ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মধ্যবিত্তের ব্যয়বহুল শহরজীবন

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০১, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মধ্যবিত্তের ব্যয়বহুল শহরজীবন

সাইফ বরকতুল্লাহ : নোমান কবির। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। ছেলে, স্ত্রীকে নিয়ে থাকেন উত্তরায়। যে টাকা বেতন পান, মাসের শুরুতে বাড়ি ভাড়া, বাজার খরচ দিয়ে তাতে খুব বেশি টাকা হাতে থাকে না। মাস শেষে দেখা যায় প্রায়ই ঋণ করতে হয় তার। নোমান কবিরের সঙ্গে কথা হয় গত শনিবার। তিনি বলেন, ‘বাসা ভাড়াইতো পুরো টাকা চলে যায়। যে কারণে চলতে কষ্ট হয়। ময়লা ফেলা, সাবান থেকে শুরু করে পানি- সবকিছুই তো টাকা ছাড়া হয় না। মধ্যবিত্তের জন্য এ শহর নয়।’

শুধু কী মধ্যবিত্তদের এ সমস্যা তা কিন্তু নয়। কয়েকদিন আগে অফিস থেকে বাসায় যাওয়ার সময় যানজটের কারণে রাত বেশি হচ্ছিল। যে কারণে সেদিন বাস থেকে নেমে হাঁটার পথটুকু রিকশায় গেলাম। এ সময় মধ্যবয়সী ওই রিকশাওয়ালার সঙ্গে মধ্যরাতে কথা হলো তার জীবনের নানা প্রসঙ্গ নিয়ে। তিনি বললেন, ‘আর দুই মাস ঢাকায় থাকব। তারপর গ্রামে চলে যাব।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন গ্রামে যাবেন- উত্তরে উনি জানালেন, গ্রামে গিয়ে সে গরু চাষ করবে। সঙ্গে শাকসবজি চাষ করবে। নানা সমস্যায় শহুরে জীবন তার ভালো লাগছে না। গ্রামে গেলে বাড়ি ভাড়া লাগবে না। শেরপুরে নিজের বাড়ি থাকলেও ঢাকায় রিকশা চালাচ্ছেন তিনি প্রায় দশ বছর ধরে। যদি বাড়ি ভাড়া না লাগত তাহলে যে টাকা আয় হয়েছিল তা দিয়ে গ্রামের বাড়িটা সে বিল্ডিং করতে পারত।

দুই.
কয়েকদিন আগে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সিলেটে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘দেশের ৬০-৭০ শতাংশ এলাকাই এখন উন্নত। শহর ও গ্রামে এখন খুব বেশি তফাৎ নেই। সবখানেই উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। ২০২৪ সালের মধ্যেই দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে’ [সূত্র: রাইজিংবিডি ডটকম, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭]। অর্থমন্ত্রী হয়তো ঠিকই বলেছেন শহর ও গ্রামে উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে। শহরে এখন অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু শহরে স্বল্প আয় ও মধ্যবিত্তদের জীবনমান কি উন্নত হয়েছে?

মধ্যবিত্তদের পদে পদে সমস্যা মোকাবিলা করতে হয়। অফিসের উদ্দেশ্যে বের হয়ে বাসে হুড়োহুড়ি করে উঠা, অটোরিকশা বা ক্যাবের যে ভাড়া তাতে একদিন উঠলেই চিন্তা আসে পরের দিনগুলো চলবে কীভাবে, সরকারি হাসপাতালের আউটডোরে লম্বা লাইনে দাঁড়ানো যেন নিত্যদিনের ঘটনা। বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকের বাড়তি ব্যয়, ভালো স্কুল-কলেজে সন্তানকে পড়ানো সবই করতে হয় সংসারের অন্য খরচের কাটছাঁট করে।

ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহর বলে যে দুর্নাম এখন এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনমান ব্যয়। মধ্যবিত্তের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠছে ঢাকায়। গত পরশু বাজারে গিয়ে দেখলাম সবজিসহ সব ধরনের জিনিসের যে দাম তাতে আমাদের মতো পরিবারের ঢাকায় থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বাজারে গেলে ৫০০ টাকা নিমিশেই শেষ হয়ে যায়। অথচ আগে দুই-তিন বছর আগেও ৫০০ টাকায় পুরো বাজার হয়ে যেত। নগরজীবনে প্রাত্যহিক অনেক সমস্যার মধ্যে অসহনীয় যানজট, গণপরিবহণ সংকট দিনে দিনে আরো প্রকট আকার ধারণ করছে। রাজধানীর বাসিন্দাদের বাড়ির হোল্ডিং ট্যাক্স বৃদ্ধি করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। সামনে হয়তো বাড়ি ভাড়া আরো বাড়বে। এতে বিপাকে পড়বেন নগরীর বাসিন্দারা। শহরে সুস্থ সুন্দর এবং নিরাপদে জীবনযাপন করাটা এখন রীতিমতো চ্যালেঞ্জিং ব্যাপার হয়ে উঠেছে।

তিন.
ঢাকার সীমিত আয়ের মধ্যবিত্ত এবং খেটে খাওয়া মানুষের জীবন অনিয়ন্ত্রিতভাবে বর্ধিত বাড়ি ভাড়ার যাঁতাকলে নিষ্পেষিত। নারীদের গণপরিবহন চাহিদার সাপেক্ষে অত্যন্ত অপ্রতুল। প্রায় কোটি জনতা অধ্যুষিত এই শহরে পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা ও মান অত্যন্ত নিম্নতর। মধ্যবিত্তের জন্য ঢাকায় সবচেয়ে বড় সমস্যা আবাসন। শুধু ঢাকাতেই এই সমস্যা নয়। বর্তমানে বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় শহরে একটি বাড়ির মূল্য এত বেশি যে, তা ক্রমেই মধ্যম আয়ের মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। আয়-ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় করতে শহুরে জীবন ছেড়ে অনেকেই অন্যত্র কম ব্যয়বহুল উপশহরগুলোয় চলে যাওয়ার কথা ভাবছেন।

এক জরিপে দেখা যায়, ২০১৬ সালের শেষ দিকে হংকংয়ে সাশ্রয়ী মূল্যের আবাসনের সংখ্যা সর্বনিম্ন এবং যার মূল্য থেকে আয়ের অনুপাত ১৮ দশমিক ১। যার মানে দাঁড়ায়, মাঝারি দামের একটি বাড়ির দাম মেটাতে একজন মধ্যম আয়ের ব্যক্তিকে ৩০ বছর ধরে সঞ্চয় করতে হবে, যা তার সারা জীবনের আয়ের অর্ধেক। যদিও হিসাবটি করা হয়েছে সুদের বাড়তি অর্থ যোগ না করে। হংকংয়ে বাড়ি ক্রয়বাবদ সুদের হার শূন্য না হলেও তুলনামূলক কম। তা সত্ত্বেও মধ্যম আয়ের কোনো ব্যক্তির পক্ষে এখানে একটি বাড়ির মালিক বনে যাওয়া সম্ভব নয়। হংকংয়ের পর নাম আসে সিডনির (১২ দশমিক ২)। এর পরের শহরগুলোর মধ্যে রয়েছে ভ্যাঙ্কুভার (১১ দশমিক ৮), অকল্যান্ড (১০), সিলিকন ভ্যালি (৯ দশমিক ৬), মেলবোর্ন (৯ দশমিক ৫) ও লস অ্যাঞ্জেলেস (৯ দশমিক ৩)। তালিকায় পরের দুটি শহরের মধ্যে রয়েছে লন্ডন ও টরন্টোর নাম, যেখানে মূল্য থেকে আয়ের অনুপাত যথাক্রমে ৮ দশমিক ৫ ও ৭ দশমিক ৭। এ শহরগুলোয় আবাসন ব্যয়বহুল, কিন্তু বাসিন্দাদের আয়ের পরিমাণও বেশি। বিশ্বের নয়টি দেশের ৯২টি শহরে এ জরিপ করা হয়  [সূত্র : বণিক বার্তা, রবার্ট জে শিলার, ‍নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, ৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭]।

চার.
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে। আর বাংলা মাধ্যমে পড়ে দুই-তৃতীয়াংশ মধ্যবিত্তের ছেলে-মেয়েরা। তবে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৭৫ শতাংশই বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। এর কারণ পরিবারের আয়। মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষের ইচ্ছা থাকলেও ভালো কিছু করা অন্তত শহরে হচ্ছে না।

পরিশেষে বলব, সামনের দিনগুলো মধ্যবিত্তের জন্য আরো কঠিন হয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই পরকিল্পনা করে সামনে এগোনোর পথ মধ্যবিত্তদের বের করা জরুরি।

লেখক  : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক

আরো পড়ুন :



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭/সাইফ/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়