ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

এফবিসিসিআইয়ের একগুচ্ছ বাজেট প্রস্তাবনা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:৫৭, ৩০ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এফবিসিসিআইয়ের একগুচ্ছ বাজেট প্রস্তাবনা

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : আগামী ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট উপলক্ষে দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) একগুচ্ছ বাজেট প্রস্তাব দিয়েছে।

রোববার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের উপস্থিতিতে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন এফবিসিসিআই সভাপতি হয়েছেন আবদুল মাতলুব আহমাদ।

প্রস্তাবগুলো হলো:

আয়কর

ব্যক্তি করমুক্ত আয়ের সীমা বৃদ্ধি
উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মোট করের বেশিরভাগ প্রত্যক্ষ কর আয়কর থেকে আদায় করে থাকে। বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাত দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশের তুলনায় কম। মোট রাজস্ব আহরণে প্রত্যক্ষ করের অবদান মালয়েশিয়ায় ৭৫ শতাংশ, পাকিস্তানে ৩৭ শতাংশ, ভারত ৫৬ শতাংশ সেখানে বাংলাদেশ ৩০ শতাংশ। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সফলতায় এ বছর ই-টিআইএন ধারীর সংখ্যা ২৮ লাখ অতিক্রম করেছে। এদেরকে আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় এনে আয়কর খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধি করা। একই সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় ব্যক্তি আয়করমুক্ত আয়ের সীমা ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ।

করপোরেট কর হার
সব কোম্পানির ক্ষেত্রে করপোরেট কর হার ২৫% এবং ৩৫%। কর প্রদানে স্বচ্ছতা আনা এবং সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে করপোরেট কর হার ২.৫ শতাংশ হ্রাস করা। এ ছাড়াও মূসক নিবন্ধনকারী তালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার ট্রেডিং কোম্পানির চেয়ে ২.৫ শতাংশ কম রাখা।

সারচার্জ
সঞ্চয়, মূলধন গঠন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ব্যক্তি করদাতার প্রদর্শিত নিট পরিসম্পদের ভিত্তিতে সারচার্জের শুন্য শতাংশের সীমা বর্তমানে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা থেকে ৫ কোটি টাকা পর্যন্ত বাড়ানো।

অগ্রিম আয়কর
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড যেভাবে ডিজিটালাইজড হচ্ছে তাতে আমদানিপর্যায়ে এআইটি নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। তাই দেশীয় শিল্পের স্বার্থে শিল্পের মৌলিক কাচাঁমালের ওপর ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়করবা এআইটি প্রত্যাহার করা। এতে উৎপাদন খরচ কমবে এবং উৎপাদিত শিল্পপণ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।

রপ্তানির ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন
রপ্তানি উৎসাহিতকরণ ও প্রতিযোগিতার সক্ষমতার টিকে থাকতে পোশাকসহ সব রপ্তানি উৎসে কর ০.৭ শতাংশ থেকে হ্রাস করে ০.৫ শতাংশ ধার্য্য করার প্রস্তাব। এ ছাড়া রপ্তানি ক্ষেত্রে এবং রেমিট্যান্স প্রেরণের ক্ষেত্রে ডলার ইনসেনটিভ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।

গ্রস প্রফিট (জিপি)
গ্রস প্রফিট (জিপি) নির্ধারণের ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা গতানুগতিক ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না এবং করদাতারা নানাবিধ হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন। করদাতা ও কর কর্মকর্তাদের মধ্যে মতপার্থক্য দূর করার লক্ষ্যে যৌক্তিক ও স্ট্যান্ডার্ড গ্রস মুনাফা হার নির্ধারণের জন্য সঠিক গাইডলাইন বা দিক-নির্দেশনা প্রদান করতে হবে।

আমদানি শুল্ক    

শুল্ক স্তর
আবদুল মাতলুব আহমাদ বলেন, দেশীয় শিল্পের বিকাশ, বর্ধিত হারে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এবং ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে বর্তমান শুল্কস্তর ১%, ৫%, ১০%, ১৫% ও ২৫% অব্যাহত রাখতে হবে। এ ছাড়া বর্তমানে ট্যারিফ সিডিউলে ৩১২ টি পণ্যের ওপর শুন্য শতাংশ শুল্ক আছে তা আগামী অর্থবছরে অব্যাহত রাখার প্রস্তাব দিচ্ছি। যেমন সুতা, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, ভিটামিন, শস্যবীজ, কাচাঁপণ্য ইত্যাদি।

স্পেসিফিক ডিউটি
৪৭টি পণ্যের ক্ষেত্রে স্পেসিফিক ডিউটি নির্ধারণ করা আছে তা অব্যাহত রাখা যেমন- স্টিল ও লোহা জাতীয় পণ্য, চিনি, সিমেন্ট ক্লিংকার, পেট্রোলিয়াম জাতীয় পণ্য ইত্যাদি।

শক্তিশালী কমিটি গঠন
আন্ডার ইনভয়েসিং এবং মিস ডিক্লেরেশন এ কারণে সরকার যেমন রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও বৈষম্য তৈরি হয়। এজন্য আন্ডার ইনভয়েসিং এবং মিস ডিক্লেরেশনরোধের জন্য পণ্যভিত্তিক বিনিময় মূল্যের ডাটাবেজ প্রণয়নের লক্ষ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক নীতি সদস্যকে আহ্বায়ক করে এফবিসিসিআই, ট্যারিফ কমিশন, শুল্ক মূল্যায়ন কমিশনারেট-এর সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করার প্রস্তাব করছি।

শুল্ক আইন
বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাস্টমস ভ্যালুয়েশন এগ্রিমেন্ট ও ট্রেড ফ্যাসিলিটেশন এগ্রিমেন্টের আলোকে আধুনিক এবং বাস্তবসম্মত ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরি এবং রাজস্ব বান্ধব করার লক্ষ্যে নতুন শুল্ক আইন চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে। আগামী বাজেট অধিবেশনে উক্ত শুল্ক আইন পাশ করার জন্য প্রস্তাব করছি।

সম্পূরক শুল্ক
নতুন মূসক আইন অনুযায়ী ১৫২০টি পণ্যে ও সেবার মধ্যে ১৩৫০টি পণ্য ও সেবা থেকে সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এতে দেশীয় বাজারে বিদেশি পণ্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং স্থানীয় শিল্প প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। এ কারণে  বর্তমানে সে সকল পণ্যে ও সেবার ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা আছে তা অব্যাহত রাখা বা রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়ার প্রস্তাব।

মূল্য সংযোজন কর (মূসক/ভ্যাট)
এ বিষয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, মূল্য সংযোজন কর ও সম্পুরক শুল্ক আইন-২০১২ পুনঃনিরীক্ষাপূর্বক সুপারিশ প্রণয়নের নিমিত্তে গঠিত যৌথ কমিটির ৭ (সাত) দফা সুপারিশ এবং ওয়ার্কিং কমিটির যৌথ সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়িত না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিচ্ছে। এ অবস্থায় নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে অনলাইন ভ্যাট সিস্টেম চালু হয়েছে। যার জন্য আমরা সাধুবাদ জানিয়েছি। আমরা নতুন ভ্যাট আইনের বিপক্ষে নই। কিন্তু ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুযায়ী নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন করা না হলে তা বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে যাবে। যৌথ কমিটির সুপারিশের আলোকে বাজেটে ভ্যাট নিয়ে প্রস্তাব পেশ করছি।

অব্যাহতির সীমা
সব সরবরাহের (উৎপাদন, ব্যবসা, সেবা প্রদান) ক্ষেত্রে ৩০ লাখ টাকার পরিবর্তে ৩৬ লাখ টাকা টার্নওভার পর্যন্ত অব্যাহতি প্রদান করার সুপারিশ করা হয়েছে। ক্ষুদ্র, গ্রামীণ উদ্যোগ, কুটির শিল্প ইত্যাদি প্রান্তিক খাতের বিকাশে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বা দোকানদারদের হিসাব সংরক্ষণের সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিবেচনা করে উক্ত সীমা অবিলম্বে ৩৬ লাখ টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব।

টার্নওভার সীমা
উৎপাদন, ব্যবসা ও সেবা সরবরাহের ক্ষেত্রে বার্ষিক টার্নওভার ৩৬ লাখ টাকা থেকে ১ দশমিক ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত কেবলমাত্র উৎপাদনপর্যায়ে ৩ শতাংশ টার্নওভার কর আরোপের প্রস্তাব। মুদ্রামান ও মূল্যস্ফীতির নিরিখে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা প্রদানের উদ্দেশ্যে এবং সহজ পদ্ধতি ও সহনশীল করদায় প্রবর্তনের জন্য এ সুপারিশ করে এফবিসিসিআই। 

ব্যবসায়ী বা দোকাদারদের ক্ষেত্রে
ব্যবসায়ীপর্যায়ে বার্ষিক ৩৬ লাখ টাকার ঊর্ধ্বে টার্নওভারের পরিমাণ নির্বিশেষে, ২ শতাংশ হারে মূসক আরোপের সুপারিশ। তবে এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা আমদানি স্তরে পরিশোধিত আগাম কর বা উপকরণ কর সমন্বয় করতে পারবে না মর্মে শর্ত আরোপের বিধান করার সুপারিশ।

হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপ
উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণে অসমর্থ প্রতিষ্ঠানের করযোগ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের বিধান অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করে সংগঠনটি। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি সেবা খাতের স্বার্থে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাস হারে মূসক হার নির্ধারণ করার প্রস্তাব করে।

পণ্য পরিবহন সেবা
আইনের ধারা ২৬ অনুযায়ী অব্যাহতিপ্রাপ্ত সরবরাহ বা আমদানির প্রথম তফসিলের ১ম খণ্ডে মৌলিক চাহিদার ক্রমিক নং-৩ এ বর্ণিত ট্যাক্সি, বাস, মিনিবাস বা ফেরির মাধ্যমে প্রদত্ত পরিবহন সেবা সরবরাহে ট্রাক, মিনি ট্রাক এবং পিকআপ শব্দটি অর্ন্তভুক্ত করার প্রস্তাব।

উক্ত প্রস্তাবনার আলোকে মূসক ও সম্পুরক শুল্ক আইন-২০১২ সংশোধন করে বাস্তবায়নের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে সকল করদাতার নিকট ব্যবসা-বান্ধব করার লক্ষ্যে আইনের আকার ছোট এবং ভাষা সহজবোধ্য করার প্রস্তাব করেন আবদুল মাতলুব আহমাদ।

তিনি বলেন, এফবিসিসিআই এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মধ্যে চলমান পার্টনারশিপ ব্যবস্থা আগামীতে আরো শক্তিশালী করার লক্ষ্যে এফবিসিসিআইয়ের সদস্যভুক্ত ৬৪টি জেলা চেম্বারসহ খাতভিত্তিক ৩৮৪টি অ্যাসোসিয়েশনের সহযোগিতায় ভবিষ্যতে ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ এবং রাজস্ব-বান্ধব পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে মূসক আইন বাস্তবায়নে এফবিসিসিআইয়ের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

এ সময় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমানসহ ব্যবসায়ী শীর্ষ নেতারা উপস্থিত ছিলেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩০ এপ্রিল ২০১৭/এম এ রহমান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়