ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১০ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক : আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা রয়েছে, তবে দ্বিমতও রয়েছে। ওই রায়ে আপিল বিভাগ যেসব যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন সেসব যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।’

বৃহস্পতিবার সকালে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ কথা বলেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে মূলত এ সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়।

আনিসুল হক বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের এ রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ। তাই আমরা চিন্তা-ভাবনা করছি এ রায়ের রিভিউ করা হবে কি-না। আমরা এখনো কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হই নাই।  রায়ের খুঁটিনাটি আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরেছেন। সেখানে কিছু অপ্রাসঙ্গিক ও আপত্তিকর বিষয় এসেছে। সেগুলো এক্সপাঞ্জ করার উদ্যোগ আমরা নেব।’

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে কি ছিল তা উল্লেখ করে আনিসুল হক বলেন, ৯৬(১) অনুচ্ছেদের অন্যান্য বিধানাবলী সাপেক্ষে কোনো বিচারক সাতষট্টি বছর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত স্বীয় পদে বহাল থাকিবেন,

(২), প্রমাণিত অসদাচরণ কিংবা অসামর্থের কারণে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার অনূন্য দুই তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতার দ্বারা সমর্থিত সংসদের প্রস্তাবক্রমে প্রদত্ত রাষ্ট্রপতির আদেশ ব্যতীত কোনো বিচারককে অপসারিত করা যাইবে না।

(৩), এই অনুচ্ছেদের (২) দফার অধিন প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং কোনো বিচারকের অসদাচরণ কিংবা অসামর্থ সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করিতে পারিবেন।

(৪), কোনো বিচারক রাষ্ট্রপতিকে উদ্দেশ্য করিয়া স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে স্বীয় পদত্যাগ করিতে পারিবেন।

ষোড়শ সংশোধনীর আগে বাংলাদেশ সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদে কি উল্লেখ ছিল তাও তুলে ধরেন আইনমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ষোড়শ সংশোধনীর আগের ১৯৭২ সালের সংবিধানে ৯৬ অনুচ্ছেদ হুবহু ষোড়শ সংশোধনীর মতই ছিল। সংসদ পঞ্চদশ সংশোধনীতে অনেক বিষয় ১৯৭২ সালের গণ পরিষদ দ্বারা জাতির পিতার অংশ গ্রহণসহ যে সংবিধান প্রণয়ন করেছিল বহুলাংশে সেই সংবিধানে ফিরে গিয়েছিল। বিচার বিভাগের সম্মান, স্বাধীনতা এবং বিচারকদের অপসারণের ব্যাপারে নিরপেক্ষতা বজায় রাখার অভিপ্রায়ে এই ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়েছিল এবং তা জাতীয় সংসদে পাস করা হয়।

মন্ত্রী জানান, এই সংশোধনী পাসের পর একটি জনস্বার্থ মামলা দ্বারা হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং হাইকোর্ট বিভাগ ৫ মে ২০১৬ তারিখে রায়ে এটাকে সংবিধান পরিপন্থী রায় দেয় তারপর আপিল বিভাগে আপিল করা হয়। আপিল বিভাগ পরে মূলত তিনটি কারণে হাইকোর্টের রায় বলবৎ রাখেন।

এসব কারণ হলো- ১) ষোড়শ সংশোধনী যেহেতু বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ব্যঘাত ঘটাবে সে কারণে এটি সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারের পরিপন্থী।

২) সংসদের হাতে যদি বিচারপতিকে অপসারণের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে বিচারকগণ স্বাধীনতভাবে তাদের কাজ করতে পারবেন না কারণ তারা সবসময় ভয়ে থাকবেন যে সংসদ সদস্যদের বিপক্ষে রায় দিলেই তাদেরকে অপসারিত করা হবে।

৩) যেহেতু পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদকে ১৯৭৭ সালের মার্শাল ল প্রক্লেমেশন দ্বারা সংশোধিত অবস্থা বহাল রাখা হয়েছিল, সে জন্য এটা সংবিধানের বেসিক স্ট্রাকচারে স্থান পায়।

মন্ত্রী সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের এই রায়ের দ্বিমত পোষণ করে বলেন, শ্রদ্ধেয় আপিল বিভাগ যে যুক্তিতে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করেছেন সেসব যুক্তি আমাদের কাছে গ্রহণযোগ নয়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সরকার এবং জাতীয় সংসদের কোনো দিনই এই অভিপ্রায় ছিল না যে কোনো সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন কিংবা খর্ব করা হবে।

ষোড়শ সংশোধনীর প্রয়োজনিয়তা তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হয়নি বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরও সুদৃঢ় ও সুসংহত হয়েছে। আরো স্বচ্ছ হওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় করা এবং গণতন্ত্রের মৌলিক যে মন্ত্র ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পদ্ধতি’তে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার উদ্দেশ্যে এই ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়।’

‘ইতিহাস স্বাক্ষ্য দেয় যে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত গণপরিষদ দ্বারা পাসকৃত সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারককে অপসারণ করা হয় নাই। কিন্তু ১৯৭৭ সালের সামরিক শাসন দ্বারা সংশোধিত ৯৬ অনুচ্ছেদ থাকা সত্ত্বেও সুপ্রিম কোর্টের অনেক বিচারককে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলে না নিয়েও রাজনৈতিক কারণে চাকরি থেকে অপসারণ করা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ১৯৭২ সালে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত মূল সংবিধান (যেটাকে বুকে ধারন করে) অসাংবিধানিক হতে পারে না বলে আমি মনে করি। সংসদের মাধ্যমে বিচারকেদের অপসারণের বিধান ভারত, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ৩৮ শতাংশ কমনওয়েলথভূক্ত দেশে বিদ্যমান রয়েছে। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংসদ নিজে তদন্ত করে না তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে এ কাজ (তদন্ত) প্রমাণের দায়িত্ব পদান করে থাকে যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পরিপন্থী নয়। আমরাও অনুরূপ একটা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করি। আমি বলতে চাই যে মূল সংবিধানের কোনো বিধান জুডিশিয়াল রিভিউ হয় কি না এ বিষয়ে যথেষ্ট বিতর্ক আছে।

ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা বিচার ও সংসদ মুখোমুখি হবে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, না তা হবে কেন। আমি পরিস্কার করে বলতে চাই, ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা সংসদ বিচার বিভাগের সঙ্গে কোনো পাওয়ার কনটেস্টে অবতীর্ণ হয় নাই। বরং বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় করার প্রচেষ্টাই করা হয়েছে।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৯৬ অনুচ্ছেদকে পরিবর্তন করা হয় নাই বলেই আর কখনো ৯৬ অনুচ্ছেদকে সংশোধন করা যাবে না এরকম কোনো সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা কোথাও নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করা হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, রাজনৈতিক ভাবে মোকাবেলা করার সুযোগ নাই। আমরা যা কিছুই করব, আইনগতভাবে করব।

আনিসুল হক বলেন, ‘দেশকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি, অপরাধীদের নৈরাজ্য, অপসংস্কৃতি এবং গণতন্ত্রকে ভূলুণ্ঠিত করার প্রথা থেকে শেখ হাসিনার সরকারই মুক্ত করেছেন। তাই রায়ে যখন উল্লেখ থাকে যে, আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করছি ষোড়শ সংশোধনী দ্বারা, তখন ব্যথিত হওয়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না।’

তিনি বলেন, ‘গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আপিল বিভাগের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পুর্ণাঙ্গ কপি আমরা পেয়েছি। যেহেতু রায়টি ৭৯৯ পৃষ্ঠার তাই এটি সম্পূর্ণ পড়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে আমার এটুকু সময় লেগেছে।’

প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছ থেকে জাতীয় সংসদের সদস্যদের হাতে দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস হয় । এরপর ওই সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করা হয়।

হাইকোর্ট ওই রিটের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ৫ মে রায় দেন আদালত। রায়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

এরপর চলতি বছরের ৩ জুলাই ওই রায় বহাল রাখে আপিল বিভাগ। ১ আগস্ট আপিল বিভাগের সেই পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।


 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১০ আগস্ট ২০১৭/নঈমুদ্দীন/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়