ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

আট অনুচ্ছেদ ৫৮টি উপধারায় আসছে স্বর্ণ নীতিমালা

এম এ রহমান মাসুম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৪, ২১ মে ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
আট অনুচ্ছেদ ৫৮টি উপধারায় আসছে স্বর্ণ নীতিমালা

এম এ রহমান মাসুম : বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকিতে দেশের অনুমোদিত ডিলার (এডি) দুই বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে আমদানি হবে ব্যবসায়ীদের চাহিদাকৃত সোনা বা স্বর্ণবার। যা দেশের মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট/মূসক) নিবন্ধিতসহ আরো কিছু শর্তসাপেক্ষে প্রকৃত স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও ডিলার আমদানি করতে পারবে প্রয়োজনীয় সোনা।

অন্তত ১৫ দিন আগে চাহিদাপত্র দাখিল ও মোট মূল্যের ৫ শতাংশ জামানত দিয়ে মিলবে কাঙ্ক্ষিত সুযোগ। এছাড়া রপ্তানিতে বন্ড সুবিধাসহ বিশেষ প্রণোদনা কিংবা ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণসহ আটটি অনুচ্ছেদ, ৫৮টি উপ-অনুচ্ছেদ থাকছে প্রস্তাবিত স্বর্ণ আমদানি নীতিমালায়।

চূড়ান্ত প্রায় স্বর্ণনীতিমালা বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে শিগগিরই মন্ত্রিপরিষদে উত্থাপন হয়ে চূড়ান্ত রূপ পেতে যাচ্ছে। স্বর্ণ আমদানি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্তে গঠিত কমিটি সর্বশেষ গত ৮ মে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠকে মিলিত হয়।

ওই বৈঠকেই স্বর্ণ আমদানি নীতিমালার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে তা নিশ্চিত করেছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও আসছে বাজেটের আগেই স্বর্ণ আমদানির নীতি চূড়ান্ত করার বিষয়টি রাইজিংবিডির কাছে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।

স্বর্ণনীতিমালার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সংযুক্ত কমিটির অন্যতম সদস্য শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে রাইজিংবিডিকে বলেন, স্বর্ণনীতিমালা বাস্তবায়ন হলে এ খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। সরকারও বড় অংকের রাজস্ব পাবে। ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকিমুক্তভাবে ব্যবসা করতে পারবে।

অন্যদিকে কমিটির অপর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য এবং শুল্ক মূল্যায়ন ও অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা কমিশনারেট ড. মইনুল খান রাইজিংবিডিকে বলেন, শুল্ক গোয়েন্দার মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে চোরাচালানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছিলাম। দায়িত্ব পালনকালে সর্বশেষ একটি স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীর কাছে থেকে ১৫ মণ স্বর্ণ জব্দের পর নীতিমালার বিষয়টি জোরালোভাবে সামনে আসে। এরপরই সরকার সংশ্লিষ্ট সবাইকে সঙ্গে নিয়ে ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। নীতিমালা হলে স্বর্ণ ব্যবসায় শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সরকার ও ব্যবসায়ী উভয়ই লাভবান হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষিত হবে।

নীতিমালার বিষয়ে আরো জানা যায়, প্রস্তাবিত স্বর্ণনীতিমালাকে ‘স্বর্ণনীতিমালা’ নামে অভিহিত করে ১নং ধারা সাজানো হয়েছে। এই ধারায় সংযোজন করা হয়েছে ৩টি উপধারা। উপধারাগুলোতে উদ্দেশ্য এবং প্রয়োগ ও পরিধির বিষয়ে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।

এর মধ্যে ১নং ধারার উপধারা (১) এ স্বর্ণ নীতিমালায় লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের বিষয়ে বলা হয়েছে- দেশের অভ্যন্তরে স্বর্ণের বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং রপ্তানির উদ্দেশ্যে স্বর্ণের চাহিদা পূরণ করার লক্ষ্যে স্বর্ণ আমদানি প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বিধানের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট আমদানিকারক কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করাই প্রধান উদ্দেশ্য। পাশাপাশি স্বর্ণালংকার রপ্তানিতে উৎসাহ ও নীতি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে রপ্তানি বৃদ্ধিকরণ, সকল অংশীজনের অংশীদারিত্ব এবং কার্য‌্কর সমন্বয় নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে স্বর্ণখাতে সুষ্ঠু ও টেকসই বিকাশে একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করাও এর উদ্দেশ্য।

উপধারা ১(৩) এ প্রয়োগ ও পরিধির বিষয়ে বলা হযেছে- এই নীতিমালা স্বর্ণখাতে আমদানি, ব্যবসা ও রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। এই নীতিমালা রপ্তানি প্র্রক্রিয়াকরণ এলাকা, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল ও বেসরকারি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকাসহ বাংলাদেশের অন্যান্য সকল এলাকায় এই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে। যেখানে অলংকার বলতে স্বর্ণ, হীরক, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবাদ ধাতু দ্বারা প্রস্তুতকৃত এবং মূল্যবান পাথর দ্বারা খচিত অলংকার।

নীতিমালায় স্বর্ণ আমদানি সহজীকরণ সম্পর্কিত বিধানাবলি ২নং অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। আর এই ধারায় ১২টি উপধারা যোগ করা হয়েছে।

বিধানাবলিতে বলা হয়েছে : বর্তমান স্বর্ণ আমদানি নীতি ও পদ্ধতির অতিরিক্ত হিসেবে দেশের অভ্যন্তরীণ স্বর্ণালংকারের চাহিদাপূরণকল্পে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকের মাধ্যমে স্বর্ণবার আমদানির নতুন পদ্ধতি প্রবর্তন করা যেতে পারে। যেখানে প্রাথমিকভাবে দুটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে স্বর্ণ আমদানির জন্য অনুমোদিত ডিলার (এডি ব্যাংক) হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে। সাফল্য বিবেচনায় ভবিষ্যতে অন্যান্য আগ্রহী ব্যাংককে এ সুযোগ প্রদান করা যাবে। এডি ব্যাংক সরাসরি আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য স্বর্ণবার প্রস্তুতকারী ও সরবারহকারী প্রতিষ্ঠান থেকে স্বর্ণবার আমদানি করবে। এডি ব্যাংক স্বর্ণবার ব্যতীত অলংকার বা অন্য কোনো ফর্মে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবে না। এডি ব্যাংকসমূহ স্বর্ণবার আমদানির সময় শুল্কমুক্ত সুবিধা বা বন্ড সুবিধা গ্রহণ করে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে স্বর্ণবার আমদানি করতে অনুমোদিত ডিলার ব্যাংককে আবশ্যিকভাবে আমদানি নীতি আদেশ ও শুল্ক আইনের বিধানাবলি মেনে বন্ড কমিশনারেট থেকে বন্ড লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে। অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকসমূহ স্বর্ণালংকার ব্যবসায়ীদের চাহিদার ভিত্তিতে বাৎসরিক/ষাণ্মাসিক/ত্রৈমাসিক/মাসিক ভিত্তিতে স্বর্ণবার আমদানি করতে পারবে। তবে স্বর্নালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও ডিলার থেকে প্রাপ্ত চাহিদার বিপরীতে স্বর্ণবার আমদানির পূর্বে এডি ব্যাংক সম্ভাব্য বৈদেশিক মূদ্রা ব্যয়ের পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংককে অবহিত করে ওই ব্যয়ের বিষয়ে অনাপত্তি গ্রহণ করতে পারবে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক এ অনাপত্তি প্রদান করবে।

স্বর্ণ কীভাবে ও কারা ক্রয় করতে পারবে এ বিষয়ে নীতিমালার ২(৭) এ বলা হয়েছে। এডি ব্যাংক সাইট ঋণপত্র, ডেভার্ড ঋণপত্র (৯০ দিনের মধ্যে বিলম্বে মূল্য পরিশোধের শর্তে), চুক্তি বা টিটি কিংবা কনসাইনমেন্ট ভিত্তিতে স্বর্ণবার ক্রয় করতে পারবে।

আর স্বর্ণবার ক্রয় করতে পারবে ভ্যাট কমিশনারেট নিবন্ধিত প্রকৃত স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও ডিলার। তবে স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানকে একই সঙ্গে গোল্ড প্রকিউরমেন্ট, স্টোরেজ ও ডিস্ট্রিবিউশন আদেশ, ১৯৮৭-এর আওতায় জেলা প্রশাসকের কাছ লাইসেন্সপ্রাপ্ত হতে হবে। একই সঙ্গে ওই সকলকে সংশ্লিষ্ট নিবন্ধিত ব্যবসায়ী সমিতির বৈধ সদস্য হতে হবে। আর স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বর্ণবারের চাহিদা এডি ব্যাংকের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কমপক্ষে ১৫ দিন পূর্বে প্রদান করতে হবে। চাহিদাপত্র দাখিলকালে নিরাপত্তা জামানত হিসেবে ক্রয়তব্য পরিমাণ স্বর্ণবারের সে সময়ের বাজার মূল্যের কমপক্ষে ৫ শতাংশ জামানত হিসেবে এডি ব্যাংকে জমা দিতে হবে।

অন্যদিকে এডি ব্যাংক স্বর্ণবার বিক্রয়ের সময়ে আবশ্যিকভাবে স্বর্ণালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী ও ডিলার কর্তৃক পূর্ববর্তী বছরসমূহ মোট স্বর্ণালংকার বিক্রয়ের পরিমাণ, সরকারি রাজস্ব পরিশোধ, স্বর্ণের প্রকৃত মজুত, রেকর্ডপত্র ও হিসাব বিবরণীর স্বচ্ছতা ইত্যাদি যাচাই করবে। এডি ব্যাংক প্রয়োজনে ভ্যাট কমিশনারেটের সহযোগিতায় যাচাই প্রতিবেদন ভ্যাট কমিশনারেটকে প্রদান করবে এবং স্বর্ণবার বিক্রয়ের সময়ে প্রযোজ্য শুল্ক করাদি আদায় করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা প্রদান করবে।

অনিয়মে আইনগত ব্যবস্থার বিষয়ে ২(১২) ধারায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানকে এনবি্আরের ভ্যাট কমিশনারেট নিয়মিত পরিদর্শন করতে পারবে এবং পরিদর্শনে কোনো অনিয়ম পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিক ভ্যাট নিবন্ধন বাতিলসমূহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবে।

এছাড়া স্বর্ণ বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের বিষয়ে নীতিমালার ৩নং ধারায় বলা হয়েছে। যেখানে ১১টি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে।

৪নং ধারায় রাখা হয়েছে স্বর্ণমান প্রণয়ন, যাচাই ও নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি। যেখানে মোট ৪টি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে।

ভোক্তা-স্বার্থে বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে প্রস্তাবিত নীতিমালায় মোট ৫টি উপধারা সংযোজন করে ৫নং ধারাটি সাজানো হয়েছে।

পরিবর্তন আনা হয়েছে যাত্রী (অপর্যটক) ব্যাগেজ বিধিমালায়। যা প্রস্তাবিত বিধিমালার ৬নং ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে। এই ধারায় সংযোজন হবে মোট ৫টি উপধারা।

স্বর্ণালংকার রপ্তানিতে প্রণোদনা ও বিশেষ সুযোগ-সুবিধা রেখে প্রস্তাবিত বিধিমালা ৭নং ধারা সাজানো হয়েছে। যেখানে মোট ১০টি উপধারা সংযোজন করা হয়েছে।

স্বর্ণখাতের তথ্য সংরক্ষণের বিষয়ে প্রস্তাবিত নীতিমালার ৮নং ধারায় বর্ণনা করা হয়েছে।

২০১৭ সালের শুরু দিকেই স্বর্ণ আমদানিকে উৎসাহিত করতে নীতিমালা প্রণয়নের দাবি জানান ব্যবসায়ীরা। এজন্য স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি (বাজুস) থেকে অর্থমন্ত্রীকে চিঠিও দেওয়া হয়। অর্থমন্ত্রীও এ ব্যাপারে একমত হয়ে সংশ্লিষ্ট ১৪টি মন্ত্রণালয় ও ব্যবসায়ী সংগঠনের সঙ্গে বৈঠকে আগ্রহ দেখান।

বাজুসের পক্ষ থেকে বৈধপথে স্বর্ণ আমদানি করতে তিনটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। নীতিমালা প্রণয়নসহ ব্যাংকিং জটিলতা নিরসন ও ন্যূনতম কর নির্ধারণ সাপেক্ষে কমপক্ষে ১০ কেজি স্বর্ণ আমদানি অনুমতির দাবি ছিল অন্যতম।

চলমান পদ্ধতিতে আমদানিকৃত স্বর্ণে ভরিপ্রতি (১১.৬৬৪ গ্রাম) তিন হাজার টাকা এবং ৪ শতাংশ ট্রেড ভ্যাট দিতে হয়।

২০১৭ সালের মে মাসে অর্থমন্ত্রীর জন্য একটি পরিস্থিতিপত্র তৈরি করে অর্থ মন্ত্রণালয়। তাতে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সই করেন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায়ও অর্থমন্ত্রী জুয়েলারি শিল্পকে ব্যবসাবান্ধব করতে স্বর্ণ আমদানির নীতিমালা প্রণয়নের বিষয়ে সংসদকে অবগত করেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মে ২০১৮/এম এ রহমান/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়