ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে শীর্ষ দেশীয় অর্থদাতা ওয়ালটন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ২৬ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে শীর্ষ দেশীয় অর্থদাতা ওয়ালটন

হাসান মাহামুদ : শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত তহবিলে ২০০৮ সালে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল মাত্র ৮ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। এই তহবিলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ২০১৩ সালে অর্থ জমা দেওয়া শুরু হয়। এরপর বাড়তে থাকে ফান্ডের আকার।

২০১৫ সালে এই ফান্ডের আকার দাঁড়ায় ১২২ কোটি টাকা। ২০১৬ সালের শেষে হয় ১৮০ কোটি ৫০ লাখ ৬৪ হাজার ৩০৩ টাকা। বর্তমানে এ তহবিলের আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা।

তহবিলের প্রধান তদারকি প্রতিষ্ঠান শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, দেশি-বিদেশি ৯৪টি প্রতিষ্ঠান এ তহবিলে অর্থ জমা দিয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি অর্থ জমা দিয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ ইলেকট্রিক্যাল, ইলেকট্রনিক্স, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, অটোমোবাইলস ও টেলিকমিউনিকেশন পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ওয়ালটন গ্রুপ।

তহবিলে অর্থ জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে প্রথম পাঁচটিই বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান। দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেরা ওয়ালটন। ওয়ালটনের পরের চারটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান হচ্ছে যথাক্রমে কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেড, লাফার্জ সুরমা লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড।

ওয়ালটন গ্রুপ এখন পর্যন্ত এই ফান্ডে জমা দিয়েছে ৭ কোটি ৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত ১৮ এপ্রিল একবারেই ৩ কোটি ৯৬ লাখ ২৯ হাজার ১৩১ টাকা জমা দেওয়া হয় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নানা কায়দাকানুন করে শ্রম আইনের আওতায় গঠিত এ তহবিল বড় করছে। কারখানার মালিকদের বাধ্য করেছে শ্রম আইন অনুযায়ী মুনাফার একটি অংশ এ তহবিলে দেওয়ার জন্য। এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাধুবাদ জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক।

ফান্ডে অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, শ্রমিকদের দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন আপৎকালীন সহায়তা দিতে শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত শ্রমিক ও তাদের পরিবারের কল্যাণ সাধন, অসুস্থ ও অক্ষম বা অসমর্থ শ্রমিকদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকদের পরিবারকে সাহায্য প্রদান, শ্রমিকদের জীবন বীমার জন্য যৌথ বীমা ব্যবস্থার প্রবর্তন এবং শ্রমিকের পরিবারের মেধাবী সদস্যদের শিক্ষাবৃত্তি দেয় শ্রমিক কল্যাণ তহবিল।

তিনি আরো বলেন, শ্রমিক কল্যাণ তহবিল থেকে আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় নিহত ও আহতদের প্রত্যেক পরিবারকে ১ লাখ টাকা ও আহতদের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ঘটনায় নিহত, আহত ও অসুস্থ শ্রমিকের পরিবারের সদস্যদেরকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।

ফান্ডে অর্থ জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যারা এই ফান্ডে অর্থ জমা দিচ্ছেন, তারা অবশ্যই কর্মীবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচয় বহন করে। এক্ষেত্রে ওয়ালটন নিঃসন্দেহে সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য।

ওয়ালটন গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (পলিসি, এইচআরএম অ্যান্ড অ্যাডমিন) এস এম জাহিদ হাসান বলেন, দেশীয় শ্রম আইনের প্রতি সম্মান রেখে এবং প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশে শ্রমিকদের যে একটি অধিকার থাকে সে বিষয়টির প্রতি সম্মান রেখে আমরা নিয়মিতই এ তহবিলে অর্থ জমা দিচ্ছি। পাশাপাশি শ্রমিকদের সার্বিক কল্যাণ, শ্রমিকদের প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের অংশীদারিত্বে নিয়ে আসা প্রভৃতি বিষয় মাথায় রেখে ওয়ালটন এই ফান্ডের বিষয়ে সবসময় যত্নশীল।

তিনি আরো বলেন, দেশে একসময় প্রযুক্তিনির্ভর পণ্যের চাহিদা ছিল, কিন্তু উৎপাদন ছিল না। আমরা দেশে প্রযুক্তি খাতে কাজ করে যাচ্ছি। দেশীয় শ্রমশক্তি ব্যবহার করে দেশেই চাহিদামাফিক প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পণ্য উৎপাদন করছে। সেক্ষেত্রে শ্রমিকদের অবদানকে আমরা সম্মান করি। তাদের সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্যের বিষয়টিকেও আমরা সম্মান করি। সে দৃষ্টিকোণ থেকে ওয়ালটন সবসময় এই ফান্ডে অর্থ দিয়ে আসছে। আগামীতেও বিষয়টি অব্যাহত থাকবে।

জানা গেছে, ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই ফান্ডে মোট জমা পড়েছে ২৫০ কোটি টাকার মতো। দেশি-বিদেশি ৯৪টি প্রতিষ্ঠান এ অর্থ জমা দিয়েছে। এর মধ্যে ১০টি প্রতিষ্ঠানই দিয়েছে মোট তহবিলের ৬৮ শতাংশ। শ্রমিকদের কল্যাণে জমা দেয়া এ ১০ প্রতিষ্ঠানের অর্থের পরিমাণ ১৬৯ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রথম পাঁচটিই বহুজাতিক। তালিকায় ষষ্ঠ কিন্তু দেশীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সেরা ওয়ালটন গ্রুপ।

দেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিকদের দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন আপৎকালীন সহায়তা দিতে ‘শ্রমিক কল্যাণ তহবিল’ গঠন করে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর অসুস্থ কিংবা দুর্ঘটনায় আহত কিংবা নিহতদের পরিবারকে সহায়তা দিতে তহবিলটি গঠিত হয়। বর্তমানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (শ্রম) ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ফাউন্ডেশনের ২০ সদস্যের একটি পরিচালনা বোর্ড রয়েছে। পরিচালনা বোর্ডের চেয়ারম্যান শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী, ভাইস চেয়ারম্যান মন্ত্রণালয়ের সচিব। শ্রমিক ও মালিকপক্ষের পাঁচজন করে প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাতজন যুগ্ম সচিব এ বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব আফরোজা খান এ বিষয়ে বলেন, এই তহবিলের আকার আরো বড় হতে পারত যদি সব প্রতিষ্ঠান তহবিলের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিত। আইন প্রতিপালনে অনেকেই অনীহা প্রকাশ করে এসেছেন। আমরা আশা করব, তহবিলের বিষয়ে সবাই গুরুত্ব দেবেন। কারণ, এটি দেশের শ্রমিকদের স্বার্থে। দেশের কাছে, মালিকদের কাছে তাদের প্রাপ্য রয়েছে, এটি অবশ্যই পরিশোধ করা উচিত।

তিনি আরো বলেন, শ্রমিকদের মধ্যে অনেকেই আইনটি সম্পর্কে জানেন না। আমরা এ বিষয়ে প্রচারণা বিষয়ে ভাবছি।

প্রসঙ্গত, শ্রমিক কল্যাণ তহবিলের প্রধান উৎস হচ্ছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মুনাফার অংশ। ২০০৬ সালের শ্রম আইন অনুযায়ী কোম্পানির মালিক বছর শেষ হওয়ার সর্বোচ্চ ৯ মাসের মধ্যে তার নিট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে প্রদান করেন। এছাড়া এ তহবিলে সরকার অনুদান দেয়। ফাউন্ডেশনের তহবিলে অর্থ আসে বিনিয়োগ থেকে এবং ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মাধ্যমে।

কোনো শ্রমিকের সন্তানের সাধারণ শিক্ষার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেডিক্যাল কলেজ, কৃষি, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সরকারি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের টিউশন ফি, শিক্ষা উপকরণ ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্য ৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়। কর্মরত অবস্থায় কোনো শ্রমিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে অক্ষম হয়ে গেলে বা মারা গেলে ২ লাখ টাকা দেওয়া হয়। মৃতদেহ পরিবহন ও সৎকারের জন্য ২৫ হাজার এবং ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয় জরুরি চিকিৎসার জন্য। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত মহিলা শ্রমিকের মাতৃত্ব কল্যাণে দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা। দুরারোগ্য ব্যাধির চিকিৎসার জন্য ১ লাখ টাকা পর্যন্ত মেলে। শ্রমিকের বিশেষ দক্ষতার স্বীকৃতির জন্য দেওয়া হয় ২৫ হাজার টাকা।

অনুদান নেওয়ার উপায় : শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনের তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা পাওয়ার জন্য নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়। প্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীর আবেদন ফরমে কর্মরত প্রতিষ্ঠানপ্রধানের সুপারিশ লাগে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক সংগঠন থাকলে তার অনুমোদন প্রয়োজন। শ্রমিক সংগঠনের সদস্য না হলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্র আবেদন ফরমের সঙ্গে দিতে হয়। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট এলাকার প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং শ্রম অধিদপ্তর কল-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার প্রত্যয়নপত্র আবেদন ফরমের সঙ্গে সংযুক্ত করে দিতে হয়। এছাড়া শ্রমিকের পরিবারের মেধাবী সদস্যকে শিক্ষার জন্য বৃত্তি কিংবা সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের প্রত্যয়নপত্র ও পরীক্ষার নম্বরপত্র জমা দেওয়ার নিয়ম। নির্ধারিত আবেদন ফরমে তহবিল থেকে প্রতি অর্থবছর একজন শ্রমিক বা কর্মচারী একবার আর্থিক সহায়তা বা অনুদানের জন্য আবেদন করতে পারেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৭/হাসান/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়