বক্স অফিস হিট। তাহলে এখানে দেখে যেতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু সেদিন ছিলো রোববার। ছুটির দিন। তাই টিকিট প্রাপ্তি নিয়ে সন্দেহ ছিলো।

ব্রেকফাস্ট শেষে ঘোষণা এলো- টিকিট পাওয়া গেলে বিকেলে বা সন্ধ্যায় সবাই সিনেমা হলে থাকব। গ্রুপে টাইম জানিয়ে দেয়া হবে। এর আগ পর্যন্ত ফ্রি টাইম।
 

গাড়ি থেকে দার্জিলিং শহরের ছবিটি তুলেছেন ফিরোজ আলম


নাস্তা সেরেই অনেকে বেরিয়ে গেলেন কেনাকাটা করতে। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশিদের জন্য ওখানে কেনাকাটার তেমন কিছু নেই। পশমিনা শাল, টুপি, নিন্মমানের কিছু সোয়েটার বা জ্যাকেট এই-ই। বিশ্বাস করেন- এই গরমের দিনে বাংলাদেশে এসব পরা যাবে না। শুধু শুধু টাকা নষ্ট। তবু অনেকেই বিদেশে যান কম। আত্মীয়-স্বজন পথ চেয়ে থাকে, জনি বিদেশ গেছে দেখি কি নিয়ে আসে। সোহাগ প্রথমবারের মতো বিদেশে গেছে দেখা যাক কি আনে। ওরা অনেক কিছুই চিনে না। চিনুক। যা ইচ্ছে কিনুক।

লাঞ্চ টাইমে আবার সবাই একত্রে। সিনেমার টিকিট পাওয়া গেছে। বিকেল সাড়ে ৫ টায় শো। শাকিল যথারীতি এবারের ট্যুরে ফ্লপ। তার সংক্ষিপ্ত মন্তব্য- ভালোই হলো। টিকিট পাওয়ায় নুরুলের সে কি আনন্দ! মজা স্যার, ভীষণ ইয়া হবে, বলে হাসছিলেন। সাহেল চুপচাপ থাকলেও চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। ছোটবেলায় কত কষ্টে গোপনে সিনেমা দেখতে হতো। এখন বিদেশে এসে সবাই মিলে এসকঙ্গে সিনেমা দেখব!

লাঞ্চ টেবিলে সবার পেছনে সাইফুল আর নারকেল জাহিদ। দেরি কেন? সাইফুল কিনেছিলেন রাইস কুকার! আর নারকেল জাহিদ চাল। এই নিয়ে সবাই হাঁসাহাসি। সবাই কেনে শাল, আর পিচ্চি জাহিদ কিনেছেন চাল। ওদিকে সাইফুলের কা- দেখে হাঁসব না কাঁদব সেটাই বুঝছিলাম না। দার্জিলিং গিয়ে কেনে রাইস কুকার। কি করে বোঝাবে বুদ্ধিটা কত বোকার! জনা পাঁচেক সিনিয়র বাদে বাকিদের সবার অবস্থা একই। কি কিনতে হবে কোনটা কেনার দরকার নেই- সেটুকু বুদ্ধিও অনুপস্থিত। মিজান, আলভি, মামুন, কোচ জাহিদ এরা মুচকি হাসছিলেন। যাক, যে যার মতো থাক।

দার্জিলিংয়ে আসার পর থেকে ল্যাপটপে চার্জ দিতে পারছিলাম না। একটা প্লাগের অভাবে। মিলটন নাকি আগের দিন অনেক খুঁজেছিলেন। পান নি। ফিরোজ আলমও তাই। বিকেলে সময় পেয়ে ভাবলাম- এবার নিজেই যাই। মিজানকে পেয়ে গেলাম রাস্তায়। শপিং করে হন্তদন্ত হয়ে বিগ বাজারের দিকে যাচ্ছিলেন। রিপোর্টিং টাইম সোয়া ৫ টায়, বিগ বাজার পয়েন্টে। তখনো ঘন্টাখানেক সময় ছিলো। বেশ কিছু দোকান, শপিং সেন্টার ঘুরলাম। এটা সেটা দেখলাম। কেনা হলো না তেমন কিছু। মাথায় ঘুরছিলো ইলেকট্রিক প্লাগ। যে যেদিকে দেখিয়ে দি্িচ্ছলো সেদিকেই যাচ্ছিলাম। খাঁড়া পথ বেয়ে বার দুয়েক নিচে নামলাম, উপরে উঠলাম। নেই কোথাও। কেউ বলছিলেন এদিকে হার্ডওয়্যারের দোকান নেই। কেউ বলছিলেন, রোববার, দোকান বন্ধ। শেষে ঢাকার বঙ্গবাজারের মতো একটা ওপেন মার্কেটে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই একজন দেখিয়ে দিলেন পথ। ৩৫ রুপি দিয়ে কিনলাম প্লাগ।

আবারো সেই একই কাহিনী। পিচ্চি জাহিদ নেই। ফিরোজ আলম টিম লিডার। ক্ষেপে গেলেন। আবার নিজে নিজেই শান্ত হলেন। সবাই টিকিট বুঝে পেয়ে ছুটলাম হলের দিকে।

আইনক্সের ছোট হল এটি। একেবারেই ছোট বলা চলে। থ্রিডি ছবি হলে সামনের দিকের কয়েক সারি ফাঁকা রাখতে হয়। এ কারণেই টিকিট পাওয়া মুশকিল।

অন্যদের থ্রিডি চশমা দিয়েছিলো। আমাদের দেয় নি। প্রথমে বুঝতে পারছিলাম না, এটি থ্রিডি ফিল্ম কি না। পরে ফিরোজ আলম আর মিলটন আহমেদ গিয়ে সবার জন্য চশমা নিয়ে এলেন।

ঝড়ের মতো মারামারি দিয়ে শুরু হলো সিনেমা। ভাবছিলাম পরে বোধহয় সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। কই? হচ্ছিলো না। মিনিট পনেরো চলে গেলো, কাহিনী বুঝলাম না। ওয়েট করি, পরে হয়তো বুঝব। আধা ঘন্টা চলে গেলো। বুঝছিলাম না কাহিনী! ইন্টারভেল এসে গেলো। বিরতির সময়ও বসে আছি। কি দেখলাম এতোক্ষণ! মাথা মুণ্ডু কিছুই বুঝছিলাম না। সিনেমা একসময় শেষও হয়ে গেলো।

এই ছবি দেখার জন্য মানুষ পাগল! সত্যিই পাগল! ন্যূনতম কোনো কাহিনী নেই। যুক্তিহীন, বিবেকহীন যুদ্ধ, মারামারি। ঘটনার কোনো পরম্পরা নেই। ম্যুরালিটি নেই। শিক্ষা নেই। এই যদি হয় একটা হিট সিনেমার উপজীব্য! তাহলে আমাদের ভবিষ্যত কি?

রাতের বেলা হোটেলে ফিরছিলাম। ভাবছিলাম- এরকম সিনেমা দেখে আমরা কি শিখব? জঙ্গিবাদ, ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড, খুনোখুনিতে মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় এসব দেখেই। এটাতো প্রজন্ম ধ্বংস করে দেবে!

ধ্বংস-বিদ্বেষ নয়; সুষ্ঠু সুন্দর মানবিক বাসযোগ্য পৃথিবী চাই।

**




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ মে ২০১৮/অগাস্টিন সুজন

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়